Ajker Patrika

যে হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হলো না

সঙ্গীতা ইমাম
আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২২, ০৯: ৫৮
যে হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হলো না

‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’—বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার এই পঙ্‌ক্তিটিই ছিল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের স্লোগান। ১৯৯৯ সালের ৪, ৫ ও ৬ মার্চ যশোরের ঐতিহাসিক টাউন হল মাঠে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিনে এক ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হয় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। ওই দিন মৌলবাদী গোষ্ঠী উদীচীর সম্মেলনে বোমা মেরে ১০টি তাজা প্রাণ কেড়ে নেয়। উদীচীর ওপর বোমা হামলার মাধ্যমেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ সন্ত্রাসের নজির শুরু হয়।

উদীচীর একাদশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায়। সে সময় প্রথম সাংগঠনিক দিক থেকে শ্রেষ্ঠ জেলা নির্বাচন শুরু হয়। সাংগঠনিক যোগ্যতার ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ জেলা হিসেবে নির্বাচিত হয় যশোর জেলা। দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় যশোর জেলার ওপর। সেবারই প্রথম ঢাকার বাইরে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যশোর জেলায় আয়োজিত প্রতিনিধি সম্মেলনে সারা দেশ থেকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ সাংস্কৃতিক কর্মী ও উদীচীর ভাই-বোনেরা আসেন। এই সম্মেলন হয়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক কর্মীদের এক অপূর্ব মিলনমেলা।

৬ মার্চ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল। ভারতের মেদিনীপুর থেকে আসা সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ষড়ভুজ’সহ আরও বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনা চলছিল মঞ্চে। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছিলেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর যশোর জেলা সংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত ডি এম শহীদুজ্জামান। তখনই পর পর দুটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হয় অনুষ্ঠানস্থলে। উদীচীর ১০ জন সাংস্কৃতিক কর্মী এতে প্রাণ হারান, আহত হন দুই শতাধিক। নিহত ১০ জন হলেন নূর ইসলাম, নাজমুল হুদা তপন, সন্ধ্যা রানী ঘোষ, ইলিয়াস মুন্সী, শাহ আলম বাবুল, বুলু, রতন রায়, বাবুল সূত্রধর, শাহ আলম ও রামকৃষ্ণ।

এই নৃশংস হামলার ২২ বছর পেরিয়ে গেছে। এই ২২ বছর বিচারহীনতার ২২ বছর, জঙ্গিবাদী, মৌলবাদী গোষ্ঠীর নৃশংস আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়ানোর ২২ বছর, ১০ জন সাংস্কৃতিক কর্মী ও সহযোদ্ধা হারানোর ২২ বছর। ২২টি বছর ধরে উদীচীর ভাই-বোনেরা এই নৃশংস ঘটনার বিচার দাবি করে আসছেন। কোনো বিচার হয়নি কিন্তু বারবার হামলা হয়েছে উদীচীসহ দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর।

এই ভয়াবহ হামলার পর সারা দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন উদীচীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এ হামলা কেবল উদীচীর ওপরই নয়, এ হামলা ছিল বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের ওপর এক ন্যক্কারজনক হামলা। তাই আমরা যেমন হারিয়েছিলাম আমাদের সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধাদের, তেমনি আবার সাহসে-প্রতিরোধে সারা দেশের প্রগতিশীল সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এই হামলার প্রতিবাদে।

উদীচীর দ্বাদশ সম্মেলনে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন যথাক্রমে নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম এবং গণসংগীতশিল্পী মাহমুদ সেলিম। বোমা হামলায় আহতদের উদ্ধার এবং সুচিকিৎসার জন্য উদীচীর তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে সারা দেশের উদীচীর ভাই-বোনেরা একসঙ্গে কাজ শুরু করেন।

উদীচী আমাদের কাছে কেবলই একটি সংগঠন নয়; এ আমাদের এক পরিবার। পরিবারের সদস্যদের রক্ষার জন্য সারা দেশের উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন তখন। এখানেই একটি সংগঠনের শক্তি। ঘটনার পরদিন মারাত্মক আহতদের যশোর থেকে হেলিকপ্টারে করে খুলনায় এবং ঢাকা এনে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়। নিহত ১০ জনের পরিবারের সব দায়িত্ব নিয়েছে উদীচী। তাদের মধ্যে উদীচী পরিবারের সদস্য ছিলেন ৫ জন। বাকি ৫ জন ছিলেন অনুষ্ঠানের দর্শক-শ্রোতা।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারের নামে পোস্ট অফিসে ৫০ হাজার টাকা জমা করে দেন। নিহতদের মধ্যে যাঁদের পরিবারের কোনো সদস্য চাকরির উপযুক্ত, তাঁকে চাকরির বন্দোবস্ত করে দেওয়া, কাউকে দোকান করে দেওয়া, রিকশা বা ভ্যান কিনে দেওয়া থেকে শুরু করে সার্বিক দায়িত্ব তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে পালন করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

যাঁদের অঙ্গহানি ঘটেছে, তাঁদের কৃত্রিম অঙ্গ সংস্থাপনের উদ্যোগও নিয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। আহতদের মধ্যে চারজন তাঁদের পা হারান। এই চারজনেরই কৃত্রিম পা সংযোজনের উদ্যোগ নেয় উদীচী। তৎকালীন সভাপতি সৈয়দ হাসান ইমাম প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করে জার্মানি থেকে কৃত্রিম পা এনে তা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সংযোজনের কাজ সম্পন্ন করেন। কৃত্রিম পা সংযোজনের পর উদীচীর ভাই-বোনদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাঁদের হাঁটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং সুস্থ হওয়ার পর বাড়ি পাঠানো হয়।

আজ ২২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু এই নৃশংস বোমা হামলার কোনো বিচার আমরা পাইনি। ঘটনার পরই হত্যাকাণ্ড ও বিস্ফোরণ নিয়ে দুটো পৃথক মামলা হয়। মামলার তদন্ত করেছিল সিআইডি। ২০০৬ সালের ৩০ মে মামলার রায় ঘোষণা হলে সব আসামি খালাস পেয়ে যায়। সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে ২০১১ সালে। কিন্তু আজও তার শুনানির কোনো সুরাহা হলো না। সেই থেকে মামলাটির বিচারকাজ থমকে আছে। মামলার ২৩ আসামির মধ্যে চারজনের ইতিমধ্যে মৃত্যু হয়েছে। বাকিরা জামিনে আছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি আলোচিত মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে বা এখনো চলছে। কয়েকটি মামলায় দণ্ডিত অপরাধীদের শাস্তিও কার্যকর হয়েছে। কিন্তু যশোর ট্র্যাজেডির বিচারকাজ শেষ না হওয়া দুঃখজনক। দেশে জঙ্গিবাদ দমনে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু উদীচীর ওপর বোমা হামলার কোনো বিচার না হওয়ার পেছনে বিশেষ কোনো রহস্য আছে কি?

এই ২২ বছর ধরে উদীচী যেমন যশোর হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছে, তেমনি এই বোমা হামলায় আহতদের পাশে আজও উদীচী দাঁড়িয়ে আছে তার মানবিক আদর্শ নিয়ে। সংগঠনের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল সেদিন, তাতে আমরা চূড়ান্তভাবে আহত হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু ভেঙে পড়িনি। কারণ, ‘সত্যেন রণেশের আঁকা পদচিহ্ন’ আমাদের শিখিয়েছে নিদারুণ দুর্যোগও সহযোদ্ধাদের নিয়ে কী করে মোকাবিলা করতে হয়।

লেখক:সঙ্গীতা ইমাম, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী,

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশসহ এশিয়ার ৫ দেশে সফর বাতিল করলেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনি

স্ত্রীকে হতে হবে নোরা ফাতেহির মতো, না খাইয়ে রেখে তিন ঘণ্টা করে ব্যায়াম করান স্বামী

বাংলা বলায় কলকাতার মার্কেটে ছুরি, বন্দুকের বাঁট ও হকিস্টিক নিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা

চাকরির নামে মিরপুর-শেওড়াপাড়ায় বাসায় ডেকে নারীর সঙ্গে ভিডিও ধারণের পর টাকা হাতিয়ে নিত ‘হানি ট্র্যাপ’ চক্র

দুস্থদের ৩৪ লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা মোহনগঞ্জ সমাজসেবা কর্মকর্তা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত