Ajker Patrika

সয়াবিন-পাম অয়েলের দাম বিশ্বে কমল, দেশে বাড়ল

ফারুক মেহেদী, ঢাকা
আপডেট : ০৭ মে ২০২২, ০৯: ১২
সয়াবিন-পাম অয়েলের দাম বিশ্বে কমল, দেশে বাড়ল

নানা অজুহাতে দেশের বাজারে গতকাল শুক্রবার থেকে ভোজ্যতেল সয়াবিন আর পাম অয়েলের দাম যখন এক লাফে লিটারে ৪৪ আর ৩৬ টাকা বাড়ানো হলো, ঠিক সেই সময়েই বিশ্ববাজারে পণ্য দুটির দামই কমতে শুরু করেছে। এক দিনেই সয়াবিনের দাম ১ দশমিক ১৭ শতাংশ আর পাম অয়েলের দাম ৫ শতাংশের বেশি কমেছে।

গতকাল থেকেই বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন ১৯৮ টাকা আর পাম অয়েল ১৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হেঁশেলের আবশ্যিক এ পণ্য এর আগে কখনো বাংলাদেশের মানুষ এত দাম দিয়ে কেনেনি। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মাত্র ৬-৭টি বড় শিল্পগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে পুরো রান্নার তেলের বাজার। তাই বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও দেশে তার চেয়ে বেশি বাড়ানো হয়। এখনই নজরদারি না বাড়ালে সামনে বাজার আরও অস্থির হতে পারে।

এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা–অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ কমিটির সদস্য হলেও একবারে এত টাকা দাম বাড়ানো নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে এক-দু দিনের দাম দেখে নয়; অন্তত দুই সপ্তাহের গতি–প্রকৃতি দেখে দাম নির্ধারণ করা হয়। এটা রিয়েল টাইমে করা যায় না। এখন যদি দাম কমার প্রবণতা স্থায়ী হয় সেটা দেখে হয়তো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, ‘আমরা ভোক্তা অধিকারের পক্ষ থেকে নজরদারি জোরদার করেছি। ঈদের আগে ডিলার, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের একশ্রেণির ব্যবসায়ী তেল মজুত করে দাম বাড়ানোর প্রবণতা তৈরি করেছিল বলে মনে হয়েছে। তবে আগামীকাল রোববার থেকে আমরা বসে ঘোষিত দামের চেয়ে আর যেন দাম না বাড়ে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেব।’

বিশ্ববাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জানা যায়, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করা, কানাডা ও ব্রাজিলে খরার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ—এ সব কারণে দেশের ভোজ্যতেল আমদানিকারকেরা বেশ কিছুদিন থেকেই লোকসানের অজুহাতে দাম বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়ে সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিলেন। তবে তাদের প্রস্তাবে সায় দিয়ে বর্ধিত দাম কার্যকরের দিনই বিশ্ববাজারে পণ্য দুটির দাম কমার কথা জানিয়েছে পণ্যবাজার নিয়ে গবেষণা করে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং ইকোনমিকস বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

ট্রেডিং ইকোনমিকসের লাইভ আপডেট প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গতকাল ৬ মে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম প্রতি টনে কমেছে ১৭ দশমিক ৫ ডলার। শতাংশের হিসাবে একদিনে তা প্রায় ১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কমেছে। এক মাসের হিসাবে পণ্যটির দাম বেড়েছে ১ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর বছর ব্যবধানে বেড়েছে ২ দশমিক ৭০ শতাংশ। গতকাল পাম অয়েলের দাম এক লাফে কমেছে ৩৪২ ডলার। শতাংশের হিসাবে এক দিনে তা কমেছে ৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। যদিও এক মাসের ব্যবধানে এর দাম বেড়েছে ১০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। আর বছর ব্যবধানে বেড়েছে ৪৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির গতকালকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১৯০ টাকা ধরে বছর ব্যবধানে দাম প্রায় ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর একই সময়ে পাম অয়েলের দাম প্রতি লিটার ১৭২ টাকা ধরে ৪৬ দশমিক ২৬ শতাংশ বাড়ানোর তথ্য দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম মাত্র পৌনে ৩ শতাংশ বাড়লেও একই সময়ে তা দেশের বাজারে ২৭ শতাংশ বেড়েছে। আর পাম অয়েলের বিশ্ববাজারে ৪৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ বাড়লেও, দেশের বাজারে তা বেড়েছে ৪৬ শতাংশের বেশি। অথচ এ সময়ে আমদানিকারকরা প্রতি লিটারে শুল্ক–কর ছাড় নিয়েছেন প্রায় ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। এর বাইরেও তারা আমদানিতে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন।

পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, মূলত ৬-৭টি শীর্ষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানই পুরো রান্নার তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার প্রবণতা হলেই সরকারের কাছে দেনদরবার শুরু করে দেয় দাম বাড়ানোর। বিশ্ববাজারে যে হারে বাড়ে স্থানীয় বাজারে তার চেয়ে বেশি বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। আমদানি ও বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহের বিচারে এসব প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও তাদের অগ্রাহ্য করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আজিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এর ভেতরে অবশ্যই একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। তাদের চোরাই লাভ করার মনোভাব পরিষ্কার। এ চেষ্টা তারা করবেই। তবে এর কাউন্টার দিতে হবে সরকারকে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় বাজারে দাম বাড়ানো হয়। অথচ দাম যখন কমে তার কোনো খবর থাকে না। মূল কথা হলো কঠোর নজরদারি। এটা হচ্ছে না। আমদানিকারকদের কথায় এক লাফে প্রতি লিটারে এত দাম বাড়ানোর ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়নি। তিনি বলেন, একটি প্রস্তাব দিলে তার যৌক্তিকতা দেখে, কতটুকু বাড়ানো উচিত ইত্যাদি পর্যালোচনা করে তবে দাম বাড়ানোতে সায় দেওয়া উচিত।

জানা যায়, গত বছর বাংলাদেশ ১৮ লাখ ১৮ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি করেছে। শুল্ক কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান বলছে, আমদানি করা ভোজ্যতেলের ৮৮ শতাংশই আমদানি করেছে টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপ। ছাড়াও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (বিইওএল), বসুন্ধরা, গ্লোব, সেনা এডিবল অয়েল, মজুমদার গ্রুপসহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেল আমদানি করে থাকে। গতকাল নতুন যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হয়েছে। পরে তারা তা সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে। তবে এবারের দাম বাড়ানোর হার অনেক বেশি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত