Ajker Patrika

‘লেফট রাইট লেফট...’

এ আর চন্দন, ঢাকা
‘লেফট রাইট  লেফট...’

এক দিন বিরতির পর ১৯ মার্চ ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে তৃতীয় দফা আলোচনা হয়। ১০ মিনিট স্থায়ী এই বৈঠকে অন্য কেউ ছিলেন না। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক হয়।

আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামাল হোসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন। দুই ঘণ্টার বৈঠকে পরদিনের আলোচনার কার্যপরিধি ঠিক করা হয়। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকে প্রধান শিরোনাম করা হয়, ‘শীর্ষস্থানীয় সহকর্মীসহ অদ্য মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক’। সংবাদে সাত কলাম শিরোনাম হয় ‘আজ উপদেষ্টাসহ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক’। দৈনিক পাকিস্তানের শিরোনাম ছিল ‘আলোচনায় এক ধাপ অগ্রগতি’।

ঢাকাসহ সারা দেশে এ দিনও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। পরদিন দৈনিক পাকিস্তানে এ-সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম করা হয় ‘ঢাকা এখন মিছিলের নগরী’। পূর্বদেশ শিরোনাম করে ‘গৃহশীর্ষে কালো পতাকা উড়ছে আর রাস্তা এখনো মুখর বিক্ষোভে’।

একাত্তরে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে জানাজানি হলো, ৫৭ ব্রিগেডের প্রধান জাহানজেব আরবাবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা ২ ইবিআরকে নিরস্ত্র করতে জয়দেবপুরের দিকে এগিয়ে আসছে। দ্রুত হাজারো শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ চারদিক থেকে লাঠিসোঁটা, বন্দুকসহ জয়দেবপুরে উপস্থিত হয়। জয়দেবপুর রেলগেটে মালগাড়ির বগি, গাছের গুঁড়ি, ইত্যাদি দিয়ে বিশাল ব্যারিকেড দেওয়া হলো। জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত আরও পাঁচটি ব্যারিকেড দেওয়া হয়।

একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি ছুড়লে শহীদ হন নেয়ামত ও মনু খলিফা; আহত হন শত শত মানুষ। ব্রিগেডিয়ার আরবাব চান্দনা চৌরাস্তায় এসে আবার প্রবল বাধার মুখে পড়েন। নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত এক পাঞ্জাবি সেনাকে পেছন থেকে আক্রমণ করলে অন্যরা তার রাইফেল কেড়ে নেন। কিন্তু আর এক পাঞ্জাবি সেনা হুরমতের মাথায় গুলি করলে তিনি সেখানেই মারা যান। পরদিন ইত্তেফাকের প্রধান প্রতিবেদনের ওপরে রাখা হয় ‘জয়দেবপুরে জনতায়-সেনাবাহিনীতে সংঘর্ষঃ অন্যূন ৩ জন নিহতঃ সান্ধ্য আইন জারি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি। ডান দিকে ছাপা হয় জয়দেবপুরের ঘটনা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিন্দা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে ছাত্র ইউনিয়নের নিবিড় প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল ৮ মার্চ থেকে। বেশ কয়েক শ ছাত্রছাত্রী ‘গণ বাহিনী ছাত্র ইউনিয়ন’ নামে সংগঠিত হয়ে প্রতিদিন ‘কুচকাওয়াজ’ নামের প্রশিক্ষণে অংশ নিত ডামি রাইফেল নিয়ে। একাত্তরের ১৯ মার্চ দৈনিক পাকিস্তানে শেষ পাতায় ডান দিকে ছাত্রীদের রাইফেল চালনা শেখার চার কলাম ছবিসহ মোট তিনটি ছবি ও প্রতিবেদন ছাপা হয়। ‘লেফট রাইট লেফট তালে তালে ওরা পা মেলাচ্ছিল’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘লেফট রাইট লেফট, লেফট রাইট লেফট—শব্দের তালে তালে ওঠানামা করছিল ওদের গর্বিত পাগুলো।

ফাল্গুনের তপ্ত রোদে গা ভিজিয়ে ওরা একসাথে তৈরী করছিল ওদের নিয়মতান্ত্রিক পদক্ষেপ। ট্রেনারের আওয়াজের তালে তাই ছন্দভরা শব্দের ঢেউ উঠছিল বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়ামের মাঠটাতে—লেফট রাইট লেফট...। তালে তালে পা ফেলছিল এই বাংলার কয়েকশ ছেলেমেয়ে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ওরা মার্চ করছিল। মেয়েরাও অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে প্যারেড করছিল। নানা বয়সী মেয়ে আছে ওদের মধ্যে। মধ্যবয়সী থেকে বালিকা পর্যন্ত। ছেলেদের পাশে দাঁড়িয়ে গর্বিতভাবে ওরা পা মেলাতে চেষ্টা করছে।’

করাচিতে জাতীয় পরিষদের স্বতন্ত্র সদস্যসহ সংখ্যালঘিষ্ঠ দলগুলোর পার্লামেন্টারি পার্টির নেতারা এক বৈঠকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোবিরোধী একটি যুক্তফ্রন্ট গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইত্তেফাকে পরদিন এ-সংক্রান্ত খবর ছাপা হয় প্রধান শিরোনামের নিচে ‘পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ’ শিরোনামে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত