Ajker Patrika

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন /ট্রাম্পের শুল্কে পোশাক রপ্তানিতে ধস, ধুঁকছে ভারতের ‘ডলার সিটি’

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১৮: ০১
ভারতীয় একটি তৈরি পোশাকের কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা। ছবি: সংগৃহীত
ভারতীয় একটি তৈরি পোশাকের কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা। ছবি: সংগৃহীত

আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হন এবং আপনার টি-শার্টে লেখা থাকে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’—তাহলে বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে, সেটি এসেছে ভারতের দক্ষিণের শিল্পকেন্দ্র তিরুপ্পুর থেকে। শহরটি দীর্ঘদিন ধরে ‘ডলার সিটি’ নামে পরিচিত, কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে এটি ভারতের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় রপ্তানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সাত সপ্তাহের মাথায় শহরটির বহু পোশাক কারখানার চাকা প্রায় থমকে গেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় তিরুপ্পুর শিল্পনগরীর বড় কারখানা থেকে ছোট ওয়ার্কশপ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব পড়েছে। হাজার হাজার শ্রমিক হঠাৎ বেকার হয়ে পড়েছেন।

তিরুপ্পুর সেন্টার অব ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জি শম্পথ বলেন, মোট উৎপাদন ২৫ শতাংশের মতো কমে গেছে। তিরুপ্পুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এই শহর থেকে ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পোশাক যায় যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় খুচরা বিক্রেতা—ওয়ালমার্ট, টার্গেট ও সিয়ার্সের মতো ব্র্যান্ডে।

কারখানার শ্রমিক, শ্রম ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী—এমন এক ডজনেরও বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রাম্পের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ কত দ্রুত তিরুপ্পুরের মানুষের জীবন ও জীবিকা ওলট-পালট করে দিয়েছে। অধিকাংশ শ্রমিকের কোনো লিখিত চুক্তি বা চাকরির নিশ্চয়তা নেই। গ্রামাঞ্চল থেকে আসা বহু শ্রমিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যাঁরা এখনো কাজ করছেন, তাঁদেরও কাজের সময় ও বেতন কমে গেছে।

রপ্তানিকারকেরা জানান, অর্ডার বাতিল বা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় তাঁরা পুরোনো স্টক পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারণ, নতুন পণ্য বিক্রি না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক মার্কিন ক্রেতা শুল্কের ক্ষতি পোষাতে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দাবি করছে। ৪৪ বছর বয়সী কর্মী মনোহর সাহনি গত দুই বছর ধরে নতুন তৈরি পোশাকের অতিরিক্ত সুতা ছেঁটে ফেলার কাজ করতেন। পূর্ব ভারতের দরিদ্র রাজ্য বিহার থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি তিরুপ্পুরে এসেছিলেন কাজের আশায়। স্ত্রীও একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। দুজনে মিলে মাসে প্রায় ৪৫০ ডলার আয় করতেন—যা দিয়ে সংসার চলত, মেয়ের বিয়ের দেনাও শোধ হচ্ছিল ধীরে ধীরে।

তাঁরা যত বেশি পোশাক তৈরি করতেন, তত বেশি পারিশ্রমিক পেতেন। কিন্তু উৎপাদন কমে যাওয়ায় আয় নেমে এসেছে মাসে ২৫০ ডলারের নিচে—যা দিয়ে এখন আর ভাড়া ও খাবার খরচ ঠিকমতো মেটানো যায় না। সাহনি বলেন, ‘আমি বুঝে উঠতে পারছি না কী করব। অল্প যা টাকা আছে, সেটা দিয়ে পরিবারের খাওয়ার ব্যবস্থা করব, না মেয়ের বিয়ের দেনা শোধ করব?’

গত মাসে সাহনি স্ত্রী-সন্তানকে রেখে কয়েক শ কিলোমিটার দূরে কর্ণাটক রাজ্যে গিয়েছেন, যেখানে এখন নির্মাণশ্রমিক হিসেবে দিনে ৪ ডলারে কাজ করছেন। তিনি বললেন, ‘বিশ্ববাণিজ্য বা নীতিনির্ধারণ সম্পর্কে আমি খুব একটা জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে, সরকার আমাদের ভুলে গেছে। কোনো সাহায্য পাইনি। কেউ আমাদের খোঁজও নেয় না।’

তিরুপ্পুরের জিনা গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা অংশীদার মোহন শংকর বলেন, ‘এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো লাভ নয়, টিকে থাকা। নগদপ্রবাহ বজায় রাখা এখন মূল লক্ষ্য।’ যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা অর্ডার কমাচ্ছে বা বিলম্ব করছে জানিয়ে শংকর বলেন, তিনি মার্কিন বাজারের জন্য উৎপাদন ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন। তিনি বলেন, ওভারহেড কস্ট তথা অন্যান্য খাতের খরচ কমাতে হবে, প্রয়োজনে কর্মীও ছাঁটাই করতে হবে।

তিরুপ্পুরের বেশির ভাগ কারখানা কম দামের পোশাক তৈরি করে—যেসব টি-শার্ট, লেগিংস ও অন্তর্বাস যুক্তরাষ্ট্রে ৫ থেকে ১০ ডলারের মধ্যে বিক্রি হয়। ফলে অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান তিরুপ্পুরের কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির সাবেক চেয়ারম্যান ও কটন ব্লসমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিল্টন অ্যামব্রোস জন। তিনি বলেন, মার্কিন ক্রেতাদের দেওয়া কোনো ছাড়ই টেকসই নয়—৫ শতাংশও নয়। অথচ এখন অনেক ক্রেতা ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দাবি করছে।

যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছরের আগস্টে ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। বাণিজ্য আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়ায় পরের ধাপে দেশটি রুশ তেল কেনার জন্য ভারতের ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে শুল্কহার বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে উন্নীত করে। গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে আলোচনায় অগ্রগতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে গত বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দুই নেতার মধ্যে এমন কোনো ফোনালাপের বিষয়ে তাদের জানা নেই।

গত ২৮ আগস্ট ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ার এক দিন পর ভারত সরকার তুলা আমদানিতে শুল্কমুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। পোশাকশিল্পকে কিছুটা স্বস্তি দিতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয় বলে মনে করা হচ্ছে। তবে দক্ষিণ ভারতের তিরুপ্পুরের পোশাক ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু এ ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়, সরকারকে আরও দ্রুত ও কার্যকর সহায়তা দিতে হবে।

জন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, সরকারের জরুরি ঋণসহায়ক নীতি নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, শহরের অচল তাঁতকলগুলোর অবস্থা এখন করোনাকালের মতো হয়ে গেছে। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য জানানো হয়নি।

স্বল্পমেয়াদি ক্ষতির পাশাপাশি ভারতীয় রপ্তানিকারকদের মধ্যে এখন আরও বড় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দ্রুতই বাংলাদেশের ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো ভারতীয় পণ্যের জায়গা দখল করে নেবে। কারণ, ওই দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এ বিষয়ে গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য অন্য দেশে অর্ডার সরিয়ে নেওয়া খুব সহজ হবে।

৩২ বছর বয়সী সানোজ কুমার স্মরণ করেন, শুল্কহার বাড়ার আগে শেষ মুহূর্তে অর্ডার শেষ করার জন্য তাঁকে দিন-রাত কাজ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিনিধিরা পর্যন্ত এসে তদারকি করতেন, চাপ দিতেন কাজ শেষ করতে। কিন্তু শুল্ক আরোপের কয়েক দিন পরই তাঁকে জানানো হয়, আর কোনো অর্ডার নেই—কাজে যেতে হবে না।

বিহারের বাসিন্দা কুমার তাঁর কিশোর বয়সে চাচাদের সঙ্গে তিরুপ্পুরে চলে আসেন। পোশাক কারখানায় ‘চেকার’ হিসেবে কাজ করতেন। মূলত তাঁর কাজ ছিল প্রস্তুতকৃত পোশাক থেকে বাড়তি সুতার প্রান্ত ছেঁটে দেওয়া। পাশাপাশি তিনি ঠিকাদারি কাজও করতেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিভিন্ন কারখানায় যুক্ত করতেন। এখন প্রায় সবাই গ্রামে ফিরে গেছেন।

কুমার বলেন, মানুষ এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানিতে ঘুরে ঘুরে কাজ খুঁজছে, কিন্তু কাজ মিলছে না। তিনি জানান, তাঁর সঞ্চয়ও শেষ হয়ে গেছে। কুমার কারখানায় চাকরির পাশাপাশি একটি মোবাইল ফোন মেরামতের দোকান চালান। আগে দোকান থেকে কিছু আয় হতো, এখন শহরের অচলাবস্থায় ক্রেতা নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, রপ্তানিকারক কারখানায় কাজ না থাকলে শহরের অন্য ব্যবসাগুলোও চলবে না।

মার্কিন শুল্কের চাপে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন আত্মনির্ভরতার ডাক দিচ্ছেন। আগস্টে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তিনি বলেন, ‘নির্ভরতা যখন অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন তা দুর্ভাগ্যজনক। উন্নত ভারত গড়তে আমরা না থামব, না মাথা নোয়াব।’ তবে তিরুপ্পুরের শ্রমিক মনোজ কুমার বলেন, ‘মাথা না নোয়ানোর কথা শুনতে ভালো লাগে বটে, কিন্তু পেটে খাবার না থাকলে কীভাবে টিকে থাকব?’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ল ১৫ শতাংশ, সঙ্গে শর্ত

‘জনতার জন্য হিজাব আইন, খামেনির উপদেষ্টার মেয়ের জন্য ডানাকাটা জামা’

ত্রিভুজ প্রেম থেকে মুক্তি পেতেই জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করে ছাত্রী: পুলিশ

স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সাপ্লাই চেইন বিভাগে চাকরির সুযোগ

যুগান্তকারী উদ্ভাবন: চোখে চিপ বসিয়ে দেখতে পাচ্ছেন দৃষ্টিহীনেরা

এলাকার খবর
Loading...