Ajker Patrika

পেয়ারাই অর্থনীতির প্রাণ

খালিদ আবু
আপডেট : ২৯ জুন ২০২১, ২১: ২০
পেয়ারাই অর্থনীতির প্রাণ

পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি ও বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার ৩৬টি গ্রামজুড়ে দেশের সবচেয়ে বড় পেয়ারাবাগান অবস্থিত। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠি, ধলহার, কঠুরাকাঠি, আন্দাকুল, জিন্দাকাঠি, ব্রাহ্মণকাঠি, আতা, জামুয়া, মাদ্রা, শশীদ, পূর্ব জলাবাড়ী, আদাবাড়ী ও জৌসার গ্রাম এবং ঝালকাঠি ও বরিশালের বানারীপাড়ার মোট ৩৬টি গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়। কয়েক হাজার পেয়ারাবাগানে হাজার হাজার চাষি পেয়ারা চাষাবাদ করে আসছেন।

পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানা বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারাসমৃদ্ধ গ্রাম। এশিয়ার বিখ্যাত এই পেয়ারাকে স্থানীয় ভাষায় গইয়া কিংবা সবরি বলা হয়। তবে জাতীয়ভাবে এটি পেয়ারা নামে পরিচিত। আর পুষ্টিমানের দিক থেকে একটি পেয়ারা চারটি আপেলের সমতুল্য বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। তাই পেয়ারাকে কেউ বলে ‘বাংলার আপেল’ আবার কেউ বলে ‘গরিবের আপেল’।

বর্ষা মৌসূমে এই এলাকা থেকে লাখ লাখ টন পেয়ারা সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কুড়িয়ানার পেয়ারাগ্রাম বহন করছে পেয়ারা চাষের শত বছরের ঐতিহ্য। অধিক ফলনের পরও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে লাভবান হতে পারছেন না এলাকার কৃষকেরা। পেয়ারা চাষই এখানকার কৃষকদের প্রধান জীবিকা। দক্ষিণাঞ্চলে পেয়ারা উৎপাদন প্রচুর হলেও সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর চাষিদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। পেয়ারা দ্রুত পচনশীল একটি ফল। তাই দ্রুত বিক্রি না করতে পারলে চাষিরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। বছরের পর বছর ভালো ফসল উৎপাদন করলেও আজ পর্যন্ত পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য গড়ে ওঠেনি কোনো হিমাগার। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও যাতায়াতের অভাবে গড়ে ওঠেনি পেয়ারার জ্যাম-জেলি প্রস্তুত কারখানা। কৃষকেরা প্রকৃত সুফল না পেলেও মুনাফা অর্জন করে নিচ্ছেন স্থানীয় ফড়িয়া ও বহিরাগত ব্যবসায়ীরা। বহু আবেদন–নিবেদন করে কোনো ফল না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেন স্থানীয় জনপ্রতিধিরা।

আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্রের অর্ধেক—এই আড়াই মাস জমে ওঠে পেয়ারা বেচাকেনা। পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০টিরও বেশি ছোট-বড় ব্যবসাকেন্দ্র ও হাট। স্থানীয়ভাবে বলা হয় পেয়ারার মোকাম। এই মোকামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আটঘর, কুড়িয়ানা, ভিমরুলী, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি, বাউকাঠি। প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙিতে করে সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে এসে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। পাইকাররা তা কিনে ট্রলারযোগে নৌপথে নিয়ে যান ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। এ বছরের ফাল্গুনে পেয়ারাগাছে ফুল ধরার পর অতিরিক্ত খরায় পানির অভাব দেখা দেওয়ায় ফুল ঝরে পড়ার পাশাপাশি অনেক গাছও মারা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পেয়ারাচাষিরা গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সার ও মাটি দিতে পারেননি। তার পরও এবার পেয়ারার ভালো ফলন হওয়ার আশা চাষিদের। তাঁদের বিশ্বাস, কেটে যাবে দুশ্চিন্তা।

উৎপত্তির কথা
কবে এই জনপদে পেয়ারার চাষ শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে দুটি মত প্রচলিত এখানে। জনশ্রুতি বলে, দুই শতাধিক বছর আগে তীর্থ করতে এখানকার কেউ একজন ভারতের বিহার রাজ্যের গয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে এই ফল দেখে চাষ সম্পর্কে জেনে বীজ এনে বুনেছিলেন আটঘর-কুড়িয়ানায়। গয়া থেকে আনা বীজ বপন করে গাছ এবং সেই গাছ থেকে ফল পাওয়ার পর এর নাম রাখা হয়েছিল গয়া। সেখান থেকে অপভ্রংশ হয়ে স্থানীয়রা এখন এই ফলকে গইয়া নামে ডাকে। উৎপত্তির অপর কাহিনি সম্পর্কে আটঘর গ্রামের প্রবীণ পেয়ারাচাষি নিখিল মণ্ডল জানালেন, আন্দাকুল গ্রামের পূর্ণচন্দ্র মণ্ডল কাশীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সর্বপ্রথম তিনিই পেয়ারার বীজ নিয়ে আসেন এই এলাকায়। সেই বীজ থেকে যেসব গাছ উৎপন্ন হয়েছে এবং ওই গাছে উৎপাদিত পেয়ারা এখনো পূণ্যমণ্ডলী পেয়ারা নামে পরিচিত। এই পেয়ারার গায়ে কমলালেবুর মতো শির আঁকা আছে। খেতে বেশ সুস্বাদু, ভেতরের রং লালচে ধরনের এবং সুগন্ধিযুক্ত। এই হিসাব অনুযায়ী, ১৭৫ বছরের কাছাকাছি হতে পারে এখানের পেয়ারা চাষের বয়স। পূর্ণচন্দ্র মণ্ডলের নাতি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নির্মল চন্দ্র মণ্ডল জানালেন, তাঁর পিতার লাগানো শতাধিক বছরের পুরোনো বাগান এখনো বিদ্যমান।

যেভাবে হয় পেয়ারার চাষ
সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় পেয়ারা চাষ হয়ে থাকে। বীজ থেকে চারা উৎপন্ন করে কান্দি কেটে আট হাত দূরত্বে একত্রে দুটো করে চারা লাগানো হয়। তিন বছরের মধ্যে গাছে ফল ধরে। এই গাছ এক শ থেকে সোয়া শ বছর বেঁচে থাকে এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফল দেয়। প্রতিবছর দুবার করে বাগান নিড়াতে হয়। অগ্রহায়ণ–পৌষ মাসে মাটির প্রলেপ দিতে হয় সব কান্দিতে। ফাল্গুন মাসে দখিনা বাতাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গাছে নতুন পাতা গজাতে থাকে। ফাল্গুন ও চৈত্র এই দুই মাসে ফুল থেকে ফল বের হয়। পহেলা শ্রাবণ থেকে পূর্ণাঙ্গ ফল পাড়তে শুরু করেন চাষিরা। শ্রাবণ মাসের পুরোটা সময় প্রতিদিনই পেয়ারা সংগ্রহ করতে পারেন। বিশেষ করে পুরোনো গাছের ফুল দেরিতে আসে বলে ফলও দেরিতে হয়। তবে পুরোনো গাছের পেয়ারা চারা গাছের পেয়ারার চেয়ে বেশি সুস্বাদু হয়।

পেয়ারাচাষি জাহিদ মিয়া জানান, মৌসুমের শুরুতেই ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে প্রতি মণ পেয়ারা ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। প্রতিবছর পেয়ারার মৌসূমে বিভিন্ন স্থান থেকে নৌপথে পেয়ারাবাগানে আসেন পর্যটকেরা। পেয়ারাবাগানে এসে দেখে মুগ্ধ হয়ে এখান থেকে পেয়ারা কিনেও নিচ্ছেন পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের জন্য। বছরের পর বছর ধরে পেয়ারা উৎপাদিত এসব এলাকার চাষিদের একমাত্র সমস্যা হিমাগার ও সড়কপথে যোগাযোগের যথোপযোগী ব্যবস্থা না থাকা।

এই অঞ্চলের সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠলে পেয়ারা দ্রুত বাজারজাত করা যেত। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা হলে পেয়ারাচাষিদের বাগান থেকে সরাসরি ট্রাকযোগে প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতেই ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পেয়ারা পৌঁছে দেওয়া এবং পচন রোধ করা সম্ভব হতো।

কুড়িয়ানার পেয়ারাচাষি বিশ্বজিত চৌধুরী জানান, সরকারি বা বেসরকারি  উদ্যোগে বড় সাইজের পেয়ারা প্রসেসিং করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ মেট্রিকটন উৎপাদিত পেয়ারা থেকে বছরে প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা আয় হয়। পেয়ারার চাষাবাদ ও বিপণনব্যবস্থার সঙ্গে এই এলাকার প্রায় সাত থেকে আট হাজার শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। পেয়ারাবাগান পরিচর্যাসহ শ্রমমজুরি বেশি হওয়ায় চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তবু পূর্বপুরুষদের এই পেশা আগলে রেখেছেন এখানকার চাষিরা। পেয়ারাই পিরোজপুরবাসীকে অন্য জেলা থেকে আলাদা করেছে। 

খালিদ আবু
সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নিজের প্রস্রাব পান করে ‘আশিকি’ অভিনেত্রী অনু আগারওয়াল বললেন, ‘আহা অমৃত’

মে. জে. ফজলুরের সেভেন সিস্টার্স দখলের মন্তব্য সমর্থন করে না সরকার: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিংকের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের বিস্তারিত চায় ভারত

গায়ে কেরোসিন ঢেলে কলেজছাত্রীর আত্মহনন, পলাতক ইমাম গ্রেপ্তার

সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকেরা পাচ্ছেন গেজেটেড মর্যাদা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত