Ajker Patrika

রোহিঙ্গা শিবিরে আতঙ্ক ‘আরসার টার্গেট কিলিং’

মাইনউদ্দিন শাহেদ, কক্সবাজার ও ইফতিয়াজ নুর নিশান, উখিয়া
আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২২, ০৯: ৪১
রোহিঙ্গা শিবিরে আতঙ্ক ‘আরসার টার্গেট কিলিং’

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে গোলাগুলি, অপহরণ, হত্যা-ধর্ষণ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অপরাধের পেছনে অন্যতম কারণ মাদক ব্যবসা ও ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলেও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলোয় একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়েছে। আর তা হলো যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা নেতা বা মাঝি ছিলেন। তাঁরা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করছিলেন। এসব হত্যাকাণ্ডে অভিযোগের তির মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) দিকে।

টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দাদের অনেকেই মনে করেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বেকারত্ব, মাদক পাচার ও ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব তো আছেই।

জানা গেছে, উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় চলতি মাসেই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হয়েছেন এক শিশুসহ সাতজন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ভোরে ১৭ নম্বর শিবিরে এক রোহিঙ্গা মাঝির ভাই আয়াত উল্লাহ এবং স্বেচ্ছাসেবক ইয়াসিনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আরসা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা। তাঁরা জানান, নিহত আয়াত উল্লাহর ভাই ১৭ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের সি ব্লকের মাঝি সালামাত উল্লাহর সঙ্গে আরসার বিরোধ ছিল। এ জন্য তারা আয়াত উল্লাহকে খুন করে।

নিহত মোহাম্মদ ইয়াছিনের ভাই মোহাম্মদ হাছন বলেন, ‘আয়াত উল্লাহর এক ভাইয়ের হাত ও পা কেটে ফেলেছিল সন্ত্রাসীরা। তখন মাঝি ও পুলিশকে আমার ভাই সহযোগিতা করতেন। এ জন্য টার্গেট করে আমার ভাই ইয়াছিনকে মেরে ফেলেছে।’

গত বুধবার ভোরে বালুখালী ১০ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে শ্বশুরবাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে খুন করা হয় রোহিঙ্গা যুবক জসিমকে। নিহত জসিমের স্ত্রী সাবেকা বেগম জানান, আরসার ভয়ে পলাতক ছিলেন জসিম। মাঝেমধ্যে স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে শ্বশুরবাড়িতে আসতেন তিনি।

এর আগে ১৮ অক্টোবর খুন হন বালুখালী ১৯ নম্বর শিবিরের একটি ব্লকের সাব মাঝি সৈয়দ হোসেন। এ হত্যাকাণ্ডের এক বছর আগে সৈয়দের বাবা জামাল হোসেনকে খুন করেছিল সন্ত্রাসীরা। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ, জামাল হোসেন প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করার কারণে আরসার সন্ত্রাসীরা তাঁকে খুন করেছে।

রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ বলেন, সৈয়দ হোসেন ছিলেন তাঁর বাবার হত্যা মামলার বাদী। এ মামলার আসামিদের ধরতে তৎপর থাকায় সন্ত্রাসীরা তাঁকেও খুন করেছে।

১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দুই মাঝি আনোয়ার ও মৌলভি ইউনুসকে খুন করে সন্ত্রাসীরা।

রোহিঙ্গা শিবিরের এফ ব্লকের হেড মাঝি আনোয়ার শিক্ষিত এবং সুবিচারক মাঝি হিসেবে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরতে প্রত্যাবাসনের পক্ষে সরব ছিলেন তিনি। চলতি বছরের ২০ জুন প্রত্যাবাসনের দাবিতে ১৩ নম্বর শিবিরে আয়োজিত ‘গো হোম ক্যাম্পেইন’ সমাবেশে বক্তব্য দেন আনোয়ার।

ওই শিবিরের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আনোয়ার প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করায় আরসার টার্গেটে পড়ে। তাদের কথা না মানায় তাকে খুন করা হয়।’

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ার লম্বাশিয়া শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ হত্যাকাণ্ড আরসাপ্রধান আতাউল্লাহ জুনুনির নির্দেশে করা হয়েছে বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। এরপর থেকেই ক্যাম্পে আরসার একের পর এক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠে আসছে।

আরসা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা মাঝি ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের তালিকা করে রোহিঙ্গা শিবিরে অরাজকতা করছে বলে অভিযোগ করেছেন উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘আরসা কখনো চায় না আমরা দেশে ফিরে যাই। তারা এখন তালিকা করছে যারা প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করছে, তাদের।’

অবশ্যই এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কক্সবাজারে সাংবাদিকদের বলেন, সন্ত্রাসীদের পাকড়াও করতে শিগগিরই যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে ১২১ জন খুন হয়েছে। এ সময়ে হত্যা, মাদক, চোরাচালান, অপহরণ, ধর্ষণসহ ১২ ধরনের অপরাধে ২ হাজার ৪৭৮টি মামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে ৫ হাজার ২৫৬ জন।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে। পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মামলা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে।

ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে।

১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুনুর রশীদ বলেন, ‘হঠাৎ করে ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। পালিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসীরা রাতে এসে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তারপরেও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের বিশেষ অভিযান অব্যাহত আছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাকা দিয়ে নারীর চাবুকের ঘা খাচ্ছিলেন পুরুষ, দুজন গ্রেপ্তার

মানবিক করিডর না ভূরাজনৈতিক কৌশল? সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতায় উদ্বেগ

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিংকের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের বিস্তারিত চায় ভারত

নির্দেশনা মানেননি পাইলট, মদিনা–ঢাকা ফ্লাইটকে নামতে হলো সিলেটে

ভারত–বাংলাদেশ বাণিজ্য বিধিনিষেধের মূল্য গুনছেন ব্যবসায়ীরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত