Ajker Patrika

শিশু নির্যাতনের অবসান দরকার

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ
আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১০: ০১
শিশু নির্যাতনের অবসান দরকার

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পাশাপাশি বাংলাদেশে শিশু আইন, ২০১৩-এর ৪ ধারা অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত সবাইকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশ, তাদের শিক্ষা গ্রহণ-প্রক্রিয়া ও ভবিষ্যতে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিশেষ অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর ‘শিক্ষার স্তরনির্বিশেষে, বিশেষ কয়েকটি পদক্ষেপ’ অধ্যায়ে ১০ ধারায় বলা হয়েছে: ‘শিক্ষার কোনো স্তরেই শিক্ষার্থীরা যেন কোনোভাবেই শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।’ জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষার সব স্তরের জন্য পৃথক কমিটি গঠন করে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর জন্য আচরণবিধি তৈরি করা হবে। তবে নীতিমালার এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর না হওয়া দুঃখজনক।

উল্লেখ্য, শিশু আইন, ২০১৩-এর ৭০ ধারা অনুসারে শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব আইন ও নিয়মনীতি থাকার পরেও যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতার অভাবে বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন এবং করোনা পরিস্থিতিতে ও পরবর্তী অবস্থায় তা আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণে আইনের সংস্কার যে আবশ্যক, তা এ লেখাটির মূল আলোচ্য বিষয়।

২০২০ সালে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ-সম্পর্কিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বে বছরব্যাপী প্রায় ১০০ কোটি শিশু শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রতিবেদনের আওতায় করা জরিপ থেকে দেখা যায়, এক মাসে দেশে ১ থেকে ১৪ বছরের ৮৯ শতাংশ শিশুকেই শৃঙ্খলার নামে নির্যাতন করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ব্লাস্টের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ৬৯ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, নিয়মানুবর্তিতার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। ৫৫ শতাংশ মনে করেন, শিশুদের সুপথে নিতে শাস্তি সহায়ক। ২৭ শতাংশ মনে করেন, শাস্তি না দিলে শিশুরা বখে যায় এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন, শাস্তি দিলে শিশুরা শিক্ষকদের কথা শুনবে।

এই করোনার ক্রান্তিকালে দেশের বেশির ভাগ স্কুল বন্ধ থাকার সময় শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কমেনি; বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় শিশুর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতনের হার আরও বেড়ে যাওয়ার কারণ করোনা থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা ও সমাজব্যবস্থায় পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আয় কমে যাওয়ায় অথবা আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিশুর প্রতি আচরণে এ সময় অসহিষ্ণুতা বেড়েছে কয়েক গুণ। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতির কারণে জাতীয় বাজেট ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর ওপর চাপ বাড়ায় শিশু নির্যাতন বন্ধের উদ্যোগ আরও বাধার সম্মুখীন হয়।

শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯-এর ৩ (১), ১৯ (১), ৩৭ (১), ৩৭ (২) ও ৩৭ (৩) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, শিশুদের শারীরিক শাস্তি প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ, ১৯৬৬-এর অনুচ্ছেদ ৭-এ সব ধরনের নিষ্ঠুর ও মর্যাদাহানিকর আচরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সনদ দুটিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শিশুদের প্রতি নির্যাতন বন্ধে অঙ্গীকারবদ্ধ। এরই অংশ হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ও শিশু আইন, ২০১৩-তে শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০১১ সালে ব্লাস্ট এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র কর্তৃক যৌথভাবে করা একটি জনস্বার্থ মামলার রায়ে বলা হয়েছে, শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থীদের প্রতি শারীরিক শাস্তি এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অপমানকর আচরণ সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২ ও ৩৫ (৫) নং অনুচ্ছেদে প্রদত্ত শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘন করে। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতন বন্ধের উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র এবং ২০১১ সালে সরকার একটি নীতিমালা জারি করে।

কিন্তু এসব ইতিবাচক আইন ও নীতিমালা থাকলেও আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতার অভাবে শিশুর প্রতি নির্যাতনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। করোনার জন্য স্কুলগুলো বন্ধ থাকার সময় জনসমক্ষের আড়ালে বাড়িতেই শিশুরা বেশি নির্যাতিত হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে শিশুর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১৯৯টি। এই সাত মাসে খুন হয়েছে ৩৬৫টি শিশু। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং নেতিবাচক মানসিকতার কারণেও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। এ ক্ষেত্রে শিশু আইন, ২০১৩-এর ৭০ ধারাটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথমত, এই আইনের ব্যাপারে সচেতনতার অভাব। দ্বিতীয়ত, করোনা পরিস্থিতিতে পরিবারে শিশুর প্রতি নির্যাতন বন্ধের ক্ষেত্রে আইনটির প্রয়োগ না থাকা। তৃতীয়ত, নির্যাতনের কারণে শিশুর মনে যে নেতিবাচক মানসিক প্রভাব পড়ে, তা ওই ৭০ ধারার আওতায় প্রমাণ করা খুবই কঠিন।

করোনা-পূর্বকালে এবং বর্তমানেও অনেক বাবা-মা শিশুদের মারধর করেন। অথচ শিশুদের আত্মসম্মানবোধ ও মারধরের কারণে তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি তারা অনুধাবন করেন না। শিশুদের সংশোধনে বিকল্প ব্যবস্থার ব্যবহার জানা দরকার, যা বিশ্বের বহু দেশের শিক্ষক ও বাবা-মায়েরা করতে অভ্যস্ত। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া যাবে না, এ কথা শিক্ষকদের নিয়োগপত্রে ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালে উল্লেখ থাকা দরকার। আবার কোনো শিক্ষক অথবা শিক্ষাব্যবস্থাপক বিধিবহির্ভূত অসংগত আচরণ করলে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বক্স স্থাপনের কথা বলা হলেও সেটা প্রকাশ্য স্থানে অনেক জায়গায় নেই।

বর্ণিত পরিস্থিতিতে করোনার ক্রান্তিকালে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সকল পর্যায়ে শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে শিশু আইনের ৭০ ধারার সংস্কার করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আইনে দুর্যোগকালে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা যেমন বিবেচনায় আনতে হবে, তেমনি শিশুর প্রতি লঘু শাস্তি প্রদানকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষক ও অভিভাবকদের এই আইন ও আইনের বিদ্যমান ধারার ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।

এদিকে দেশের সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে হাইকোর্ট ৪ নভেম্বর ২০২১ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে উপজেলা পর্যায়ে মনিটরিং কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। উল্লেখ্য, শিশু আইনের মূল লক্ষ্য নির্যাতনকারীকে শাস্তি দেওয়া নয়; বরং কোনো শিশু যেন নির্যাতনের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারীর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে এই সংকটাপন্ন পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ: জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর অন্যতম প্রণেতা, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে গঠিত কোয়ালিশনের আহ্বায়ক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত