Ajker Patrika

একজন আনিসুজ্জামান

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ১৪ মে ২০২২, ১০: ৩৩
একজন আনিসুজ্জামান

দুই বছর আগে এই দিনে ভেসে এসেছিল দুঃসংবাদটি। আনিসুজ্জামান আর নেই। হ্যাঁ, জীবনঘাতী কোভিডই তাঁর মৃত্যুর কারণ।

আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ছিল পারিবারিক। আমার বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে বড় ভাই বলেই গণ্য করতেন তিনি। সম্পর্কের গভীরতা সৃষ্টি হয়েছিল দেশভাগের আগে থেকেই। আনিসুজ্জামানের শিক্ষক হিসেবে সিরাজুদ্দীন হোসেনকে কাজ দিয়েছিলেন তাঁর বাবা এ টি এম মোয়াজ্জেম। সিরাজুদ্দীন হোসেন তখন পড়তেন ইসলামিয়া কলেজে। আরও একজন শিক্ষক আনিসুজ্জামানকে পড়াতেন বলে আব্বা ছিলেন ছোট শিক্ষক নামে পরিচিত। আব্বার আঁকার হাত এবং হাতের লেখা দুটোই ভালো ছিল বলে তা আকৃষ্ট করেছিল শিশু আনিসুজ্জামানকে।

দেশভাগের পর খুলনা হয়ে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন এ টি এম মোয়াজ্জেম। সেই বাড়িতে ছিল আমাদের যাতায়াত। আমাদের মানে আমার বড় ভাইয়েরাও যেতেন সেই বাড়িতে। এ আমার জন্মের আগের গল্প।

আমি আনিসুজ্জামানের কথা স্মরণ করতে পারি আব্বার মৃত্যুর পর। তিনি তখন আমাদের ‘আনিস কাকা’। আব্বাকে নিয়ে ‘স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁরই সুযোগ্য সম্পাদনায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর প্রজ্ঞার কথা জানে সবাই। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজনীতির মানুষ না হয়েও তিনি রেখেছেন বলিষ্ঠ অবদান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে তাঁর ভাবনার গভীরতা ছিল অপরিসীম।

অনেক বেশি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বা সভাপতি হিসেবে যেতেন তিনি। এ নিয়ে তাঁকে কথাও শুনতে হতো। তাঁকে কেউ কেউ বলতেন, ‘ফিতে কাটা অধ্যাপক।’ যে অর্বাচীনেরা এ কথা বলতেন, তাঁরা কেউ সেসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন কি না, জানি না; কিন্তু যদি উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়ে থাকে, তাহলে তাঁরা নিশ্চিতভাবেই জানবেন, ছোট্ট একটি বক্তৃতায় কী অসাধারণভাবে তিনি বিষয়টির তাৎপর্য তুলে ধরতেন, অর্থাৎ প্রতিটি অনুষ্ঠানের জন্যই ছিল তাঁর আলাদা প্রস্তুতি।

মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে তাঁকে বলতাম, ‘এসব অনুষ্ঠানে না গিয়ে আরেকটু লেখালেখি করলে তো আমাদের উপকার হতো।’

বলতেন, ‘কেউ অনুরোধ করলে তো না করতে পারি না।’

অন্যকে উৎসাহ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর তুলনা ছিল না। একবার ছোটদের জন্য লেখা তাঁর একটি বইয়ের রিভিউ করেছিলাম। লেখাটি ছাপা হওয়ার পর সে রাতেই তিনি ফোন করে বলেছিলেন, ‘তোমার লেখাটা তো আমার বইটির চেয়েও ভালো হয়েছে।’

এ ছিল নিছক বিনয়। কিন্তু তা যে আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, সেটা তো মিথ্যে নয়।

তাঁর লেখালেখির পরিসর ছিল অনেক বড়। সংক্ষেপে লিখতেন, কিন্তু তা ছিল লক্ষ্যভেদী। তাঁর লেখা ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আলোচনা হয়েছে তাঁর তিন খণ্ডে লেখা আত্মজীবনী নিয়ে। বাঙালি ও বাংলাদেশ নিয়েও তাঁর লেখা রয়েছে অনেক। বেশ কিছু লেখা লিখেছেন পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য। কিন্তু সেগুলোর সুচিন্তিত প্রকাশভঙ্গি নজর কাড়ে।

তাঁর ভাবনার ধরনটি বুঝতে হলে পড়তে হবে তাঁরই লেখা। একটা প্রবণতা আছে, আমরা অন্যের লেখা পড়ে একজন মানুষকে নির্মাণ করি। অথচ সে মানুষটির কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো তাঁরই লেখা পড়ে ফেলা। চন্দ্রাবতী একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আত্মপরিচয় ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা’ নামের বইটির নাম আমি নিচ্ছি এ কারণে যে এ বইটিতে এই দেশ, এই দেশের ভাষা, এই দেশের স্বাধিকার চিন্তা নিয়ে তিনি আসলেই কী ভেবেছেন, তাঁর একটা পরিচয় পাওয়া যাবে।

তাঁর বিশ্বাসের একটি ছবি এঁকে লেখাটি শেষ করব। এই মুহূর্তে এ বিষয়টি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। ধর্ম নিয়ে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তার একটি জবাব হয়তো পাওয়া যাবে তাঁর লেখা ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী যে ধর্মবিশ্বাসী হতে পারবে না, তা নয়; তবে রাজনীতিতে ধর্ম টেনে আনবেন না বলে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি নামাজ পড়ুন, রোজা রাখুন, জাকাত দিন, হজ পালন করুন, মন্দিরে যান, চার্চে প্রার্থনা করুন, কিন্তু এই ধর্মবোধের সঙ্গে যেন রাজনীতির সংমিশ্রণ না ঘটান, এটাই তাঁর কাছে দাবি।’বোধ করি, এভাবেই তিনি ধর্ম নিয়ে চলা অস্থিরতার জবাব দিয়েছেন।

জাহীদ রেজা নূর,উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাকা দিয়ে নারীর চাবুকের ঘা খাচ্ছিলেন পুরুষ, দুজন গ্রেপ্তার

ভারতের সঙ্গে সংঘাতে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির

প্রবাসীর রেমিট্যান্সের অর্থ আত্মসাৎ, নারী ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে

পাকিস্তানে কীভাবে হামলা চালাতে পারে ভারত, ইতিহাস যা বলছে

কোটি টাকা ‘ভর্তুকি’র জিম্বাবুয়ে সিরিজে বাংলাদেশ যা পেল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত