Ajker Patrika

উচ্চশিক্ষায় আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন

এস এম আবু হাসনাত রানা
উচ্চশিক্ষায় আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন

ইংরেজিতে একটি কথা আছে—বেটার লেট দ্যান নেভার, অর্থাৎ কখনো না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হলেও ভালো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়টি উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য ঠিক তেমনই; ‘দেরিতে হলেও ভালো’ একটি প্রকল্প। আকাশ ও মহাকাশবিজ্ঞান প্রকৌশল সম্পর্কিত দেশের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অবহেলিত এই জনপদের মানুষের সামনে খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সক্ষমতার আরও এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর পাশাপাশি উত্তরবঙ্গকেও বিশ্বদরবারে দেবে নতুন পরিচয়—স্থানীয়দের এমন বিশ্বাসে সহমত জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরাও।

‘অ্যাভিয়েশন’ ও ‘অ্যারো স্পেস’ শব্দ দুটি পরিচিত হলেও অনেকের কাছে এর অর্থ সুস্পষ্ট নয়। শব্দ দুটির পারিভাষিক অর্থ অনেক গভীর এবং কারিগরি হওয়ায় আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের কাছে বিষয়গুলো ভাসা ভাসা অর্থ বহন করে। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়টির সুযোগ ও সম্ভাবনার ব্যাপারে অনেকেই এখনো বিশদভাবে অবগত নন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানলে সবাই নিশ্চয়ই উচ্ছ্বসিত হবেন। আগামী প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বিমান প্রকৌশল ও মহাকাশ শিক্ষার প্রযুক্তিনির্ভর এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মেগা প্রকল্প গ্রহণের মধ্য দিয়ে যে চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। এই উদ্যোগ বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশিদের জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। আর্থসামাজিক ও ভূরাজনৈতিকভাবেও অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদা। এমন দুঃসাহসী মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উত্তরবঙ্গকে বেছে নেওয়ায় এই অঞ্চলের বাসিন্দা হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে আবেগাপ্লুত। শেষ পর্যন্ত এই এলাকার মানুষ যে মেগা প্রকল্পটি পেয়েছে, সেটি তাদের জন্য বয়ে আনবে অভাবনীয় সুফল। শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, সারা দেশ তো বটেই, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্যও উচ্চশিক্ষার এক তীর্থস্থান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। এমন সুবিশাল একটি উদ্যোগের সঙ্গে উত্তরবঙ্গকে সম্পৃক্ত করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, লালমনিরহাটে অবস্থিত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পরিত্যক্ত বিমানবন্দরটিকে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হোক। ফের চালু হলে বিমানবন্দরটি এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও এ ব্যাপারে বিগত দিনে কোনো সরকারের উল্লেখযোগ্য তেমন তৎপরতা চোখেই পড়েনি। অথচ অন্তত গত তিন দশক ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অবস্থানে দায়িত্ব পালন করেছেন উত্তরের নেতৃবৃন্দ। তার পরও বারবার উন্নয়নের দিক দিয়ে অবহেলিত হয়েছে এই অঞ্চল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। মেডিকেল এবং অন্যান্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও পেয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলা। তবে উত্তরবঙ্গের কোনো জেলা স্থান পায়নি সেই তালিকায়। এই সরকারের আমলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্পায়নসহ বড় বড় প্রকল্পের মধ্যে বেশির ভাগই পেয়েছে দক্ষিণাঞ্চল। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, হাইওয়েসহ আরও অনেক কিছু। একটি দেশের সুষম উন্নয়ন বলতে যা বোঝায়, আমরা ছিলাম তার বাইরে। দেরিতে হলেও অবশেষে এই অঞ্চলের উন্নয়নে নজর দিয়েছে সরকার। ঢাকা-রংপুর-বুড়িমারী ফোর লেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর বিভাগ, সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উন্নীতকরণ, চিলাহাটি-শিলিগুড়ি রেল সংযোগসহ বেশ কিছু প্রকল্প উত্তরবঙ্গে দিয়ে এই এলাকার মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহানুভূতি ও সুদৃষ্টির প্রমাণ দিয়েছেন।

২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি লালমনিরহাটে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বিমান বাহিনীর তৎকালীন প্রধান মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত। ভবন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অস্থায়ী ক্যাম্পাসও রয়েছে। তেজগাঁওয়ে পুরোনো বিমানবন্দর ও পিএসসির পুরোনো কয়েকটি ভবনে ৭৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে গত বছরের জানুয়ারি থেকে প্রথম একাডেমিক সেশনও চালু হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে কার্যক্রম কিছুটা বিঘ্নিত হলেও আগামী আগস্টে নতুন সেশনে ভর্তির সার্কুলার হওয়ার কথা। ২০২২ সালেই স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করা যাবে বলে আশাবাদ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এয়ার ভাইস মার্শাল এ এইচ এম ফজলুল হক জানান, তাঁদের কারিকুলাম, সিলেবাসসহ পাঠদানের প্রক্রিয়া নির্ধারণ এবং বিশ্বমানের ক্যাম্পাস, ল্যাবরেটরি নির্মাণসহ অন্যান্য কারিগরি সহযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। ইতিবাচক সাড়াও মিলেছে। বিশ্বখ্যাত বোয়িং বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে এবং তাদের স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বমানের শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড সেফটি অথোরিটির (ইএসএসএ) মান সনদ পাওয়ার চেষ্টাও চলছে। শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক মান অর্জনের জন্য কভেন্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়, সারে বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টারসহ ইউরোপের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াও চলমান। এ ছাড়া শিক্ষক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানে আনতে উন্নত দেশের সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অভিজ্ঞ বাঙালিদের সঙ্গেও কথাবার্তা চলছে। দেশের টানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে তাঁরা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলেও জানান উপাচার্য। এসব ইতিবাচক সংবাদ আমাদের আশাবাদী করে তুলছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন উত্তরবঙ্গের এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মুখরিত হয়ে উঠবে দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমসহ দেশের সব অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের পদচারণায়। দেশি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছেও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষার তীর্থস্থান হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরর রহমানের নামে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়টি।

বিশ্বব্যাপী অ্যাভিয়েশন খাতে ৪০-৫০ লাখ দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন ও অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আমাদের তারুণ্যকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুশিক্ষিত ও দক্ষ করে তুলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ এখন ঘরের দুয়ারে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাইলট প্রশিক্ষণ, দক্ষ বৈমানিক তৈরি, হেলিকপ্টার ও যুদ্ধজাহাজ তৈরি, মেরামত তথা এয়ারক্রাফটের থার্ড লাইন মেইনটেন্যান্স, ওভারহোলিংসহ সব ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং পর্যায়ক্রমে মহাকাশ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। উন্নত দেশের এয়ারক্রাফট মেরামতের জন্য এখন সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াকে বেছে নেওয়া হয়। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশও এই খাতে অবদান রাখতে পারবে। এই বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে গড়ে উঠবে অ্যাভিয়েশন হাব।

একই সঙ্গে সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মর্যাদা দিয়ে ভুটান ও নেপালের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি এবং রংপুর, লালমনিরহাট, বুড়িমারী, শিলিগুড়ি সরাসরি সড়ক ও রেলযোগাযোগ স্থাপন এবং লালমনিরহাট বিমানবন্দর ঘিরে অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনার উদ্যোগ নিলে ত্রিদেশীয় কানেকটিভিটি স্থাপনের সম্ভাবনাও রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, পর্যটনশিল্প উন্নয়ন এবং আমদানি–রপ্তানিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। এসব পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করা গেলে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, আমরা বিশ্বসম্প্রদায়কে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো কিছু করে ফেলব। 

এস এম আবু হাসনাত রানা
প্রভাষক, আদিতমারী কেবি স্কুল অ্যান্ড কলেজ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাকা দিয়ে নারীর চাবুকের ঘা খাচ্ছিলেন পুরুষ, দুজন গ্রেপ্তার

মানবিক করিডর না ভূরাজনৈতিক কৌশল? সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতায় উদ্বেগ

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিংকের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের বিস্তারিত চায় ভারত

নির্দেশনা মানেননি পাইলট, মদিনা–ঢাকা ফ্লাইটকে নামতে হলো সিলেটে

ভারত–বাংলাদেশ বাণিজ্য বিধিনিষেধের মূল্য গুনছেন ব্যবসায়ীরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত