Ajker Patrika

ডাকসু নির্বাচন: মুক্ত পরিবেশে ভোটের লড়াই শুরু

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
ডাকসু নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়েছে গতকাল। সকাল থেকে বিভিন্ন প্যানেলভুক্ত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রচারে নামেন। সিনেট ভবন থেকে বেরিয়ে ‘প্রতিরোধ পর্ষদের’ জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসুর সঙ্গে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের কুশল বিনিময় (বাঁয়ে)। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত প্যানেলের সদস্যরা (ডানে)। ছবি: আজকের পত্রিকা
ডাকসু নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়েছে গতকাল। সকাল থেকে বিভিন্ন প্যানেলভুক্ত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রচারে নামেন। সিনেট ভবন থেকে বেরিয়ে ‘প্রতিরোধ পর্ষদের’ জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসুর সঙ্গে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের কুশল বিনিময় (বাঁয়ে)। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত প্যানেলের সদস্যরা (ডানে)। ছবি: আজকের পত্রিকা

জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে ক্যাম্পাসে একক কোনো সংগঠনের দখলদারত্ব নেই। নেই গেস্ট রুম সংস্কৃতি, জোর করে মিছিলে নেওয়ার দৃশ্য। এমন মুক্ত পরিবেশে পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ডাকসু ও হল সংসদের এই নির্বাচন ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) এখন উৎসবের আমেজ।

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে। গতকাল মঙ্গলবার শুরু হয়েছে আনুষ্ঠানিক প্রচার কার্যক্রম। নির্বাচনী প্রচারের প্রথম দিনেই পোস্টার ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে ঢাবি ক্যাম্পাস। হল থেকে একাডেমিক ভবন, টিএসসি থেকে লাইব্রেরি—লিফলেট হাতে সবখানেই চষে বেড়াচ্ছেন প্রার্থীরা। থেমে থেমে কানে ভেসে আসছে স্লোগানের আওয়াজ, নির্বাচনী স্লোগান।

প্রার্থীদের পক্ষে সমর্থকেরা নানা স্লোগান দিচ্ছেন, আবার শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন প্রশ্নে তাঁদের ঘিরে ধরছেন। কেউ বলছেন শিক্ষার্থীদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করার কথা। আবার কেউ দিচ্ছেন আবাসনের সংকট নিরসন ও গণপরিবহনের সুবিধা বৃদ্ধি এবং ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি।

গতকাল বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি, জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু, এজিএস প্রার্থী মো. জাবির আহমেদ জুবেলসহ অন্য প্রার্থীরা। শহীদ মিনার থেকে তাঁরা কার্জন হল এলাকায় জনসংযোগ করেন।

এদিকে গতকাল দুপুরে জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে ফুল দিয়ে একাত্তরের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রম শুরু করে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা, জিএস প্রার্থী আল সাদী ভূঁইয়াসহ অন্য প্রার্থীরা।

এ ছাড়া দুপুরের দিকে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে থেকে কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ডাকসু নির্বাচনের প্রচার শুরু করেন। আর বিকেলে একাত্তরের শহীদদের স্মৃতিফলক ‘স্মৃতি চিরন্তনে’ ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করে নির্বাচনের প্রচার শুরু করে ছাত্রদল। ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের প্রার্থীরা গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে থেকে শুরু করে আনুষ্ঠানিক প্রচার।

ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার। সভায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদের সব প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে। ছবি: আজকের পত্রিকা
ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার। সভায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদের সব প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে। ছবি: আজকের পত্রিকা

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চার বড় সুযোগ তৈরি করবে। এতে কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হবে। দর্শন বিভাগের ২০১৯-২০ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুরো ক্যাম্পাসে একধরনের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। এই আমেজকে উপভোগ করতে আজ বেশি সময় ক্যাম্পাসে কাটিয়েছি।’

বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ বর্ষের শিক্ষার্থী সজীব রায় বলেন, ‘গণতান্ত্রিক চর্চার বড় সুযোগ ডাকসু নির্বাচন। আশা করি, এ নির্বাচনে যারা জয়ী হবে, তারা কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে কাজ করবে।’

ডাকসু নির্বাচনে ২৮ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭১ প্রার্থী। গতকাল ডাকসু নির্বাচনের চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ভিপি পদে, ৪৫ জন। এ ছাড়া জিএস পদে ১৯ জন ও এজিএস পদে ২৫ জনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কেন্দ্রের পাশাপাশি ১৮টি হলেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে হল সংসদ নির্বাচন।

ডাকসু নির্বাচনে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, স্বতন্ত্রসহ ১০টির মতো প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু কোনো ছাত্রসংগঠনই সব হল সংসদের নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে পারেনি। তবে প্যানেল ঘোষণা না করলেও বিভিন্ন হল সংসদে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছে শিবির ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। আর ছাত্রদল সর্বোচ্চ ১৪টিতে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে পেরেছে।

চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

ডাকসু নির্বাচন ঘিরে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ‘অদক্ষতা’ এবং ‘ভোটার উপস্থিতি কম রাখে এমন পদক্ষেপ’ নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন প্রতিরোধ পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মেঘমল্লার বসু। গতকাল মধুর ক্যানটিনের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি বুঝতে পারি, আসলে পুরো ভোটের ব্যাপারটি একটা স্ক্যামে পরিণত করা হচ্ছে এবং এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ন্যূনতম মেরুদণ্ড নাই, তাহলে এমনও হতে পারে, শেষ পর্যন্ত আমরা এই নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারি।’

এদিকে প্রার্থীদের ছবি বিকৃত করার জন্য ‘কালচারাল ফ্যাসিস্টদের’ দায়ী করেছেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম। তিনি বলেন, কিছু দুষ্কৃতকারী চারুকলায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের নির্বাচনী উপকরণ ভাঙচুর করেছে এবং প্রার্থীদের ছবি বিকৃত করেছে। যারা কালচারাল ফ্যাসিস্ট, তারাই এ ধরনের কাজ করেছে বলে অভিযোগ তাঁর।

ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের প্রার্থিতা বাতিলের দাবি জানিয়েছে তিন বাম সংগঠনের প্যানেল ‘অপরাজেয়-৭১ ও অদম্য-২৪ ’। এ প্যানেলের জিএস পদপ্রার্থী এনামুল হাসান অনয় বলেন, একাত্তরের ও চব্বিশের পরাজিত শক্তি ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের প্রার্থিতা বাতিল করা হোক। তাদের নির্বাচন করতে দেওয়া মানে এ দেশের মা, মাটি ও মানুষের সঙ্গে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি করা।

ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা থাকবে, হবে সেনা মোতায়েন ডাকসু নির্বাচনে বুথ ছাড়া পুরো কেন্দ্র সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে বলে জানিয়েছেন চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। নির্বাচনকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গতকাল নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের কনফারেন্স কক্ষে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় সিসি ক্যামেরার সামনে ভোট গণনা, সাইবার বুলিং ও গুজব দমনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে জানান অধ্যাপক জসীম উদ্দিন।

বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গতকাল থেকেই ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখ ও ভেতরে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। তিন ধাপে কাজ করছে পুলিশ। এ ছাড়া সাইবার বুলিং বা অনলাইনে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থিত আইবিএ হোস্টেল, লেদার ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল, শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হল, কবি সুফিয়া কামাল হলসহ প্রশাসনিক ও আবাসিক এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে পুলিশ। নির্বাচনের দিন শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্ন যাতায়াতের জন্য নিউ মার্কেটের লেন উন্মুক্ত রাখা হবে। ভোটের দিন ২৫০ জন বিএনসিসি সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন এবং সহকারী প্রক্টরের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে।

এদিকে ডাকসু নির্বাচনের আট ভোটকেন্দ্রে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রথম স্তরে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি সদস্য ও প্রক্টরিয়াল টিম। দ্বিতীয় স্তরে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন থাকবে। আর তৃতীয় স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি প্রবেশমুখে সেনাবাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে অবস্থান করবে। ডাকসু নির্বাচনের ভিপি, জিএস ও এজিএস পদপ্রার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন কমিশনের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর।

জুলিয়াস সিজারের নাম প্রত্যাহার

স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী জুলিয়াস সিজার তালুকদারের বিষয়ে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ দিলে সেটি ট্রাইব্যুনাল আমলে নিয়ে তদন্ত করে। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ২০২৫-এ অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। জুলিয়াস সিজারের বিষয়ে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ দিলে সেটি ট্রাইব্যুনাল আমলে নিয়ে তদন্ত করে। তদন্তে জুলিয়াস সিজারের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল জুলিয়াস সিজারের প্রার্থিতা বাতিলের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সুপারিশ করে। যেহেতু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত রিটার্নিং কর্মকর্তারা নিতে পারেন না, তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সিন্ডিকেটে উপস্থাপনের জন্য বিষয়টি প্রেরণ করে। বিচারাধীন থাকায় চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা থেকে জুলিয়াস সিজারের নামটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। আগামীকাল সিন্ডিকেট তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত