Ajker Patrika

প্রয়োজন আর মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব

রুমা মোদক
আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২২, ১১: ০১
প্রয়োজন আর মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব

এই সেদিন পত্রিকার খবর হলেন ডা. ইকবাল উদ্দিন আহমেদ। একসময়ের ডাকসাইটে ডাক্তার। একা মরে পড়ে ছিলেন ঘরে। স্ত্রী, সন্তান দেশের বাইরে।

প্রৌঢ়দের নিয়ে এক বিশাল সংকটের সময় যাচ্ছে আমাদের সামাজিক জীবনে। প্রয়োজন আর মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব। মানবিক বোধ সেখানে অসহায়। যে অসহায়ত্বে হাবুডুবু খাচ্ছে আমাদের বৈচিত্র্যময় বিত্তের সমাজ।

উচ্চবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের বেলায় বিত্তগত কারণে সমস্যাটি খুব প্রকট না হলেও, মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে দিনে দিনে গুরুতর হয়ে তা দেখা দিচ্ছে।

উচ্চবিত্ত শ্রেণি আবেগ, অনুভূতি, মূল্যবোধের ধার ধারে না। অর্থের বিনিময়ে সেবা কিনে নিতে পারে। আর নিম্নবিত্তের তো ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ জীবন, কোনো মূল্যবোধ কিংবা মানবিক বোধের তেমন তোয়াক্কা নেই। উপায়হীন, সমাধানহীন অথই সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে মধ্যবিত্তরা। যারা আর্থিক দিক থেকেও প্রাচুর্যে নেই, মূল্যবোধের হাতছানি অস্বীকার করার মতো অমানবিকও তারা হতে পারে না। ফলে এই মধ্যবিত্তের পারিবারিক জীবনে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে এক গভীর সংকট তৈরি হয়েছে।

এই সংকট এক দিনে তৈরি হয়নি; বরং সময়ের পরিবর্তন ও প্রয়োজনের আবশ্যিক অনুষঙ্গ এই সংকট সমাজ পরিবর্তনের ধাপে ধাপে সৃষ্ট হয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এক প্রজন্ম আগেও আমাদের পরিবারগুলো ছিল একান্নবর্তী। বাবা-চাচাদের একান্নবর্তী হাঁড়ি। দাদা-দাদিরা সেই ঘরের কর্ত্রী। তাঁদের সিদ্ধান্ত আর দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হতো পরিবার। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সেসব পরিবারের ঐক্যের প্রতীক হয়েই ছিলেন।

তারপরের জেনারেশনে এই একান্নবর্তী মূল্যবোধ ভাঙতে থাকলেও তখন সংসারে অন্তত দুইয়ের অধিক তো বটেই, কখনো চারের অধিক সন্তানও ছিল। ফলে পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলে সামন্ত সমাজের মতো তাঁদের আধিপত্য হয়তো রইল না, কিন্তু মা-বাবা কোথায় থাকবেন, তা নিয়ে সংকট তৈরি হয়নি। কর্ম বা বৈবাহিক প্রয়োজনে ছেলেমেয়েরা দূরে সরে গেলেও কেউ না কেউ একজন মা-বাবাকে আগলে হয়তো থেকে যেতেন। তা ছাড়া, তখন পর্যন্ত পারিবারিক, আর্থিক কারণে নারী-পুরুষ উভয়ের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের প্রয়োজন প্রকট হয়ে ওঠেনি।

সমস্যাটি প্রকট হয়ে উঠেছে এই প্রায় দুই দশক ধরে এবং আগামী দুই দশকে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। পূর্ববর্তী প্রজন্মের অনেকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সন্তানসংখ্যা অধিকাংশেরই দুই বা তিনের অধিক নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন। আবশ্যিক অর্থনৈতিক প্রয়োজনে সংসারের স্বামী-স্ত্রী উভয়ের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তখন বৃদ্ধ মা-বাবা কোথায় থাকবেন, কে তাঁদের দেখাশোনা করবে? বিষয়টি অনস্বীকার্য এক সমস্যা হয়ে উঠেছে নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবনে। এই সমস্যা শিশুসন্তানের বেলায়ও সমান সত্য। অর্থনৈতিক প্রয়োজনে যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই ঘরের বাইরে যাওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে, তখন ভবিষ্যৎ নাগরিক শিশুরা আর সাবেক নাগরিকেরা হয়ে পড়েছেন সবচেয়ে বেশি অসহায়।

আরেকটি সমস্যা, সাবেক নাগরিকেরা মানসিকভাবে সামন্ত মূল্যবোধ ধারণ করেন। ঠিক যেভাবে তাঁরা নিজেরা ঘরসংসার করেছেন কিংবা তারও আগে তাঁদের শ্বশুর-শাশুড়িকে, ঘরকন্নাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে দেখেছেন, তাঁরা তাঁদের ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধূর কাছ থেকেও একই রকম ট্রিটমেন্ট দাবি করেন। অর্থনৈতিক প্রয়োজন, পেশাগত ব্যস্ততা—সবই তাঁরা বোঝেন কিন্তু এর সঙ্গে পালটে যাওয়া মূল্যবোধ তাঁরা মানতে পারেন না।

এখনকার কিছু কিছু ছেলেমেয়েকে ক্যারিয়ারমুখী দৌড়ের জন্য প্রস্তুত করেছেন অভিভাবকেরা। ফলে না তারা পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়ে বড় হয়েছে, না তারা নিজেদের ক্যারিয়ারের বাইরে অন্য কিছুকে গুরুত্ব দিতে শিখেছে; বরং পেশাগত ব্যস্ততাকে তারা ব্যবহার করতে শিখেছে অজুহাত হিসেবে—মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব না পালনের অজুহাত।

নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রমও আছে। মা-বাবাকে সময় দিতে চান সন্তানেরা, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কর্মজীবী ছেলেমেয়েরা চাইলেও কয়দিন পেশাগত ব্যস্ততা ফেলে মা-বাবাকে সময় দিতে পারবেন? তাঁদের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজন তো আর অস্বীকার করা যাবে না।

একটি সমাজের অর্থনৈতিক রূপান্তরের ক্রান্তিকালীন উপজাত এ সমস্যা। এর জন্য পিতা-মাতা, প্রৌঢ়-বৃদ্ধদের এই পরিবর্তন মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়নি। উন্নত দেশের মতো প্রৌঢ়দের সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থাও তৈরি হয়নি। এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও কেউ অনুভব করছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ খুব দ্রুতই ভাবা উচিত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

অপারেশন সিন্দুর ঘিরে আলোচিত কে এই কর্নেল সোফিয়া কুরেশি

কাশ্মীরে বিধ্বস্ত বিমানের অংশবিশেষ ফরাসি কোম্পানির তৈরি, হতে পারে রাফাল

সীমান্তে সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত: পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী

নিজ কার্যালয়ে র‍্যাব কর্মকর্তার গুলিবিদ্ধ লাশ, পাশে চিরকুট

আকাশ প্রতিরক্ষায় কে এগিয়ে, পাকিস্তান কি ভারতের আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত