Ajker Patrika

ধর্মনিরপেক্ষতা বাঙালিত্বের উৎসমূল

আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৪, ১২: ৫৮
ধর্মনিরপেক্ষতা বাঙালিত্বের উৎসমূল

বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই সেই ইতিহাসে।

খ্রিষ্টপূর্ব কয়েক শতক আগে কৃষি ও বাণিজ্যকেন্দ্রিক সভ্যতার যে উন্মেষ, তা ক্রমে ধারাবাহিকভাবে বিকশিত হয়েছে বঙ্গভূমিতে, তার বৈচিত্র্য ও অভিন্নতা, উভয়কে অবলম্বন করে। রাঢ়, সমতট, হরিকেল, পুণ্ড্র—যতটা না রাজ্যসীমা, তার চেয়ে বেশি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে।

এই বৈচিত্র্যকে একসূত্রে বেঁধেছে বাংলা ভাষা, যা সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে নিজস্বতা নিয়ে বিকশিত হতে থাকে এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যসূত্র গড়ে তোলে। বাংলায় পাল ও সেন যুগে ছিল বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের প্রাধান্য। সুলতানি ও মোগল আমলে ইসলামের যে বিস্তৃতি, তা বাঙালির বৈচিত্র্যে নতুন মাত্রা বয়ে আনে এবং একই সঙ্গে বৈচিত্র্যের মধ্যে সুর-সংগীত রচনার নানা প্রয়াসও আমরা দেখি। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সংঘাত ও ধর্মীয় পার্থক্য ছাপিয়ে সমন্বয়বাদী এক জীবনচেতনা বাঙালি সমাজে সব সময় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে।

এই ধারার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ দেখা যায় বাংলার বাউল সাধনায়, যা নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আজও বঙ্গসমাজে প্রবহমান। কখনো এমন হয়েছে—সমাজে সংঘাত বড় হয়ে উঠেছে, কিন্তু শেষাবধি সম্প্রীতিরই জয় হয়েছে। অন্তত বাংলার ইতিহাস সে শিক্ষাই আমাদের দেয়। 
বিশ শতকের বাংলায় ধর্মকে কেন্দ্র করে বিভাজন ঔপনিবেশিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রমে সামাজিক বিন্যাসে ফাটল বড় করে তুলেছিল এবং জন্ম দিয়েছিল রক্তাক্ত হানাহানি, যা রায়ট বা দাঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান মিলে যে যৌগ সমাজ, সেখানে বিভাজনরেখা ক্রমে অনতিক্রম্য ও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল, যার পরিণাম আমরা দেখি ১৯৪৬ সালের মধ্য আগস্টে কলকাতা মহানগরজুড়ে সংঘটিত ভয়ংকর দাঙ্গা, দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ে। এর জের ধরে নোয়াখালীর গ্রামাঞ্চলজুড়ে সংঘটিত হয় দাঙ্গা এবং বিহারের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে রায়ট।

এই বিশেষ সময়ে মূলধারার রাজনৈতিক নেতারা বিভাজন অতিক্রম করার প্রয়াস পরিত্যাগ করে ধর্মীয় ফারাককে রাষ্ট্রীয় রূপদানের পক্ষে অবস্থান নিলেন, যার ফলে আমরা দেখি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটল এবং উপমহাদেশ ভাগ করে জন্ম নিল পাকিস্তান ও ভারত। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলার যাত্রা শুরু হয়।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের লড়াইকে বলা যেতে পারে বিভাজনের বিপরীতে সম্প্রীতির লড়াই, বাঙালির অধিকার তথা বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, যা শেষ পর্যন্ত বাঙালির স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পরিণতি পায়। ধর্ম ও জাতিসত্তার মধ্যে যে কোনো বিরোধ নেই, ধর্মবৈচিত্র্য জাতিসত্তায় পায় সহজাত আশ্রয়, এই উপলব্ধি সংঘাত পেরিয়ে সম্প্রীতির বন্ধন সংহত করে, যেকোনো সমাজের জন্য যা বিশেষ গুরুত্ববহ। পাকিস্তানের সূচনাকালে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই কথাগুলো বলেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।

তিনি বহুভাষিক পণ্ডিত ব্যক্তি; যেমন ইসলামি দর্শনে, তেমনি বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে তাঁর জ্ঞান। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আয়োজিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা; যা প্রকৃতি স্বয়ং আমাদের কপালে সেই তিলক এঁকে দিয়েছেন।’

বাংলাদেশের আন্দোলন যখন রাজপথে উত্তাল, তখনই উচ্চারিত হয়েছিল স্লোগান, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ অর্থাৎ পদ্মা কিংবা মেঘনা অথবা সুরমাপারের মানুষ ওই নদীর নামেই পরিচিত হয়, তার ধর্ম-পরিচয় তাতে ক্ষুণ্ন হয় না। ভাষাভিত্তিক নৃতাত্ত্বিক ভৌগোলিক পরিসরে যে জাতিসত্তা, সেখানেও মিলবে নানা ধর্মের মানুষের দেখা। তারা সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিতে গড়ে তুলবে তাদের স্বাধীন জীবনধারা, সে জন্যই বাংলাদেশ, সে জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতা।

ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আমাদের অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্য জরুরি। তা আমরা কতটা রক্ষা করতে পারছি, সেই প্রশ্ন গুরুত্ববহ। ধর্মের আদর্শে বিকৃতি ঘটিয়ে কী নৃশংসতা ঘটানো সম্ভব, সেটা আমরা একাত্তরে দেখেছি। আজও নানাভাবে দেখছি। আর তাই ধর্মের মহৎ আদর্শ অক্ষুণ্ন রাখতেই ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের প্রয়োজন।

লেখক: মফিদুল হক, ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত