Ajker Patrika

পিসি কলেজে বহিরাগতদের দাপট

এস এস শোহান, বাগেরহাট
আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭: ১৬
পিসি কলেজে বহিরাগতদের দাপট

দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সরকারি পিসি কলেজে দীর্ঘদিন ধরে বহিরাগত অছাত্রদের আধিপত্য রয়েছে বলে অভিযোগ। নবীনবরণ, বিদায় অনুষ্ঠান, জাতীয় দিবস, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাঁদের। ভর্তি, ফরম পূরণ, টার্ম পেপারের মতো একাডেমিক কার্যক্রমও অনেকটা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। কলেজের দাপ্তরিক কাজেও হস্তক্ষেপ করেন তাঁরা। বহিরাগতদের এসব অন্যায় এত দিন মুখ বুজে সহ্য করেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা।

সম্প্রতি কলেজের অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এই অবস্থায় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বহিরাগতদের বের করে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা।

সরকারি পিসি কলেজশিক্ষক কর্মকর্তা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ জানুয়ারি শিক্ষার্থী পরিচয়ে কিছু বহিরাগত কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুল আলম খানকে জনসমক্ষে হেনস্তা করেন। পরে জোর করে অধ্যক্ষের ব্যবহৃত সরকারি গাড়ি নিয়ে ছাত্র সংসদের সামনে আটকে রাখেন। এ ঘটনায় ৩১ জানুয়ারি কলেজশিক্ষক কর্মকর্তা পরিষদের পক্ষ থেকে জরুরি সভা ডাকা হয়। ওই সভায় কলেজে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বেশকিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষক পরিষদের নেতারা।

পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ ফেব্রুয়ারি কলেজে প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমে বহিরাগতদের অযাচিত হস্তক্ষেপের বিষয়ে জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে একটি অবগতিপত্র পাঠানো হয়। অধ্যক্ষ স্বাক্ষরিত অবগতিপত্রে বহিরাগতদের কারণে কলেজে সৃষ্ট নানা সমস্যা উল্লেখ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়।

অবগতিপত্রে আরও বলা হয়, ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসসমূহে শিক্ষার্থী পরিচয়ে বহিরাগতরা অবস্থান করায় পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও দাপ্তরিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করছে তারা। তারা টার্ম পেপার প্রস্তুত, ভর্তি ও পরীক্ষার আবেদনপত্র উত্তোলন বাবদ অবৈধ টাকা আদায় করছে। বহিরাগতদের কারণে ক্যাম্পাস এখন মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। অধ্যক্ষের গাড়ি জোর করে নিয়ে ছাত্র সংসদের সামনে রেখেছে। তাদের আচরণে অধ্যক্ষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এই অবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করে শিক্ষক পরিষদ।

শুধু শিক্ষক পরিষদ নয়, সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যেও বহিরাগতদের এমন আচরণে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কলেজের বিভিন্ন অনৈতিক কাজে নেতৃত্ব দেওয়াদের মধ্যে ইকবাল হাসান বাপ্পি, কাওছার আহমেদ, রাজিবুল হাসান, মুমিনুল হক আকাশ, সন্দীপ শিকদার, অসীত কুমার দে, লেলিন পারভেজ, অনিরুদ্ধ দাস গোপাল, নিলুফা ইয়াসমিন পাখি, আফসানা মিমি, আরমান সরদার, আল আমিন ফেরদাউস ও রায়হান হৃদয় অন্যতম। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সরকারি পিসি কলেজে দীর্ঘদিন ধরে প্রাইভেট ডিগ্রিতে ভর্তি রয়েছেন। তবে তাঁরা চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন না।

কলেজ ছাত্রাবাসে থাকা এক শিক্ষার্থী বলেন, পরিবার ছেড়ে এখানে পড়াশোনা করতে এসেছেন বড় ভাইদের হুকুম তামিল করতে নয়। তাঁদের যেকোনো সময় ছাত্রলীগের বা অন্য কোনো প্রোগ্রামে এক ধরনের জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়। কলেজের ক্লাস, টিউশনি বা যত জরুরি কাজ থাক না কেন, তাঁদের যেতে হয়। না গেলে নানা ধরনের ঝামেলা করে। পিসি কলেজে পড়েই বিপদে পড়েছেন তাঁরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রতিটি পরীক্ষার সময় ছাত্র সংসদ থেকে ফরম তুলতে হয়। বাইরে থেকে ফরম পূরণ করে আনলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ফরম পূরণের জন্য অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। ২০ টাকার ফরম ১০০ টাকা দিয়ে পূরণ করতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক বলেন, শিক্ষকদের কাছ থেকে টার্ম পেপারের বিষয় নিয়ে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের নামে জমা দেওয়া হয়। এই বাবদ প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা আদায় করে। কোনো শিক্ষার্থী আসতে না পারলে বিকাশের মাধ্যমে টাকা নেয়। শিক্ষা নিয়ে এই ধরনের নজিরবিহীন বাণিজ্য বন্ধ না হলে ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও এক শিক্ষক বলেন, কলেজ ক্যাম্পাস থাকে ছাত্রলীগ এবং বহিরাগতদের দখলে। কলেজ চলাকালে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে ভীতির সৃষ্টি করে। সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে মাদকের আসর বসে। কলেজে স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ নেই।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে ইকবাল হাসান বাপ্পি বলেন, তিনি একসময় পিসি কলেজে পড়তেন, এখন পড়েন না। কলেজে যানও না। অন্যদের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

বর্তমানে পিসি কলেজের শিক্ষার্থী না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে ছাত্র সংসদের এজিএস আফসানা মিমি বলেন, ২০ দিনের বেশি সময় ধরে তিনি কলেজে যান না। অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত ও গাড়ি নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি তেমন কিছু জানেন না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগগুলো আসলে অপপ্রচার। এসব বিষয়ে তদন্ত করা হলে সঠিক তথ্য জানা যাবে।

এ বিষয়ে জানতে রাজিব হাসানকে ফোন করা হলে তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। অসীত কুমার দেকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আসাদুল আলম খান বলেন, ২০২১ সালের ২ অক্টোবর যোগ দেওয়ার পর থেকে দেখছেন, কলেজের দাপ্তরিক, একাডেমিক কার্যক্রমসহ সব ক্ষেত্রে বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ রয়েছে। কলেজ ক্যাম্পাস, ছাত্রাবাস-ছাত্রীনিবাসে বহিরাগতরা অবস্থান করছে। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের কাছে ব্যবহারিক খাতা বিক্রি, টার্ম পেপার প্রস্তুত, ভর্তি ও পরীক্ষার আবেদনপত্র উত্তোলন বাবদ অবৈধ টাকা আদায় করছে। তাদের কারণে ক্যাম্পাস এখন মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বহিরাগতদের অনৈতিক কার্যকলাপের প্রতিবাদ করায় তাকে হেনস্তা ও অপমান করে। ছাত্র-ছাত্রী নামধারী কিছু বহিরাগতরা বাগেরহাট পুরোনো কোর্ট চত্বর এলাকা থেকে তাঁর অফিসের গাড়ি জোর করে নিয়ে যায়। বর্তমানে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক বলেন, কলেজের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যক্ষের পক্ষ থেকে একটি অবগতিপত্র পেয়েছেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত রয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নিজের প্রস্রাব পান করে ‘আশিকি’ অভিনেত্রী অনু আগারওয়াল বললেন, ‘আহা অমৃত’

মে. জে. ফজলুরের সেভেন সিস্টার্স দখলের মন্তব্য সমর্থন করে না সরকার: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিংকের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের বিস্তারিত চায় ভারত

নির্দেশনা মানেননি পাইলট, মদিনা-ঢাকা ফ্লাইটকে নামতে হলো সিলেটে

গায়ে কেরোসিন ঢেলে কলেজছাত্রীর আত্মহনন, পলাতক ইমাম গ্রেপ্তার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত