Ajker Patrika

ভালোর পক্ষে যখন সাধারণ মানুষ

স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ৩৫
ভালোর পক্ষে যখন সাধারণ মানুষ

এ কথা বলা বেশ কঠিন যে, এ দেশের সাধারণ মানুষ খুব সহজেই ভালোর দেখা পেয়েছে কিংবা ভালোয় বসবাস করেছে নির্বিঘ্নে, যা তার ও তাদের জীবনকে করেছে নিরাপদ। নিরাপদ না হলেও, ভালোভাবে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা না দেখলেও সাধারণ মানুষ ভালোর পক্ষেই তার অবস্থানকে প্রতীয়মান করেছে বারংবার, ভালোটাই দেখতে চেয়েছে, পেতে চেয়েছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সাধারণ মানুষ ভালোর সন্ধান পায়নি ভালোকে মনে-প্রাণে চেয়েও, প্রার্থনা করেও এক দিন নয়, বহুদিন সেই আশাহতের ঘটনা। সাধারণ মানুষ বোকা বনে গেছে তখনই, যখন তাদের বোকা ভাবা হয়েছে। বোকা থাকতে থাকতে অতিচালাক হয়ে উঠলেও সাধারণ মানুষ তার, তাদের জীবনের পরিবর্তন কখনোই আনতে পারেনি। তার অন্যতম কারণ, যারা সাধারণ তারা কখনোই অসাধারণ হতে চায় না, চায়নি। যে অসাধারণত্ব ক্ষমতাবলে, ক্ষমতার মোহে কেউ কেউ কিংবা অনেকেই অর্জন করেছে, করছে।

কেমন ভালো থাকতে চান—এমন একটা প্রশ্নের জবাব সাধারণ মানুষ খুব সহজেই দেবে। একটা শ্রেণির জবাব হবে, ‘দুবেলা খেয়েপরে,  ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষ বানিয়ে সুস্থভাবে ও নিরাপদে থাকতে চাই। এই নিরাপত্তা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে—দুভাবেই হতে হবে। তা ছাড়া রাষ্ট্রের যেসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান জনগণের রাজস্বে চলে, সেখান থেকে সব অধিকার বিনা প্রতিবন্ধকতায় ভোগ করতে চাই। কোনো ধরনের প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা দেখতে চাই না।’ আরেক শ্রেণি হয়তো বলবে, ‘সব ধরনের নাগরিক অধিকার ভোগসহ সংবিধানসম্মতভাবে একজন নাগরিক তার ন্যায্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে, সংস্কৃতির চর্চা করবে, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারবে—এটাই হলো ভালো থাকা।’ আইনের যথাযথ প্রয়োগ তারা দেখতে চায়।

একজন রিকশাচালক চাইবেন আয় অনুযায়ী ব্যয়ের সামর্থ্য থাকুক। এবং তাঁর জীবনে আরও সচ্ছলতা আসুক। সন্তানকে নিয়ে তারও একটা স্বপ্ন থাকে, সেই স্বপ্ন সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখার। নিজের মানবমর্যাদা পাওয়ার। একজন রিকশাচালক কখনোই বৈমানিক হওয়ার চিন্তা করেন না, স্বপ্ন দেখেন না। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখেন তাঁর সন্তান বৈমানিক হবে, একজন ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে অন্য সবার মতো। যাঁরা শ্রমজীবী মানুষ, তাঁরা অতিরিক্ত কোনো কিছুই পেতে চান না। যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকুই চান। বেশি চাওয়াদের সঙ্গে অল্প চাওয়াদের জীবনাচরণে ব্যাপক ফারাক থাকে। বেশি চাহিদাবাজেরা আবার অল্প চাহিদাপ্রত্যাশীদের শোষণ-শাসন করে সহায়তার নামে, মানবতার ব্যানারে। বিচক্ষণ ব্যক্তিরাই কেবল তা অনুধাবন করতে পারেন। যাই হোক, প্রকৃত মানুষ মাত্রই ভালোর পক্ষে থাকে, ভালোয় বসবাস করে।

অনেক সময়, অনেক ক্ষেত্রে ভালোর সংজ্ঞা নিরূপণ হয় ব্যক্তি, গোষ্ঠীর চেতনার ওপর দাঁড়িয়ে। যে ব্যক্তির গোষ্ঠী প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর, তিনি বা তাঁরা যাই-ই বলেন, সেটাই সমাজে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। অর্থাৎ, সমাজ ক্ষমতাধরদের চেতনায় চলে। চলতে অভ্যস্ত হয় অনেকটা বাধ্যবাধকতায়। সেই চেতনা ভালো হোক কিংবা মন্দ। ক্ষমতাধরদের ভালো বা মন্দ চিন্তার, বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। যা করেন, সেটাই ভালো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। দুঃখজনক ঘটনা হলো, সাধারণ মানুষের অধিকাংশই দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। যাদের সব ধরনের পরিবেশ, পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। ধনীদের আরও ধনী হওয়ার রেকর্ড যেমন আছে, দরিদ্রদের আরও দরিদ্র হওয়ার রেকর্ডও আছে। এর নেপথ্যের ঘটনা কেউ গভীরভাবে দেখে না। দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। সবাইকে সন্তুষ্ট করে রাখার চেষ্টা চলে। এমনটাই চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে।  

অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও সাধারণ মানুষ সহনশীল পরিবেশ চায়। প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা সাধারণ মানুষের হিসাবে নেই। সাধারণ মানুষের এহেন বিনয়ী স্বভাবকে ব্যবহার করে স্বার্থবাদী শ্রেণি। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে নিজেদের ফায়দা লোটে। তারা বন্ধু সাজে। বন্ধুত্বের বেশে নিজেদের আখের গোছায়। এটা সত্য যে, সোজা-সরল মানুষকে ঠকানো সহজ। কারণ,  তারা অন্যকে বিশ্বাস করতে শেখে, অন্যকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করে। এখানেই সে ধরা খায়। বিশ্বাস হয়ে ওঠে বিষফোড়া। সমাজে বিশ্বাস এক বহুল ব্যবহৃত পোশাক, যা কমবেশি সবাই পরিধান করে। সময়মতো আবার তার নকশা পরিবর্তন করে। এই কাজটা বেশি হয় চতুর শ্রেণিতে। 
ভালো কথা বলার মানুষ কিন্তু কমে আসছে দিনে দিনে। যা শোনা যায়, তা পুনরাবৃত্তি এবং নতুন ভঙ্গিতে। ভেতরে আলো নেই, অথচ আলোর মতো একটা কিছু চোখে লাগে। তাই দেখেই মানুষ আলোর স্বপ্ন দেখে, আলোকিত হতে চায়। অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে মানুষের আবেগ বেশি বলেই হয়তো মানুষ অল্পতেই স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। এটা তার দোষ নয়, সহজাত প্রবৃত্তি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত