Ajker Patrika

কেন ব্রাজিল কেন আর্জেন্টিনা

সাজিদ মোহন
কেন ব্রাজিল কেন আর্জেন্টিনা

ইফতেখার আহমেদ ফাহমি পরিচালিত ‘ফাউল’ নাটকটি দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে। নাটকের বাবা চরিত্র আর্জেন্টিনার সমর্থক, ছেলে চরিত্র পছন্দ করে ব্রাজিল। পিতা-পুত্রের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থনের কারণ গড়পড়তা সমর্থকদের মতোই। মা চরিত্রের ফুটবল সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তবু তিনি ইংল্যান্ড সমর্থন করেন, কারণ তাঁর ভাই থাকেন ইংল্যান্ডে!

কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতিটি ফুটবল বিশ্বকাপের মতোই আমাদের দেশের ফুটবলপ্রেমীরা মোটা দাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে দুই ভাগে। বাংলাদেশে কোন দলের সমর্থক বেশি—এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো পরিসংখ্যান নেই। ফুটবল বিশ্বকাপে ৫টি মহাদেশের ৩২টি দল, ইউরোপের এত দল; ভালো খেললেও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে ঘিরেই কেন এত উন্মাদনা? এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে জানতে হবে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা সমর্থনের পেছনে সমর্থকদের মনস্তত্ত্ব।

নিজেকেই করি প্রথম প্রশ্ন—কেন তুমি আর্জেন্টিনার সমর্থক? ছোটবেলায় দেখেছি আমার চাচা আর্জেন্টিনার সমর্থক ছিলেন।আর্জেন্টিনার গল্প করতেন। নাটকের মা চরিত্রের মতো আমিও ছোটবেলায় আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়ে গেলাম।

কেন ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা সমর্থন করেন—এমন প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন বয়সী ফুটবলপ্রেমীদের কাছে পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন উত্তর। ১৯৭৮ বিশ্বকাপের ফাইনাল, ১৯৮২ বিশ্বকাপের কিছু ম্যাচ, এরপর ১৯৮৬ বিশ্বকাপের বেশির ভাগ ম্যাচই সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন। ১৯৮২ সালে বিশ্বকাপের কিছু ম্যাচ দেখানো হলেও জেলা শহরে তখনো সহজলভ্য ছিল না টেলিভিশন, ১৯৮৬ বিশ্বকাপে কিছুটা সহজলভ্য হয়। পৌঁছে যায় গ্রাম পর্যন্ত। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ থেকেই মূলত মফস্বল ও গ্রামগঞ্জে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা তৈরি হয়। বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে গাঢ় হয় আত্মীয়তা।

মেক্সিকোর মেহিকোয় আয়োজিত ১৯৮৬ বিশ্বকাপে জয়ী হয়েছিল আর্জেন্টিনা। আমাদের দেশের ফুটবল দর্শকদের খেলা দেখার শুরুর বিশ্বকাপে জয়ী দল আর্জেন্টিনা তাঁদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। হাজার হাজার মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিল আর্জেন্টিনা। আর সেই বিশ্বকাপে রাজপুত্র ছিলেন ম্যারাডোনা। জিতেছিলেন গোল্ডেন বল। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার দুটি গোল ‘হ্যান্ডস অব গড’ ও ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ তাঁকে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি এনে দেয়। একক কৃতিত্ব আর নৈপুণ্য দিয়ে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে জায়গা করে নেন এ দেশের মানুষের হৃদয়েও।

১৯৮৬ বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতেছিল তিনবার (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০)। ‘দ্য গ্রেটেস্ট প্লেয়ার অব দ্য সেঞ্চুরি’খ্যাত কালো মানিক পেলের জাদুতেই এ তিনটি বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল। তিনটি বিশ্বকাপজয়ী পেলে অবসর নেন ১৯৭৭ সালে। ম্যারাডোনার মতো পেলের ক্রীড়ানৈপুণ্য টেলিভিশনে দেখার সৌভাগ্য বেশির ভাগ দর্শকের না হলেও, হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পেলের গৌরব ও সৌরভ পৌঁছে গিয়েছিল এ দেশের মানুষের কাছে। ব্রাজিলের তিনটি বিশ্বকাপ আর পেলের নৈপুণ্যের গল্পের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল মানুষের অন্তরে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘কালো মানিক’ শিরোনামে পাঠ্য পেলের জীবনী পড়েও অসংখ্য ভক্ত জুটেছিল পেলে ও ব্রাজিলের। আর মিডিয়া কাভারেজ তো আছেই।

১৯৮৬ বিশ্বকাপের পর অবশ্য পেলে-ম্যারাডোনাকেন্দ্রিক সমীকরণ পাল্টে গেছে অনেকটাই। এরপর ব্রাজিলের দুইবার (১৯৯৪, ২০০২) শিরোপা লাভ বাড়িয়েছে সমর্থক। উত্তরাধিকার সূত্রে ক্রমেই বেড়েছে দুই দলের সমর্থক। পেলে-ম্যারাডোনার পর দুই দলেই আলো ছড়িয়েছেন রোমারিও, রিভালদো, কাকা, রোনালদো, রোনালদিনহো (ব্রাজিল), বাতিস্তুতা, রিকুয়েলমের (আর্জেন্টিনা) মতো একাধিক বিশ্বনন্দিত ফুটবলার। সর্বশেষ মেসি ও নেইমারে বুঁদ হয়ে আছেন দুই দলের সমর্থকেরা।

যুগ যুগ ধরে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা যেভাবে সমর্থক ধরে রেখেছে এবং বাড়িয়েছে, চারবার বিশ্বকাপ জিতেও তা করতে পারেনি ইতালি ও জার্মানি। অবশ্য ইতালি ও জার্মানির তিনটি বিশ্বকাপই আমাদের দেশে টেলিভিশনে খেলা দেখা শুরু হওয়ার আগের। ইতালির ক্যানভেরো, জার্মানির মুলারের মতো তারকা ফুটবলার থাকলেও পেলে-ম্যারাডোনা, মেসি-নেইমারের সমকক্ষ তাঁরা নন। এ ছাড়া ঔপনিবেশিক সময়ের প্রভাব, সাদা চামড়ার খেলোয়াড়দের সঙ্গে একধরনের দূরত্ব এবং ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের সংগ্রামী জীবনের গল্প, ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা নৈকট্য তৈরি করেছে এ দেশের মানুষের সঙ্গে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার।

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার গণ্ডি পেরিয়ে অনেকেই সমর্থন করেন জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল ও অন্যান্য দল। ব্যতিক্রম দু-একজন বয়স্ক সমর্থকের দেখা মিললেও মূলত তরুণদের মধ্যে গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে আসার প্রবণতা লক্ষণীয়। এর কারণ, বছরব্যাপী দেশে দেশে চলতে থাকা ইউরোপা লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগ, প্রিমিয়ার লিগ, লা লিগা ইত্যাদি। এসব পেশাদার ফুটবল লিগে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, আতলেটিকো মাদ্রিদ, সেভিয়া, ম্যানচেস্টার সিটি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল, বায়ার্ন মিউনিখ, ইন্টার মিলান, জুভেন্টাস, পিএসজির মতো ক্লাবগুলোর হয়ে খেলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসি, নেইমার, এমবাপ্পে, বেনজেমা, ইব্রাহিমোভিচের মতো তারকা ফুটবলাররা।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্তরা ওয়েইন রুনি এবং রিয়াল মাদ্রিদের ভক্তরা দীর্ঘদিন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর খেলা দেখে প্রথমে ভক্ত হন রুনি-রোনালদোর, পরে তাঁদের ভালোবাসার টান এড়াতে না পেরে সমর্থন করেন ইংল্যান্ড-পর্তুগালের। অনেকে আছেন মৌসুমি সমর্থক। তাঁরা নির্দিষ্ট কোনো দলের স্থায়ী সমর্থক নন। একেক বিশ্বকাপে তাঁরা একেক দলের সমর্থক। বিভিন্ন পরিসংখ্যান ঘেঁটে কোন দলের কম্বিনেশন সেরা, কে বিশ্বকাপ জিততে পারে—এমন পূর্বানুমানের ভিত্তিতেও তাঁরা দল পছন্দ করে থাকেন।

এসব ছাড়াও বিচিত্র সব কারণে দল সমর্থন করেন ভক্তরা। কবি-সাহিত্যিকদের কেউ কেউ দেখেছি আর্জেন্টিনা সমর্থন করেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কারণে। রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসতেন যে দেশের মেয়ে, সেই দেশকে ভালো না বেসে পারেন কোনো বাঙালি?

লেখক: শিশুসাহিত্যিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত