Ajker Patrika

র‍্যাবের নিষেধাজ্ঞা মাথায় রেখে নির্বাচনী কৌশল নিচ্ছে পুলিশ

রাশেদ নিজাম, ঢাকা
র‍্যাবের নিষেধাজ্ঞা মাথায় রেখে নির্বাচনী কৌশল নিচ্ছে পুলিশ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শুরু হতে এখনো প্রায় এক বছর বাকি। কিন্তু এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে পুলিশ বাহিনী। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় বাহিনীটি। পুলিশের নতুন প্রধান বাহিনীর সদস্যদের মাঝে তেমনই আভাস দিয়েছেন বলে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গত বুধবার টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান পরিদর্শন শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ সফলভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবে।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, পুলিশ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। তারা আইন মেনে সর্বদা দায়িত্ব পালন করে। নির্বাচনে সংবিধান মেনে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিজেদের দায়িত্ব পালনে সব সময় সচেষ্ট থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। কোনো দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করার সুযোগ নেই।

৯ জানুয়ারি শেষ হওয়া পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে নিজেদের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে প্রকাশ করেছে পুলিশ। বেশির ভাগ চাওয়া ছিল ক্ষমতা ও পদবিষয়ক। যার সর্বাগ্রে ছিল আইজিপির পদকে ‘চিফ অব পুলিশ’, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার, র‍্যাবের মহাপরিচালকসহ (ডিজি) পুলিশ বাহিনীতে থাকা ১০টি অতিরিক্ত আইজিপির পদকে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার (গ্রেড-১) করে ‘আইজিপি’ পদ করার দাবি।

পুলিশ সপ্তাহের শেষ দিনে রাজধানীর রাজারবাগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সঙ্গে মতবিনিময়েও এসব দাবি তুলে ধরেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এসব দাবির লক্ষ্য ছিল আগামী নির্বাচনে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে তুলে ধরা।

আগামী নির্বাচন ও পুলিশের দাবিদাওয়া নিয়ে সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি ও উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার অন্তত চারজনের সঙ্গে কথা হয় আজকের পত্রিকার। তাঁরা বলেন, রাজনৈতিকভাবে বাহিনীকে ব্যবহারের দীর্ঘদিনের অভিযোগ থেকে কৌশলগত উপায়ে বের হতে চায় পুলিশ। গত দুই নির্বাচনে ঢালাওভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের যে অভিযোগ রয়েছে, সেখান থেকে বের হতে এখনই পরিকল্পনা ঠিক করা হচ্ছে।

র‍্যাবের প্রতি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং আসন্ন নির্বাচন ঘিরে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ পর্যবেক্ষণে রয়েছে বলে জানান দুই লাখ সদস্যের বাহিনীর শীর্ষ পদে থাকা এসব কর্মকর্তা।

একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসের আগে পুলিশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে—এমন প্রচারণায় ছেয়ে গিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সে কারণে সব দিক মাথায় রেখে নির্বাচনী কৌশল সাজানো হবে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি একটি গবেষণা প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০ আসনের মধ্যে কোন কোন আসনে ক্ষমতাসীন দল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে, তা উঠে আসে। আবার ওই ৫০টির মধ্যে ৩৬টি আসনে বিরোধী দলের প্রচার কীভাবে বাধা পায়, তা-ও উঠে আসে। এতে বলা হয়, সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, পুলিশ বা প্রশাসনের হুমকি ও হয়রানি, প্রার্থী ও নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার এবং ভয়ভীতি দেখানো হয়। টিআইবি ছাড়াও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি একই ধরনের অভিযোগ করেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, মোটামুটিভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, পুলিশ সরাসরি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করলেও তারা নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়নি। শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, স্থানীয় নির্বাচনেও পুলিশের ভূমিকা ভোটদাতাদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ভরসা রাখতে চাই, আসন্ন নির্বাচনে পুলিশ বাহিনী তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করবে এবং নিজেদের অবস্থান সমুন্নত রাখবে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের তথ্য হালনাগাদ শুরু করে পুলিশ। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জেলায় জেলায় এ ব্যাপারে বিশেষ বার্তাও পাঠানো হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশও ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সব ধরনের মামলার তথ্য হালনাগাদ করছে। গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে এই কাজ শুরু হয়। ঢাকার আটটি অপরাধ বিভাগের উপকমিশনার কার্যালয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে এ তথ্য চাওয়া হয়। পুলিশের সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের মামলাগুলোর বিষয়ে আলাদা নজর দেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ ১১ জানুয়ারি রাজধানীর নয়াপল্টনে গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘পুলিশ ও আমলার ওপর নির্ভর করে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলে রাখতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে।’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা এ প্রসঙ্গে বলেন, নির্বাচনের সময় পুলিশ কীভাবে কাজ করবে তা আইনে বলা আছে, এখানে নতুন কৌশল নেওয়ার কিছু নেই। শান্তি বজায় রাখা, নিরপেক্ষ নির্বাচনে সহায়তা করাই পুলিশের বড় দায়িত্ব। যেহেতু নির্বাচনকালে পুলিশ ইসির অধীনে থাকে, তাই কোনো অভিযোগ এলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে তো বাধা নেই। সেটা তো নেওয়া হয় না। তারা আইনের মধ্যে থেকে যদি কাজ করে, তাহলে নির্বাচনে পুলিশকে ব্যবহারের যে অভিযোগ তা গ্রহণযোগ্য হবে না। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত