Ajker Patrika

কাঠ কাটার খটখট শব্দ আর নেই

ইমাম হাসান মুক্তি, লালপুর (নাটোর)
আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪: ৩৯
কাঠ কাটার খটখট শব্দ আর নেই

কাঠ কাটার খটখট, খটখট শব্দ। যেদিকেই যাই, কানে বাজে একই ধরনের শব্দ। কিছুদিন আগেও নাটোরের লালপুরের গৌরীপুর, পালিদেহা ও আরামবাড়িয়া গ্রামের চিত্র ছিল এটি। ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনায় মুখরিত থাকত গ্রামগুলো, যা পরিচিত মিস্ত্রিপাড়া নামে। গ্রামের ঘরে ঘরে শোনা যেত কাঠের চাকার শব্দ। সেই প্রাণচাঞ্চল্যের গৌরীপুর ও পালিদেহায় এখন শুধুই নিস্তব্ধতা।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্য চাকাশিল্প এখন প্রায় বিলুপ্ত। বাপ-দাদার পেশা চাকা তৈরির কাজ ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন কারিগরেরা। এখানে তৈরি গরু, মহিষ ও ঘোড়ার গাড়িতে ব্যবহৃত কাঠের চাকার কদর ছিল ভৈরব, গাজীপুর, সিলেট ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আজিমনগর ও ঈশ্বরদী স্টেশন থেকে প্রতিদিন ট্রেনে করে এসব চাকা দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যেত।

এ বিষয়ে কারিগর ও ব্যবসায়ীরা বলেন, '৩৫-৪০ বছর আগেও এই এলাকায় চাকা তৈরির দেড় শতাধিক কারাখানা ছিল। এখন কোনো রকম ৮ থেকে ১০ জন এই ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা ধরে রেখেছেন। কাঠসহ চাকা তৈরির বিভিন্ন সামগ্রীর দাম বাড়ায় এবং আগের মতো চাকার চাহিদা না থাকায় বেশির ভাগ চাকা তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।'

ধারণা করা হয়, যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৫০০০ বছর আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় প্রথম চাকা আবিষ্কৃত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় চাকার প্রচলন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দের দিকে মিশরে যান্ত্রিক কাজে চাকার ব্যবহার শুরু হয়। স্কটিশ জন ডানলপ ১৮৮৮ সালে মোটরগাড়িতে ব্যবহারের উপযোগী চাকা আবিষ্কার করেন। এ ছাড়া রেলগাড়ি, বিমান, ওয়াগন, মোটরগাড়ি, গরু-মহিষের গাড়ি, সাইকেল, রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে চাকা ব্যবহৃত হচ্ছে।

এ বিষয়ে গাড়িয়াল মজের উদ্দিন প্রামাণিক (৬৫) বলেন, 'প্রায় ৩৫ বছর ধরে মহিষের গাড়ি চালাচ্ছি। দিনকে দিন চাকার দাম বাড়ছে। এক জোড়া চাকা দুই-তিন বছর চলে। বর্তমানে সময় বাঁচাতে গরু-মহিষের গাড়ির বদলে পিকআপ, নসিমন, করিমন ব্যবহৃত হচ্ছে।'

আজ বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, গৌরীপুর ও পালিদেহা গ্রামের সব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গৌরীপুর মিস্ত্রিপাড়া পদ্মা নদীর করালগ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। এই পেশার বেশির ভাগ হিন্দু শ্রমিক ভারতে চলে গেছেন।

চাকা তৈরি করছেন এক শ্রমিকএখন আরামবাড়িয়ায় মাত্র চারটি কারখানায় মন্দিরপাড়ার বিপদ কুমার (৫৫), বাজারপাড়ার হাশেম মালিথা (৭৫), গোরস্থান এলাকার মাজদার রহমান (৫০) ও সাবুল চেয়ারম্যানপাড়ার ইনু (৫৬) চাকা তৈরি করছেন।

এ বিষয়ে চাকা মিস্ত্রি দিনু (৫৯) বলেন, 'গৌরীপুর গ্রামের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আরামবাড়িয়ার কারখানায় কাজ করে কোনো রকম পেট চলছে।' 

মো. হাবিবুল্লাহ (৬৭) ও গোরিবুল্লাহ (৭২) এ বিষয়ে বলেন, 'পালিদেহা গ্রামের কারখানা বন্ধ হওয়ায় ৬০০ থেকে ৬২৫ টাকায় আরামবাড়িয়ায় কাজ করেন। এক জোড়া চাকা তৈরিতে দুজন শ্রমিকের চার দিন সময় লাগে।'

কারখানার মালিক হাশেম মালিথা (৭৫) বলেন, 'প্রায় ৪০ বছর ধরে এ পেশায় আছি। মানের ভিত্তিতে এক জোড়া চাকা ৭ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এক জোড়া চাকা তৈরিতে বাবলাগাছের কাঠ ও মিস্ত্রি খরচ হয় প্রায় ৬ হাজার টাকা। তৈরি খরচ বেশি ও চাহিদা কম হওয়ায় সামনের দিনে এই ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।'

এ বিষয়ে লালপুরের ঈশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জয় বলেন, 'কারখানা বন্ধ থাকায় চাকা তৈরির শ্রমিকেরা অন্যত্র কাজ করছেন। আশা করছি তাঁদের সহযোগিতার উদ্যোগ নেব।'

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত