Ajker Patrika

বছরে একবার শুনানি, দুর্ভোগে পাওনাদার

আশরাফ-উল-আলম, ঢাকা
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২২, ১২: ০৫
বছরে একবার শুনানি, দুর্ভোগে পাওনাদার

গাজী গোলাম মোস্তফা রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা। তিনি নাজমা সুলতানা নামে এক নারীকে আড়াই লাখ টাকা ধার দেন। নাজমা ওই টাকা পরিশোধের জন্য দুটি ব্যাংকের দুটি চেক দেন। কিন্তু নাজমার ব্যাংক হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেক দুটি ফেরত দেয় (ডিসঅনার করে) সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এরপর আইনি নোটিশসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গোলাম মোস্তফা ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এনআই অ্যাক্টে মামলা করেন। ২০১৯ সালের ২৬ মে মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বদলি হয়। মামলা দুটি নিষ্পত্তি হয়নি। দুটি মামলার একটি ঢাকা মহানগর দ্বিতীয় যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে, আরেকটির পঞ্চম যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে বিচার চলছে। দ্বিতীয় যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের মামলার শুনানির তারিখ ছিল গত ২৮ জুলাই। পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়েছে আগামী বছর ২৭ জুন। আর পঞ্চম যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন মামলার সর্বশেষ শুনানির তারিখ ছিল গত ৩১ মার্চ। পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়েছে আগামী বছর ২৩ মার্চ।

বছরে একবার শুনানির তারিখ ধার্য হওয়ায় মামলা নিষ্পত্তি নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে গাজী গোলাম মোস্তফার। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘করোনার সময়ে মামলার তারিখ পড়েছে। বাদী ও আসামি কারও হাজির হতে হয়নি। এরপর একটা তারিখে অসুস্থতার জন্য যেতে পারিনি। পরে শুনি এক বছর পর তারিখ পড়েছে। তাহলে এই মামলা শেষ হবে কবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

শুধু এই মামলাই নয়। ঢাকার যুগ্ম মহানগর দায়রা আদালতগুলোতে এ রকম হাজার হাজার চেক প্রতারণার মামলা আছে। বছরে একটা শুনানির তারিখ ধার্য হচ্ছে। চেক প্রতারণার শিকার হয়ে যাঁরা মামলা করেছেন, তাঁরা টাকা পাওয়ার আশায় ঘুরছেন বছরের পর বছর। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। টাকা আদায়ের মামলা করে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

চেক প্রতারণার মামলার বিচার হয় হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন বা নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট (এনআই অ্যাক্ট), ১৮৮১-এর বিধান অনুযায়ী। পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য যেসব চেক দেওয়া হয়, তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে যেকোনো প্রকারে চেক ফেরত হলে (ডিসঅনার হলে) এই আইনের ১৩৮ ও ১৪০ ধারায় মামলা হয়। এই ধরনের মামলায় সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড ও চেকে উল্লিখিত টাকার সর্বোচ্চ তিন গুণ পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। জরিমানার টাকার একটি অংশ অর্থাৎ চেকে উল্লিখিত টাকা মামলার বাদীকে দেওয়া হয়।

এসব মামলা হয় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুতি শেষে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মামলা দায়রা আদালতে স্থানান্তরিত হয়। আর যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে হয় বিচার। ঢাকা মহানগরের মামলাগুলো বিচারের জন্য যুগ্ম মহানগর দায়রা আদালত রয়েছে সাতটি। এই সাতটি আদালতের বাইরে ঢাকার পরিবেশ আদালতে (যুগ্ম দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারক) সরকারের বিশেষ আদেশেও চেক প্রতারণার মামলার বিচার হয়।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার আটটি আদালতে বিচারের জন্য চেক প্রতারণার চলমান মামলা রয়েছে লাখের বেশি। প্রতিটি আদালতে গড়ে ১২ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন। এর সঙ্গে প্রতি মাসে নতুন মামলা বিচারের জন্য আসে প্রায় ১০ হাজার করে। তাই এত মামলা বিচারের জন্য হিমশিম খেতে হয়। সামাল দিতে না পারায় দীর্ঘ বিরতিতে তারিখ ধার্য করতে হচ্ছে আদালতকে।

মহানগর দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তাদার রিয়াজুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সঠিক বলা যাবে না। তবে এক লাখের বেশি চেক প্রতারণার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। একই আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মামলার হিসাব আমাদের কাছে নেই। অনুমান করে বলতে হচ্ছে।’

আরও কিছু মামলা
 রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকার সেলিম মোল্লা ২১ লাখ টাকার চেক প্রতারণার তিনটি মামলা করেন আরিফ জিয়াউদ্দিন নামের একজনের বিরুদ্ধে। তৃতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ ও পঞ্চম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে গত জানুয়ারিতে শুনানির তারিখ ধার্য ছিল। আগামী বছর জানুয়ারিতে এসব মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য হয়েছে।

২০১৯ সালে ৪০ হাজার টাকা আদায়ের জন্য কাফরুলের জুয়েল ফকির চেকদাতা মো. রায়হানের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এখন মামলাটি বিচারাধীন আছে ঢাকার দ্বিতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে। গত ৭ জুলাই মামলার শুনানির তারিখ ছিল। আগামী শুনানির তারিখ পড়েছে আগামী বছরের ১৪ মে।

১০ লাখ টাকা আদায়ের জন্য রেজাউল করিম বাদী হয়ে গোলাম হোসেন সরোয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন ২০১৭ সালে। ঢাকার যুগ্ম মহানগর দায়রা আদালতে বিচারাধীন এই মামলার শুনানি ছিল গত ২১ জুন। নতুন তারিখ ধার্য হয়েছে আগামী বছরের ৬ আগস্ট। এক বছর দুই মাস পর পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ হওয়ায় মামলার বাদী রেজাউল করিম এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তি হতে কয়েকটা তারিখ ধার্য করতে হয়। প্রতিবছরে একবার শুনানির তারিখ ধার্য হলে এক মামলা শেষ হতে কয়েক বছর লাগবে। মানুষকে টাকা ধার দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছি। এখন আদালতে এসেও সময়মতো প্রতিকার পাচ্ছি না। তাহলে বিচার চেয়ে লাভ কী?’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘বছরে একবার শুনানির বিষয়টা অবশ্যই বিচারপ্রার্থীদের জন্য, বিশেষ করে যাঁরা টাকা আদায়ের জন্য মামলা করেন, তাঁদের জন্য বিব্রতকর ও ভোগান্তির। কিন্তু উপায় নেই। এত এত মামলা বিচারাধীন। তা সামাল দেওয়া আদালতের জন্য কষ্টকর।’ তিনি বলেন, যুগ্ম মহানগর দায়রা আদালতের সংখ্যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। আদালতের সংখ্যা না বাড়ালে এসব মামলার বিচার আরও বিলম্বিত হবে।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, মামলার চাপের কারণে দীর্ঘ বিরতিতে মামলার তারিখ ধার্য করা হচ্ছে। চেক প্রতারণার মামলা করতে এসে পাওনাদারেরা সময়মতো প্রতিকার পাচ্ছেন না। এ কারণে আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে একটি শুনানির তারিখ থেকে আরেকটি শুনানির তারিখের ব্যবধান কমানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তা না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।

কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চেক প্রতারণার মামলা করেন সঞ্জীব কুমার দাশ। তিনি বলেন, চেক প্রতারণার মামলা হচ্ছে সবচেয়ে সহজ মামলা। মাত্র একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলেই মামলা রায়ের জন্য দিন ধার্য হয়। কিন্তু ওই একজনের সাক্ষ্য নিতে বছরের পর বছর চলে যাওয়ায় পাওনাদারদের ভোগান্তি হয় চরম। ঢাকার আদালতে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হলো যুগ্ম দায়রা আদালতের সংখ্যা বাড়ানো। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

গভর্নর আমাকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়ার কে: বিএফআইইউর প্রধান শাহীনুল

সেই রুহুল আমিনের বসুন্ধরা, বনানী ও উত্তরার জমিসহ ৫০০ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোক

ঠাকুরগাঁওয়ের ৩টি আসনেই জয়ী হবে জামায়াত: মাওলানা হালিম

ছাত্রীকে তিন দিন আটকে রেখে ধর্ষণ, গ্রাম্য সালিসের মাধ্যমে বিয়ে

কেশবপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বর্ণের কারিগরসহ দুই ব্যক্তি নিহত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত