Ajker Patrika

আমার বন্ধু রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

ইসহাক খান
আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২২, ১০: ১৯
আমার বন্ধু রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

আগামীকাল ১৬ অক্টোবর, আমার প্রিয়তম বন্ধু রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জন্মদিন। জন্মদিনে বন্ধু তোকে আকাশের ঠিকানায় শুভেচ্ছা পাঠালাম।

তোর মৃত্যুর এত বছর পরও তোর চলে যাওয়ার মুহূর্তগুলো এখনো জীবন্ত হয়ে আছে। আমি যখন তোকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম, তখন বিকেল। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের দেয়ালজুড়ে পড়ন্ত বিকেলের রোদ মাখামাখি করে আছে। এই রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলেও মনটা অস্বস্তিতে ভরা। তিনতলার একটি কেবিনে সে আছে। ওর চিকিৎসা চলছে।

কী করে মনটা স্বস্তিতে থাকে?

আমি খবর পেয়েছি ওর হাসপাতালে ভর্তির তিন দিন পর। রুদ্র তিন দিন হলো হাসপাতালে আর আমি ওকে এখনো দেখতে যাইনি! বড় বেদনাবোধ নিয়ে ওর কেবিনে ঢুকলাম। চারপাশ ঘিরে আছে ওর স্বজনেরা। সবাই আমার চেনা। একপাশে বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে বীথি। রুদ্রর ছোট বোন। ওরা পিঠাপিঠি ভাইবোন। দুজনের এমন মধুর সম্পর্ক আমি আগে কখনো কোনো ভাইবোনের মধ্যে দেখিনি। দাদার জন্য বীথির উদ্বেগ তার চেহারায় প্রকটভাবে লেপটে আছে। ওর পরের ছোট ভাই ডা. সাইফুল্লাহ দাদার চিকিৎসার ব্যাপারে ভীষণ ব্যস্ত। চোখে চোখে আমাদের কুশলবিনিময় হলো।

রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম। ওকে দেখে আমার বুক ভেঙে আসছিল। ওর নাকে-মুখে অনেক নল ঢোকানো। কথা বলা বন্ধ। খাওয়াও নল দিয়ে। আমাকে দেখে চোখের ইশারায় কাছে ডাকল। আমি এগিয়ে কাছে যেতে ওর চোখজোড়া স্থির হয়ে গেল। তারপর সেই স্বপ্নবান চোখজোড়ায় অঝোরে জল গড়াতে লাগল। দেখে আমার বুক ফেটে কান্না উঠে আসতে থাকে। ওর মতো তেজি তরুণের চোখে জল—নিশ্চয়ই ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সেই কষ্ট যেন আমাকেও ছুঁয়ে যেতে লাগল। আমিও চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। আমাদের নীরব কান্না পুরো কেবিনটাকে বেদনাময় করে তুলল। ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন কোথাও পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচি।

ডা. সাইফুল্লাহর সঙ্গে কথা হলো। আমি জানতে চাইলাম, ‘ওর কী হয়েছে?’

‘দাদার আলসার। ঘা হয়ে গেছে। নল দিয়ে ঘায়ের লালা বের করা হচ্ছে।’

‘তাহলে তো ওর খুব কষ্ট হচ্ছে?’

সাইফুল্লাহ দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, ‘তা তো একটু হচ্ছে।’

‘এভাবে আর কত দিন নল নাকে-মুখে থাকবে?’

‘সেটা তো চিকিৎসার ওপর নির্ভর করছে।’

হাসপাতালের ব্যালকনিতে আমাদের কথা হচ্ছিল। আমার চোখের সামনে দুর্দান্ত এক তেজি তরুণের মুখোচ্ছবি ভেসে উঠছিল বারবার। আমাদের সময়ে সবচেয়ে সাহসী বন্ধু, সবচেয়ে তেজি, প্রতিবাদী রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, তার এই অসহায় পরিণতি আমি মানতে পারছিলাম না।

ব্যালকনির এপাশে-ওপাশে ওর ভাইবোনেরা বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আহা! ওর ভাইবোনগুলো একেকটা যেন সোনার টুকরো। কী বিনয় সবার। আবীর আবদুল্লাহ, রুদ্রর ৩ নম্বর ভাই। ইদানীং এই ভাইটি ফটোগ্রাফিতে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে। হাসপাতালের ব্যালকনিতে আমার পাশে উদাস তাকিয়ে ছিল। ওর বিষণ্ন চোখে আমি যেন রুদ্রর ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। দুই ভাইয়ের চেহারায় অদ্ভুত মিল। আমার চোখে ভেসে ওঠে, তাগড়া এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে দ্রোহের কবিতা পড়ছে, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন...’।

১৯৭৮ সালে সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’-এ ওর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতার নাম ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’। সেই শুরু উজান স্রোতে যাত্রা। কবিতাটি তাকে ব্যাপক খ্যাতি ও পরিচিতি এনে দেয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতাটি আবৃত্তি হতে থাকে। এ কথাটা বোধ হয় জোর দিয়েই বলা যায়, বাংলাদেশে যাঁরা আবৃত্তি চর্চা করেন, তাঁরা সবাই কোনো না কোনো দিন নিজের তাগিদে এ কবিতাটি কোনো অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছেন। রুদ্র নিজেও এ কবিতাটি অনেক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছে। বাংলাদেশের খ্যাতিমান সব আবৃত্তিকারের কণ্ঠে আমি এ কবিতাটির আবৃত্তি শুনেছি। এমনকি আমি নিজেও এ কবিতাটি দু-একটি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছি। কিন্তু রুদ্র যখন পড়ত, তখন যেন কবিতাটি অন্য মাত্রা পেত। ওর আবৃত্তি আমাকে বেশি টানত।

ওর সঙ্গে পরিচয়ের পর্বটা নাটকীয়। যদিও আমরা একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছিলাম। কিন্তু আমাদের পরিচয় হয়েছে পরে। আমি কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের। সোজা বাংলায় যাকে বলে পলায়নমুখী। তবে আমি ওকে চিনতাম। বাবরি চুল উড়িয়ে সে দল বেঁধে ক্যাম্পাসে আড্ডা দিয়ে বেড়াত। আমারও ইচ্ছা করত ওদের আড্ডায় অংশ নিই। কিন্তু আমি আমার স্বভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারতাম না। আড়ালে থাকতেই আমার বেশি ভালো লাগত। একদিন হাকিম চত্বরে আমাদের আরেক বন্ধু কবি তুষার দাস আমার সঙ্গে রুদ্রর পরিচয় করায়। রুদ্র বিস্ময়ে বলে, ‘আপনি ইসহাক খান! আমি তো মনে করেছিলাম আপনার অনেক বয়স।’

‘আপনার এ রকম মনে হওয়ার কারণ?’

‘আপনার লেখা পড়ে। যাক বাদ দেন। আপনি তো প্রচুর লেখেন।’

কথার ফাঁকে কখন আমরা আপনি থেকে তুই হয়ে গেছি, তা নিজেরাও জানি না। কী পেল সে আমার মধ্যে—আমি জানি না। আমি নিজেও ওর মধ্যে এমন কী পেয়ে গেলাম—যা আজও আমার কাছে ব্যাখ্যাতীত। ক্রমে আমাদের ‘তুই’-এর ঘনত্ব বাড়তে লাগল। আমার নাকি বন্ধুভাগ্য ভালো। আমি স্বীকার করি। রুদ্রর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কিংবা রুদ্র আমাকে বন্ধু বলে গ্রহণ করেছিল কিংবা একসময় আমার হলের ঠিকানা হয়ে উঠেছিল রুদ্রর স্থায়ী ঠিকানা। আমরা একসঙ্গে থাকি। একসঙ্গে চলি। একসঙ্গে খাই। একসঙ্গে ঘুমাই। মজার ব্যাপার হলো, রুদ্র আবাসিক ছাত্র ছিল না। বাসা ভাড়া করে থাকত। বাসাভাড়া ঠিকই দিত, থাকত আমার সঙ্গে হলে ডাবলিং করে। আমার হলের ঠিকানা হয়ে গেল ওর যোগাযোগের একমাত্র ঠিকানা। ওর চিঠি আসত আমার হলের ঠিকানায়। পত্রিকা আসত। চেক আসত। আর আসত ওর একসময়ের ভালোবাসার সঙ্গী তসলিমা নাসরিনের চিঠি। অসম্ভব সুন্দর তার হাতের লেখা। তসলিমা চিঠি লিখত নিয়মিত। প্রতি সপ্তাহে তার চিঠি আসত।

 রুদ্র আমাকে অন্তর্মুখী স্বভাব থেকে টেনে বহির্মুখী করে। সাহিত্যের আড্ডায় ও-ই আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যেত। ওর পরিচয়ের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। কোনো নতুন জায়গায় গিয়েও ঠিকই ওর চেনা মানুষের কমতি হয়নি। রুদ্র চেনার আগে তারাই চিৎকার করে জড়িয়ে ধরত রুদ্রকে।

১৯৯১ সালের ১৯ জুন। হাসপাতালে গিয়ে ওকে দেখে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। বেশ পরিপাটি লাগছিল ওকে। বেডে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে উঠে বসল। ‘কেমন আছিস?’

বলল, ‘অনেকটা ভালো।’

আমি বললাম, ‘তোকে দেখেও তাই মনে হচ্ছে। দেখে ভালো লাগছে। নাকে-মুখে নল নেই।’ সেদিন আমরা অনেকক্ষণ কথা বললাম।

ফেরার সময় বললাম, ‘কাল আসতে পারব না। তারপর দিন আসব।’

পরদিন মানে ২১ জুন আসব। কিন্তু আমি তখনো জানি না ২১ জুন হবে আমার বন্ধুর 
জীবনের শেষ দিন।

২০ জুন হাসপাতালে আসতে হলো বন্ধু মানস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে। রুদ্র আমাকে দেখে বলে, ‘তোর তো আজ আসার কথা না।’

বললাম, ‘মানস ধরে এনেছে। বলল, “রুদ্র অসুস্থ, আমি এখনো দেখতে যাইনি। এইটা কোনো কথা হলো?”’

রুদ্র বলল, ‘এসে ভালোই করেছিস। আজ আমাকে রিলিজ করে দিচ্ছে।’

সেদিন আমরা অনেক মজা করেছিলাম। হাসিঠাট্টা হয়েছিল বেশ। তারপর ট্রলি করে ওকে নিচে নামালাম। ওর হাতে অনেকগুলো রজনিগন্ধার ডাঁটি। গাড়িতে ওঠার পর রজনিগন্ধার একটি ডাঁটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘শ্যামলীকে দিস। আর বলিস, এবার সত্যি-সত্যি বদলে যাব।’ শ্যামলীকে কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। পরদিনই তাকে ভয়াবহ দুঃসংবাদটি দিতে হলো। বললাম, ‘আমি একা হয়ে গেছি শ্যামলী। আমার প্রিয়তম বন্ধু রুদ্র আর নেই!’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত