Ajker Patrika

আসলে কতটা মানবিক আমরা?

রিফাত মুনীর ইতি
আসলে কতটা মানবিক আমরা?

নিজের দেহের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি ও চোখের কর্নিয়া মৃত্যুর পর দান করে মানবিকতার এক বড় নজির রেখে গেল মাত্র ২০ বছরের সারা। পৃথিবীকে জানিয়ে গেল, ঠিক কীভাবে মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে হয়। এই যে মহৎ উদ্যোগকে সফল করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফলে দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর সচেতনতা, এর পেছনে আমার মনে হয় সারার চেয়েও বড় ভূমিকা রেখেছেন তাঁর মা। নিজের প্রচণ্ড মানসিক শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা তথা সত্যি সত্যি অসুস্থ, বিপদগ্রস্ত ও সাহায্যপ্রত্যাশীদের জন্য তাঁর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠা যেকোনো বিবেকবান মানুষের অন্তরকে নাড়িয়ে দেয়, আমাদের সত্যিকারের মহৎ কাজে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।

এখন দেখা যাক সারাকে নিয়ে মায়ের ভাবনার দিকটি। মেয়েটার মূলত ‘ব্রেন ডেথ’ চিকিৎসকদের ঘোষিত এমন একটি বিষয়, যা আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগে মোটামুটি সাধারণ মানুষের কাছেও স্পষ্ট একটি বিষয়। কোনো মানুষ তার মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেললে তাকে আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় জীবিত বলা চলে না, যদিও কৃত্রিমভাবে তার হৃদ্‌যন্ত্র সচল দেখানোর মেশিন চালু করা সম্ভব। এ ধরনের কেসে একজন মানুষের বেশ কিছু অঙ্গ প্রায় ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত বেশ কার্যকর সংকেত দেয়, যেটা সারার ক্ষেত্রে ঘটল। এখন মেয়ের চাওয়া পূরণে দীর্ঘকাল রোগভোগের পর যা অনিবার্য সত্য, সেই মৃত্যু এড়ানো অসম্ভব জেনে সারার মা যে মানসিক লড়াইয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন, তা সত্যি ভীষণ কঠিন। তিনি উপলব্ধি করলেন, তাঁর মেয়ের চোখের কর্নিয়া অন্যের চোখে সংযোজন মানে মূলত তাঁর মেয়েরই দৃষ্টি কোনো না কোনো উপায়ে ফিরে আসা কিংবা মেয়ের কিডনি প্রতিস্থাপনে সহায়তা করা মানে একজন মরণাপন্ন রোগীর পাশে সত্যিকারে এগিয়ে আসা। এই যে উপলব্ধি, এটি মূলত তাঁকে শুধু মেয়ের স্বপ্নপূরণে সহযোগী নয়, বরং আপামর অসুস্থ, বিপন্ন জনগণের প্রতি তাঁর সত্যিকার মানবতাবোধের পরিচয়কে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এই সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই মানবতা প্রতিষ্ঠা কিংবা মানবিক বোধের বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়।  

এবার দেখা যাক ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে আমাদের মানবিক চর্চার বিষয়টি। মুখে যতই বলি না কেন, মানবিকতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আমরা কতটা আন্তরিক, তা প্রশ্নবিদ্ধ। এ দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান যতটাই বাড়ুক না কেন, আমাদের ব্যক্তিগত উদারতা বা মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারার পরিবর্তন খুব শিগগির দেখা  যায় না। মানবদেহের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান রক্ত প্রতি তিন মাস পর পর তাদের কোষ পরিবর্তন করে বলে তা দান করা মূলত রক্তদানকারীর জন্যই স্বাস্থ্যসম্মত। অথচ এটি বুঝতে এবং আগ্রহী রক্তদাতাকে পারিবারিক সমর্থন পেতে যতটা বেগ পেতে হয়, অন্য কোনো কিছুতে তা হয় না। দেশে কর্নিয়া-সংক্রান্ত জটিলতায় অন্ধত্ব বরণকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও চক্ষুদানে ইচ্ছুক অনেক ব্যক্তি পান না পারিবারিক সমর্থন। যেমনটা দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রে ঘটে। শুনতে অবাক লাগবে, কিন্তু এটাই সত্যি যে জীবিত অবস্থায় প্রিয়জনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতি যত্নবান হওয়ার চেয়ে তার মৃত্যুর পর যেন বেশি করে মৃতদেহের প্রতি যত্নবান হওয়ার লোক দেখানো প্রতিযোগিতা চলে।  

এতেই শেষ নয়, সমাজে যারা শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী, তাদের প্রতিও আমাদের মানবিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা অতি সহজেই এটা বলি যে জন্মে কারও হাত থাকে না। একটি শিশুর জন্মগত ত্রুটি হোক কিংবা হোক পরবর্তী সময়ে তার আচরণগত কোনো ত্রুটি, তাকে মানবিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করে তার প্রতি সহনশীল আচরণ করতে হবে। কিন্তু আসলে বাস্তব চিত্র ঠিক তার উল্টো। এ দেশে সম্ভবত একজন জন্মকালীন প্রতিবন্ধী শিশুর মা কিংবা বাবা নিজেদের চরম অসহায় ভাবেন, সর্বদা শিশুটির নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা তাঁদের ঘিরে ধরে। সামাজিক জীবনে এই শিশুকে নিয়ে তাঁদের অস্বস্তি ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় প্রায়ই। যে নিদারুণ হীনম্মন্যতায় তাঁরা ভোগেন, সমাজের সদস্যরা তা বাড়িয়ে দেন কয়েক গুণ। এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানকে বিরত রাখেন প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশায়, নিজেদের বানানো, অন্ধ, লৌকিক সংস্কারে। এতে শিশুটির স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। শিশুর ব্যক্তিগত যে প্রতিভা, তা বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াই আমরা, তার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ অবরুদ্ধ করে দিই।  

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মানবিক ও সহানুভূতিশীল আচরণ যেমন কাম্য প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্ষেত্রে, তেমনি সমাজের সব ক্ষেত্রে তার চর্চা ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি।  

আমাদের সম্মিলিত, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা একটা মানবিক বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য—এই বোধ জাগ্রত করাই হোক সবার অঙ্গীকার।

রিফাত মুনীর ইতি, শিক্ষক ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত