Ajker Patrika

দারিদ্র্যকে হারিয়ে উলিপুরের জিয়াউরের বিসিএস জয়ের গল্প

উলিপুর (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১: ৪৪
দারিদ্র্যকে হারিয়ে উলিপুরের জিয়াউরের বিসিএস জয়ের গল্প

‘স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির কোচিং করার অর্থ ছিল না। তাই ঢাকায় গিয়ে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি শুরু করি। সেখানে কাজের চাপে পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারিনি। ওই বছরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মিরপুর বাঙলা কলেজে সুযোগ পেলেও অর্থের অভাবে ভর্তি হওয়া হয়নি।’

দারিদ্র্যক্লিষ্ট জিয়াউর রহমানের জীবন-সংগ্রামের গল্প বেশ দীর্ঘ। তবে তিনি এবার সেই দারিদ্র্য জয় করবেন নিশ্চয়ই। কারণ, জীবনের বড় সফলতা এবার ধরা দিয়েছে তাঁকে। তিনি ৪১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ধরনীবাড়ী ইউনিয়নের বাকারায় মধুপুর দালালীপাড়া গ্রামের ছকিয়ত আলী ও জুলেখা বেগম দম্পতির ছেলে জিয়াউর। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়।

এলাকাবাসী আবুল কাশেম (৮০) বলেন, জিয়াউর রহমানের বাবা ছকিয়ত আলী ধনুষ্টঙ্কার রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মহীন। ৩ শতক জমিতে বসতভিটা তাঁদের। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। শত প্রতিকূলতার মাঝে ২০১২ সালে উপজেলার নতুন অনন্তপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান জিয়াউর রহমান। আলিমে ভর্তি হয়ে অর্থকষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তাঁর। বই কেনার টাকা জোগাড় করতে ঢাকায় যান। সেখানে একটি দোকানে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ি ফেরেন।

স্থানীয় সহিদুল ইসলাম (৪৮) বলেন, কিন্তু বই কেনা আর হয়ে ওঠে না তাঁর। ছোট বোনের বিয়েতে সব টাকা শেষ হয়ে যায়। এরপর অর্থের জন্য মুন্সিগঞ্জের আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে গিয়ে কিছুদিন কাজ করে আবার বাড়ি ফিরে পড়াশোনা শুরু করেন। পাশাপাশি অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। প্রতিকূলতার মাঝে ধরনীবাড়ী লতিফ রাজিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা থেকে ২০১৪ সালে আলিম পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ৪.৬৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

আজ বৃহস্পতিবার জিয়াউর রহমানের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার, সেভাবে প্রস্তুতিও নেই। কিন্তু ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। পরে ২০১৫ সালে ভর্তি হই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। কিন্তু কীভাবে পড়াশোনার খরচ জুটবে সেই নিশ্চয়তা ছিল না। থাকা, খাওয়া ও সামান্য কিছু হাতখরচের টাকার জন্য খণ্ডকালীন কাজ করি।’

জিয়াউর রহমান বলেন, ‘এ ছাড়া টিউশনি, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করে ২০১৯ সালে অনার্সে সিজিপিএ ৩.৪১ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। পরে করোনা মহামারি শুরু হলে আবার আর্থিক সংকটে পড়ি। এর মধ্যেই ২০২০ সালে মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৪৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। শেষে অনেকের সহযোগিতায় ও টাইলস মিস্ত্রির কাজ করে বিসিএসের প্রস্তুতি নিই। অবশেষে কপালে জুটে যায় শিক্ষা ক্যাডার। বিসিএসের রেজাল্ট যেদিন প্রকাশ হয়, সেদিন শিক্ষা ক্যাডারে নিজের রোল নম্বর দেখে চোখে পানি চলে এসেছিল। তবে ইচ্ছা ছিল প্রশাসনে চাকরি করার। কিন্তু যা হয়েছে, তাই নিয়ে অনেক খুশি আছি।’

জিয়াউর রহমানের মা জুলেখা বেগম বলেন, ‘ছেলে সংসার চালিয়ে খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। আমরা তাকে কিছুই দিতে পারি নাই। আজ ছেলের ভালো খবরে আমরা সবাই খুশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছেলে যখন ফোন করে জানাল, মা আমি বিসিএস ক্যাডার হয়েছি, তখন বুঝতে পারিনি বিসিএস ক্যাডার কী জিনিস। পরে বুঝিয়ে বলার পর আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। আমার ছেলের জন্য সবাই দোয়া করবেন। সে যেন একজন ভালো মানুষ হতে পারে।’

জিয়াউর রহমানের শিক্ষক অনন্তপুর দাখিল মাদ্রাসার সাবেক সুপার মাওলানা আকবর আলী বলেন, ‘জিয়া ছোট থেকেই মেধাবী ছিল। এ কারণে আমরা সবাই মিলে তার শিক্ষা উপকরণ, মাদ্রাসায় রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণসহ যাবতীয় ব্যয় বহনে সহযোগিতা করতাম। সে শিক্ষা ক্যাডারে সুযোগ পাওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত।’

স্থানীয় ধরনীবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এরশাদুল হক বলেন, ‘জিয়াউর রহমান খুবই কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। কখনো দিনমজুর, কখনো টাইলস মিস্ত্রির কাজ করে পড়াশোনা করে বিসিএস পাস করেছে। সে আমাদের ইউনিয়নের গর্ব। আমরা তার সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত