Ajker Patrika

সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমছে, বাড়ছে দুর্ভোগ

নাজমুল হাসান সাগর ও শাকিলা ববি, সিলেট থেকে
আপডেট : ২২ মে ২০২২, ০৮: ২১
সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমছে, বাড়ছে দুর্ভোগ

একটা পলিথিনের ব্যাগে সামান্য কিছু মুড়ি সামনে নিয়ে বসে আছেন সুফিয়া বেগম (৫৬)। সেখান থেকে আধা মুঠ মুড়ি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলেন, তারপর মুখে পুরে আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে দেখা গেল তাঁকে। শুকনো মুড়ি চিবোতে কষ্ট হয়। তাই মুখে দিয়ে কিছু সময় রাখলে সেটা ভিজে নরম হলে গিলতে কষ্টটা কম লাগে। বন্যার পানিতে বাস্তুহারা হয়ে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করা এই বৃদ্ধা বেলা তিনটায় দিনের প্রথম খাবার খাচ্ছিলেন।

গতকাল শনিবার সিলেট নগরীর টুকের বাজার এলাকার হাজী আব্দুস সাত্তার বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে বন্যাকবলিত মানুষের জন্য খোলা অস্থায়ী আশ্রয়-কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মূলত এসব আশ্রয়কেন্দ্রে যাঁরা থাকেন, তাঁদের জন্য খাবার আসে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীর উদ্যোগে। তাই কখন খাবার আসবে, সেটা কেউ জানে না। সকাল থেকে খাবারের অপেক্ষায় থেকে বেলা তিনটায়ও তা না এলে, বাধ্য হয়ে মুড়ির পোঁটলা খুলে বসেছিলেন সুফিয়া বেগম।

সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় সুফিয়া বলেন, ‘চার দিন থেকে এখানে আশ্রয় নিয়ে আছি। এই চার দিনে ভারী খাবার জুটেছে চার বেলা। অন্যান্য সময় মুড়ি, চিড়ার মতো শুকনো খাবার খেয়েই থাকতে হয়েছে। আজ কখন খাবার জোটে সেটা বলা যাচ্ছে না। তাই কষ্ট হলেও মুড়ি খাচ্ছি। কয়েক মুঠ মুড়ি খেয়ে একটু পানি খেলে কিছুক্ষণের জন্য শান্তি লাগবে।’

এই আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ৬১টি পরিবার উঠেছে। একটি রুমে কয়েক পরিবারের মানুষের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে পুরুষ-মহিলা আলাদা করে। স্কুলের বেঞ্চগুলো এক জায়গায় করে আলাদা আলাদা চৌকির মতো বানানো হয়েছে।

কাঁথা, বালিশ বা চাদর ছাড়াই সেখানে থাকতে হচ্ছে তাদের। সেখানে বসেই কথা হলো ফাতিমা বেগম (৬০) ও হাসনা বেগমের (৬০) সঙ্গে। তাঁরা সবাই টুকের হাট এলাকার উত্তর পীরপুর ও গৌরীপুর এলাকার বাসিন্দা। আলাপে আলাপে জানা গেল, এখানে আশ্রয় নেওয়া সবারই ঘরবাড়ির সবকিছুই বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। আর কয়েক দিন পরে হয়তো নদী থেকে আসা পানি নেমে যাবে নদীতে কিন্তু তাঁরা ফিরে গিয়ে উঠবেন কোথায়? পানি কমলে ছাড়তে হবে আশ্রয়কেন্দ্র কিন্তু তখন তো বাড়িতে গিয়েও থাকার উপায় নেই বলে জানালেন হাসনা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এক কাপড়ে এসে এখানে উঠেছিলাম। এখান থেকে এক কাপড়েই চলে যেতে হবে। বাড়ি গিয়ে দেখব কিছুই নেই। এটা ভাবলেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে।’

নগরীতে মোট ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য। প্রায় সব আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থা একই দেখা গেছে।

২০০৪ সালের পরে সিলেট শহর এত বড় বন্যার কবলে আর পড়েনি। যদিও গতকাল শনিবার ভোরে বৃষ্টি দিয়ে দিন শুরু হয়েছিল কিন্তু সকাল থেকেই নগরের পানি কমতে থাকে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর পানি গত শুক্রবারের চেয়ে গতকাল দুটি পয়েন্টেই কমেছে। কুশিয়ারার পানি দুটি পয়েন্টে বাড়লেও কমেছে দুটি পয়েন্টে। লোভা, সারি ও ধলাই নদীর পানি শুক্রবারের চেয়ে কমেছে। কমা শুরু হলেও এখনো পানির বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়নি নগরীর উপশহর, জতরপুর, মেন্দিবাগ, মাছিমপুর, তালতলা, শেখঘাট, বেতেরবাজার, টুকের বাজার, নায়েরপুল ও কানাইঘাট এলাকা। এর মধ্যে মাছিমপুর, ঘাসিটুলা ও কানিশাইল এলাকার অবস্থা বেশি খারাপ দেখা গেছে সরেজমিনে।

পাউবো সিলেটের উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা আজকের পত্রিকাকে বলেন, উজানে বৃষ্টি না হলে পানি আরও কমবে।

পানি কমলেও দুর্ভোগ কমছে না সিলেট নগরবাসীর। এক সপ্তাহের বন্যায় প্রায় স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে নগরীতে। সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় সবজির বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। সিলেটের অন্যতম প্রধান ব্যবসার মধ্যে একটি পর্যটন ব্যবসা ৷ বন্যা ও বৃষ্টির কারণে ধাক্কা লেগেছে এই সেক্টরেও। অন্যান্য সময় নগরীর হোটেল-মোটেলের দিনের ব্যবসার ৬০ শতাংশ হতো পর্যটকদের মাধ্যমে। এখন সেটা খুব বেশি হলে ২০ শতাংশ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

নগরীর সব থেকে বড় সবজি বাজার ও আড়ত টুকের বাজার। বন্যার কারণে দুই দিন বন্ধ ছিল এই বাজার, ছিল না পর্যাপ্ত সবজির সরবরাহ। গতকালও এই বাজারে পানি ছিল হাঁটুসমান। এই বাজারে বড় বড় ২৫টি সবজির দোকান থাকলেও শনিবার মাত্র ৫টি দোকান খোলা পাওয়া গেল। সরবরাহ আর ক্রেতা কম থাকায় অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন সাময়িকভাবে। দোকান খুলে বসলেও খুব বেশি বিক্রি হয়নি বলে জানান সবজি বিক্রেতা দুলাল আহমেদ। তিনি বলেন, বন্যার কারণে অনেক জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। সঙ্গে ক্রেতাও কমেছে। বন্যার আগে যে কাঁচা মরিচ ৫ টাকা কেজি বিক্রি করতাম, এখন সেটার দাম ১০০ টাকা। মুলা কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। ঢ্যাঁড়স বন্যার আগে বিক্রি হতো প্রতি কেজি ৩০ টাকা এখন ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এ ছাড়া ৫৫ টাকার চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ এবং ৪০ টাকার আটা বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা। লবণের দামও গায়ের মূল্যের থেকে বেশি রাখা হচ্ছে।

নগরীতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসহীনতা, খাবার পানির সংকটের পাশাপাশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। এমন পরিস্থিতিতে দুর্ভোগ এড়াতে নগর ছাড়তে শুরু করেছেন অনেকে। শনিবার নগরের প্লাবিত এলাকার অনেক বাসিন্দাকে নগর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে দেখা গেছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে পানি এখনো নামেনি। সরকার বন্যার্তদের সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে।

সুনামগঞ্জে শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট

সুনামগঞ্জ থেকে প্রতিনিধি জাকির হোসেন জানান, এ জেলায়ও কোথাও কোথাও পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু এত দিন ধরে পানিবন্দী থাকা মানুষের বিশেষ করে নিম্নবিত্তের কষ্ট চরমে পৌঁছেছে।

পৌর শহরের পশ্চিম তেঘরিয়া আবাসিক এলাকার শ্রমজীবী স্বপ্না বেগম। রিকশাচালক স্বামী ও নিজে মানুষের বাসায় কাজ করে দিনাতিপাত করেন। তিন দিন ধরে বাসার ভেতর ও সড়কে কোমরপানি। স্বপ্না বেগম ও তাঁর স্বামী দুজনই ঘরে বসে আছেন তিন সন্তান নিয়ে। এক দিন কাজে বের না হলে চুলোয় আগুন জ্বলে না। তিন দিন ধরে ঘরবন্দী অবস্থায় সন্তানদের নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে তাঁদের।

স্বপ্না বেগম বলেন, ‘তিন দিন হইছে মানুষের কাছ থাইকা চাইয়া ইট আনছি। ইট দিয়া খাট উঁচা কইরা বাচ্চাকাচ্চা লইয়া বইয়া থাকি। ঘরে যা আছিল খাবার, তাও শেষ। মাইনসের বাসাত কাজ না করলে আমার বাচ্চারাও খাইতে পারে না। ওখন কেমনে কিতা করতাম বুঝতাছি না।’

তিন দিন ধরে উজানের ঢলে সুনামগঞ্জের পৌর শহরের ১৭টি আবাসিক এলাকায় পানি ঢুকেছে। ডুবে গেছে শহরের অন্তত ২০টি সড়ক। পৌর শহরের প্রায় এক হাজার শ্রমজীবী পরিবার অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তিন দিন ধরে ঘরের মধ্যে পানি থাকার পরও আশ্রয়কেন্দ্র না খোলায় যেতে পারছে না তারা।

জেলার ছাতক, দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার প্রায় ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। তবে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার দিকে পানি কমতে শুরু করেছে। পানি কমলেও কমেনি দুর্ভোগ।

আবহাওয়া পূর্বাভাস বলছে, আবারও সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। নতুন করে তলিয়ে যেতে পারে নিম্নাঞ্চল।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জ পৌর এলাকায় কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য সহায়তা পৌঁছানো হচ্ছে। পানিবন্দী নিম্ন আয়ের সবাইকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে।

এদিকে জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় পাঠদান সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে উপজেলার ৬০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তেহরান ওপর থেকে সুন্দর, একদিন যেতে চাই: ইরানে বোমা ফেলা ইসরায়েলি পাইলট

ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা ভাবছেন ট্রাম্প

জুলাই অভ্যুত্থান: নিজেদের মামলা তদন্তে ‘বেশি সতর্ক’ পুলিশ

সাইপ্রাসে বিপুল জমি কিনছে ইসরায়েলিরা, দেশ বেদখলের শঙ্কা রাজনীতিবিদদের

অনুকূল পরিবেশে বাংলাদেশের সঙ্গে সব বিষয়ে কাজ করতে প্রস্তুত ভারত: রণধীর জয়সওয়াল

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত