Ajker Patrika

বদলে যাওয়া সাংবাদিকতা

ড. জামিল খান
আপডেট : ৩০ জুন ২০২১, ১৩: ০৭
বদলে যাওয়া সাংবাদিকতা

একজন পেশাদার সাংবাদিকের প্রধান কাজ সংবাদ সংগ্রহ, তথ্য যাচাই, তৈরি এবং তা অভীষ্ট পাঠক-দর্শকের কাছে বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে সরবরাহ করা। সংবাদ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং প্রচারের কাজে আধুনিক যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আধুনিক সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির নানা ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে গণমাধ্যমের সঙ্গে পাঠকের সম্পৃক্ততা বাড়ানো সম্ভব, যা ওয়েব ২ দশমিক শূন্য ভিত্তিক অনলাইন মাধ্যমগুলোর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক গণমাধ্যমে কর্মরত একজন পেশাদার সাংবাদিকের দায়িত্ব-কর্তব্য এখন নতুনভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে। একজন সাংবাদিক এখন একাই একাধিক কর্মীর কাজ করেন। তাঁদের কাজের মূল্যায়ন করা হচ্ছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। নিউজরুমের কাঠামো পরিবর্তন, প্ল্যাটফর্মভিত্তিক নিউজ কনটেন্ট তৈরি, সাংবাদিক-পাঠক ও সোর্সের সঙ্গে সাংবাদিকদের যোগাযোগের ধরনেও এসেছে পরিবর্তন।

২০১৮ সালের কথা। বাংলাদেশের প্রথম সারির একটি দৈনিক পত্রিকায় তখন মোবাইল জার্নালিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলাম। সে বছর ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট কাভার করতে দুই সপ্তাহ রাশিয়ায় ছিলাম। বিশ্বকাপের ভেন্যু থেকে শুধু মোবাইল ডিভাইস, মনোপড ও মাইক্রোফোন ব্যবহারের মাধ্যমে খবর সংগ্রহ ও প্রচার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পত্রিকাটির পাঠক-দর্শকের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ফেসবুকে লাইভ ভিডিও প্রচার, মাল্টিমিডিয়া গল্প তৈরি, ইনস্টাগ্রাম-টুইটারে ছবি আপলোড, ফেসবুক স্টোরিজে ছবি প্রকাশ, ওয়েবসাইটে ছবির গল্প দেওয়া—সব কাজ একাই করেছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া এসব কনটেন্ট থেকে পাঠক-দর্শক বিশ্বকাপ এবং একে ঘিরে রাশিয়ার সমসাময়িক বাস্তব চিত্র সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এই বহুমুখী ভূমিকার কারণে একবিংশ শতাব্দীর একজন সাংবাদিককে এখন ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ বলা হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মোবাইল ডিভাইস তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির এমন দুটি উদ্ভাবন, যা গোটা সাংবাদিকতাকে পাল্টে দিয়েছে। মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তাই আমরা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলতে পারি। শুরুর দিকে তাকালে দেখব, প্রথম আইফোন এসেছিল ২০০৭ সালে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার এসেছিল ২০০৬ সালে। বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই সাংবাদিকতায় এ দুই প্রযুক্তি প্রভাব বিস্তার করছে বলা যায়। মোবাইল ফোনের উন্নত ক্যামেরা এখন ক্যানন বা নিক্কনের মতো কোম্পানিগুলোকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এত অল্প সময়ে অতীতে আর কোনো প্রযুক্তি যোগাযোগে এতটা পরিবর্তন আনতে পারেনি। 

সবার আগে ডিজিটাল কৌশল
সংবাদমাধ্যমে ডিজিটাল ফার্স্ট স্ট্র্যাটেজি বা সবার আগে ডিজিটাল কৌশল প্রয়োগের ধারণা এখন বহুশ্রুত। এ সময়ের কোনো সংবাদমাধ্যম একে উপেক্ষা করে চলতে পারে না। সবার আগে ডিজিটাল কৌশল বলতে কী বোঝায় বা সনাতনি গণমাধ্যমের সঙ্গে এর পার্থক্য কোথায়—সে বিষয়ে এখানকার অনেক সংবাদকর্মীরই পরিষ্কার ধারণা নেই। অনেকেই মনে করেন, সবার আগে ডিজিটাল কৌশল হচ্ছে ওয়েবনির্ভর বা ওয়েব-ফার্স্ট কৌশল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। 

নাগরিক সাংবাদিকতাকে উপেক্ষা নয়
বদলে যাওয়া যে সাংবাদিকতার কথা আমরা বলছি, সেখানে পাঠক-দর্শকের ভূমিকায় পরিবর্তন আসাটাও দারুণভাবে আধুনিক সাংবাদিকতায় প্রভাব ফেলেছে। দেশের অনেক আলোচিত ঘটনা সবার আগে সাধারণ নাগরিকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেছে। সাভারে ছাদবাগানের গাছ কেটে ফেলা, সিলেটে শিশু রাজন হত্যা, ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা প্রকাশ্যে এনেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এ ছাড়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেরই ফল।

মূলধারার সাংবাদিকতায় নাগরিক সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ এখন অনেক বেড়েছে। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মোবাইল ডিভাইসের কারণেই সম্ভব হয়েছে। এখানে পেশাদার সাংবাদিকদের পাশাপাশি যে কেউ চাইলে যেকোনো ঘটনা বা সংবাদ প্রচার করতে পারেন। তবে মূলধারার গণমাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে পাওয়া যেকোনো ঘটনা সংবাদ হিসেবে প্রচার করতে হলে অবশ্যই তাতে কিছু উপাদান থাকা চাই। অনলাইনে কোনো কিছু লিখে দেওয়া বা ছবি-ভিডিও আপলোড করাকে নাগরিক সাংবাদিকতা বলা যায় না। নাগরিক সাংবাদিকদের কনটেন্ট মূলধারার সাংবাদিকদের প্রতিবেদন তৈরিকে যেমন আরও বৈচিত্র্যময় করেছে, তেমনি অনেক ঝুঁকিও সৃষ্টি করেছে। তাই গণমাধ্যমে নাগরিক সাংবাদিকদের কনটেন্ট প্রচারের আগে সাংবাদিকদের সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল অবলম্বন করতে হয়। 

সাংবাদিকের বহুমুখী গুণ থাকা চাই
সাংবাদিকতায় পরিবর্তনের এই ঢেউ পশ্চিমা বিশ্ব পেরিয়ে আমাদের দেশেও আছড়ে পড়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম সনাতনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। লোকবল নিয়োগের পাশাপাশি কনটেন্ট তৈরিতে অনেক বৈচিত্র্য এনেছে। ব্রেকিং নিউজ, ছবি, ভিডিও, অডিও, টকশো, বিনোদনভিত্তিক অনুষ্ঠানসহ নানা কনটেন্ট আমরা বাংলাদেশি গণমাধ্যমের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখছি। 
সাংবাদিকদের এখন দায়িত্ব-কর্তব্য ছাপা কাগজ, রেডিও কিংবা টেলিভিশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একাধারে তাঁদের ছবি, অডিও-ভিডিওর সমন্বয়ে ওয়েবসাইটের জন্য মাল্টিমিডিয়া গল্প তৈরির কাজ করতে হচ্ছে। তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা দিনদিন আরও বেশি মাল্টিমিডিয়া–নির্ভর হয়ে উঠেছে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক কিংবা অনলাইন সংবাদমাধ্যম অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ওয়েব ভিডিওর ওপর বেশি জোর দিচ্ছি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য আলাদা ডিজিটাল স্টোরি প্রচার করছে, যা টেলিভিশনের স্ক্রিনে দর্শক দেখতে পান না। আর এ কাজের জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট বিভাগে আলাদা লোকবল নিয়োগ দিচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো। নতুন সাংবাদিক নিয়োগের বেলায় এখন মাল্টিটাস্কারদের বেছে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

সাংবাদিক নিয়োগের সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি বিজ্ঞপ্তিতে সংবাদমাধ্যমগুলো আবেদনকারীদের যোগ্যতা হিসেবে মোবাইলে সংবাদ লেখা, ছবি-ভিডিও ধারণ ও সম্পাদনার কথা উল্লেখ করেছে। ওয়েবনির্ভর এই সাংবাদিকতার যুগে একজন সংবাদকর্মী শুধু তাঁর মোবাইল ফোন ব্যবহার করেই ছবি ও ভিডিও ধারণ, সম্পাদনা ও অনলাইনে তা পরিবেশনের কাজটি করতে পারবেন—এমন প্রত্যাশা এখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। অনলাইননির্ভর এই ‘ডিজিটাল জার্নালিজম’ সাংবাদিকতার পূর্বমান, কর্মপদ্ধতি ও সরঞ্জামের ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন এনেছে। 

ড. জামিল খান, সহকারী অধ্যাপক
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাকা দিয়ে নারীর চাবুকের ঘা খাচ্ছিলেন পুরুষ, দুজন গ্রেপ্তার

মানবিক করিডর না ভূরাজনৈতিক কৌশল? সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতায় উদ্বেগ

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিংকের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের বিস্তারিত চায় ভারত

নির্দেশনা মানেননি পাইলট, মদিনা–ঢাকা ফ্লাইটকে নামতে হলো সিলেটে

ভারত–বাংলাদেশ বাণিজ্য বিধিনিষেধের মূল্য গুনছেন ব্যবসায়ীরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত