Ajker Patrika

গুম হওয়া মানুষেরা জীবিত নাকি মৃত জানতে চান স্বজনেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
গুম হওয়া মানুষেরা জীবিত নাকি মৃত জানতে চান স্বজনেরা

শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরে যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাঁরা জীবিত নাকি মৃত সেই তথ্য অবিলম্বে জানতে চায় তাঁদের স্বজনেরা। এ ছাড়া গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেছেন তাঁরা। 

আজ শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের প্ল্যাটফর্ম ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এই দাবি জানানো হয়। 

দুপুর ১টা পর্যন্ত চলা মানববন্ধনে অংশ নেন মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, শিল্পী ও নিখোঁজদের ছবি হাতে স্বজনেরা। 

প্ল্যাটফর্মটির সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, ‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। অবশিষ্ট অপশক্তিগুলো এখনো দেশে অবস্থান করছে। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্যগুলো এখনো পরিবারের কাছে আসছে না।’ 

২০১৩ সালে নিখোঁজ হওয়া আব্দুল কাদের মাসুমের মা আয়েশা আলী বলেন, ‘গুমের সরকার পালিয়ে চলে গেছে। তাঁরা আমার ছেলেকে গুম করেছে। দেশ আবার স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমার ছেলে এখনো ঘরে ফেরেনি। আমার ছেলে মাসুমের জন্য কি দেশ স্বাধীন হয়নি?’ —কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। 

নিখোঁজ খালেদ হাসানের স্ত্রী সৈয়দা সাম্মী সুলতানা বলেন, ‘২০১৩ সালে আমার স্বামীকে গুম করা হয়। এত দিনেও আমার স্বামীকে খুঁজে পাই না। ১১ বছর হয়েছে আর এভাবে দাঁড়াতে চাই না।’ 

২০১৯ সালের ১৯ জুন শাহ আলী মাজার এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ইসমাইল হোসেন বাতেন। গত পাঁচ বছর ধরে বাবার ছবি হাতে নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে নিখোঁজ বাতেনের মেয়ে কিশোরী আনিশা ইসলাম। আনিশা বলে, ‘বলা হচ্ছে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন দেশে আমার বাবাকে ফেরত চাই। আমার ছোট ভাই প্রতি রাত অপেক্ষা করত, বাবা কখন ফিরবে। আমি আমার ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই, আমার বাবার সঙ্গে কী হয়েছে।’ 

২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক সংগঠন ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা। ঢাকার কল্যাণপুর থেকে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। পাঁচ বছরের বেশি সময় আটকে রাখা হয়েছিল গোপন বন্দিশালায়, যা ‘আয়না ঘর’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাকে চট্টগ্রামের একটি সড়কের ধারে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়। শহীদ মিনারে মাইকেল চাকমা বলেন, ‘আমাকে ৫ বছর তিন মাস গুম করে রাখা হয়েছিল। আলো-বাতাসহীন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। এই কষ্টটা আমি জানি। দিনের পর দিন সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়েছে। এটা শুধু বেঁচে থাকা নয়, অনেকটা মৃত্যুর মতো। এটা বুঝি, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার কত কষ্টে দিন কাটায়।’ 

‘আয়না ঘর’ তৈরি করার পেছনের কারিগর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানসহ এতে জড়িতদের বিচার দাবি করেন স্বজনেরা। 

মাইকেল চাকমা বলেন, ‘হাসিনাসহ তাঁর নির্দেশে যারা গুম, খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল তাঁদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে, অতি সত্তর তাঁদের ন্যায়বিচার করা হোক। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে এই অন্যায়, অপরাধ যারা করেছে তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যেন আমার মতো আর কোনো নাগরিক, মানুষ গুম হয়ে মাসের পর মাস মৃত্যুপুরিতে দিন কাটাতে না হয়।’

মাইকেল চাকমা বলেন, যেই তদন্ত কমিশন হয়েছে তাঁদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। যারা গুম হয়েছে এখনো অনেকের সন্ধান নেই। যদি খুন করা হয়, মেরে ফেলা হয় তাও জানাতে হবে। 

মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমাদের এখন অতীতকে স্মরণ করে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। কল্পনাও করা যাবে না, গত সরকারের অধীনে পুলিশ কতটা অমানবিক ছিল। আমি ২৩ ঘণ্টা গুম ছিলাম, দুই মাস জেলে ছিলাম। সেময় এমন অনেক ঘটনা দেখেছি, সেগুলো লিখলে বিরাট এক বই হয়ে যাবে। গুম নিয়ে মায়ের ডাকসহ অনেকেই তালিকা তৈরি করেছে, তার ৯৫ শতাংশের মতো সঠিক, শতভাগ সঠিক করতে পারবেন কি না জানি না।’ 

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি কমরেড সাইফুল হক বলেন, ‘আয়নাঘরে যারা ছিলেন এখনো পর্যন্ত অনেকে ফিরে আসেন নাই। আয়নাঘরে এখনো অনেকে বন্দী আছেন কি না। তাঁরা কোথায় গেছেন আমরা জানি না। আমরা সমস্ত তথ্য দেখতে চাই। শুধু ঢাকাতে না সারা দেশব্যাপী আয়না ঘর ছড়িয়ে আছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আয়না ঘর সম্পর্কে সরকারের পরিষ্কার ব্যাখ্যার দাবি করছি এবং আয়না ঘর সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি করছি।’ 

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘আইনে গুম শব্দ নেই বলে বিচার করা যাবে না, এটা সঠিক নয়। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের মুখ বন্ধ ছিল। আদালত এই ব্যাপারে নীরবতা পালন করেছে। কোনো হস্তক্ষেপ আমরা দেখিনি।’ 

এদিকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে ওয়েব সাইটে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। তাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ৭০৯ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৫৫ জন ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি। অধিকার মনে করে প্রকৃত গুমের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কারণ কর্তৃত্ববাদী সরকারের সৃষ্ট ভয়ের পরিবেশের কারণে তাঁরা মুখ খোলেননি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত