Ajker Patrika

সুকুমার রায় সম্পর্কে

সৈকত দে
সুকুমার রায় সম্পর্কে


উপেন্দ্রকিশোরের মানসবিশ্ব গড়ে ওঠার পশ্চাৎপট মনে রাখতে হবে আমাদের সুকুমার রায়ের কথা ভাবতে গেলে। তাঁর ঠাকুরদা লোকনাথ রায় ছিলেন তন্ত্রসাধক। রীতিমতো মানুষের মাথার খুলির মালা সহযোগে তিনি তন্ত্র সাধনা করতেন। লোকনাথের বাবা রামকান্ত খোল বাজিয়ে খোলা গলায় কীর্তন গাইতেন আর এত জোরে খোলে চাঁটি মারতেন যে ভালোভাবে আচ্ছাদিত খোলও অনেক সময় ফেটে যেত। তিনি পুত্রের এসব সাধনা পছন্দ করতেন না। একদিন সব সাধনার জিনিস ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দেন। সেই শোকে পুত্র লোকনাথ মাত্র ৩২ বছরে ইহধাম ত্যাগ করেন আর তখন বউ কৃষ্ণমণি সন্তানসম্ভবা। কৃষ্ণমণির পুত্র কালীনাথ রায় হলেন উপেন্দ্রকিশোরের বাবা।

কালীনাথ তিন ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন—আরবি, ফারসি আর সংস্কৃত। সুকণ্ঠ স্তবের জন্য ভক্ত শ্রোতামণ্ডলীতে তিনি ‘শ্যামসুন্দর’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। জন্মের সময় উপেন্দ্রকিশোরের নাম ছিল কামদারঞ্জন এবং দূরসম্পর্কের এক কাকা হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে পোষ্যপুত্র হিসেবে নিয়ে আসেন ও নাম পাল্টে দেন। উপেন্দ্রকিশোর আর রবীন্দ্রনাথের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। উপেন্দ্রকিশোরের বিয়ে হয় ১৮৮৫ সালের ১৫ জুন। ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর সুকুমার জন্মালেন ৷ ১৮৯২ সালের দিকে সুকুমার মসূয়া গ্রাম আর মধুপুরে হাওয়াবদলে এসেছিলেন সপরিবার। ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগ মহামারি দেখা দিলে রায়চৌধুরী পরিবার মসূয়ায় চলে আসেন কিছুদিনের জন্য। উপেন্দ্রপুত্র সুকুমার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহের ‘যুবক বন্ধু’। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর উপেন্দ্রকিশোর চলে গেলেন। সেদিন ভোরবেলা জানালার পাশে একটা পাখি গান গেয়েছিল আর চারপাশে দণ্ডায়মান বিপন্ন আত্মীয়দের তিনি বললেন, ‘পাখি কী বলে গেল জানো? সে বললে, যাও চিরদিনের পথে এবার শান্তিতে যাও।’ স্ত্রী বললেন, ‘চোখ বুঝলেই কী সুন্দর আলো দেখি, ভগবান কত দয়া করে আমাকে পরকালের পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন।’

সুকুমার রায় বিদেশ থেকে ফেরার পর তাঁর বাবা-মায়ের পাত্রী খোঁজার সময় তিনি যে মন্তব্যটি করেন, তাতে তাঁর ধাতটা বোঝা যায়, ‘সুন্দরটুন্দর বুঝি না, দেখতে খারাপ না হলেই হলো। গান গাইতে পারলে ভালো হয়। আর ঠাট্টাতামাশা করলে যেন বুঝিয়ে বলতে না হয়।’ অর্থাৎ আজকালকার ভাষায় উইট আর সেন্স অব হিউমারসমৃদ্ধ জীবনসঙ্গীর অনুসন্ধানে ছিলেন সুকুমার রায়। সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা রায়, সাধক কালীনারায়ণ গুপ্তের নাতনি। কালীনারায়ণ অসংখ্য সাধনসংগীতের প্রণেতা। সুপ্রভা সুন্দর কণ্ঠের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্রী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গেয়েছেনও একাধিকবার। ১৯১৩ সালে সুকুমার সুপ্রভার বিয়ে হয়।

বাংলা ১৩২৭ সালের মাঘ মাসে কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন সুকুমার এবং ১৩২৮ সালের বৈশাখের ঊনবিংশ দিবসে জন্মালেন সত্যজিৎ। ১৯২১ সালে যে কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন সে কালান্তক ব্যাধি আর তাঁকে বাঁচতে দিল না। ১৯২৩ সালের ২৯ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ সুকুমারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আনন্দের, স্বস্তির, সুখের, পূর্ণতার গান শুনতে চেয়েছিলেন সুকুমার। রবীন্দ্রনাথ বন্ধুর অনুরোধে একাধিক গান গেয়েছিলেন ৷ একটা গান হচ্ছে–‘দুঃখ এ নহে সুখ নহে গো, গভীর শান্তি এ যে।’ ১০ সেপ্টেম্বর সকাল সোয়া আটে চলে গেলেন সুকুমার। কলকাতায় সেদিন ভূমিকম্প ঘটার তথ্য নথিবদ্ধ আছে। মাধুরীলতা রায়ের স্মৃতিকথায় জানা যাচ্ছে, তাঁর শেষ কথা, ‘এইবার বেরিয়ে পড়ি।’ ঠিক ১০০ বছর আগে, ১৯২৩ সালে প্রয়াত হয়েছিলেন সুকুমার রায় মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। এই ছোট নিবন্ধে তাঁর সম্পর্কেই দু-একটা কথা বলা হবে।


৯ বছর বয়সে, ১৮৯৬ সালে অর্থাৎ বাংলা ১৩০৩ সালের ২ জ্যৈষ্ঠ বালকদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকা ‘মুকুল’-এ প্রকাশ পেল সুকুমার রায়ের প্রথম রচনা। এটি ‘নদী’ নামে একটি কবিতা। অল্প বয়সে মুকুল পত্রিকাতে তাঁর একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯০৪ সালের নভেম্বর সংখ্যা ‘বয়েজ ওন পেপার’-এর আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় অল এইজেস ডিভিশনের ‘পেটস’ বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার পান। পরের বছর ‘রামধনবধ’ রচনা করেন বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যদিও পরবর্তীকালে পাণ্ডুলিপি লুপ্ত হয়ে গেছে ৷ ১৯০৬ সালে তিনি ফিজিকস আর কেমিস্ট্রিতে অনার্সসহ বিএসএসি পাস করেন। এবং তাঁর তোলা রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি পরের সময়ে ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ তরুণ সুকুমারকে স্নেহ করতেন। ১৩১৮ সালে, ২৪-২৬ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ৫০তম জন্মদিন উদ্‌যাপনের জন্য সুকুমার শান্তিনিকেতনে যান ৷ সেখানে তাঁর রচিত ‘অদ্ভুত রামায়ণ?’ গান হয়। সেখানে ছিল—‘ওরে ভাই তোরে তাই কানে কানে কই রে, ঐ আসে, ঐ আসে, ঐ ঐ ঐ রে’। এই লাইন শুনে আশ্রমিকরা তাঁর নাম দেয়, ‘ঐ আসে?’ এই বছরের অক্টোবরে বোম্বে থেকে ‘এস এস অ্যারাবিয়া’ জাহাজে বিদেশ পাড়ি দেন ৷ প্যারিস, ক্যালে, ডোভার হয়ে লন্ডনে এলেন ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৫ নাগাদ। একদিন বিশ্রাম নিয়ে ২৫ তারিখ ‘লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল স্কুল অব ফটোগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি’-তে ভর্তি হলেন। পড়ার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজ থেমে থাকছিল না। বন্ধ ছিল না অগ্রজ বন্ধু রবীন্দ্রনাথের প্রতি স্ব-আরোপিত দায়িত্ব। ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ লন্ডন এলেন ১৬ জুন। ১৯ জুন উইলিয়াম উইনস্ট্যানলি পিয়ার্সনের বাড়ি বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে নিবন্ধ পড়েন ৷ ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে উপাদান সংগ্রহ করেন সুকুমার। শ্রোতা হিসেবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, রথেনস্টাইন সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্র কবিতার অনুবাদ পাঠ করেন এই সময়ে। উপস্থিত প্রকাশক, সম্পাদকেরা খুশি হন এই অনুবাদে। বলা যেতে পারে, উইজডম অব দ্য ইস্ট সিরিজের সম্পাদকের কথা। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির বছর তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি, লন্ডনে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা জানা যায়। প্রতি রোববার উপাসনা হতো এখানে। অর্থাৎ সুকুমার রায় প্রবাসে থাকাকালেও নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে বিচ্যুত হন নাই। ১৯১৩ সালের ১৫ জুন রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণে গেলে সন্দেশ প্রথম সংখ্যা পড়ে রবীন্দ্রনাথ আনন্দ পাওয়ার কথা জানান। এই বছরের ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ সুপ্রভা দেবীকে বিয়ে করেন। পান্তীর মাঠের কাছে ‘রাজমন্দির’-এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ আসেন। ১৯১৮ সালের রবীন্দ্র জন্মদিনে গান গেয়ে শোনান সুপ্রভা।

বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিশীলতা সুকুমার রায়ের সকল লেখার অভিনিবেশের কেন্দ্র। খেয়ালখুশি বা ননসেন্স লেখাতেও তিনি কখনো কুসংস্কার প্রশ্রয় দেন নাই। সন্দেশ সম্পাদক হিসেবে লেখা শিক্ষাপ্রচারমূলক নিবন্ধ থেকে বিজ্ঞানী সুকুমারকে আমরা চিনে উঠতে পারি। বিজ্ঞান দুনিয়া, যন্ত্রসভ্যতার নিত্যনতুন আবিষ্কারের ইতিহাস কিশোরদের উপযোগী ভাষায় পরিবেশন করেছেন তিনি। পরিবেশনের গুণে কেবল গবেষক নয়, সাধারণ কিশোর পাঠকদের কাছেও লেখাগুলি অমূল্য। বাবা উপেন্দ্রকিশোর বাংলা মুদ্রণ ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি, শিশুসাহিত্যের নিরলস ধারার কথা যদি উহ্য থাকে তবু। পুত্র সুকুমার, জানিয়েছি একটু মাত্র, মুদ্রণের নানা স্তরের অনুপুঙ্খ পাঠ নিতে গেলেন লন্ডনে। এবং, সে দেশেও নিজের প্রজ্ঞায় ও শ্রমে যথেষ্ট মনোযোগ ও সম্মান পেলেন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে প্রয়াত না হলে, আমরা আরও কত-কী যে পেতাম, বাংলা সাহিত্য আরও কত রং পেত, এসব আলাপ অনুশোচনাই বাড়াবে। তাই বলি, যা পেয়েছি, তা পাঠ ও চর্চায় যদি আমরা এই অসময়ে নিজের মন রঙিন সার্থক করতে পারি, তবেই সুকুমার রায়ের জীবনসাধনা নতুন মাত্রা পাবে।

সূত্র: এই রচনা সিদ্ধার্থ ঘোষের সুকুমার রায়সংক্রান্ত একাধিক রচনার কাছে ঋণী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চস্থ করল স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।

মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।

হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।

মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।

মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।

নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।

বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল যেন তাঁর দীর্ঘ কোনো বাক্যের সমাপ্তি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।

১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।

তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।

ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।

তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।

২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।

চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।

তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত