Ajker Patrika

মেহেরপুরে ভেজাল বীজে গমচাষিদের মাথায় হাত

  • বিএডিসির গমবীজ আবাদ করে ঠকেছেন কৃষি বিভাগ থেকে প্রণোদনা পাওয়া ১১ হাজার কৃষক।
  • মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে গম সংগ্রহ বিএডিসির।
  • বিএডিসির বীজে প্রতিবছর বাড়ছে মিশ্রণের পরিমাণ। এতে জাতের পরিবর্তন ঘটার আশঙ্কা।
রাশেদুজ্জামান, মেহেরপুর 
বিএডিসির উৎপাদিত বীজ ব্যবহারে প্রতিবছর খেতে বাড়ছে মিশ্রণের পরিমাণ। গমখেত থেকে ভিন্ন জাতের চারা তুলছেন দুই চাষি। সম্প্রতি মেহেরপুর সদর উপজেলার হরিরামপুর গ্রামে। ছবি: আজকের পত্রিকা
বিএডিসির উৎপাদিত বীজ ব্যবহারে প্রতিবছর খেতে বাড়ছে মিশ্রণের পরিমাণ। গমখেত থেকে ভিন্ন জাতের চারা তুলছেন দুই চাষি। সম্প্রতি মেহেরপুর সদর উপজেলার হরিরামপুর গ্রামে। ছবি: আজকের পত্রিকা

মেহেরপুর সদর উপজেলার হরিরামপুর গ্রামের কৃষক কলিম উদ্দীন। চলতি বছর তিনি কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া বারি-৩০ জাতের গম লাগিয়েছেন এক বিঘা জমিতে। কিন্তু যবের দুটিসহ পাঁচ প্রকারের জাতে ছেয়ে গেছে তাঁর পুরো খেত। এখন উৎপাদিত এ গম থেকে কীভাবে বীজ উৎপাদন করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষি কলিম উদ্দীন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সরবরাহ করা বীজে ফলন কয়েক গুণ কমেছে বলে দাবি তাঁর।

শুধু কলিম উদ্দীন নন, বিএডিসির উৎপাদিত গমবীজে আবাদ করে ঠকেছেন কৃষি বিভাগ থেকে প্রণোদনা পাওয়া জেলার ১১ হাজার কৃষক। বারি-৩০, ৩২, ৩৩ ও বিডব্লিউএমআরআই-২ বীজে ছড়িয়েছে মিশ্রণ। মাঠ ঘুরে দেখা গেছে চাষিদের দুরবস্থার চিত্র।

ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা বলছেন, বিএডিসির উৎপাদিত গমবীজে তাঁদের সর্বনাশ হয়েছে। মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে গম সংগ্রহ করে বিএডিসি। সেখান থেকে বীজে মিশ্রণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ বিএডিসি কর্তৃপক্ষ।

চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএডিসির উৎপাদিত বীজে আবাদ করে প্রতিবছর বাড়ছে মিশ্রণের পরিমাণ। গত বছর ২০ থেকে ২৫ ভাগ মিশ্রণ থাকলেও এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ ভাগে। এভাবে চলতে থাকলে জাতের পরিবর্তন ঘটার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএডিসির বীজে অধিক মিশ্রণ এমনকি জাতের স্বকীয়তা হারানোর অভিযোগে ২০২৪ সালে ঢাকা অফিস থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পায় মেহেরপুর বিএডিসি কর্তৃপক্ষ। তাতে বলা হয়, প্রত্যয়িত বারি গম-৩২ বীজে ১০ ভাগ মিশ্রণ রয়েছে, বারি গম-৩৩-এ যথেষ্ট মিশ্রণ রয়েছে আর বিডব্লিউএমআরআই-২ জাতটি সঠিক নয়। এটি হবে বারি গম-৩০। অর্থাৎ জাতের পরিবর্তন ঘটেছে মাঠপর্যায়ে।

সদর উপজেলার বেলতলাপাড়া গ্রামের বিএডিসির চুক্তিবদ্ধ চাষি জাহিদুল ইসলাম বলেন, বিএডিসির কর্মকর্তাদের জেলার ৫ হাজার ২০০ জন চুক্তিবদ্ধ চাষির কাছ থেকে গম ও ধান সংগ্রহ করার কথা। সেটি না করে মেহেরপুর বিএডিসিতে ১০-১২ জনের ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে ওই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে গম ও ধান সংগ্রহ করে বীজ উৎপাদন করা হয়। সদর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের বেল্টু, জিয়া; গহরপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম; বারাদি গ্রামের মোমিনুল ইসলাম; রাজনগর গ্রামের আরমান আলী; ষোলমারি গ্রামের আক্তার মেম্বার; মুজিবনগর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের আলমাছ হোসেন শিলু; দারিয়াপুর গ্রামের আলতাব হোসেন ও সোনাপুর গ্রামের মন্টু এই সিন্ডিকেটের সদস্য বলে দাবি বিএডিসির চুক্তিবদ্ধ চাষি জাহিদুলের।

একই গ্রামের বিএডিসির চুক্তিবদ্ধ চাষি জহির উদ্দীন বলেন, ‘বিএডিসির কর্মকর্তারা চুক্তিবদ্ধ চাষিদের কাছ থেকে ধান ও গম সংগ্রহ না করে সুযোগ দেন ব্যবসায়ীদের। চাষিরা দিতে গেলে ৫০ কেজির বস্তা থেকে কেটে নেওয়া হয় এক থেকে দেড় কেজি করে। বস্তা নিতে গেলে দিতে হয় ১০০-২০০ টাকা। এ ছাড়া নানা অজুহাতে চাষিদের রিজেক্ট করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ব্যবসায়ীদের বেলায় এসবের কিছুই দেখা হয় না।’

বিএডিসির একটি সূত্র বলছে, দুর্নীতির অভিযোগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুর থেকে ঝিনাইদহের সাধুহাটির বিএডিসিতে বদলি করা হয় প্রসেসিং বিভাগের উপপরিচালক শামীম হায়দারকে। কিন্তু সেখানে না গিয়ে মেহেরপুর বিএডিসিতে অফিস করছেন তিনি। কৃষকদের বস্তাপ্রতি যে পরিমাণ ধান ও গম কেটে নেওয়া হয়, সেখান থেকে বছরে কমিশন-বাণিজ্য হয় প্রায় ৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রতি বস্তায় যে টাকা নেওয়া হয়, সেখান থেকে কয়েক কোটি টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। আর এই টাকা ভাগ হয় বিএডিসির দুই উপপরিচালক শামীম হায়দার ও এনামুল হক, প্রসেসিং বিভাগের সহকারী পরিচালক রেজওয়ানুল ইসলাম, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা রাসেল আহাম্মেদসহ ১২ কর্মকর্তার মধ্যে।

প্রসেসিং বিভাগের সহকারী পরিচালক রেজওয়ানুল ইসলাম কয়েক মাস আগে বদলি হন গাংনীর চিৎলা পাটবীজ খামারে। সেখানে কয়েক মাস অফিস করে তদবির চালান ঢাকা অফিসে। বদলি বাতিল করে আবারও ফিরে আসেন মেহেরপুরের প্রসেসিং বিভাগে। সম্প্রতি তাঁকে আবার বদলি করা হয়েছে আমঝুপি ডাল ও তেলের বীজের খামারে। জানা গেছে, সেখান থেকে প্রসেসিং বিভাগে আসার জন্য ঢাকা অফিসে আবারও লবিং শুরু করেছেন তিনি।

বিএডিসির প্রসেসিং বিভাগের সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা রাসেল আহাম্মেদ বলেন, মেহেরপুর বিএডিসিতে কেউ আসতে চাইলে ঢাকা অফিসকে গুনতে হয় ৫-৬ লাখ টাকা। সেই টাকা তুলতে গিয়ে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এখানকার কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে মেহেরপুর বিএডিসির প্রসেসিং বিভাগের উপপরিচালক শামীম হায়দার গম ও ধান সংগ্রহের বিষয়ে সব দায় চাপান কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার্সের অফিসের ওপর। আর কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার্সের উপপরিচালক এনামুল হক বলেন, ‘ঢাকা অফিস থেকে কথা বলা নিষেধ।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত