Ajker Patrika

দাসত্বের বেড়াজাল

আব্দুর রাজ্জাক
দাসত্বের বেড়াজাল

ব্রিটিশ আমল গেল, এল পাকিস্তানি আমল। সে সময়েও চা-শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি হয়নি। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর অল্প কিছু অপুষ্টিকর খাবার খেত। একদিন কাজ না করলে পরের দিন উপোস থাকতে হতো।

চা-বাগানের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ও বদ্ধ জায়গায় প্রায়ই বিভিন্ন রোগশোকে ভুগত শ্রমিকেরা। কোনো মানবাধিকারের বালাই ছিল না, ছিল না যুগের সঙ্গে চাহিদা মেটানোর আনুষ্ঠানিকতা। পাকিস্তান আমল পর্যন্ত চা-শ্রমিকদের ভোটাধিকার ছিল না। কারও বিরুদ্ধে নালিশ করা, কারও ব্যাপারে কোনো অভিযোগ তোলার কোনো আইনি সুযোগ ছিল না। বাগান কর্তৃপক্ষ শত অন্যায়-অবিচার করতে পারত শ্রমিকদের। শ্রমিকদের এই জীবনে অভ্যস্ত করার একটি মূল কারণ ছিল, তাদের যেন মেধাবিকাশ না হয়। মেধাবিকাশ হলে তারা পৃথিবী সম্পর্কে জানতে পারবে, শোষণের বিরুদ্ধে একদিন রুখে দাঁড়াবে।

চা-শ্রমিকদের ছেলেমেয়ে যেন পড়াশোনা না করে এবং ভালো খাবার খেয়ে মেধাবিকাশ না করে, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ সজাগ ছিল। পুষ্টিকর খাবার, ভালো বাসস্থান ও সুচিকিৎসা দিলে মানুষের আয়ু বেড়ে যায়। তারপরও একটি বয়সের পর মানুষকে বিশ্রাম দিতে হয়। সেই বিশ্রাম যেন না দিতে হয়, চা-শ্রমিকেরা যেন তাড়াতাড়ি মরে যায়, সে জন্যই এ রকম ব্যবস্থা ছিল। মালিক কর্তৃপক্ষের একান্ত চাওয়া ছিল, যত দিন শ্রমিক কর্মক্ষম থাকবে তত দিনই যেন বাঁচে; মরে গেলে তাঁদের ছেলেমেয়েরা কাজ করবে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু চা-শ্রমিকদের ভোটাধিকারের আওতায় আনেন, ন্যূনতম জীবনধারণের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে একটি মজুরিকাঠামো তৈরি করে দেন। বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশের পরে চা-শ্রমিকেরা নিজেদের মানুষ ভাবতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসন অবসরের পরে এই শ্রমিকদের কল্যাণের লক্ষ্যে কেউ তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

চা-শ্রমিকদের যে বাসস্থানের কথা বলা হয়, সেই বাসস্থান আসলেই ‘আসমানিদের বাড়ি’র মতো। হুমায়ূন আহমেদের দুই দুয়ারি ঘরের একটি দুয়ার বাদ দিলে অর্থাৎ এক দুয়ারি ঘরের মতো, মাটির বেড়া, ওপরে টিনের ছাউনি, একটি মাত্র রুম। সেখানে চার থেকে ছয়জন মানুষের বসবাস। এ রকম ৫০-১০০ ঘর মিলে একটি টিউবওয়েল, মলমূত্র ত্যাগের জায়গা নেই।

আমার এক আত্মীয় সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলেন। তাঁর কাছে শোনা, কর্তৃপক্ষ ম্যানেজারকে নির্দেশ দিত কোনো শ্রমিক যেন কোনো রকম অর্থকড়ি সঞ্চয় করতে না পারে। নইলে তারা বাইরে গিয়ে ব্যবসা বা অন্য কাজ করতে পারে। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করেই চা-শ্রমিকদের জন্য একটি নেশাজাতীয় খাবারের ব্যবস্থা করে। খাবারটি হলো, পান্তাভাত পচানো অর্থাৎ ফারমেনটেশন করা একজাতীয় তরল পানীয়। সপ্তাহ বা মাসের শেষে যদি কোনো শ্রমিক কোনো রকম সঞ্চয় করে, সেটা তারা ওই তরল খেতে ব্যয় করে।

চা-শ্রমিকদের চা-বাগানের বাইরে গিয়ে কোনো বিনোদনের সুযোগ নেই। ওরা শুধু নিজেদের মতো করে ঘরোয়াভাবে চা-বাগানের মধ্যে ছোটখাটো অনুষ্ঠান করতে পারে।

বর্তমানে পঞ্চগড়ে কিছু চা-বাগান গড়ে উঠেছে। সেখানে সমতলের মানুষেরা কাজ করে। তাদের দৈনিক বেতন ৪০০ টাকার ওপরে। তারপরও কিন্তু বাগানের কর্তৃপক্ষ অনেক লাভ করে। এসব বাগান থেকে সিলেটের মতো উন্নত মানের বা পরিমাণে বেশি চা পাওয়া যায় না। এরপরও বাগানগুলো ভালোভাবে টিকে আছে। চট্টগ্রামের কয়েকটি চা-বাগান কর্তৃপক্ষও শ্রমিকদের ৪০০ টাকার বেশি বেতন দেয়।  

যত সব শোষণের হাতিয়ার তৈরি হয়েছে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে, যেখানে পরিমাণে বেশি ও ভালো মানের চা উৎপন্ন হয়। সেখানে শ্রমিকদের ওপর শোষণের হাতিয়ার চলছে যুগ যুগ ধরে। এই শোষণের একমাত্র কারণ তারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা; তাদের মাঝে শিক্ষার আলো নেই, তারা সমতলের মানুষের চেয়ে চলনবলনে, শারীরিক গঠনে একটু আলাদা। চা-বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের এটাই বুঝিয়ে দিয়ে আসছে—তোমরা আমাদের মতো মানুষ নও, তোমরা তোমাদের শ্রেণির মতো। অতএব, তোমরা যে বেতন পাও সেটা তোমাদের মতো করেই দেওয়া হয়, তোমাদের যোগ্যতা অনুসারে।

লেখক: প্রকৌশলী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখামাত্র পুতিনকে গ্রেপ্তারের আহ্বান

জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে উচ্চপদস্থ বোর্ড গঠন: আইএসপিআর

ফেসবুকে ছাত্রলীগ নেতার ‘হুমকি’, রাবিতে ১৫ আগস্টের কনসার্টে যাচ্ছে না আর্টসেল

পাবনায় প্রবাসীর স্ত্রীকে নিয়ে এএসআই উধাও, থানায় শ্বশুরের জিডি

সিঙ্গাপুরে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ, আবেদন ফি মাত্র ৭ হাজার টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত