Ajker Patrika

জাকসু নির্বাচন

শিবিরের জয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ভোটব্যাংক

মুশফিকুর রিজন, জাবি
জাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর নবনির্বাচিত ভিপি ও জিএসসহ বিজয়ীদের উচ্ছ্বাস। শনিবার সিনেট ভবনে। নির্বাচনে ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতেই জয় পেয়েছেন শিবির সমর্থিতরা।	ছবি: আজকের পত্রিকা
জাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর নবনির্বাচিত ভিপি ও জিএসসহ বিজয়ীদের উচ্ছ্বাস। শনিবার সিনেট ভবনে। নির্বাচনে ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতেই জয় পেয়েছেন শিবির সমর্থিতরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে প্রায় নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল। জাকসুর ২৫টি পদের ২০টি পদেই জয়ী হয়েছেন এই প্যানেলের প্রার্থীরা। এখন শিবিরের এমন বিজয়ের কারণ খুঁজছেন বিশ্লেষকেরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক জাকসুতে শিবিরকে এমন জয় এনে দিয়েছে।

গত শনিবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে জাকসুর ফলাফল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনিরুজ্জামান। ফলাফলে দেখা যায়, শীর্ষ চারটি পদের তিনটিতেই জয় পেয়েছেন শিবির-সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা। নির্ধারিত ২৫টি পদের মধ্যে ২০টি পদে শিবির-সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন, ৩টি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ২টি পদে বাগছাস-সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রসংগঠনগুলোর রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। তারা এমন একটি সংগঠনকে ভোট দিতে চেয়েছে, যারা তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখবে। শিবির নিজেদের সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত দল হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে অনেক নিরপেক্ষ শিক্ষার্থী শিবিরকেই তাঁদের আস্থার জায়গা হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শিবিরের প্যানেল ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে, বিশেষ করে সুইং ভোটারদের কাছে আর কোনো অপশন ছিল না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন একটা বামবিরোধী সেন্টিমেন্ট চলছে, যার ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বামদের ভোট দেয়নি। বাগছাস কিছু কার্যকলাপের কারণে শিক্ষার্থীদের থেকে দূরে সরে গেছে। এ ছাড়া বাদবাকি যে প্যানেল আছে, সেখানে জিতু ভাই ছাড়া সে রকম হেভিওয়েট কোনো প্রার্থী ছিলেন না, যার ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিবিরের প্যানেলের ওপরই আস্থা রেখেছেন।’

দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘শিবিরের সাংগঠনিক নিষ্ঠা অন্য যেকোনো দলের চেয়ে ভালো। শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের রাজনীতি ছাত্রদল মারফত ফিরে আসুক, এটা হয়তো চাননি। দীর্ঘকাল ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ থাকায় বর্তমান শিক্ষার্থীরা শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখতে পাননি, হয়তো ভেবেছেন, এরা ধর্মের নামে খারাপ কিছু নিশ্চয়ই করবে না।’

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর গত বছরের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে আসে ছাত্রশিবির। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে যখন শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন, তখনো হলে হলে কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখে শিবির। রাজনৈতিক পরিচয় সামনে না এনে হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নানা কার্যক্রমে যুক্ত থেকেছে তারা। হলে ও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজেও সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা যুক্ত ছিলেন। প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরুর পর ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পবিত্র কোরআন শরিফ বিতরণ, ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উপলক্ষে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন, শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, শিক্ষার্থী বৃত্তি, শীতের পোশাক বিতরণ, জুলাইয়ে আহত ব্যক্তিদের সম্মাননা, কোরবানির ঈদে শিক্ষার্থীদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন, অসুস্থদের সহায়তা প্রদানসহ নানা কার্যক্রম চালিয়েছে সংগঠনটি। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের যুক্ততা তৈরি হয়, যা নির্বাচনী প্রস্তুতির ক্ষেত্রও তৈরি করে দেয়।

এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশিশক্তির রাজনীতি বন্ধ আছে, গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতিও নেই। কোনো রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচিতে যাওয়া এখন আর কারও জন্য বাধ্যতামূলক নয়। হল ও ক্যাম্পাসকে ভবিষ্যতেও এ রকম রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রচার চালিয়েছে শিবির। এই প্রচারও নির্বাচনে তাদের সহায়তা করেছে।

বিশাল এই জয়ের বিষয়ে শিবিরের নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজ রাখা, সংকটে পাশে থেকে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন কাজে গত এক বছর যুক্ত ছিলেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু এ নিয়ে তাঁরা প্রচার চালাতেন না, যা শিক্ষার্থীরা পছন্দ করেছেন। যার ফলে খুব সহজেই শিক্ষার্থীরা শিবিরের প্যানেলে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এ বিষয়ে জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শিবির দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে রাজনীতি না করায় সবার মধ্যেই তাদের নিয়ে একটি আগ্রহ ছিল। গত বছর প্রকাশ্যে আসার পর থেকে শিবির যে কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করেছে, সেগুলো তাদের প্রতি একটি ইতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। আর সেটার প্রতিফলন ঘটেছে জাকসুতে।’

সুনির্দিষ্ট ভোটব্যাংক

শিক্ষার্থীরা মনে করেন, শিবিরের জয় নিশ্চিত করেছে শিবিরের নিজস্ব ভোটব্যাংক। ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শিবির প্যানেল থেকে যাঁরা বিজয়ী হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগের ভোটসংখ্যাই দুই থেকে আড়াই হাজারের মধ্যে ছিল। এর থেকে বেশি ভোট যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা আগে থেকেই বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিলেন। সেখান থেকে বলা যায়, শিবিরের প্রায় এক থেকে দেড় হাজারের মতো নিজস্ব ভোট রয়েছে, যাঁরা সংগঠনের বাইরে কাউকে ভোট দেননি। এর বাইরে যে ভোটগুলো এসেছে, তার ছিল বেশির ভাগ সুয়িং ভোটার, যাঁরা অন্য কোনো প্যানেলকে ভরসা করতে না পেরে শিবিরের প্যানেলকে বেশি যোগ্য মনে করেছেন।

এ বিষয়ে পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের শিক্ষার্থী তারেক মাহমুদ বলেন, ‘আমার ধারণা, ক্যাম্পাসে শিবির এবং ছাত্রী সংস্থার আনুমানিক এক থেকে দেড় হাজারের মতো প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য জনশক্তি রয়েছে, যাদের শতভাগ ভোট কাস্টিং নিশ্চিত করেছে শিবির। সঙ্গে তাবলিগ জামায়াতের মতো ডানপন্থী সংগঠনের ভোটও যুক্ত হয়েছে।’

সুনির্দিষ্ট ভোটব্যাংক থাকার পাশাপাশি এক পদে ছয়-সাতজন করে প্রার্থী থাকায় শিবিরের সুবিধা হয়েছে। এতে ভোট ভাগাভাগির সুবিধা পেয়েছে শিবির।

ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে যিনি বিজয়ী হয়েছেন, তাঁর থেকে ৩৪৪ ভোট কম পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) জিয়া উদ্দিন আয়ান। এই পদে জিয়ার দুই ব্যাচমেট ও সংগঠনের আরও একজন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। তাঁরা তিনজন মোট ভোট পেয়েছেন ১ হাজার ১৭২টি। এই ভোটগুলো ভাগ না হলে জিয়া উদ্দিন আয়ানের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকত।

এ বিষয়ে জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মৃধা মো. শিবলী নোমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জাকসু নির্বাচনে যেসব প্যানেল হয়েছিল, সেখানে বেশ কয়েকটি প্যানেলের সুযোগ ছিল সমঝোতার মাধ্যমে একটি প্যানেল করার। সেটি না করায় তাদের ভোটগুলো ভাগ হয়েছে। এদিক থেকে শিবির একটি বড় সুবিধা পেয়েছে বলে মনে হয়।’

ডাকসুর প্রভাব জাকসুতে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ফলাফল জাকসুতে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে মেয়েরা এখানে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী হাজেরা আলম রুহানা বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের নিরঙ্কুশ বিজয় জাহাঙ্গীরনগরের ভোটারদের কিছুটা প্রভাবিত করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা শিবিরের প্রার্থী ছিলেন, চার-পাঁচজন ছাড়া বাকিদেরকে সবাই ভালোভাবে চিনত না। তবে সার্বিকভাবে শিবিরের যেই ইমেজ তৈরি হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির যেভাবে নানান প্রতিকূলতাকে সামলে জনগণের মন জয় করেছে, সে কারণেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাকসুতে শিবিরের প্যানেলের ওপর আস্থা রেখেছেন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত