Ajker Patrika

প্রাণের মেলায় মিলেছে প্রাণ

খান মুহাম্মদ রুমেল
প্রাণের মেলায় মিলেছে প্রাণ

ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনের বিকেল। সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে টিএসসির কোলজুড়ে বহু মানুষের ভিড়। চায়ের কাপে ঝড়। ফুলওয়ালি কিশোরীর রিনরিনে গলার আওয়াজ—একটা মালা নিবেন আফা? নেন না একটা মালা! জ্যামে আটকে পড়া গাড়ি এক্সিলেটরে ঘনঘন চাপ দেয়— ঘোঁত ঘোঁত শব্দ তোলে! মনে হয় খাটো দড়িতে বাঁধা খ্যাপা লাল ষাঁড় বাঁধনমুক্ত হতে চাইছে। আছে রিকশাচালকদের খিস্তি খেউড়। এসব থেকে চোখ এড়ানো না গেলেও, এগোলাম গন্তব্যের দিকে।

টিএসসির গেট দিয়ে ঢুকে পড়ি মেলায়। প্রবেশ মুখে এদিন পুলিশের উপস্থিতি নেই, নেই নিরাপত্তা তল্লাশি। মানুষ নিজের মতো ঢুকছেন। খুব বেশি ভিড় নেই বলে বিশৃঙ্খলাও নেই। এগিয়ে জানলাম অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ উদ্বোধন হয়ে গেল একটু আগে। তারপর পর থেকেই খুলে দেওয়া হয়েছে মেলা চত্বর সাধারণ মানুষের জন্য। গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে পেনসিল স্কেচ আঁকিয়েদের ভিড়। প্রতি বছর মেলার একমাস এখানটায় বসে থাকেন তাঁরা। তাৎক্ষণিক ছবি এঁকে দেন আগ্রহী মানুষের—অবশ্যই টাকার বিনিময়ে। তাদের সামনে জড়ো হয়েছে অল্প কিছু মানুষ।

আগেই বলেছি- প্রথম দিনের মেলায় স্বাভাবিক নিয়মেই ভিড় নেই খুব বেশি। যদিও শনিবার—সাপ্তাহিক ছুটির দিন উপলক্ষে ভিড়টা আরেকটু বেশি হতেই পারত। তবে সপ্তাহ পেরোনোর আগেই এই ভিড় আরও অনেকটা বাড়বে— নিশ্চিত।

এবার অনেকটা হুট করেই নগর থেকে বিদায় নিল শীত। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনেই মেলার মাঠে বসন্তের হু হু হাওয়া। গেটের পেরোনোর পরেই বিশাল রেইনট্রি গাছটা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাই। হাতের বাঁয়ে বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রটা তৈরি হয়নি তখনো। উল্টোদিকের বাংলা একাডেমির নিজেদের বই বিক্রির স্টলও তখন পর্যন্ত অপ্রস্তুত। বাতিহীন স্টলে বই গুছিয়ে রাখছেন বিক্রয় কর্মীরা। সামনের দিকে এগিয়ে যাই। ছোট ছোট দল বেঁধে হাঁটছেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তাদের মধ্যে তারুণ্যের সংখ্যাই বেশি। দক্ষিণ দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে মুক্ত মঞ্চের সামনে দাঁড়াই। প্রস্তুত হয়ে গেছে বেশির ভাগ স্টল প্যাভিলিয়ন। তবে কিছু স্টলে এখনো নির্মাণকাজ চলছে— যেমনটা হয়ে থাকে প্রতিবছর। সময় সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবাই স্টল প্রস্তুত করে উঠতে পারেন না। এবারও ব্যতিক্রম নয়।

মুক্তমঞ্চের সামনে থেকে পূব দিকে চোখ মেললে চোখে ধরা দেয় পুরো মেলা। হাঁটতে থাকি ধীর পায়ে। কোনো তাড়া নেই, কাউকে খোঁজা নেই। সন্ধ্যা মিলিয়েছে কেবল, জ্বলে উঠেছে স্টলগুলোর বিজলিবাতি। যারা এদিন মেলায় এসেছেন— বেশির ভাগই ঘুরে-ফিরে দেখছেন। প্রথম দিনে বই কেনার তাড়া নেই কারোর। বিভিন্ন স্টলের বিক্রয়কর্মীরা হেঁটে চলা মানুষের দিকে তাকিয়ে আছেন আগ্রহ ভরে। কোথাও কোথাও বিক্রয়কর্মীরা নিজেদের মধ্যে আড্ডায় মশগুল।

প্রথম দিনে বেশ কিছু শিশু-কিশোরের দেখা মেলে হেঁটে চলার পথে। বাবা মায়ের হাত ধরে হাঁটছে তারা। কলকল কথার স্রোত বইছে তাদের মুখে। এদের প্রায় সবার হাতে বইয়ের প্যাকেট। বোঝা যায় মেলার প্রথম দিনের ক্রেতারা বেশির ভাগই শিশু কিশোর।

পুরো মেলা চত্বর একদফা চক্কর দিয়ে থিতু হই। চা কফির খোঁজ করি। অন্যবারের মতো এবারও মেলা প্রান্তরে চায়ের কোনো আয়োজন নেই। মেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এবারও কোনায় কোনায় করপোরেট কফির দোকান। তবে সেগুলোও বেশির ভাগ বন্ধ। চা পাগল লেখক পাঠক দর্শনার্থীর কথা এবারও বিবেচনায় নেই! অথচ প্রতিবছরই এ নিয়ে খেদ ঝাড়েন মেলার মানুষেরা।

ইত্যাদি প্রকাশের সামনে চোখে পড়ে লেখক গণমাধ্যমকর্মীদের ছোট্ট আড্ডা। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি। কাছে যাব কি না ভাবছি— এমন সময় উঁচু গলায় ডেকে ওঠেন একজন। তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আড্ডায় সময় কাটে। খানিক বাদে চোখে পড়ে সস্ত্রীক হেঁটে যাচ্ছেন সাখাওয়াৎ হোসেন সায়ন্থ। কবি, কথা সাহিত্যিক, সমালোচক, টকশোর তুখোড় আলোচক নানা পরিচয় তাঁর। এসবের আড়ালে তাঁর চিকিৎসক পরিচয় ঢাকা পড়ে যায় মাঝে মাঝে। সহাস্য কুশল বিনিময় শেষে সাখাওয়াৎ হোসেন সায়ন্থ জানতে চান —অনন্যা প্রকাশনীর স্টলটা কোন দিকে? হাত দিয়ে ডান কোনার দিকে নির্দেশ করেন একজন। চলে যান তিনি। আড্ডায় মন বসে না। আবার হাঁটতে থাকি। হেঁটে হেঁটে আবারও দেখা হয়ে যায় সাখাওয়াৎ সায়ন্থ’র সঙ্গে। বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন তিনি। এখান থেকে বের হয়েছে তার উপন্যাস নিঃসঙ্গ সত্য। বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখি। ফ্ল্যাপে সায়ন্থ লিখেছেন—কিছু সত্য থাকে যা কাউকে বলা যায় না। মনের মধ্যে সেই গোপন নিঃসঙ্গ সত্যটা কখনো নাড়া দিয়ে উঠে। তা প্রকাশের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে মন।

এগিয়ে যাই তার দিকে। প্রশ্ন রাখি— সত্য কেন নিঃসঙ্গ? হেসে ওঠেন সাখাওয়াৎ সায়ন্থ। বলেন— কিছু সত্য থাকে যা কখনো কাউকে বলা যায় না। সেই দিক বিবেচনা করলে কিছু সত্য নিঃসঙ্গ থেকে যায় সব সময়। যেমন আমার এই বইয়ের প্রধান চরিত্র সাফওয়ানের একটা সত্য আছে, যেটা কাউকে বলা যায় না। কিন্তু আবার বলার জন্য মনে আকুলি-বিকুলি চলে। এক সময় সে তার গোপন সত্যটা একজনকে বলে ফেলে ভার মুক্ত হওয়ার আশায়। পরে সাফওয়ানের মনে হয় সত্যটা প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। একপর্যায়ে সেই লোককে খুন করে সাফওয়ান। পরে ভীষণ আত্মদহন থেকে এক সময় সে নিজেও আত্মহত্যা করে।

— এটা কি থ্রিলার? প্রশ্ন করি আমি।

— নাহ, থ্রিলার নয়। এটি একটি নিটোল প্রেমের কাহিনি। যার শেষটা বিয়োগান্তক।

আমি আবার চোখ রাখি বইয়ে। ফ্ল্যাপের শেষ অংশে সায়ন্থ লিখেছেন—ভালোবাসা হারানোর হতাশায় আচ্ছন্ন একজন মানুষ কীভাবে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন হন্তারক এবং শেষ পর্যন্ত আত্মবিধ্বংসী, সেই মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক গল্পের হয়তো পাঠককে আলোড়িত করবে।

আমাদের কথার মাঝখানেই হাজির হোন সায়ন্থের বেশ কয়েকজন বন্ধু। তাদের আড্ডার সুযোগ করে দিয়ে বিদায় নিই। হাঁটতে হাঁটতে মুক্তমঞ্চের সামনের পাচিলে বসে থাকি কিছুক্ষণ। মেলায় এখনো মানুষ ঢুকছেন দলে দলে। আর আমি ধীর পায়ে বের হয়ে আসি মেলা থেকে। ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলি শাহবাগমুখী।

আরামদায়ক শীতে একা একা হাঁটতে বেশ ভালো লাগে!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এত শক্তি প্রদর্শন আপনাদের মানায় না—অন্তর্বর্তী সরকারকে কড়া হুঁশিয়ারি সালাহউদ্দিনের

মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে ডাকাতির চেষ্টা ব্যর্থ, দোকানদার থেকে ২৫ সেকেন্ডে খেলেন ২০টি চড়

ফরিদপুরে বিএনপির সংঘর্ষের সময় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুবক, ভিডিও ভাইরাল

বেতনের টাকায় সব গাড়ি কোম্পানি, এমনকি দেশও কিনতে পারবেন ইলন মাস্ক

মাথায় হেলমেট নেই চালকের, এক লাখের স্কুটারে জরিমানা ২১ লাখ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চস্থ করল স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।

মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।

হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এত শক্তি প্রদর্শন আপনাদের মানায় না—অন্তর্বর্তী সরকারকে কড়া হুঁশিয়ারি সালাহউদ্দিনের

মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে ডাকাতির চেষ্টা ব্যর্থ, দোকানদার থেকে ২৫ সেকেন্ডে খেলেন ২০টি চড়

ফরিদপুরে বিএনপির সংঘর্ষের সময় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুবক, ভিডিও ভাইরাল

বেতনের টাকায় সব গাড়ি কোম্পানি, এমনকি দেশও কিনতে পারবেন ইলন মাস্ক

মাথায় হেলমেট নেই চালকের, এক লাখের স্কুটারে জরিমানা ২১ লাখ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এত শক্তি প্রদর্শন আপনাদের মানায় না—অন্তর্বর্তী সরকারকে কড়া হুঁশিয়ারি সালাহউদ্দিনের

মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে ডাকাতির চেষ্টা ব্যর্থ, দোকানদার থেকে ২৫ সেকেন্ডে খেলেন ২০টি চড়

ফরিদপুরে বিএনপির সংঘর্ষের সময় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুবক, ভিডিও ভাইরাল

বেতনের টাকায় সব গাড়ি কোম্পানি, এমনকি দেশও কিনতে পারবেন ইলন মাস্ক

মাথায় হেলমেট নেই চালকের, এক লাখের স্কুটারে জরিমানা ২১ লাখ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।

মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।

মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।

নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।

বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এত শক্তি প্রদর্শন আপনাদের মানায় না—অন্তর্বর্তী সরকারকে কড়া হুঁশিয়ারি সালাহউদ্দিনের

মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে ডাকাতির চেষ্টা ব্যর্থ, দোকানদার থেকে ২৫ সেকেন্ডে খেলেন ২০টি চড়

ফরিদপুরে বিএনপির সংঘর্ষের সময় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুবক, ভিডিও ভাইরাল

বেতনের টাকায় সব গাড়ি কোম্পানি, এমনকি দেশও কিনতে পারবেন ইলন মাস্ক

মাথায় হেলমেট নেই চালকের, এক লাখের স্কুটারে জরিমানা ২১ লাখ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল যেন তাঁর দীর্ঘ কোনো বাক্যের সমাপ্তি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।

১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।

তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।

ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।

তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।

২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।

চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।

তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এত শক্তি প্রদর্শন আপনাদের মানায় না—অন্তর্বর্তী সরকারকে কড়া হুঁশিয়ারি সালাহউদ্দিনের

মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে ডাকাতির চেষ্টা ব্যর্থ, দোকানদার থেকে ২৫ সেকেন্ডে খেলেন ২০টি চড়

ফরিদপুরে বিএনপির সংঘর্ষের সময় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুবক, ভিডিও ভাইরাল

বেতনের টাকায় সব গাড়ি কোম্পানি, এমনকি দেশও কিনতে পারবেন ইলন মাস্ক

মাথায় হেলমেট নেই চালকের, এক লাখের স্কুটারে জরিমানা ২১ লাখ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত