Ajker Patrika

সঞ্চয়পত্রের ৪০ লাখ টাকার জন্য বৃদ্ধা মাকে হত্যার অভিযোগ

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১: ০১
সঞ্চয়পত্রের ৪০ লাখ টাকার জন্য বৃদ্ধা মাকে হত্যার অভিযোগ

কিশোরগঞ্জে সন্তানের বিরুদ্ধে ফরিদা খাতুন (৬৯) নামে এক বৃদ্ধা মাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। পোস্ট অফিসে রাখা মায়ের সঞ্চয়পত্রের প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে দাবি অন্য দুই মেয়েসন্তানের।

এ ঘটনায় ফরিদা খাতুনের দুই মেয়ে বাদী হয়ে ভাই সারোয়ার জাহান (৫০), তাঁর স্ত্রী সাবিকুন্নাহার (৪৫) এবং তাদের ছেলে-মেয়ে ও পোস্ট অফিসের কর্মচারীসহ ১০ জনকে আসামি করে পৃথকভাবে আদালতে হত্যা ও প্রতারণার মামলা করেছেন। তবে অভিযুক্ত সারোয়ার জাহান তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন।

মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের বত্রিশ মনিপুর এলাকার প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান কবিরের স্ত্রী ফরিদা খাতুন (৬৯) সমাজসেবা অধিদপ্তরে চাকরি করতেন। তাঁর স্বামী শাহজাহান কবিরও পিডিবিতে চাকরি করতেন। স্বামী মারা গেছেন ২০০৭ সালে। ফরিদা খাতুন স্বামীর পেনশনের টাকা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা এবং নিজের টাকা মিলিয়ে পোস্ট অফিসে ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এতে দুই মেয়ে লীনা জাহান তান্নী ও নুসরাত জাহানকে নমিনি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

ফরিদা খাতুন তাঁর ছেলে সারোয়ার জাহানকে বিষয়টি জানান এবং পোস্ট অফিস থেকে সঞ্চয়পত্রের ফরম আনতে বলেন। সারোয়ার জাহান ফরম এনে মায়ের স্বাক্ষর নিয়ে তাতে নমিনি হিসেবে দুই মেয়ের নাম লিখে দুই মেয়ের ছবি ও আইডি কার্ডের কপি নিয়ে ২০১৭ সালের ১৮ মে পোস্ট অফিসে যান। সেখানে পোস্ট অফিসের অসৎ কর্মচারীদের যোগসাজশে ফরমটি ছিঁড়ে ফেলে নতুন একটি ফরমে মায়ের স্বাক্ষর জাল করে তাতে সারোয়ার জাহান নিজেকে নমিনি হিসেবে উল্লেখ করেন। এরপর ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র করে আসেন এবং সঞ্চয়পত্রের যাবতীয় কাগজপত্র তাঁর কাছেই রেখে দেন।

২০২২ সালের ১৮ মে সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে সুদে-আসলে ৩৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা হয়। গত ২১ জুলাই সারোয়ার জাহান সম্পূর্ণ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে আসেন। পরদিন মাকে তাঁর কক্ষে রাত ৮টার দিকে অমানুষিক নির্যাতন করেন। এরপর তাঁকে হত্যা করে দুই ঘণ্টা পর শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁর মা আরও দুই ঘণ্টা আগে মারা গেছেন বলে ঘোষণা দেন।

এদিকে অভিযুক্তরা ঘটনা গোপন রাখার জন্য ঢাকা থেকে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি এনে এলাকার লোকজন জানার আগেই নিহতের স্বামীর গ্রামের বাড়ি কুলিয়ারচরের লক্ষ্মীপুর ভাটিপাড়া এলাকায় মরদেহ নিয়ে যান। ময়নাতদন্তের দাবি উপেক্ষা করে স্বামীর কবরের পাশে মরদেহ দাফন করেন।

এ ঘটনার পর মেয়ে লীনা জাহান তান্নী কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করতে গেলে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন। ফলে লীনা জাহান তান্নী গত ১৬ আগস্ট ১ নম্বর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দণ্ডবিধির ৩০২ / ১০৯ / ৩৪ ধারায় মামলা রুজু করেন এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৬ ধারার ২ উপধারা মতে কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের আবেদন জানান।

আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদুল আমিন গত ২৪ আগস্ট মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডিকে দায়িত্ব দেন। সিআইডি আদেশের কপি গ্রহণ করেছে ১ সেপ্টেম্বর। 

মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইদ্রিছ আলী জানান, ভুক্তভোগী যেহেতু সমাহিত, ফলে সিআইডিকে তদন্তের আদেশের মাধ্যমে বস্তুত মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

হত্যা মামলার বাদী লীনা জাহান তান্নী বলেন, ‘আমার মা ১৪ আগস্ট ২০২১ সালে আমাকে বলেছিলেন যে টাকার জন্য আমার ভাই আমার মাকে মেরে ফেলতে পারে। এর আগেও দুবার আমার ভাই মাঝরাতে আমার মায়ের মাথার কাছে বালিশ হাতে বসেছিল। তা দেখে আমার মা চিৎকার শুরু করেন। এ ছাড়া আমার মায়ের মারা যাওয়ার পর কবর দেওয়া পর্যন্ত আমার ভাইয়ের প্রতিটি কাজ অস্বাভাবিক তাড়াহুড়া এবং গোপন রাখার চেষ্টা করে। আর সঞ্চয়পত্রের ৩৯ লাখ ৭০ হাজার টাকাটাও আমার সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।’

এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে কথা হয় অভিযুক্ত সারোয়ার জাহানের সঙ্গে। তিনি আজকের পত্রিকাকে জানান, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আদালতে যে মামলা করা হয়েছে তা মিথ্যা ও বানোয়াট। তদন্তের মাধ্যমেই সব বেরিয়ে আসবে বলে জানান তিনি।

টাকা উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ওই টাকা তিনি নিজেই উত্তোলন করেছেন। তাঁর মায়ের সঞ্চয়পত্রের টাকা সঠিক উপায়ে উত্তোলন করেছেন বলে জানান তিনি।

এ নিয়ে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা জুলফিকার চৌধুরী বলেন, তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আরও গভীর তদন্তের প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, নিহত ফরিদা খাতুনকে আগে থেকেই ছেলে সারোয়ার জাহান অত্যাচার-নির্যাতন করতেন বলে সদর থানায় মায়ের নিজের জিডি রয়েছে। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর করা ৮৫ নম্বর জিডিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ছেলের নামে জায়গা-সম্পত্তি হেবা করে দেওয়ার পর তাঁকে ভরণপোষণ না দিয়ে ছেলে ও ছেলের বউ তাঁকে শারীরিকভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করছেন। এ ছাড়া বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পাঁয়তারাসহ খুন-জখমের হুমকি দিচ্ছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত