Ajker Patrika

চট্টগ্রামের পরিবহন খাত: নিজস্ব গাড়ি না থেকেও সমিতির শীর্ষ নেতা তারা

সোহেল মারমা, চট্টগ্রাম
আপডেট : ০৮ মে ২০২৪, ১১: ৪৪
চট্টগ্রামের পরিবহন খাত: নিজস্ব গাড়ি না থেকেও সমিতির শীর্ষ নেতা তারা

চট্টগ্রামে পরিবহন মালিক সমিতিগুলোর শীর্ষ পদে যাঁরা আছেন, তাঁদের একটি বড় অংশের নিজস্ব গাড়ি নেই। যদিও শহরে পরিবহন বাণিজ্য থেকে চাঁদাবাজি—সব এই নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। সাধারণ মালিকদের অভিযোগ, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এই প্রভাবশালী নেতারা কোম্পানি খোলেন। এরপর অন্যদের গাড়ি ওই কোম্পানির অধীনে আনেন। বিনিময়ে তাঁরা চাঁদা আদায় করেন। বিআরটিএ ও প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে রুট পারমিট, নতুন গাড়ি নামানোর পুরো ব্যবস্থাটি এই নেতারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

বাস, থ্রি-হুইলার, মিনিবাসসহ চট্টগ্রামে এমন মালিক সমিতির সংগঠনের সংখ্যা ১৭ থেকে ১৮। এগুলোর মধ্যে আছে চট্টগ্রাম মহানগরী মেট্রো সার্ভিস, চট্টলা পরিবহন, মেট্রো লিংক, লিটন মোটরস প্রাইভেট লিমিটেড, লুসাই পরিবহন, যাত্রীসেবা, সিটি সার্ভিস, চট্টগ্রাম মহানগরী বাস-মিনিবাস-হিউম্যান হলার মালিক সমিতি। এই সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপ নামের একটি সংগঠন। আর আন্তজেলায় পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ।

নিয়ন্ত্রণ হাজারী পরিবারের
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপ মূলত নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন হাজারী। তিনি এই সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা। চট্টগ্রাম জেলা অটোটেম্পো ও অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নসহ আরও দুটি সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। অথচ তিনি কোনো গাড়ির মালিক  নন। স্ত্রী হালিমা হাজারী লিপিকেও বানিয়েছেন পরিবহন নেতা। তিনি চট্টগ্রাম বাস-মিনিবাস-হিউম্যান হলার মালিক সমিতি ও চট্টগ্রাম মহানগর বাস-মিনিবাস-হিউম্যান হলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটির (আরটিসি) সদস্য। পুলিশ, বিআরটিএ, রাজনৈতিক ক্যাডার ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে শহরের রাস্তায় রুট পারমিট, নতুন গাড়ি নামানো থেকে শুরু করে গণপরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে এই দম্পতির বিরুদ্ধে। এ দুজনই ২০১৯ সালে অবৈধভাবে ৩ কোটি ২ লাখ ৩২ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হন।

আমজাদ হোসেন হাজারী হলেন মেট্রো সার্ভিস নামের পরিবহন কোম্পানির মালিক। নিজেকে চট্টগ্রাম লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন আমজাদ।

পরিবহন মালিকদের অভিযোগ, কোনো গাড়ির মালিক না হয়েও সংগঠনগুলোর ব্যানারে নগরের নিউমার্কেট থেকে হালিশহর-অলংকার-সিটি গেট, কালুরঘাট থেকে নিউমার্কেট, ইপিজেড, চকবাজার থেকে বড়পুল পর্যন্ত চলাচলকারী বাস, মিনিবাস ও হিউম্যান হলার গাড়ির বর্তমানে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করছেন আমজাদ হাজারী। তিনি এসব রুটে গাড়ির মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন। এসব কাজে জনবলও নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। আমজাদ হোসেন হাজারী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার আগে ১২টি বাস ছিল। কিন্তু লসে পড়ে ১০টি বিক্রি করে দিয়েছি। এখন চট্টমেট্রো-ব-১১-১০৯২ ও চট্টমেট্রো-ব-১১-১৩১৬ নম্বরের দুটি বাস রয়েছে। সময়ের কারণে বাস রক্ষণাবেক্ষণ না করায় নষ্ট হয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমজাদ হাজারীর বর্তমানে কোনো বাস নেই। যে দুটি বাসের কথা বলেছেন, এর নিবন্ধন মূলত তাঁর স্ত্রী হালিমা হাজারীর নামে। বহু বছর ধরে নষ্ট অবস্থায় পড়ে থাকায় স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। নগরের কালুরঘাটে রুবেল নামের এক গ্যারেজ মালিক বাস দুটি স্ক্র্যাপ হিসেবে কিনে নেন। রুবেল বলেন, গাড়ি দুটির নিবন্ধন নম্বরসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তিনি কিনে নিয়েছেন।

সভাপতির নেই গাড়ি
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল। তবে সংগঠনের সূত্র জানায়, সাধারণ মালিকদের গাড়ি বেলায়েত নিজের গাড়ি হিসেবে দেখিয়ে আসছেন। তাঁর নিজস্ব কোনো গাড়ি নেই। আমজাদ হাজারীর মেট্রো সার্ভিস নামে পরিবহন কোম্পানির ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বে থাকা বেলায়েত বর্তমানে দাপুটে পরিবহন নেতা। মেট্রো প্রভাতি ও সোনার বাংলা নামে দুটি কাউন্টারভিত্তিক টিকিটিং বাস সার্ভিস তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন। বেলায়েত হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার নিজস্ব গাড়ি আছে। আমার যদি কোনো গাড়ি না থাকত, তাহলে আমি কীভাবে মালিক সমিতির নেতা হব! চট্টগ্রামে ৮ থেকে ১০ জন নেতা রয়েছেন, যাঁদের কোনো গাড়ি নেই বলে আমি জানি।’

আরেক সংগঠন লুসাই পরিবহনের নিয়ন্ত্রণে বাস-মিনিবাস ও হিউম্যান হলার ছয়টি রুটে চলাচল করে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই সংগঠনের সভাপতি নিপু এবং সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সমু। তাঁদেরও গাড়ি নেই। তবে শহীদুল ইসলাম সমু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার আগে সাতটি বাস ছিল। এখন দুটি আছে। এগুলো ৪ নম্বর রুটে চলছে। নিপুর দুটি বাস ৭ ও ১১ নম্বর রুটে চলে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মালিকদের কাছে গাড়ি থাকবে কীভাবে? শহরে বৈধ ও অবৈধ যতগুলো ছোট গাড়ি চলছে, তাতে বাসমালিকেরা লসে পড়ে বিক্রি করছেন।’

এ ছাড়া চট্টলা পরিবহনের সহসভাপতি রায়হান ও সাধারণ সম্পাদক মিজানের কোনো গাড়ি নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রায়হান ও মিজানের মতো আরও ছয়-সাতজন নেতা রয়েছেন, যাঁদের নিজস্ব কোনো গাড়ি নেই। তবে পরিবহন ব্যবসা তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী মঞ্জু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মালিক সমিতির নেতা হয়েও অনেকের গাড়ি নেই—এটা সত্য; কিন্তু আমি এ ব্যাপারে বলতে পারব না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক উজ্জ্বল বিশ্বাস বলেন, প্রকৃত গাড়ির মালিক না হয়ে মালিক সমিতির ব্যানারে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছেন। সাধারণ মালিকেরা হারাচ্ছেন মূলধন। সমিতির ব্যানারে গাড়িতে স্টিকার সাঁটিয়ে ওয়েবিলের নামে দৈনিক ও মাসিক চাঁদাবাজিতে সড়ক পরিবহনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

বিবাহিতদের পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশ না করার প্রস্তাব

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বিমানবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা

সারজিসের সামনেই বগুড়ায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত