Ajker Patrika

সমৃদ্ধির পথে সাগরকন্যা

ফরহাদ জামান বাদল
সমৃদ্ধির পথে সাগরকন্যা

পৃথিবীর যেখানেই যাই, প্রশান্তি খুঁজে পাই ছায়াঘেরা প্রান্তর আর সবুজ–শ্যামলে নির্মল নিশ্বাসের আশ্বাসমাখা প্রিয় জনপদ পটুয়াখালীতে এসে। এখানে ভালোবাসার বন্ধন আছে, আছে মুক্ত জীবনের আস্বাদ। শৈশব–কৈশোর আর যৌবনের আবেগময় ঘটনার স্মৃতি নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটে চলার আরেক নামই জীবন। এই সদা ছুটতে থাকা জীবনে ভালোবাসার একমাত্র বন্দর পটুয়াখালী।

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী অসংখ্য নদনদী, খালবিল ও বনাঞ্চলে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। মাটি অত্যন্ত উর্বর বলে এখানে প্রচুর শস্য ফলে। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ কৃষিনির্ভর। তবে কৃষিতে এগিয়ে থাকলেও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব সময়ই পিছিয়ে। বড় কারণ—বিনিয়োগকারীর অভাব। এ ছাড়া ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা এবং অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থাও অন্যতম কারণ।

এর অর্থ এই নয় যে, এ অঞ্চলের মানুষ ব্যবসা–বাণিজ্যের সঙ্গে একেবারেই সম্পৃক্ত নয়। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ছোট ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল পটুয়াখালীতে। বিড়ি ও লবণশিল্প, ছাপাখানা, বেকারি, মিষ্টি, চালকল, বরফকল, মৎস্য ব্যবসাসহ নানা ধরনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানই ছিল ব্যবসায়ীদের প্রধান অবলম্বন। প্রাচীনকাল থেকে ধান–চালের পাশাপাশি পটুয়াখালী জেলার অন্যতম প্রধান ব্যবসা ছিল মৎস্য। জেলার সর্বত্র থাকা নদনদী, খালবিল থেকে সংগৃহীত মাছ বিক্রিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করত নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকেরা। এ এলাকায় পাওয়া মাছের প্রায় ৬০ শতাংশই ছিল ইলিশ। পটুয়াখালী থেকে এই ইলিশ খুলনা, ঢাকা, বরিশাল, কুষ্টিয়া ও চট্টগ্রামে পাঠানো হতো।

আর ছিল লবণ। মোগল আমলে ‘নিমক মহল’ নামে পরিচিত ছিল পটুয়াখালী জেলার লোহালিয়া ইউনিয়ন। প্রচুর লবণ উৎপাদন হতো এ এলাকায়। স্থানীয়দের একটি বড় অংশ একসময় লবণশিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু কৃষির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এ শিল্প ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল জলপথ। এ কারণে নৌকা তৈরির ব্যবসাও ছিল উল্লেখযোগ্য। এই নদনদীর সঙ্গেই জুড়ে আছে এ অঞ্চলের বনাঞ্চলের ইতিহাস। এখানকার নদনদীর পলিমাটি জমে তৈরি হওয়া চরাঞ্চলগুলোই পরে বনাঞ্চলে রূপান্তরিত হয়। সময়ের সঙ্গে গাছ কাটাও একটি পেশা হয়ে দাঁড়ায়। কাঠুরেদের মধ্যে যাঁরা সুন্দরবনে গাছ কাটতেন, তাঁদের বলা হতো বাওয়ালি। এই বাওয়ালিদের আনা কাঠের জোগানের ওপর ভিত্তি করে এলাকার নদীর তীরে গড়ে ওঠে অনেক স–মিল। কাঠ সংগ্রহ, সরবরাহ, বিক্রি ইত্যাদি ক্রমে উল্লেখযোগ্য ব্যবসা ও পেশা হিসেবে গড়ে ওঠে।

পটুয়াখালীর তাঁতশিল্পও অনেক পুরোনো। জেলার খেপুপাড়া, কুয়াকাটা, আমতলী, গলাচিপা, বরগুনা, তালতলী প্রভৃতি এলাকায় তাঁতের ব্যাপক প্রচলন ছিল একসময়। এসব অঞ্চলের অধিবাসীরা বংশপরম্পরায় তাঁতশিল্পে জড়িত ছিল। খেপুপাড়া, কুয়াকাটা ও তালতলী অঞ্চলের রাখাইনরা অনেক আগে থেকেই এই শিল্পে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তারা গাছের বাকল থেকে সুতা বের করে কাপড় তৈরি করত। বাংলার ঐতিহ্য যে পাটের শাড়ি, তা তৈরির চল রাখাইনদের মধ্যেও ছিল। পাট ছাড়াও ধঞ্চে ও শণের সুতাও ব্যবহার করত তারা। এ জেলার চর ও বিলে প্রচুর পরিমাণে নল, হোগলাপাতা, রানাপাতা, হেলিপাতা জন্মাত। এগুলো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মাদুর তৈরি করা হতো, যা জেলার বাইরে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হতো।

পটুয়াখালী জেলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের কেন্দ্র বলা যায় বাউফলের কনকদিয়া গ্রামকে। হাঁড়ি, পাতিল, বাসনসহ মাটির বিভিন্ন তৈজসপত্রই রয়েছে এর মূলে। প্রচলিত কুমারপপাড়া ছাড়াও মৃৎশিল্পের একটা বড় জোগান আসে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা কারখানা থেকে। বর্তমানে এই শিল্প আধুনিকতার ছোঁয়ায় নবরূপ পেয়েছে। দেশের বাজার তো বটেই আন্তর্জাতিক বাজারেও এর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রয়েছে কামারদের তৈরি দা, ছুরি, কাঁচি, কোদাল, খন্তা, কুড়াল, লাঙল প্রভৃতি পণ্য।
মোটাদাগে পটুয়াখালী জেলা ও এখানকার বাসিন্দাদের পেশার এই হলো চালচিত্র। এটা স্পষ্ট যে, এই অঞ্চলের মানুষের পেশায় বৈচিত্র্য এবং নানা ধরনের শিল্পের সম্ভাবনা থাকলেও শিল্পের বিকাশ তুলনামূলক কম হয়েছে। সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগিয়ে সেই অর্থে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখানে গড়ে ওঠেনি।

বংশপরম্পরায় নানা বৃত্তি বা পেশা থাকলেও তা বড় পরিসরে বিকশিত হয়নি। মূল কারণ—এখানকার লোকেরা ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল অপটু। প্রভাবশালী ও বুদ্ধিমান লোকেরা ব্যবসা-বাণিজ্যে না আসাও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। যতটুকু যা হতো বা হয়ে আসছে, তা কৃষিপণ্য ঘিরে। বিশেষত ধান, চাল, ডাল, মরিচ, তামাক, পান-সুপারি, সরিষা, লবণ, হলুদ, আদা, রসুন ইত্যাদির বেচাকেনানির্ভর ব্যবসা–বাণিজ্য অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে।

জেলার বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে জেলা সদর, খেপুপাড়া, কালিশুরী, বগা, কালাইয়া প্রভৃতি এলাকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ জেলায় বগা, লেবুখালী, সুবিদখালী ও কালাইয়া ছিল ধান-চাল ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে জেলার দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর নৌকা আসতে দেখা যেত এবং দু-তিন মাস পর সে নৌকাগুলো ধানে ভর্তি হয়ে ফিরে যেত। এসব ধান অন্য জেলার প্রয়োজন মেটাত। ব্রিটিশ আমলে এ এলাকার ধান-চাল কলকাতার চব্বিশ পরগনা, ঢাকা ও ময়মনসিংহে রপ্তানি করা হতো। সুপারি চালান দেওয়া হতো কলকাতা ও চট্টগ্রামে। পান চালান হতো ঢাকায়। কাঠ ও কাঠের তৈরি দ্রব্যাদি পাঠানো হতো কলকাতায়।

পটুয়াখালী জেলা থেকে কৃষিপণ্য ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় মাছ রপ্তানি হতো প্রচুর পরিমাণে। প্রতিবছর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী থেকে বহু নৌকা এসে শুঁটকিবোঝাই করে আবার ফিরে যেত। পটুয়াখালী ও বগা থেকে চিংড়ি রপ্তানি হতো চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে। ইলিশ মাছ খেপুপাড়া, আমতলী ও কালাইয়া থেকে রপ্তানি হতো খুলনা, ঢাকা, যশোর, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম ও বরিশালে। খেপুপাড়া ও তালতলী থেকে শুঁটকি পাঠানো হতো চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও ঢাকায়।

এ জেলায় আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্যের মূল্য নির্ভর করত বাজার ও স্থানের ওপর। কারণ, কৃষিজাত দ্রব্যের মাপ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রকমের ছিল। উদাহরণস্বরূপ পটুয়াখালীতে আগে ধান, চাল ও ডালের সের ১০০ তোলায় ও ৪০ সেরে মণ মাপা হতো। সুবিদখালীতে ১০৫ তোলায়, আর বরগুনায় ১১০ তোলায় সের মাপা হতো। আবার মণের হিসাবেও রকমফের ছিল। অধিকাংশ এলাকায় ৪০ সেরে এক মণ মাপা হলেও বগা, কালাইয়া, গলাচিপা, বামনা ও বেতাগী অঞ্চলে ৩২ সেরে ১ মণ মাপা হতো। ওজনের এই তারতম্যের কারণে পণ্য আমদানি–রপ্তানিতে দামের হেরফের হতো। এখন সারা দেশে কেজির মাপই সবাই অনুসরণ করে। 

শিল্পায়নের দিকে যাত্রা
শৈশব থেকে যে জনপদকে অবহেলিত দেখেছি, সময়ের ব্যবধানে তার অনেক কিছুই বদলে গেছে। এখন এই জনপদ কাঙ্ক্ষিত শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যোগাযোগব্যবস্থায় এসেছে বড় বদল। উন্নয়ন হয়েছে সার্বিক অবকাঠামোতে। ফলে পটুয়াখালীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার হয়েছে। বিশেষত অবকাঠামো উন্নয়নের যে ধারা শুরু হয়েছে, তাতে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সব সংকট মোকাবিলা করেই পটুয়াখালী এগিয়ে যাবে বলে অনায়াসে আশা করা যায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারকে এ জন্য ধন্যবাদ দিতেই হয়। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়োচিত মূল্যায়নের কারণেই অনগ্রসর এই জনপদে লেগেছে প্রাণের ছোঁয়া। রূপকথার গল্পের মতোই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখছে পটুয়াখালীবাসী। এই স্বপ্ন আবার স্থির নয়। সদা বিস্তারপ্রবণ এই স্বপ্নের ডিঙা আজ সম্ভাবনার উজানে এগিয়ে যাচ্ছে।
কী এমন হয়েছে যে, এতটা স্বপ্নবান হয়ে উঠছে এ অঞ্চলের মানুষ? তাহলে একটু চোখ বোলানো যাক। পটুয়াখালী জেলায় বাস্তবায়িত পায়রা সমুদ্রবন্দর, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সাবমেরিন কেব্‌লের ল্যান্ডিং স্টেশন, লেবুখালী সেতু, শেখ হাসিনা সেনানিবাস, বীজ গবেষণা ইনস্টিটিউট, চার লেন মহাসড়কসহ এমন অনেক কিছুর কথা উল্লেখ করা যাবে, যা ঘিরে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরন গেছে বদলে। সত্যিই আজ স্বপ্নপুরির জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সাগরকন্যাখ্যাত পটুয়াখালী বদলে যাচ্ছে। এখানকার মানুষ আজ চেয়ে আছে পদ্মা সেতুর দিকে। স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে যুক্ত করছে বাণিজ্যব্যবস্থা ও জীবনমান উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু রাজধানীর মূল স্রোতোধারার সঙ্গে। এ যেন এক আশ্চর্য আলাদিনের প্রদীপ, যে সব চাওয়ার জাদুকরি সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রাকে ঘিরে জেলার ব্যবসায়ীরা প্রস্তুত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য। বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে পায়রা বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্য সম্ভাবনার যে দরজা উন্মোচিত করেছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মনে, তা প্রাপ্তির সুখানুভূতি ছড়িয়ে দিয়েছে। এই সুখ মানুষকে জাগরণের দিকে নিয়ে যায়, উদ্যমী করে তোলে। কৃষিভিত্তিক এই অঞ্চলের মানুষ আজ ব্যবসা–বাণিজ্যের নানা সম্ভাবনা নিয়ে হিসাব কষছে, প্রস্তুত হচ্ছে। জাগরণের এই যাত্রায় মুছে যাবে পেছনে ফেলে আসা সব গ্লানি, দীনতা আর অনগ্রসরতার ইতিহাস। প্রত্যাশার এই স্বপ্নরেখা স্পর্শ করতে প্রস্তুত হয়ে আছে সাগরকন্যা পটুয়াখালীবাসী। 

ফরহাদ জামান বাদল
সিনিয়র সহসভাপতি, পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্স

তথ্যসূত্র: জেলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ‘পটুয়াখালী জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’, চিরকুটে লেখা

বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত আমদানির ঘোষণা দিতেই ভারতে হু হু করে বাড়ছে চালের দাম

ফেসবুকে ছাত্রলীগ নেতার ‘হুমকি’, রাবিতে ১৫ আগস্টের কনসার্টে যাচ্ছে না আর্টসেল

জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে উচ্চপদস্থ বোর্ড গঠন: আইএসপিআর

পাবনায় প্রবাসীর স্ত্রীকে নিয়ে এএসআই উধাও, থানায় শ্বশুরের জিডি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত