Ajker Patrika

নগরীর বুকে ধর্মসাগর

দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ, কুমিল্লা
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২১, ১১: ৫৪
নগরীর বুকে ধর্মসাগর

কুমিল্লা নগরীর বুকে নির্মল বাতাস প্রাণভরে নিতে বাসিন্দারা ছুটে যান ধর্মসাগর পাড়ে। জলরাশি আর ইতিহাসের ছাপ গায়ে মেখে মুহূর্তে নিজেদের ক্লান্তি ভুলে যান। স্থানীয় বাসিন্দাসহ পর্যটকদের মন্তব্য হচ্ছে, ধর্মসাগর ছাড়া কুমিল্লা নয়।

নামের সঙ্গে ‘সাগর’ থাকলেও ধর্মসাগর কিন্তু সাগর নয়। সাগরের মতো উত্তাল ঢেউ নেই এখানে। তবে এর বাতাসে মৃদুমন্দ ঢেউয়ের কলকল ধ্বনি। কুমিল্লা নগরীর হৃৎপিণ্ডে ধর্মসাগরের অবস্থান। এটি একটি প্রাচীন দিঘি।

১৪৫৮ সালে ত্রিপুরার রাজা ধর্মমাণিক্য স্থানীয় বাসিন্দাদের পানির চাহিদা মেটাতে এটি খনন করেন। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ধর্মসাগরের আয়তন ২৩ দশমিক ১৮ একর। তাঁর নামানুসারেই এর নাম ধর্মসাগর। এই দিঘির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পৌনে ৬০০ বছরের ইতিহাস।

নগরীর কর্মময় জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ একটু স্বস্তির জন্য এখানে ছুটে আসেন। স্বাস্থ্য সচেতন লোকজন সকালে ও সন্ধ্যায় ধর্মসাগরের পশ্চিমপাড়ে হেঁটে বেড়ান। দিঘিটির পূর্ব দিকে কুমিল্লা স্টেডিয়াম ও কুমিল্লা জিলা স্কুল, উত্তরে নগর উদ্যান ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। উত্তর কোণে রানীর কুঠির। পশ্চিম পাড়ে পথচারীদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে।

কুমিল্লায় বেড়াতে এলে দিঘিটি না দেখে কেউ ফেরেন না। দিঘির পাড়ের গাছের সারি ধর্মসাগরকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। কান পাতলে গাছের পাতার আড়াল থেকে ভেসে আসে পাখির কলরব। উত্তর পাড়ে দাঁড়ালে দিঘির পানি ছুঁয়ে আসা বাতাস অনুভব করা যায়।

রাজমালা গ্রন্থ অনুসারে, ধর্মমাণিক্যের ৩২ বছর রাজত্ব করেন (১৪৩১-৬২ খ্রিষ্টাব্দ)। ধর্মসাগর উৎসর্গের সময় যে তাম্রলিপি তৈরি করা হয় তাতে বলা হয়, ‘চন্দ্র বংশোদ্ভব ধর্মমাণিক্য শস্য-সমন্বিত ফল ও বৃক্ষরাজি পূর্ণ উনত্রিশ দ্রোণ ভূমি দান করিলেন। আমার বংশ বিলুপ্ত হইলে যদি এই রাজ্য অন্য কোনো ভূপতির হস্তগত হয়, তিনি এই ব্রহ্মবৃত্তি লোপ না করিলে আমি তাহার দাসানুদাস হইব।’

রাজা যে উদ্দেশ্যে ধর্মসাগর খনন করেছিলেন, এটির সেই ব্যবহার এখন আর নেই। বিশাল শান্ত এই দিঘি মানুষের পানির তৃষ্ণা নিবারণের উৎসের মর্যাদা হারিয়েছে বহু বছর হলো। তবে ঠিকই মনের তৃষ্ণা মিটিয়ে যাচ্ছে।

নগরীর যে কয়টি স্থান শচীন দেববর্মণ আর কাজী নজরুল ইসলামের ভাবুক মনকে টানত, এর একটি এই ধর্মসাগর পাড়। একসঙ্গে দুজনের অনেক সময় কেটেছে বলে শোনা যায়। হয়তো অনেক গানের কলি, কবিতার অনেক শব্দ তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন ধর্মসাগর পাড়ের এলোমেলো হাওয়া থেকে।

দিঘিটি খনন হওয়ার পর থেকে কখনোই না শুকানোর কারণে এতে বিরল প্রজাতির জলজ প্রাণী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

এ ছাড়া দিঘির সৌন্দর্য বাড়াতে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে চারু শিল্পী জুনায়েদ মোস্তফার মোজাইক আর্ট। এতে রয়েছে বোটাসহ সিরামিক ডিজাইনের বেঞ্চি। এসব শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। অন্যদিকে এর প্রবেশ দ্বারে স্থাপন করা হয়েছে আয়না।

নগরীর মাঝখানে হওয়ায় এর রয়েছে অনেক প্রবেশ পথ। নগরীর পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে এলে বাদুরতলার কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে রয়েছে প্রবেশপথ, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল দিয়ে এলে ঈদগাহ, স্টেশন ক্লাব বা শিশুপার্কের দিকে রয়েছে প্রবেশপথ। উত্তরাঞ্চলে এলে ডিসি পুকুরের সামনে দিয়ে যাওয়া যাবে। এ ছাড়া চাদিকে রয়েছে একাধিক পকেটগেট।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল সাক্কু বলেন, ‘ধর্মসাগরকে আমরা আরও দৃষ্টিনন্দন করতে কাজ করছি। বর্তমানে এর একপাশ দিয়ে হাঁটার ব্যবস্থা রয়েছে। ধর্মসাগর দিঘির চারদিকে হাঁটার জন্য উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ পাড়সহ চারদিকে রাস্তা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত