Ajker Patrika

কর্ণফুলী নদী ও সমৃদ্ধির গল্প

ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া
আপডেট : ২৭ জুন ২০২১, ১৬: ০০
কর্ণফুলী নদী ও সমৃদ্ধির গল্প

কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে হাজার বছরের স্মৃতিবাহী শহর চট্টগ্রামের গোড়াপত্তন হয়েছে। গড়ে ওঠে নগরসভ্যতা। এ কারণে চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রধান স্মারক হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে আছে কর্ণফুলী। এখানকার শিল্পায়নেরও গোড়াপত্তন কর্ণফুলী নদী ঘিরে। এ নদী ঘিরে পরিকল্পিত উন্নয়ন শুধু চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশেরও অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, যোগাযোগ এবং জীববৈচিত্র্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

১৯৬৪ সাল থেকে কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করার মাধ্যমে মূল নদীকে অনেকটা প্রবাহহীন মানুষ নিয়ন্ত্রিত নদীতে পরিণত করা হয়। যেখানে ইছাখালী, হালদাসহ আরও কয়েকটি ছোট নদী কর্ণফুলীতে না মিশলে এখন হয়তো একে নদী হিসেবেই সংজ্ঞায়িত করা যেত না। কর্ণফুলী নদী শুধু চট্টগ্রামের প্রাণ নয়, দেশের হৃৎপিণ্ড। কর্ণফুলীর অবদানে চট্টগ্রামে বন্দর হয়েছে, শিল্পায়ন হয়েছে। তাই এই নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যাবে।

নামকরণের ইতিহাস

সবচেয়ে প্রচলিত কিংবদন্তি হলো, এই অঞ্চলে এক মগ রাজা ছিলেন। তাঁর সুন্দরী কন্যা গোসল করত পাহাড়ি ছড়ায়। একদিন নদী বেয়ে এক যুব সওদাগর এল। সওদাগরকে দেখে রাজকন্যা বিমোহিত। একে অপরের প্রেমে পড়ে। সওদাগরের বাণিজ্যের বহর গুটিয়ে অন্য বন্দরে যাওয়ার সময় হয়। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সওদাগর চলে যায়। স্মৃতি হিসেবে রাজকন্যাকে  দেয় এক জোড়া কানের ফুল। শুরু হয় রাজকন্যার অপেক্ষা।

রাজকুমারী বিবাহযোগ্য হলে তার বিয়ের ব্যবস্থা করে রাজা। এই খবরে রাজকন্যা বিরহব্যথায় কাতর হয়ে নদীর পাড়ে কাঁদতে থাকে। জীবন থাকতে সওদাগর ছাড়া আর কাউকে মালা দিতে পারবে না রাজকন্যা। সওদাগরও আসছে না। একদিন পাগলপারা রাজকন্যার কানের ফুল হারিয়ে যায় নদীর বুকে। খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে পড়ে কন্যা। রাজকন্যা মনে করে সওদাগর আর আসবে না কোনো দিন। কানের ফুল হারিয়ে যাওয়া যেন তারই লক্ষণ। হতাশ, ক্লান্ত রাজকন্যা আরেক কানের ফুল তীরে খুলে রেখে, গায়ের জড়ানো ওড়না খুলে নদীর বুকে আত্মাহুতি দিয়ে প্রেমের মর্যাদা দেয়। সেই বিয়োগান্ত ঘটনার স্মরণে নদীটির নামকরণ হয়েছে কর্ণফুলী। ‘কর্ণফুলী’র অর্থ কানের দুল বা কানের ফুল। 

­উৎপত্তি, দৈর্ঘ্য ও শাখা নদীগুলো

কর্ণফুলী ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পর্বতমালা পাহাড় থেকে উৎপত্তি হলেও ৩২০ কিলোমিটার নদীটির বিস্তৃতি ভারতে খুবই কম। যে কারণে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর তালিকায় কর্ণফুলীর নাম নেই। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ২৭৫ কিলোমিটার। পার্বত্য চট্টগ্রাম অংশেই কর্ণফুলী নদীর ১৮০ কিলোমিটার পড়েছে। বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধেক এলাকাজুড়ে কর্ণফুলী নদী শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আছে। ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুংলেই জেলার ট্লাবুং (দেমাগ্রী) থানা থেকে বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার ঠেগামুখ এলাকায় প্রবেশ করেছে কর্ণফুলী নদী। নদীটি বরকল, রাঙামাটি, কাপ্তাই, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। কিন্তু এই নদীর উৎসস্থলের অন্যতম চারটি শাখা নদী কাসালং, মাইনি, রীংকং ও চেঙ্গির উৎসও ভারতে। কর্ণফুলী ও এর চারটি শাখা নদীর পানিই মূলত কাপ্তাই হ্রদের পানির মূল উৎস। এদের মিলিত স্রোতোধারাই কর্ণফুলী নদী নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।

কর্ণফুলী নদীর মাছ ও জেলে সম্প্রদায়

কর্ণফুলী নদী ঘিরে যুগ যুগ ধরে জীবিকা চালিয়ে আসছেন স্থানীয় জেলেরা। নদীতে আর আগের মতো মাছের প্রাচুর্য নেই। ফলে জেলেদের এখন দুর্দিন। দূষণসহ নানা কারণে ইতিমধ্যে বিলুপ্তির পথে এ নদীর প্রায় ৩০ প্রজাতি মাছ। একসময় কর্ণফুলীতে মিঠা, মিশ্র (মিঠা ও লবণাক্ত) ও সামুদ্রিক (নোনা) মাছের বিচরণক্ষেত্র ছিল। এই নদীতে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত, এর মধ্যে মিঠাপানির মাছ ৬৬ প্রজাতির, মোহনায় লবণাক্ত পানির মাছ ৫৯ প্রজাতির এবং সামুদ্রিক নোনা পানির মাছ ছিল ১৫ প্রজাতির।

সাংস্কৃতিক অবদান

কর্ণফুলী এ অঞ্চলের সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধ করেছে। ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে...অভাগিনীর দুঃখর কথা কইতাম বন্ধুরে—প্রয়াত শিল্পী শেফালী ঘোষের জনপ্রিয় গানের পঙ্‌ক্তি এটি। কর্ণফুলীকে ঘিরে এমন অসংখ্য সুখ-দুঃখ, হাসিকান্না, বিরহ-মিলনের গান চট্টগ্রামে প্রচলিত রয়েছে। কর্ণফুলীর হাজার বছরের ঐতিহ্য সাম্পানের মাঝিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি গান রচিত হয়েছে। নির্মিত হয়েছে ‘সাম্পানওয়ালা’ নামে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ছায়াছবি। কর্ণফুলীর এ সাম্পানওয়ালারাই ছিলেন একসময় অসংখ্য নারীর স্বপ্নের পুরুষ। যার উদাহরণ ‘কী গান মাঝি হুনাইলা.... কী বাঁশি মাঝি বাজাইলা’, ‘কর্ণফুলীর সাম্পানওয়ালা আঁর মন হরি নিলা’। কিংবা ‘রঙিলা মাঝিরে এই ঘাটদি সাম্পান ভিড়াও’। অথবা ‘চান মুখে মধুর হাসি... দেবাইল্যা বানাইলো-রে মোরে সাম্পানের মাঝি’।

কর্ণফুলী নিয়ে মলয় ঘোষ দস্তিদারের লেখা ‘চোড চোড ঢেউ তুলি/ লুসাই পাহাড়-উত্তুন/ লামিয়ারে যারগৈ কর্ণফুলী’ গানটি সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত। সংগীতজ্ঞ মোহনলাল দাশ কর্ণফুলীর মাঝিকে নিয়ে গান বেঁধেছেন এভাবে, ‘ওরে সাম্পানওয়ালা/ তুই আমারে করলি দিওয়ানা।’

চট্টগ্রাম বন্দর ও অর্থনৈতিক অবদান

কর্ণফুলী নদীর বুকে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ‘চট্টগ্রাম বন্দর’। এ বন্দরের জন্য সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। চট্টগ্রাম বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৩৪ বছর অতিক্রম করলেও তার হাজার বছর আগে প্রাকৃতিকভাবে এ বন্দরের গোড়াপত্তন হয়। ইবনে বতুতা, মার্কো পোলোসহ বিশ্বের নামকরা পরিব্রাজকদের ভ্রমণ কাহিনিতেও তৎকালীন চট্টগ্রাম বন্দরের অস্তিত্ব ফুটে উঠেছে। ঐতিহাসিকদের মতে, চট্টগ্রাম একটি প্রাকৃতিক বন্দর। কর্ণফুলী নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য একে বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্রিটিশরাই প্রথম এ বন্দরকে বিধিবদ্ধ কাঠামোর আওতায় আনে।

ইতিহাসবিদদের মতে, ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে ইংরেজ ও দেশীয় ব্যবসায়ীরা বার্ষিক এক টাকা সালামির বিনিময়ে নিজ ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীতে কাঠের জেটি নির্মাণ করেন। পরে ১৮৬০ সালে প্রথম দুটি অস্থায়ী জেটি নির্মিত হয়। ১৮৭৭-এ চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার গঠিত হয়। ১৮৮৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি মুরিং জেটি নির্মিত হয়। এ বছরের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার কার্যকর হয়। ১৮৯৯-১৯১০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে যুক্তভাবে চারটি স্থায়ী জেটি নির্মাণ করে। ১৯১০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে রেলওয়ে যুক্ত হয়। 

দখলে বিপর্যস্ত

নদীর কালুরঘাট সেতু থেকে মোহনা পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার এলাকায় এ দখলযজ্ঞ চলে আসছে। তবে শাহ আমানত সেতুর পশ্চিম পাশ থেকে বন্দরের ১নং জেটি পর্যন্ত অবৈধ দখলদারদের তৎপরতা ছিল সবচেয়ে বেশি। নদীর জায়গা দখল করে ঘরবাড়ি, বস্তি, দোকান ও কলকারখানা তৈরি করার কারণে অবৈধ দখলদারের দখলে চলে গেছে কর্ণফুলী। প্রতিবছরই দখলদারদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদীর দুই তীরও। ভর জোয়ারের সময় পানি যে জায়গায় গিয়ে স্থির হয়, সেখান থেকে ৫০ মিটার পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর সীমানা।

কর্ণফুলী নদী দূষণের কারণ

নগরীর প্রায় অর্ধকোটি মানুষ ও নদীর পার এবং আশপাশে গড়ে ওঠা প্রায় সাত শ ভারী-ছোট বড় কলকারখানার বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে ফেলার কারণে কর্ণফুলীর বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি নদীর পরিবেশও এখন হুমকির মুখে। কর্ণফুলী দূষণের তালিকায় শীর্ষে আছে চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো বর্জ্য শোধনাগার নেই। তাই প্রতিনিয়ত বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলীতে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে এই চার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না পরিবেশ অধিদপ্তর।

নতুন সম্ভাবনা দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু টানেল

চীনের সাংহাই শহরের আদলে বন্দরনগরীকে ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেলে গড়ে তুলতে নগরের পতেঙ্গা ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কাজ চলছে। এতে নদীর পূর্ব প্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং পশ্চিম প্রান্তে চট্টগ্রাম শহর-বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হবে।

মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশে নদীর ভূমিকা অপরিসীম। সিন্ধু, মেসোপটেমিয়া ও মিসরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল নদীকে কেন্দ্র করেই। পৃথিবীর বিখ্যাত শহরগুলোর মধ্যে টেমস নদীর তীরে লন্ডন, হার্ডসন নদীর তীরে নিউইয়র্ক, যমুনা নদীর তীরে দিল্লি অবস্থিত।বাংলাদেশের পুরোনো সব শহর প্রাকৃতিকভাবে নদীর তীরে গড়ে উঠলেও যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমরা সেভাবে এগিয়ে যেতে পারিনি। বুড়িগঙ্গার নদীর তীরে ঢাকা, কর্ণফুলীর তীরে চট্টগ্রাম, সুরমার তীরে সিলেট, পদ্মার তীরে রাজশাহী, শীতলক্ষ্যার তীরে নারায়ণগঞ্জ এবং রূপসার তীরে খুলনা শহর গড়ে উঠলেও উল্টো দখলে, দূষণে, ভরাটে বিপন্ন নদীর জীবন। শ্রীহীন হয়ে পড়ছে শহর। 
চট্টগ্রামকে আজ এত দূর এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কারও এককভাবে সর্বোচ্চ অবদানের কথা বলতে হয় তাহলে প্রথমেই কর্ণফুলী নদীর নাম আসে। সেই নদী আজ বিপন্ন। কাল বিপন্ন হবে এর দুই তীরের মানুষ। তাই একে বাঁচানো ও রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া
অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও সমন্বয়ক, হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত