স্বপন নাথ

দ্বিজেন শর্মা-উত্তর পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্রচর্চা প্রসঙ্গে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এমনই একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। তাঁর অভিমত, যেভাবে দ্বিজেন শর্মাকে মূল্যায়নের কথা ছিল, সেভাবে করছি না। আসলেই আমরা তা করছি না। কারণ, তাঁর কাজের প্রয়োজন আমরা অনুধাবন করিনি। এ সমাজ সেই বোধ থেকে অনেক দূরে, তা স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই। সবাই জানেন, প্রকৃতির সঙ্গে মানবসমাজের সম্পর্কের ধারণা, জ্ঞান, বোধ জন্মে পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য থেকে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা থেকে। তৃতীয়ত, এর মূলে আছে নিরন্তর আত্মোপলব্ধি। নিয়তি হলো, এ তিনের অনুপস্থিতির ভূগোলে আমরা অবস্থান করছি। কারণ, প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে, তাদের অবস্থান, জীবনযাপন আমরা হিংসা করি। প্রাকৃতিক ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদে আনন্দ পাই, বিনাশে উৎসব করি। প্রকৃতির উপাদান সংহারকর্মকে আমরা পরম নির্ধারিত বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয়ের সমর্থন নিয়ে আমরা এ বিনাশকর্ম সম্পাদন করি। সোফিস্ট দার্শনিক, আঠারো-উনিশ-বিশ শতকের আলোকসম্পাত ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি উদ্ভূত চিন্তার কেন্দ্র হলো মানুষ। ফলে এর সমর্থন নিয়ে মানবসমাজের অবনমন ভাবনা এ প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। দখলি শক্তি ও ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন অসহিষ্ণুতার স্রোত প্রজন্মান্তরে ক্রিয়াশীল। এর আলোকে বিশ্বের উদ্ভিদ, প্রাণী ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আমরা গ্রাহ্য করি না। অস্বীকারের সংস্কৃতি আমাদের জীবনের সামগ্রিক আচারাদি ও মস্তিষ্ককে দখল করে নিয়েছে। ফলে দ্বিজেন শর্মা ব্যক্তি ও তার প্রকৃতি-পরিবেশ চিন্তার সঙ্গে দখলীকৃত, বৈরী সাংস্কৃতিক আবহ এবং চর্চা খাপ খাওয়ানো দুঃসাধ্য। কারণ হলো, সামষ্টিক আঁধারচর্চা অন্যতম অবলম্বন, সেখানে প্রকৃতি, পরিবেশচিন্তা একধরনের অপ্রত্যাশিত, অন্যায্য কর্ম বলে আমরা জানি। নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রথাগত শৃঙ্খলে বন্দী থাকতে পছন্দ করি। ওই সাংস্কৃতিক উপনিবেশে একজন ব্যক্তির রুচিবোধ ও জীবনের সারার্থ উপলব্ধি করি।
ফলে, এজাতীয় শৃঙ্খলিত ভাবাচারের সাংস্কৃতিক জীবনে বাস্তুতান্ত্রিক চিন্তা না থাকারই কথা। পরিণাম ও অবশেষে বন্দিত্বের আনন্দে দ্বিজেন শর্মার মতো ব্যক্তি সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং নামও ভুলে যাওয়া। যে প্রকৃতি পরিবেশ আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন, তাকেই আমরা ধ্বংস করছি। তা করতে যুক্তি, বাসনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের আয়োজন করি। এমন পরিস্থিতিতে দ্বিজেন শর্মার কথন, বয়ান ও কর্মতৎপরতা উচ্চারণের মানে হলো, নিজের বিরুদ্ধে যাওয়া। তিনি যা-কিছু বলেছেন, এর গুরুত্ব আমরা বুঝি না, বুঝতে চেষ্টাও করি না। আমাদের সবকিছু যেন ম্লান হতে শুরু করেছে, নিরর্থক হতে শুরু করেছে। পারিপার্শ্বিক গতির সঙ্গে অবস্থান করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি চারপাশ, মাটি ও প্রকৃতির গুরুত্ব, মূল্য। দ্বিজেন শর্মা কী কামনা করেছেন তাঁর জীবনচর্চা ও লেখালেখিতে। সারাটা জীবন তিনি কাটিয়েছেন প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে। তাঁর মনে, মননে, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে, চিন্তাভাবনায় কেবল ছিল নিসর্গ। ফলে চারপাশের পরিবেশদূষণ, বিপর্যয়ে তিনি খুব বিষণ্ন হতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন নিসর্গ সংরক্ষণ ও প্লানেটারি শৃঙ্খলার কথা।
স্মৃতিতে সতত নিসর্গ
জীবনের প্রয়োজনে একপর্যায়ে গেলেন সেকালের সোভিয়েত ইউনিয়নে। মস্কোতে অবস্থানকালে স্মরণ করেছেন বাল্য-কৈশোরে দেখা পাথারিয়া-মাধবকুণ্ডের নিসর্গ। যে প্রকৃতির আবহে নিজেকে নির্মাণ করেছেন। অবশ্য তাঁর মতো ব্যক্তির পক্ষে যা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ‘জলমর্মর নৈঃশব্দ্যের গভীরতা বাড়ায়। আমি বসেই থাকি। ভয়ের কিছু নেই। কাছেই খাসিয়াদের বাড়ি, পানের জুমখেত। তাদের বৌ-ঝিরা ছড়া থেকে জল নিচ্ছে।...বারুণীস্নানে লোকের ভিড়, দিগম্বর সন্ন্যাসী দেখার কৌতূহল, ভিনগাঁয়ের লোকদের সঙ্গে হঠাৎ দেখার চমক, পূজা-আর্চা, মায়ের আঁচল ধরে চৈত্রমেলায় ঘুরে বেড়ানো, পাগল করা বাঁশির সুর, ফেরিওয়ালার কাঁধের লাঠিতে গাঁথা সোলার পাখির ওড়াউড়ি, ময়রার দোকানের প্রলুব্ধকর সওদা...’ [২০১৩ (২): ১০৬]
প্রসঙ্গত দ্বিজেন শর্মার ‘জীবনস্মৃতি: মধুময় জীবনের ধূলি’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। পরিণত বয়সে যা কিছু সম্ভব স্মরণ করতে চেষ্টা করেছেন তিনি। স্মৃতিতর্পণের বিভিন্ন প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন শৈশব-কৈশোরের নানা কথা ও বিবরণ। যেসব বিবরণে উঠে এসেছে ব্যক্তিগত স্বপ্ন, প্রতিবেশী, সমন্বিত সহিষ্ণু জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, সোভিয়েত পর্ব, লেখাপড়ার নানা প্রসঙ্গ ও জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাঁর অর্জন বিসর্জনের কথা। এসবের মধ্যে রূপায়ণ করেছেন প্রকৃতি, বিশেষত বাস্তুতন্ত্রের সাথে তাঁর সম্পর্ক, বোঝাপড়া ও এ সম্পর্কের বাস্তবতা। লক্ষণীয় সেই কৈশোরেই প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক তিনি গড়ে তোলেন। কারণ, ওই সময়ে বিনোদন বা আনন্দ যা-ই বলি, এর সবকিছু ছিল প্রকৃতিকেন্দ্রিক। পূজা-পার্বণ, উৎসব উদ্যাপনের উপাদান সংগ্রহ ও তৈরি হতো প্রকৃতির উপকরণে। যান্ত্রিক জীবনযাপনের অনেক আয়োজন তখনো গ্রামে পৌঁছায়নি। যে কারণে সাধারণ মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। এ নিসর্গের প্রতি মানবসমাজ এক অধ্যাত্ম ভালোবাসা, প্রেম অনুভব করত। তাঁর বাড়ির কাছে অবস্থিত পাথারিয়া পাহাড়, অদূরে হাকালুকি হাওর, যে পর্যন্ত বিস্তৃত সমতল। ‘গ্রামের বুক চিরে বহমান ছোট নদীটির নাম নিকড়ি। শীতে হাঁটুজল, বর্ষায় প্রমত্তা, ঘূর্ণিসহ ঘোলাজলের প্রবল তোড়ে ভয়ঙ্করী।...আমরা নদীতে বড়শি ফেলতাম। বেছে নিতাম জুৎসই জায়গা, কাশবনের কাছে, তাতে বাসা বানাত লাল রঙের মুনিয়া, পেছনে মাঠ, পশ্চিমের আকাশ, তাতে অপরাহ্ণের রঙ। মৎসবতী নদী শূন্য হাতে ফেরাত না, ধরা পড়ত পুঁটি, টেংরা, গোলসা, বাইনের বাচ্চা।’ [শর্মা ২০১৯: ১৭]
আমরা জানি, পরম্পরায় শিমুলিয়াস্থ বাড়িটি কবিরাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল। সত্যিকারভাবে ছিল কবিরাজবাড়ি। এ বাড়ির চারদিকে সকালবেলা তাঁর বাবা খালি পায়ে হাঁটতেন, সাথে তিনিও। যত্ন নিতেন প্রকৃতির। কবিরাজির প্রয়োজনেই বাড়িতে অশোক, অর্জুন, আমলকী, হরীতকী, বয়ড়া, স্বর্ণচাপা, বকুল, নাগেশ্বর, আম্বলতম, শীতপুষ্পা শিমুল, কনকচাঁপা, কামিনী, টগর, শেফালী, কালো বসাক, ছাতিম, গোলাচি, কমলাগুঁড়ি, কন্টিকারি, বালা, বিশল্যকরনী, জয়পালসহ বিভিন্ন ধরনের ফলদ, বনজ ও ভেষজ গাছ, লতাগুল্ম আবাদ করতেন। যে কারণে তাঁকে আলাদাভাবে আর এসব বৃক্ষরাজির সঙ্গে পরিচয়ের প্রয়োজন পড়েনি বা পাঠ নিতে হয়নি। বাড়ির কাছের পাথারিয়া পাহাড় ছিল তখন বনারণ্য। সে সময় এ পাহাড়ি এলাকায় অন্য প্রাণীর সাথে বাঘও পাওয়া যেত। ‘পাথারিয়া পাহাড়ে ছিল নিবিড় ও গভীর অরণ্য। জনবসতি অতি নগণ্য। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই এলাকায় ফাঁদে-ধরা বাঘ ছাড়া কোনো বাঘ দেখিনি, একবার শুধু ছড়ার পারের বালুতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছিলাম। দূর ও কাছে থেকে অনেক বন্যজন্তু দেখেছি; শূকর, সজারু, বনরুই, মায়াহরিণ, গুলিবিদ্ধ সম্বর, সাধারণ বানরের দঙ্গল, হনুমান, উল্লুক, সম্ভবত রামকুত্তা এবং নানা জাতের সাপের সঙ্গে ভয়ঙ্কর শঙ্খচূড়। পাখির কোনো গনাগুনতি ছিল না।...’ [২০১৯: ৫২-৫৩]
পারিবারিক বাগানকর্মী শোভাবুড়ার কাছে শিখেছেন তির-ধনুক চালনা, পাখি শিকার। বনজ বৃক্ষরাজি আরও প্রাণিকুলের পরিচিতি জেনেছেন তাঁর কাছে। শোভাবুড়ার কাছেই দীক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতির, পাহাড়, রহস্যময় জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। শিখেছেন কীভাবে বন থেকে খাবার সংগ্রহ করা যায় পরিবেশের বিদ্যমানতা অক্ষুণ্ন রেখে। কারণ, ‘এই প্রকৃতিপুত্ররা চিরদিনই গরিব মানুষ, কিন্তু অশেষ ধৈর্যশীল। স্মর্তব্য, দুর্ভিক্ষে বনই তাদের বাঁচিয়ে রাখে।’ [২০১৯: ৫৫] যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন কখনো একাডেমিক প্রয়োজনে, কখনো মনের তাগিদে ঘুরে বেড়াতেন বৃক্ষ, ফুল, বাগান অথবা রমনা উদ্যান ও বলধা গার্ডেনে। খুঁজে নিয়েছেন জানা অজানা গাছের নমুনা। তাঁর কথায়, ‘এ এক রাজকীয় পরিবেশ শ্যামলিমা ঢাকার বিশাল চত্বর, মোগল স্থাপত্যের কার্জন হল, পরিপূর্ণ জলাশয়, সুশোভন বোটানিক গার্ডেন, লাল ইটের ছাত্রাবাস, রেসকোর্স, রমনাপার্ক সব মিলিয়ে এক স্বপ্নভূমি।’ [২০১৯: ৯৪]
শিক্ষাজীবন শেষ হলে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে চলে গেলেন বরিশাল বিএম কলেজে। সেখানেও তিনি তার সন্ধিৎসু মন খুঁজেছে নিজের পছন্দসই বাগান ও প্রকৃতি। তিনি পেয়েও গেলেন সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ। তিনি লিখেছেন, ‘দু’কামরার একটি আধা-পাকা টিনের ঘর, পেছনে কয়েকটি নারকেল গাছ, সামনে উঠান, তারপর নদীর মতো লম্বা একটি পুকুর, ওপারে বিস্তৃত ধানখেত, শেষে গ্রাম ও গোরস্থানের ওপরে অনেকগুলি শিরীষ গাছ। সূর্যোদয় সূর্যাস্ত শিরীষবনের ওপর রঙ ছড়াত, চেয়ে থাকতাম মুগ্ধ হয়ে। উঠানে লন বানালাম, পুকুরপারে লাগালাম নানা রঙের কলাবতী, এক পাশে কয়েকটি গোলাপ, ঘরের গা-ঘেঁষে জুঁইফুলের লতা, পুকুরে রক্তকমল ও রক্তপদ্ম। উত্তর পাশে একটি পোড়ো ভিটা ছিল, হয়তো এককালের রান্নাঘর, সেখানে উঠালাম গ্রীনহাউসের মতো কিছু-একটা, জড়ো করলাম কিছু অর্কিড, ক্যাকটাস ও টবের গাছ ফার্ন, ড্রাসিনা, পাতাবাহার।’ [২০১৯: ৯৭]
এভাবে যা করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। বিদেশে গিয়ে সন্ধান করেছেন বাগান, উদ্যান ও প্রকৃতির আবহ। তাঁর কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি করে তিনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করেছেন। বিশ্বের খ্যাত বিভিন্ন উদ্যান, বাগান, ভ্রমণ করেছেন এ বিষয়ে সাম্প্রতিক ধারণা অর্জনে। তিনি নিজে সোভিয়েত ইউনিয়নে বাসকালে বাগান তৈরি ও ফল চাষ করতেন। এমন স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘প্রত্যেক বাড়ির নিচের বাগানে মৌসুমি ফুল লাগাতাম। একটি নির্দিষ্ট নকশা ছিল; পেছনে লাল স্যালভিয়া, তারপর যথাক্রমে হলুদ ও গাঁদা, এরপর সাদা ও নীল লবেলিয়া। শেষে একফালি সরু বাঁকানো লন।...স্থায়ী বাগানটিও একসময় নজরকাড়া হয়ে উঠেছিল, ফুটেছিল প্রিমরোজ, বহুবর্ষজীবী ভার্বেনা, ব্লুবেল কয়েক জাতের লিলি। বুনো আপেল, নাশপাতি, চেরি গোলাপগোত্রের ফুলগুলিও চমৎকার।’ [২০১৯: ১৮৬]
নান্দনিক নিসর্গ
সারা বিশ্বে পুঁজির বিকাশ ধাবমান। ফলে এ পরিস্থিতিতে শিল্পায়ন, রিয়েল এস্টেট বাণিজ্য এবং একই সঙ্গে সৌন্দর্যভাবনা খুব জটিল। দ্বিজেন শর্মা একালের যাবতীয় চারিত্র্যকে অস্বীকার না করেও ইকোলজির কথা বলেছেন। সব সময়ই তিনি অনুভব করতেন প্রকৃতির মায়া। ঢাকা মহানগরের গাছপালার প্রজাতি, নাম ও পরিচিতি নিয়ে চমৎকার বই হলো শ্যামলী নিসর্গ। এর পেছনে তাঁর কথা হলো, ঢাকা শহরের পুরোনো অনেক গাছই এখন দেখা যায় না। এর মধ্যে আবার নতুন নতুন গাছ সংযোজিত হয়েছে। এসব গাছগাছালি নিয়ে এ গ্রন্থ রচিত। বৃক্ষ পরিচিতির প্রতিটি শিরোনামেই রয়েছে খ্যাতিমান লেখকদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি। যেমন,
১. কাঁটাতে আমার অপরাধ আছে
দোষ নাহি মোর ফুলে,
কাঁটা, ওগো প্রিয়, থাক্ মোর কাছে,
ফুল তুমি নিয়ো তুলে। [ক্যাকটাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০১৩ (৩): ৯৪]
২. নব কুসুম্ব পুষ্পবরণ সিঁন্দুরসম রাঙা
অগুন প্রবল পবনে দ্বিগুণ জ্বলে
ব্যাকুল অনল অটবীলতারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে
ধরনীতে ঘিরি দাহ করে পলে পলে। [কুসুম, স্লিচেরা ওলিওসা, কালিদাস ২০১৯: ১৬০]
এভাবে পরিচিতি বর্ণনার কারণ হলো সহজ ও সরলভাবে উদ্ভিদজগৎকে উপস্থাপন। তিনি জানেন, বৈজ্ঞানিক নামসহ ও নিছক একাডেমিক ভাষা ও বৃক্ষবিজ্ঞানের পরিভাষায় বিবরণ দিলে এসব কেউ পাঠ করবে না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমত: সাধারণ পাঠকের কাছে বার্তা পৌঁছানো, দ্বিতীয়ত: পরিবেশ, বাস্তুবিদ্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। বস্তুত সাধারণ পাঠক যেভাবে দ্বিজেন শর্মার রচনাকে গ্রহণ করেছে, তা বিস্ময়কর। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, সাধারণত উদ্ভিদবিদ্যা, বাস্তুতন্ত্রবিষয়ক কোনো লেখা তত্ত্ব পাঠ করতে মানুষ অনাগ্রহী। দ্বিজেন শর্মা তাঁর লেখা ও তৎপরতার মাধ্যমে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি ও আন্দোলন তৈরি করতে সক্ষম হন। যে ক্ষেত্রে কেউ কোনো বিরোধ মনে করেনি বা আহত বোধ করেনি। আবার যেকোনো পাখি-ফুল-বৃক্ষ বন্দনায়ও তাঁর সৃষ্ট সহজবোধ্য, আকর্ষণীয় ভাষা প্রয়োগ লক্ষণীয়। যে বর্ণনায় ঋতুবৈচিত্র্য, সমকালিক প্রকৃতির আবহ ও নিসর্গের প্রতি মায়া সৃষ্টিতেও যে ভাষা আন্দোলিত করে। যেমন, ‘‘কদম বর্ষার দূত: এই নিবিড় অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম। কোনো বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় যখন ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ ফোটে, দমকা হাওয়ায় একঝলক গন্ধ জানালা গলিয়ে ঘরের স্তব্ধতাকে চকিত করে, আমরা তখনই বর্ষার সুগভীর আহ্বানের অর্থ উপলব্ধি করি। কী নিবিড়, কী প্রগাঢ় আর আর দূরবাহী এই সুগন্ধ! বিশাল এই তরুর অজস্র প্রস্ফুটনের গন্ধমদির বর্ষার ভেজা বাতাস আমাদের মনে যে মধুর অনুরণন তোলে, তার তুলনা নেই। কদম আমাদের অনুপম প্রকৃতির আত্মজ। বর্ণে-গন্ধে-সৌন্দর্যে কদম এ দেশের রূপসী তরুর প্রথমদের অন্যতম।’ ‘তা ছাড়াও বাংলাদেশের নিজস্ব বৃক্ষরাজির পরিচয় দিতে লিখেছেন ভিন্ন প্রবন্ধ ‘বাংলার তরুলতা’। এমন শনাক্তির কাজে তাঁকে ঘুরতে হয়েছে দেশের নানা প্রান্ত।
প্রয়োজনীয় বাগান ও উদ্যান
বাগান, জঙ্গল ও উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো ছিল তাঁর নেশা। দেশ, বিদেশে যেখানেই গেছেন, সেখানেই তিনি সংশ্লিষ্ট বনভূমি, বাগান ও উদ্যান অবলোকনের চেষ্টা করেছেন। কারণ, একালে যান্ত্রিক জীবনের বাড়াবাড়ি, বা শিল্পোন্নয়নের তাড়না বনভূমি ও বাগানের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। ফলে আগের মতো কেউ বাগান নির্মাণে স্থিত নয়। যে কারণে তিনি বাগানকে বলেছেন নকশাবদ্ধ শিল্পকর্ম। যেখানে অনেকেই বাগান তৈরিতে ভূমি, স্থান ও পরিমিতি অনুযায়ী বাগানের জ্যামিতিক নকশা সুপারিশ করে থাকেন। ফলে, গাছ লাগালেই বাগান হয় না। লক্ষণীয়, বাগানের সৌন্দর্যে পরিমিত বর্ণপরিকল্প, প্রাকপ্রস্তুতি, গাছ ও ফুল লাগানো, সার প্রয়োগ, সেচ, গাছ বা ফুলের অসুখ হলে যত্ন ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমন্বিত পরিকল্পনা ও জানাবোঝার প্রতিফলনে নান্দনিক বাগান তৈরি করা যায়।
উপসর্গ যা-ই থাক, বাগান ও উদ্যান তৈরিতে মানুষ সব সময়ই ক্রিয়াশীল। এর মৌল কারণ হলো প্রকৃতির সাথে মানবসমাজের গোপন সম্পর্ক। এ সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। পুরোনো কাল থেকেই উদ্যান তৈরির প্রতি মানুষের উদ্যোগ লক্ষণীয়। কিন্তু তা প্রকাশে অনেকেই দ্বিধান্বিত। মানুষের কারণেই এ জীবজগতের অনেক কিছুই ধ্বংস হয়েছে, এখনো হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য যে, মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতে দ্বিজেন শর্মা লক্ষ করেছেন বন ধ্বংসের মাত্রা। প্রতিবছর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় ১ কোটি ২০ লাখ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে।
অতএব বাস্তুতন্ত্রকে বজায় রাখতে গেলে যা যা করা দরকার, তা হলো চারপাশের প্রতিবেশকে তার মতো বজায় রাখা। বস্তুত এ উপমহাদেশে উদ্ভিদজগতের তথ্য সংগ্রহ, বাগান ও উদ্যান নির্মাণের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। এর আলোকেই তিনি বাগান সৃষ্টিতে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। চারপাশে ধ্বংস ও বিনাশের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে সংরক্ষণমুখী সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। লক্ষণীয় এখন শখের তাগিদে শুধু বাগানের প্রতি আগ্রহী নয়। মানবসমাজের সার্বিক বিবেচনায় এখন বৃক্ষরোপণে সবাই মনোযোগী। সংরক্ষণের প্রযোজনীয়তা বিষয়ে তাঁর কথা হলো: ‘(১) ভবিষ্যৎ ব্যবহারের পক্ষে বাছাইয়ের অধিকার তথা জিনভান্ডার অক্ষুণ্ন রাখা, (২) বৈজ্ঞানিক রেকর্ডগুলো না হারানো, (৩) উত্তরাধিকার অটুট রাখা অর্থাৎ শিক্ষামূলক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ও রোমান্টিক উপাদানগুলো টিকিয়ে রাখা, (৪) বৈচিত্র্যের ধারণা লালন, (৫) মানুষ ও সহায় সম্পদের মধ্যকার অতিগুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলো না খোয়ানো।’ [২০১৩ (২) : ৬৮]
গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি, আবহাওয়া, মাটি বিবেচনায় বৃক্ষরোপণ ও বাগান করা প্রয়োজন। সড়ক, মহাসড়কের ঢালু জমিতে গাছ লাগানোতেও তাঁর সুপারিশ হলো, ‘মহাসড়কের পাশে গ্রামের শিশুদের জন্য জাম-আমলকী-জাতীয় ছোট ছোট ফলের গাছ লাগানো উচিত।’ পরিবেশ রক্ষা ও প্রয়োজনের তাগিদে তিনি বন ও উদ্যানের প্রতি খুব আকৃষ্ট ছিলেন। যেখানেই গেছেন, সেখানের উদ্যান ও বাগানের বিষয়ে তিনি ছিলেন আগ্রহী। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখেছেন, ‘কানাডা ও স্পেনের বাগানে গুরুত্ব পেয়েছে তাদের নিজ নিসর্গ। মার্কিন বাগানে সমন্বিত হয়েছে বনভূমি ও কাঠব্যবসা। মিসর ও ইতালির বাগানে আছে ঐতিহ্যবাহী পুরাদ্রব্যসম্ভার। গ্রিস তার বাগানে নিজ নিসর্গের সঙ্গে যোগ করেছে মহাকাব্যবর্ণিত গাছপালা। চীন ও জাপান এনেছে নিজস্ব উদ্যানশৈলী। অস্ট্রেলিয়ার বৈশিষ্ট্য হলো তার ‘নিজস্ব উদ্ভিদসম্ভার’ [২০১৩ (২): ১২১]
তিনি লক্ষ করেছেন এখানে বাগানের বিষয়ে উদাসীনতা। কোনো ডিজাইন বা নকশার কেউ তোয়াক্কা করে না। বাগান হিসেবে যেনতেন গাছ লাগালেই হলো। বৃক্ষ নিধন করে আবার বৃক্ষরোপণের কথা বলে তাড়াহুড়ো বাগান করার একধরনের মানসিকতা লক্ষণীয়। মূলত এগুলো ‘না-বন না-বাগান’। বাগানের ক্ষেত্রে ইকোসিস্টেমের দিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে না। যেমন একসময় বাংলাদেশে গণহারে লাগানো হয়েছে ইউক্যালিপটাস, চাষ করা হয়েছে মনোকালাচারের মাছ। এতে মাটি ও আবহাওয়ার দিকে নজর রাখা হয়নি। এ সমস্যা আরও বেড়েছে দারিদ্র্যের কারণে। এ ক্ষেত্রে জলাভূমি ও বনভূমি রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। যাতে মানুষ মনে করে এর মালিকানায় তার সংশ্লিষ্টতা আছে। একই সঙ্গে উপলব্ধি করতে হয়, বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে এ প্রকৃতির বিকল্প নেই। বাগান, বনাঞ্চল, উদ্যান নির্মাণে দেশ ও বিদেশে মনোকালচার বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা তার অভিমত নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া নগর ও শহরে বৃক্ষ নির্মাণে প্রচলিত ধারণাকে তিনি তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছেন। যা অবশ্যই পরিবেশ সংরক্ষণের সহায়ক নয়, যদিও বলা হয় সহায়ক বা প্রচার করা হয়। আরেকটি বৈশিষ্ট্য দেখা গেল, বন বিভাগের আচরণ ও এই মনোকালচারের বদৌলতে। লক্ষণীয়, বোটানিক গার্ডেন, ইকোপার্ক, সংরক্ষিত বন—সবই বন বিভাগের অধীনে নিয়ে যাওয়া। ‘আমাদের বোটানিক গার্ডেন কীভাবে বন বিভাগের দখলভুক্ত হলো, সে এক রহস্য। কাজটা তো তাদের নয়। বোটানিক গার্ডেন কার্যত একটি একাডেমি, একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তাতে থাকবে হার্বেরিয়াম, মিউজিয়াম, গবেষণাগার ও লাইব্রেরি। এটি পরিচালনা করবেন উদ্ভিদবিদ ও উদ্যানবিদেরা।’ [২০১৩ (২): ২৭০]
এর মধ্যে তিনি ইতিবাচক কিছু কাজ বিশ্বব্যাপী লক্ষ করেছেন। মানুষ যেখানে শূন্য জায়গা পাচ্ছে, সেখানে বৃক্ষ রোপণ করছে বা বাগান তৈরি করছে। আমাদের দেশেও জীববৈচিত্র্য রক্ষার তাগিদে বনায়ন, সংরক্ষণের কর্মসূচি চলমান রয়েছে। তবে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এসব ইকোপার্ক, বন ও উদ্যান না লাগছে গবেষক ও শিক্ষার্থীদের কাজে, না লাগছে পরিবেশ রক্ষার কাজে। শুধু সীমাবদ্ধ হয়ে আছে বিনোদন ও অর্থ সঞ্চয়ের প্রয়োজনে। ইকোপার্কের নামে যা করা হচ্ছে, এর পরিণাম কী দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘কৈশোর থেকে দেখা আমার অতিচেনা অরণ্যনিসর্গের সঙ্গে এ সবই বড় বেমানান। বাড়ির পথ ধরি। হাঁটতে হাঁটতে অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত বন, ইকোপার্কের কথা ভাবি। এগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। যতটুকু জানি, এগুলোর কোনোটাতেই বিদ্যমান গাছপালার বাইরে অন্য কিছু লাগানো যায় না। অথচ এখন বড়ই প্রয়োজন দেশি বৃক্ষের এক বা একাধিক একক সংগ্রহ গড়ে তোলা। কাজটি বোটানিক গার্ডেনেরও এক্তিয়ারভুক্ত নয়।...কিন্তু আমি নিশ্চিত, ইতোমধ্যে এসব বনাঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে অনেক প্রজাতির গাছগাছালি, লতাগুল্ম। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।’ [২০১৩ (২): ২২৪]
বাস্তুতন্ত্রের বোঝাপড়া
জীবন বাস্তবতা থেকে তিনি উচ্চারণ করেছেন পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্র রক্ষার তাগিদ। প্রকৃতির সাথে মানবসমাজকে জড়িয়ে রাখার সহজ ও সাবলীল পন্থা হলো শিশু কৈশোর থেকে প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক রচনা করা। যা তিনি নিজে উপলব্ধি করেছেন। তিনি এর বর্ণনাও দিয়েছেন। তাঁর বাড়ির কাছে পাথারিয়া পাহাড়ে যেতে যেতে লক্ষ করতেন বুনো শূকরের চলাফেরা, বানরের লাফ, বনমোরগের ডাকাডাকি, বিচিত্র পাখির ওড়াউড়ি। যা থেকে তিনি প্রথমত পাখিসমাজের সঙ্গে পরিচিত হন। বাস্তুতন্ত্রের আলোচনায় বলেছেন প্রাসঙ্গিক অস্তিত্ব ও অভিযোজন প্রক্রিয়ার কথা। ফলে ‘অস্তিত্বের সংগ্রাম’ প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসেছেন। এ প্রসঙ্গ প্রধান হয়ে ওঠার কারণ হলো মানুষের দখলদারির আলোকে প্রকৃতি দখল, নিয়ন্ত্রণ। একই সঙ্গে অতিমাত্রায় প্রকৃতির ব্যবহার থেকে এখন প্রকৃতির বিকল্প হওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করি। এ দৃষ্টিভঙ্গি মূলত প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে। আমাদের দেশে জনসমাজের বৃহদাংশ এখনো পরিবেশ, এর ওপর চাপ ইত্যাদি খুব একটা বোঝেন বলে মনে হয় না। ফলে না-বুঝে, না-জেনে বন ও সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনাকে দায়িত্বশীলেরা নিজের মতো সাজিয়ে নিচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে জীববৈচিত্র্য। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘রাচেল কারসন’-এর উপন্যাস নিথর বসন্ত [silent spring]-র উদাহরণ দিয়েছেন।
সকলেই জানেন, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির সঙ্গে অমানবিকতার সম্পর্ক রয়েছে। তা হলে বোঝাই যায় বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে, প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে যারা সক্রিয় আছে, তারা অনিবার্যভাবেই মানবিক। যারা শুধু বাণিজ্য বোঝে, উৎপাদন বোঝে, তারা কখনো প্রকৃতির মূল্য দেয় না। এ ছাড়া বাস্তুতন্ত্রের সমতাও খেয়াল করে না। অথচ জীববৈচিত্র্য, জীবনচক্রের শৃঙ্খলে মানুষ পরস্পর সম্পর্কিত। যে ক্ষেত্রে উদ্ভিদ বা এই লতাগুল্ম এ সম্পর্ক রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জন্য বলা হয় এ প্রকৃতি ও মানুষ এক এবং অবিচ্ছিন্ন। ফলে এক অনিবার্য, চেতনার ঐক্য বিদ্যমান। যা থেকে আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারি না।
বিচ্ছিন্ন কর্মপ্রয়াসের ফলেই প্রকৃতির মধ্যে বিরূপ পরিস্থিতি ও অসংগতি তৈরি হয়। ‘যেখানে পাহাড় চিরে-খুঁড়ে গাছের আবাদ বানানো পাহাড়ের স্থিতি ও পরিবেশের জন্য বিপর্যয়ী হবে, তা তো বলাই বাহুল্য। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে দূরের পাহাড়টি দেখি। সেই গাঢ় নীল এখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সবটাই এখন খালি, ধসের চিহ্নও স্পষ্ট। গোটা ব্যাপারটা সম্পর্কে ভেবে কোনোই ইতিবাচক সম্ভাবনা আঁচ করতে পারি না। এই বিশাল এলাকা বনশূন্য হলে বন্য প্রাণী ও পাখিরা যাবে কোথায়? আমরা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা নিয়ে যত কথা বলি, কিন্তু কার্যত চলি উল্টো পথে। কেন এমনটি ঘটে? এই অসংগতির উৎস কোথায়?’ [২০১৩ (২): ৩৩৯]
একালে শিল্পায়ন ব্যতীত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাস্তবতা হলো শিল্পায়নে সাধারণ প্রকৃতির ওপর এর প্রভাব পড়বেই। যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রভাবের ফলে কৃষিকাঠামো, সংস্কৃতি ভেঙে ও বদলে গেছে। প্রকৃতি থেকে লুণ্ঠন বেড়েছে, কিন্তু তা রক্ষায় চেতনার উন্নতি হয়নি। তবে শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে আমরা পরিবেশ বিষয়ে একেবারে উদাসীন থেকে যাচ্ছি। ফলে পরিবেশদূষণ বিষয়ে যা কিছু আয়োজন চলছে, তা হচ্ছে সগৌরবে। এ প্রসঙ্গে বরি কমোনার বলেছেন, It is economic motivation that has impelled the sweeping anti-ecological changes in the technology of production that have occurred since the Second War. These changes have turned the nation’s factories, farms, vehicles, and shops into seed-beds of pollution; nitrates from fertilizer; phosphates from detergents; toxic residues from pesticides; smog and carcinogenic exhaust from vehicles; the growing list of toxic chemicals and the mounds of undegradable plastic containers, wrappings and gewgaws from the petrochemical industry.
প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি লক্ষ করেছেন, আমরা সমতলভূমি ছাড়িয়ে জলাভূমি পর্যন্ত লুণ্ঠনাক্রান্ত মানসিকতার প্রমাণ দেখছি। এখানে বন, পরিবেশ, জল, মৎস্য রক্ষা করতে কিছু দাপ্তরিক কর্মসূচি লক্ষণীয়, কিন্তু আন্তরিকতা একেবারে অনুপস্থিত। যেসব কাজে গভীর চিন্তা বা কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। অনেক ক্ষেত্রে মনোকালচারজাত উৎপাদন বা দ্রুত উৎপাদন ও বাজারে আর্থিক লোভলাভে অস্থির মানবসমাজ। এতে প্রাকৃতিক জলাভূমি, বনাঞ্চল ধ্বংস করছি নিরুদ্বিগ্ন। সেখানে পরিবেশের কী হলো বা হচ্ছে, এ বিষয়ে কারও কোনো চিন্তা একেবারে নেই। দ্বিজেন শর্মার পর্যবেক্ষণ হলো: ‘একদা পড়ে থাকা অগভীর বিস্তৃত জলাভূমিগুলো আর নেই, এগুলো চাষের আওতায় এসেছে, ছোট মাছের বংশবৃদ্ধিও এলাকা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অধিকন্তু রাসায়নিক সার, কীটঘ্ন ও বোরো ধানের খড় পচার সমস্যা তো রয়েছেই। তবে সবচেয়ে মারাত্মক একটি উপসর্গ জুটেছে প্রযুক্তি প্রসারের কল্যাণে পাম্প দিয়ে বড় বড় জলাশয়, নদী খাত শুকিয়ে মাছের ঝাড়বংশ উজাড় করে ফেলা। এটা আগে সম্ভব হতো না। এতে মাছই শুধু কমছে না, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও।’ [২০১৩ (২): ১৭৭]
বলা বাহুল্য, বাণিজ্যপুঁজির সচলতায় পরিবেশকে তত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন আসে, আত্মঘাতী উন্নয়ন কি খুব জরুরি? যেখানে পুরো ইকোসিস্টেমকে কোনো পাত্তাই দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু পৃথিবীর যে পরিস্থিতি লক্ষণীয়, তাতে তাঁর ধারণা, ‘হোমোসেপিয়েন্স শেষ পর্যন্ত একটি বিপন্ন প্রজাতিতে পর্যবসিত হতে পারে’। তাঁর পর্যবেক্ষণে আগে ঘটবে পৃথিবীগ্রহের ধ্বংস, একই সঙ্গে ঘটবে মানব প্রজাতির বিলুপ্তি। তিনি দেখেছেন, বিশ্বে ও দেশে প্রকৃতির সামূহিক বিনাশে অর্থমূল্য ভাবা হলেও ইকোমূল্য বিবেচনা করা হচ্ছে না। বন বা জলাভূমির বাস্তব্যতন্ত্র একটি জটিল তথা সমন্বিত সত্তা আর সেটা বদলানো আখেরে মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। বনের জীবসম্পদের গুরুত্ব ভৌত-মূল্যে কতটা নির্ধার্য? আপাতদৃষ্টে অপ্রয়োজনীয় একটি প্রজাতির সম্ভাব্য মূল্য আমরা কতটা জানি। যে গুল্ম এই মুহূর্তে একটি বর্জ্য আগাছামাত্র, তাতে কোনো দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ নেই কে বলতে পারে, তাতে থাকতে পারে এমন কিছু ‘জিন’, যা আমাদের ফসলকে জোগাতে পারে রোগ বা পতঙ্গের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা, বিরূপ পরিবেশে অব্যাহত উৎপাদনশীলতার সামর্থ্য।’ [২০১৩ (২): ২৭৬ ]
পরিবেশজনিত, জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা তৈরি করেছে নয়া পুঁজিবাদের বিবিধ প্রতিক্রিয়া। পুঁজির নানা ধরনের উপজাত বিষয়ের ক্রিয়ায় বিশ্বপ্রকৃতির নানা বিলয় ঘটছে। মানুষ প্রকৃতির বিরোধ যেন প্রকাশ্য এখন। জেনেবুঝে মানুষ প্রকৃতির বিরূপতাকে দিনে দিনে বাড়িয়ে দিয়েছে। পুঁজির কাঠামোর ওপর নয়া উদারবাদের বিষয় হলো ক্রম ভোগবাদের বিকাশ। নয়া উদারবাদের কৌশলই হলো উৎপাদনের বাইরে থাকা জনমানুষকে শুধুই কনজ্যুমার বানানো। এর ফলে পরিবেশ ও প্রকৃতি ক্রম বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এর প্রতিক্রিয়ায় মুক্তির কোনো আশ্বাসই এখন নেই। দ্বিজেন শর্মার পর্যবেক্ষণ হলো: পশ্চিমা বিশ্ব ‘নতুন নতুন পণ্যবস্তুর পর্যাপ্ত উৎপাদন ও যথেচ্ছ অপচয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি করে চলেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ, মেরুতুষার গলন, ওজোন স্তর ক্ষয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লন্ডন-নিউইয়র্ক-টোকিও ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা, জলবায়ুর সম্ভাব্য পরিবর্তনে কৃষির বিপর্যয় ইত্যাদি নিয়ে তারা তেমন ভাবিত নয়, যেন এসব সংকট মোকাবিলার মতো সামর্থ্য আছে।...করপোরেট সংস্থাগুলো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অর্থব্যয়ে অনিচ্ছুক। তারা হন্যে হয়ে তেল গ্যাস খুঁজছে, নতুন নতুন মারণাস্ত্র বানাচ্ছে, বশংবদ রাজনীতিকদের সাহায্যে বিশ্বায়নের নামে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ঘনীভূত করছে, তাতে একধরনের প্রকট নৃকেন্দ্রিকতা, সেখানে কোনো প্যারাডাইম খুবই শিফট খুবই কঠিন।’ [২০১৩ (২): ৩৪৮]
‘বিলম্বে হলেও যখন আমরা উদ্ভিদজগতের সত্যিকার মূল্য উপলব্ধি করছি, তখন যেন পরিবেশ পুনর্নির্মাণে আমাদের বিবেচনা শুধু উপযোগিতার কয়েকটি মাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, যেন সেখানে সৌন্দর্য, প্রেম ইত্যাদির মতো কিছু অধরা মাধুরীরও প্রবেশ ঘটে, যাতে জীবন পূর্ণতা পায়, উন্নয়ন বহুমুখী হতে পারে।’ [২০১৩ (২): ১৩০] সুতরাং দ্বিজেন শর্মা এ প্রকৃতির বর্ণনায় সৌন্দর্য উপস্থাপন করেননি। একীভূত ধারণায় বাস্তুতন্ত্রের সার্বিক যত্ন ও সংরক্ষণের দায় স্বীকার করেছেন। সত্য হলো, আমরা প্রকৃতিকে না দিয়ে নিচ্ছি কেবলই। এ ক্ষেত্রে তাঁর আহ্বান হলো, জুরাসিক যুগের বিপদ ডেকে আনার আগে এবং বৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব পালন করা কর্তব্য।
তথ্যসূত্র
দ্বিজেন শর্মা। ২০১৩। প্রকৃতিসমগ্র ২। ঢাকা: অনিন্দ্য প্রকাশ-২০১৩। প্রকৃতিসমগ্র ৩। ঢাকা: অনিন্দ্য প্রকাশ-২০১৯। জীবনস্মৃতি মধুময় জীবনের ধূলি।
ঢাকা: কথাপ্রকাশ
Ramchandra Guha.2014. Environmentalism A global history. Penguin

দ্বিজেন শর্মা-উত্তর পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্রচর্চা প্রসঙ্গে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এমনই একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। তাঁর অভিমত, যেভাবে দ্বিজেন শর্মাকে মূল্যায়নের কথা ছিল, সেভাবে করছি না। আসলেই আমরা তা করছি না। কারণ, তাঁর কাজের প্রয়োজন আমরা অনুধাবন করিনি। এ সমাজ সেই বোধ থেকে অনেক দূরে, তা স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই। সবাই জানেন, প্রকৃতির সঙ্গে মানবসমাজের সম্পর্কের ধারণা, জ্ঞান, বোধ জন্মে পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য থেকে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা থেকে। তৃতীয়ত, এর মূলে আছে নিরন্তর আত্মোপলব্ধি। নিয়তি হলো, এ তিনের অনুপস্থিতির ভূগোলে আমরা অবস্থান করছি। কারণ, প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে, তাদের অবস্থান, জীবনযাপন আমরা হিংসা করি। প্রাকৃতিক ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদে আনন্দ পাই, বিনাশে উৎসব করি। প্রকৃতির উপাদান সংহারকর্মকে আমরা পরম নির্ধারিত বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয়ের সমর্থন নিয়ে আমরা এ বিনাশকর্ম সম্পাদন করি। সোফিস্ট দার্শনিক, আঠারো-উনিশ-বিশ শতকের আলোকসম্পাত ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি উদ্ভূত চিন্তার কেন্দ্র হলো মানুষ। ফলে এর সমর্থন নিয়ে মানবসমাজের অবনমন ভাবনা এ প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। দখলি শক্তি ও ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন অসহিষ্ণুতার স্রোত প্রজন্মান্তরে ক্রিয়াশীল। এর আলোকে বিশ্বের উদ্ভিদ, প্রাণী ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আমরা গ্রাহ্য করি না। অস্বীকারের সংস্কৃতি আমাদের জীবনের সামগ্রিক আচারাদি ও মস্তিষ্ককে দখল করে নিয়েছে। ফলে দ্বিজেন শর্মা ব্যক্তি ও তার প্রকৃতি-পরিবেশ চিন্তার সঙ্গে দখলীকৃত, বৈরী সাংস্কৃতিক আবহ এবং চর্চা খাপ খাওয়ানো দুঃসাধ্য। কারণ হলো, সামষ্টিক আঁধারচর্চা অন্যতম অবলম্বন, সেখানে প্রকৃতি, পরিবেশচিন্তা একধরনের অপ্রত্যাশিত, অন্যায্য কর্ম বলে আমরা জানি। নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রথাগত শৃঙ্খলে বন্দী থাকতে পছন্দ করি। ওই সাংস্কৃতিক উপনিবেশে একজন ব্যক্তির রুচিবোধ ও জীবনের সারার্থ উপলব্ধি করি।
ফলে, এজাতীয় শৃঙ্খলিত ভাবাচারের সাংস্কৃতিক জীবনে বাস্তুতান্ত্রিক চিন্তা না থাকারই কথা। পরিণাম ও অবশেষে বন্দিত্বের আনন্দে দ্বিজেন শর্মার মতো ব্যক্তি সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং নামও ভুলে যাওয়া। যে প্রকৃতি পরিবেশ আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন, তাকেই আমরা ধ্বংস করছি। তা করতে যুক্তি, বাসনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের আয়োজন করি। এমন পরিস্থিতিতে দ্বিজেন শর্মার কথন, বয়ান ও কর্মতৎপরতা উচ্চারণের মানে হলো, নিজের বিরুদ্ধে যাওয়া। তিনি যা-কিছু বলেছেন, এর গুরুত্ব আমরা বুঝি না, বুঝতে চেষ্টাও করি না। আমাদের সবকিছু যেন ম্লান হতে শুরু করেছে, নিরর্থক হতে শুরু করেছে। পারিপার্শ্বিক গতির সঙ্গে অবস্থান করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি চারপাশ, মাটি ও প্রকৃতির গুরুত্ব, মূল্য। দ্বিজেন শর্মা কী কামনা করেছেন তাঁর জীবনচর্চা ও লেখালেখিতে। সারাটা জীবন তিনি কাটিয়েছেন প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে। তাঁর মনে, মননে, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে, চিন্তাভাবনায় কেবল ছিল নিসর্গ। ফলে চারপাশের পরিবেশদূষণ, বিপর্যয়ে তিনি খুব বিষণ্ন হতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন নিসর্গ সংরক্ষণ ও প্লানেটারি শৃঙ্খলার কথা।
স্মৃতিতে সতত নিসর্গ
জীবনের প্রয়োজনে একপর্যায়ে গেলেন সেকালের সোভিয়েত ইউনিয়নে। মস্কোতে অবস্থানকালে স্মরণ করেছেন বাল্য-কৈশোরে দেখা পাথারিয়া-মাধবকুণ্ডের নিসর্গ। যে প্রকৃতির আবহে নিজেকে নির্মাণ করেছেন। অবশ্য তাঁর মতো ব্যক্তির পক্ষে যা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ‘জলমর্মর নৈঃশব্দ্যের গভীরতা বাড়ায়। আমি বসেই থাকি। ভয়ের কিছু নেই। কাছেই খাসিয়াদের বাড়ি, পানের জুমখেত। তাদের বৌ-ঝিরা ছড়া থেকে জল নিচ্ছে।...বারুণীস্নানে লোকের ভিড়, দিগম্বর সন্ন্যাসী দেখার কৌতূহল, ভিনগাঁয়ের লোকদের সঙ্গে হঠাৎ দেখার চমক, পূজা-আর্চা, মায়ের আঁচল ধরে চৈত্রমেলায় ঘুরে বেড়ানো, পাগল করা বাঁশির সুর, ফেরিওয়ালার কাঁধের লাঠিতে গাঁথা সোলার পাখির ওড়াউড়ি, ময়রার দোকানের প্রলুব্ধকর সওদা...’ [২০১৩ (২): ১০৬]
প্রসঙ্গত দ্বিজেন শর্মার ‘জীবনস্মৃতি: মধুময় জীবনের ধূলি’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। পরিণত বয়সে যা কিছু সম্ভব স্মরণ করতে চেষ্টা করেছেন তিনি। স্মৃতিতর্পণের বিভিন্ন প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন শৈশব-কৈশোরের নানা কথা ও বিবরণ। যেসব বিবরণে উঠে এসেছে ব্যক্তিগত স্বপ্ন, প্রতিবেশী, সমন্বিত সহিষ্ণু জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, সোভিয়েত পর্ব, লেখাপড়ার নানা প্রসঙ্গ ও জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাঁর অর্জন বিসর্জনের কথা। এসবের মধ্যে রূপায়ণ করেছেন প্রকৃতি, বিশেষত বাস্তুতন্ত্রের সাথে তাঁর সম্পর্ক, বোঝাপড়া ও এ সম্পর্কের বাস্তবতা। লক্ষণীয় সেই কৈশোরেই প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক তিনি গড়ে তোলেন। কারণ, ওই সময়ে বিনোদন বা আনন্দ যা-ই বলি, এর সবকিছু ছিল প্রকৃতিকেন্দ্রিক। পূজা-পার্বণ, উৎসব উদ্যাপনের উপাদান সংগ্রহ ও তৈরি হতো প্রকৃতির উপকরণে। যান্ত্রিক জীবনযাপনের অনেক আয়োজন তখনো গ্রামে পৌঁছায়নি। যে কারণে সাধারণ মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। এ নিসর্গের প্রতি মানবসমাজ এক অধ্যাত্ম ভালোবাসা, প্রেম অনুভব করত। তাঁর বাড়ির কাছে অবস্থিত পাথারিয়া পাহাড়, অদূরে হাকালুকি হাওর, যে পর্যন্ত বিস্তৃত সমতল। ‘গ্রামের বুক চিরে বহমান ছোট নদীটির নাম নিকড়ি। শীতে হাঁটুজল, বর্ষায় প্রমত্তা, ঘূর্ণিসহ ঘোলাজলের প্রবল তোড়ে ভয়ঙ্করী।...আমরা নদীতে বড়শি ফেলতাম। বেছে নিতাম জুৎসই জায়গা, কাশবনের কাছে, তাতে বাসা বানাত লাল রঙের মুনিয়া, পেছনে মাঠ, পশ্চিমের আকাশ, তাতে অপরাহ্ণের রঙ। মৎসবতী নদী শূন্য হাতে ফেরাত না, ধরা পড়ত পুঁটি, টেংরা, গোলসা, বাইনের বাচ্চা।’ [শর্মা ২০১৯: ১৭]
আমরা জানি, পরম্পরায় শিমুলিয়াস্থ বাড়িটি কবিরাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল। সত্যিকারভাবে ছিল কবিরাজবাড়ি। এ বাড়ির চারদিকে সকালবেলা তাঁর বাবা খালি পায়ে হাঁটতেন, সাথে তিনিও। যত্ন নিতেন প্রকৃতির। কবিরাজির প্রয়োজনেই বাড়িতে অশোক, অর্জুন, আমলকী, হরীতকী, বয়ড়া, স্বর্ণচাপা, বকুল, নাগেশ্বর, আম্বলতম, শীতপুষ্পা শিমুল, কনকচাঁপা, কামিনী, টগর, শেফালী, কালো বসাক, ছাতিম, গোলাচি, কমলাগুঁড়ি, কন্টিকারি, বালা, বিশল্যকরনী, জয়পালসহ বিভিন্ন ধরনের ফলদ, বনজ ও ভেষজ গাছ, লতাগুল্ম আবাদ করতেন। যে কারণে তাঁকে আলাদাভাবে আর এসব বৃক্ষরাজির সঙ্গে পরিচয়ের প্রয়োজন পড়েনি বা পাঠ নিতে হয়নি। বাড়ির কাছের পাথারিয়া পাহাড় ছিল তখন বনারণ্য। সে সময় এ পাহাড়ি এলাকায় অন্য প্রাণীর সাথে বাঘও পাওয়া যেত। ‘পাথারিয়া পাহাড়ে ছিল নিবিড় ও গভীর অরণ্য। জনবসতি অতি নগণ্য। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই এলাকায় ফাঁদে-ধরা বাঘ ছাড়া কোনো বাঘ দেখিনি, একবার শুধু ছড়ার পারের বালুতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছিলাম। দূর ও কাছে থেকে অনেক বন্যজন্তু দেখেছি; শূকর, সজারু, বনরুই, মায়াহরিণ, গুলিবিদ্ধ সম্বর, সাধারণ বানরের দঙ্গল, হনুমান, উল্লুক, সম্ভবত রামকুত্তা এবং নানা জাতের সাপের সঙ্গে ভয়ঙ্কর শঙ্খচূড়। পাখির কোনো গনাগুনতি ছিল না।...’ [২০১৯: ৫২-৫৩]
পারিবারিক বাগানকর্মী শোভাবুড়ার কাছে শিখেছেন তির-ধনুক চালনা, পাখি শিকার। বনজ বৃক্ষরাজি আরও প্রাণিকুলের পরিচিতি জেনেছেন তাঁর কাছে। শোভাবুড়ার কাছেই দীক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতির, পাহাড়, রহস্যময় জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। শিখেছেন কীভাবে বন থেকে খাবার সংগ্রহ করা যায় পরিবেশের বিদ্যমানতা অক্ষুণ্ন রেখে। কারণ, ‘এই প্রকৃতিপুত্ররা চিরদিনই গরিব মানুষ, কিন্তু অশেষ ধৈর্যশীল। স্মর্তব্য, দুর্ভিক্ষে বনই তাদের বাঁচিয়ে রাখে।’ [২০১৯: ৫৫] যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন কখনো একাডেমিক প্রয়োজনে, কখনো মনের তাগিদে ঘুরে বেড়াতেন বৃক্ষ, ফুল, বাগান অথবা রমনা উদ্যান ও বলধা গার্ডেনে। খুঁজে নিয়েছেন জানা অজানা গাছের নমুনা। তাঁর কথায়, ‘এ এক রাজকীয় পরিবেশ শ্যামলিমা ঢাকার বিশাল চত্বর, মোগল স্থাপত্যের কার্জন হল, পরিপূর্ণ জলাশয়, সুশোভন বোটানিক গার্ডেন, লাল ইটের ছাত্রাবাস, রেসকোর্স, রমনাপার্ক সব মিলিয়ে এক স্বপ্নভূমি।’ [২০১৯: ৯৪]
শিক্ষাজীবন শেষ হলে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে চলে গেলেন বরিশাল বিএম কলেজে। সেখানেও তিনি তার সন্ধিৎসু মন খুঁজেছে নিজের পছন্দসই বাগান ও প্রকৃতি। তিনি পেয়েও গেলেন সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ। তিনি লিখেছেন, ‘দু’কামরার একটি আধা-পাকা টিনের ঘর, পেছনে কয়েকটি নারকেল গাছ, সামনে উঠান, তারপর নদীর মতো লম্বা একটি পুকুর, ওপারে বিস্তৃত ধানখেত, শেষে গ্রাম ও গোরস্থানের ওপরে অনেকগুলি শিরীষ গাছ। সূর্যোদয় সূর্যাস্ত শিরীষবনের ওপর রঙ ছড়াত, চেয়ে থাকতাম মুগ্ধ হয়ে। উঠানে লন বানালাম, পুকুরপারে লাগালাম নানা রঙের কলাবতী, এক পাশে কয়েকটি গোলাপ, ঘরের গা-ঘেঁষে জুঁইফুলের লতা, পুকুরে রক্তকমল ও রক্তপদ্ম। উত্তর পাশে একটি পোড়ো ভিটা ছিল, হয়তো এককালের রান্নাঘর, সেখানে উঠালাম গ্রীনহাউসের মতো কিছু-একটা, জড়ো করলাম কিছু অর্কিড, ক্যাকটাস ও টবের গাছ ফার্ন, ড্রাসিনা, পাতাবাহার।’ [২০১৯: ৯৭]
এভাবে যা করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। বিদেশে গিয়ে সন্ধান করেছেন বাগান, উদ্যান ও প্রকৃতির আবহ। তাঁর কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি করে তিনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করেছেন। বিশ্বের খ্যাত বিভিন্ন উদ্যান, বাগান, ভ্রমণ করেছেন এ বিষয়ে সাম্প্রতিক ধারণা অর্জনে। তিনি নিজে সোভিয়েত ইউনিয়নে বাসকালে বাগান তৈরি ও ফল চাষ করতেন। এমন স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘প্রত্যেক বাড়ির নিচের বাগানে মৌসুমি ফুল লাগাতাম। একটি নির্দিষ্ট নকশা ছিল; পেছনে লাল স্যালভিয়া, তারপর যথাক্রমে হলুদ ও গাঁদা, এরপর সাদা ও নীল লবেলিয়া। শেষে একফালি সরু বাঁকানো লন।...স্থায়ী বাগানটিও একসময় নজরকাড়া হয়ে উঠেছিল, ফুটেছিল প্রিমরোজ, বহুবর্ষজীবী ভার্বেনা, ব্লুবেল কয়েক জাতের লিলি। বুনো আপেল, নাশপাতি, চেরি গোলাপগোত্রের ফুলগুলিও চমৎকার।’ [২০১৯: ১৮৬]
নান্দনিক নিসর্গ
সারা বিশ্বে পুঁজির বিকাশ ধাবমান। ফলে এ পরিস্থিতিতে শিল্পায়ন, রিয়েল এস্টেট বাণিজ্য এবং একই সঙ্গে সৌন্দর্যভাবনা খুব জটিল। দ্বিজেন শর্মা একালের যাবতীয় চারিত্র্যকে অস্বীকার না করেও ইকোলজির কথা বলেছেন। সব সময়ই তিনি অনুভব করতেন প্রকৃতির মায়া। ঢাকা মহানগরের গাছপালার প্রজাতি, নাম ও পরিচিতি নিয়ে চমৎকার বই হলো শ্যামলী নিসর্গ। এর পেছনে তাঁর কথা হলো, ঢাকা শহরের পুরোনো অনেক গাছই এখন দেখা যায় না। এর মধ্যে আবার নতুন নতুন গাছ সংযোজিত হয়েছে। এসব গাছগাছালি নিয়ে এ গ্রন্থ রচিত। বৃক্ষ পরিচিতির প্রতিটি শিরোনামেই রয়েছে খ্যাতিমান লেখকদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি। যেমন,
১. কাঁটাতে আমার অপরাধ আছে
দোষ নাহি মোর ফুলে,
কাঁটা, ওগো প্রিয়, থাক্ মোর কাছে,
ফুল তুমি নিয়ো তুলে। [ক্যাকটাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০১৩ (৩): ৯৪]
২. নব কুসুম্ব পুষ্পবরণ সিঁন্দুরসম রাঙা
অগুন প্রবল পবনে দ্বিগুণ জ্বলে
ব্যাকুল অনল অটবীলতারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে
ধরনীতে ঘিরি দাহ করে পলে পলে। [কুসুম, স্লিচেরা ওলিওসা, কালিদাস ২০১৯: ১৬০]
এভাবে পরিচিতি বর্ণনার কারণ হলো সহজ ও সরলভাবে উদ্ভিদজগৎকে উপস্থাপন। তিনি জানেন, বৈজ্ঞানিক নামসহ ও নিছক একাডেমিক ভাষা ও বৃক্ষবিজ্ঞানের পরিভাষায় বিবরণ দিলে এসব কেউ পাঠ করবে না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমত: সাধারণ পাঠকের কাছে বার্তা পৌঁছানো, দ্বিতীয়ত: পরিবেশ, বাস্তুবিদ্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। বস্তুত সাধারণ পাঠক যেভাবে দ্বিজেন শর্মার রচনাকে গ্রহণ করেছে, তা বিস্ময়কর। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, সাধারণত উদ্ভিদবিদ্যা, বাস্তুতন্ত্রবিষয়ক কোনো লেখা তত্ত্ব পাঠ করতে মানুষ অনাগ্রহী। দ্বিজেন শর্মা তাঁর লেখা ও তৎপরতার মাধ্যমে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি ও আন্দোলন তৈরি করতে সক্ষম হন। যে ক্ষেত্রে কেউ কোনো বিরোধ মনে করেনি বা আহত বোধ করেনি। আবার যেকোনো পাখি-ফুল-বৃক্ষ বন্দনায়ও তাঁর সৃষ্ট সহজবোধ্য, আকর্ষণীয় ভাষা প্রয়োগ লক্ষণীয়। যে বর্ণনায় ঋতুবৈচিত্র্য, সমকালিক প্রকৃতির আবহ ও নিসর্গের প্রতি মায়া সৃষ্টিতেও যে ভাষা আন্দোলিত করে। যেমন, ‘‘কদম বর্ষার দূত: এই নিবিড় অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম। কোনো বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় যখন ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ ফোটে, দমকা হাওয়ায় একঝলক গন্ধ জানালা গলিয়ে ঘরের স্তব্ধতাকে চকিত করে, আমরা তখনই বর্ষার সুগভীর আহ্বানের অর্থ উপলব্ধি করি। কী নিবিড়, কী প্রগাঢ় আর আর দূরবাহী এই সুগন্ধ! বিশাল এই তরুর অজস্র প্রস্ফুটনের গন্ধমদির বর্ষার ভেজা বাতাস আমাদের মনে যে মধুর অনুরণন তোলে, তার তুলনা নেই। কদম আমাদের অনুপম প্রকৃতির আত্মজ। বর্ণে-গন্ধে-সৌন্দর্যে কদম এ দেশের রূপসী তরুর প্রথমদের অন্যতম।’ ‘তা ছাড়াও বাংলাদেশের নিজস্ব বৃক্ষরাজির পরিচয় দিতে লিখেছেন ভিন্ন প্রবন্ধ ‘বাংলার তরুলতা’। এমন শনাক্তির কাজে তাঁকে ঘুরতে হয়েছে দেশের নানা প্রান্ত।
প্রয়োজনীয় বাগান ও উদ্যান
বাগান, জঙ্গল ও উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো ছিল তাঁর নেশা। দেশ, বিদেশে যেখানেই গেছেন, সেখানেই তিনি সংশ্লিষ্ট বনভূমি, বাগান ও উদ্যান অবলোকনের চেষ্টা করেছেন। কারণ, একালে যান্ত্রিক জীবনের বাড়াবাড়ি, বা শিল্পোন্নয়নের তাড়না বনভূমি ও বাগানের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। ফলে আগের মতো কেউ বাগান নির্মাণে স্থিত নয়। যে কারণে তিনি বাগানকে বলেছেন নকশাবদ্ধ শিল্পকর্ম। যেখানে অনেকেই বাগান তৈরিতে ভূমি, স্থান ও পরিমিতি অনুযায়ী বাগানের জ্যামিতিক নকশা সুপারিশ করে থাকেন। ফলে, গাছ লাগালেই বাগান হয় না। লক্ষণীয়, বাগানের সৌন্দর্যে পরিমিত বর্ণপরিকল্প, প্রাকপ্রস্তুতি, গাছ ও ফুল লাগানো, সার প্রয়োগ, সেচ, গাছ বা ফুলের অসুখ হলে যত্ন ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমন্বিত পরিকল্পনা ও জানাবোঝার প্রতিফলনে নান্দনিক বাগান তৈরি করা যায়।
উপসর্গ যা-ই থাক, বাগান ও উদ্যান তৈরিতে মানুষ সব সময়ই ক্রিয়াশীল। এর মৌল কারণ হলো প্রকৃতির সাথে মানবসমাজের গোপন সম্পর্ক। এ সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। পুরোনো কাল থেকেই উদ্যান তৈরির প্রতি মানুষের উদ্যোগ লক্ষণীয়। কিন্তু তা প্রকাশে অনেকেই দ্বিধান্বিত। মানুষের কারণেই এ জীবজগতের অনেক কিছুই ধ্বংস হয়েছে, এখনো হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য যে, মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতে দ্বিজেন শর্মা লক্ষ করেছেন বন ধ্বংসের মাত্রা। প্রতিবছর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় ১ কোটি ২০ লাখ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে।
অতএব বাস্তুতন্ত্রকে বজায় রাখতে গেলে যা যা করা দরকার, তা হলো চারপাশের প্রতিবেশকে তার মতো বজায় রাখা। বস্তুত এ উপমহাদেশে উদ্ভিদজগতের তথ্য সংগ্রহ, বাগান ও উদ্যান নির্মাণের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। এর আলোকেই তিনি বাগান সৃষ্টিতে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। চারপাশে ধ্বংস ও বিনাশের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে সংরক্ষণমুখী সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। লক্ষণীয় এখন শখের তাগিদে শুধু বাগানের প্রতি আগ্রহী নয়। মানবসমাজের সার্বিক বিবেচনায় এখন বৃক্ষরোপণে সবাই মনোযোগী। সংরক্ষণের প্রযোজনীয়তা বিষয়ে তাঁর কথা হলো: ‘(১) ভবিষ্যৎ ব্যবহারের পক্ষে বাছাইয়ের অধিকার তথা জিনভান্ডার অক্ষুণ্ন রাখা, (২) বৈজ্ঞানিক রেকর্ডগুলো না হারানো, (৩) উত্তরাধিকার অটুট রাখা অর্থাৎ শিক্ষামূলক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ও রোমান্টিক উপাদানগুলো টিকিয়ে রাখা, (৪) বৈচিত্র্যের ধারণা লালন, (৫) মানুষ ও সহায় সম্পদের মধ্যকার অতিগুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলো না খোয়ানো।’ [২০১৩ (২) : ৬৮]
গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি, আবহাওয়া, মাটি বিবেচনায় বৃক্ষরোপণ ও বাগান করা প্রয়োজন। সড়ক, মহাসড়কের ঢালু জমিতে গাছ লাগানোতেও তাঁর সুপারিশ হলো, ‘মহাসড়কের পাশে গ্রামের শিশুদের জন্য জাম-আমলকী-জাতীয় ছোট ছোট ফলের গাছ লাগানো উচিত।’ পরিবেশ রক্ষা ও প্রয়োজনের তাগিদে তিনি বন ও উদ্যানের প্রতি খুব আকৃষ্ট ছিলেন। যেখানেই গেছেন, সেখানের উদ্যান ও বাগানের বিষয়ে তিনি ছিলেন আগ্রহী। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখেছেন, ‘কানাডা ও স্পেনের বাগানে গুরুত্ব পেয়েছে তাদের নিজ নিসর্গ। মার্কিন বাগানে সমন্বিত হয়েছে বনভূমি ও কাঠব্যবসা। মিসর ও ইতালির বাগানে আছে ঐতিহ্যবাহী পুরাদ্রব্যসম্ভার। গ্রিস তার বাগানে নিজ নিসর্গের সঙ্গে যোগ করেছে মহাকাব্যবর্ণিত গাছপালা। চীন ও জাপান এনেছে নিজস্ব উদ্যানশৈলী। অস্ট্রেলিয়ার বৈশিষ্ট্য হলো তার ‘নিজস্ব উদ্ভিদসম্ভার’ [২০১৩ (২): ১২১]
তিনি লক্ষ করেছেন এখানে বাগানের বিষয়ে উদাসীনতা। কোনো ডিজাইন বা নকশার কেউ তোয়াক্কা করে না। বাগান হিসেবে যেনতেন গাছ লাগালেই হলো। বৃক্ষ নিধন করে আবার বৃক্ষরোপণের কথা বলে তাড়াহুড়ো বাগান করার একধরনের মানসিকতা লক্ষণীয়। মূলত এগুলো ‘না-বন না-বাগান’। বাগানের ক্ষেত্রে ইকোসিস্টেমের দিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে না। যেমন একসময় বাংলাদেশে গণহারে লাগানো হয়েছে ইউক্যালিপটাস, চাষ করা হয়েছে মনোকালাচারের মাছ। এতে মাটি ও আবহাওয়ার দিকে নজর রাখা হয়নি। এ সমস্যা আরও বেড়েছে দারিদ্র্যের কারণে। এ ক্ষেত্রে জলাভূমি ও বনভূমি রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। যাতে মানুষ মনে করে এর মালিকানায় তার সংশ্লিষ্টতা আছে। একই সঙ্গে উপলব্ধি করতে হয়, বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে এ প্রকৃতির বিকল্প নেই। বাগান, বনাঞ্চল, উদ্যান নির্মাণে দেশ ও বিদেশে মনোকালচার বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা তার অভিমত নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া নগর ও শহরে বৃক্ষ নির্মাণে প্রচলিত ধারণাকে তিনি তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছেন। যা অবশ্যই পরিবেশ সংরক্ষণের সহায়ক নয়, যদিও বলা হয় সহায়ক বা প্রচার করা হয়। আরেকটি বৈশিষ্ট্য দেখা গেল, বন বিভাগের আচরণ ও এই মনোকালচারের বদৌলতে। লক্ষণীয়, বোটানিক গার্ডেন, ইকোপার্ক, সংরক্ষিত বন—সবই বন বিভাগের অধীনে নিয়ে যাওয়া। ‘আমাদের বোটানিক গার্ডেন কীভাবে বন বিভাগের দখলভুক্ত হলো, সে এক রহস্য। কাজটা তো তাদের নয়। বোটানিক গার্ডেন কার্যত একটি একাডেমি, একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তাতে থাকবে হার্বেরিয়াম, মিউজিয়াম, গবেষণাগার ও লাইব্রেরি। এটি পরিচালনা করবেন উদ্ভিদবিদ ও উদ্যানবিদেরা।’ [২০১৩ (২): ২৭০]
এর মধ্যে তিনি ইতিবাচক কিছু কাজ বিশ্বব্যাপী লক্ষ করেছেন। মানুষ যেখানে শূন্য জায়গা পাচ্ছে, সেখানে বৃক্ষ রোপণ করছে বা বাগান তৈরি করছে। আমাদের দেশেও জীববৈচিত্র্য রক্ষার তাগিদে বনায়ন, সংরক্ষণের কর্মসূচি চলমান রয়েছে। তবে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এসব ইকোপার্ক, বন ও উদ্যান না লাগছে গবেষক ও শিক্ষার্থীদের কাজে, না লাগছে পরিবেশ রক্ষার কাজে। শুধু সীমাবদ্ধ হয়ে আছে বিনোদন ও অর্থ সঞ্চয়ের প্রয়োজনে। ইকোপার্কের নামে যা করা হচ্ছে, এর পরিণাম কী দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘কৈশোর থেকে দেখা আমার অতিচেনা অরণ্যনিসর্গের সঙ্গে এ সবই বড় বেমানান। বাড়ির পথ ধরি। হাঁটতে হাঁটতে অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত বন, ইকোপার্কের কথা ভাবি। এগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। যতটুকু জানি, এগুলোর কোনোটাতেই বিদ্যমান গাছপালার বাইরে অন্য কিছু লাগানো যায় না। অথচ এখন বড়ই প্রয়োজন দেশি বৃক্ষের এক বা একাধিক একক সংগ্রহ গড়ে তোলা। কাজটি বোটানিক গার্ডেনেরও এক্তিয়ারভুক্ত নয়।...কিন্তু আমি নিশ্চিত, ইতোমধ্যে এসব বনাঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে অনেক প্রজাতির গাছগাছালি, লতাগুল্ম। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।’ [২০১৩ (২): ২২৪]
বাস্তুতন্ত্রের বোঝাপড়া
জীবন বাস্তবতা থেকে তিনি উচ্চারণ করেছেন পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্র রক্ষার তাগিদ। প্রকৃতির সাথে মানবসমাজকে জড়িয়ে রাখার সহজ ও সাবলীল পন্থা হলো শিশু কৈশোর থেকে প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক রচনা করা। যা তিনি নিজে উপলব্ধি করেছেন। তিনি এর বর্ণনাও দিয়েছেন। তাঁর বাড়ির কাছে পাথারিয়া পাহাড়ে যেতে যেতে লক্ষ করতেন বুনো শূকরের চলাফেরা, বানরের লাফ, বনমোরগের ডাকাডাকি, বিচিত্র পাখির ওড়াউড়ি। যা থেকে তিনি প্রথমত পাখিসমাজের সঙ্গে পরিচিত হন। বাস্তুতন্ত্রের আলোচনায় বলেছেন প্রাসঙ্গিক অস্তিত্ব ও অভিযোজন প্রক্রিয়ার কথা। ফলে ‘অস্তিত্বের সংগ্রাম’ প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসেছেন। এ প্রসঙ্গ প্রধান হয়ে ওঠার কারণ হলো মানুষের দখলদারির আলোকে প্রকৃতি দখল, নিয়ন্ত্রণ। একই সঙ্গে অতিমাত্রায় প্রকৃতির ব্যবহার থেকে এখন প্রকৃতির বিকল্প হওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করি। এ দৃষ্টিভঙ্গি মূলত প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে। আমাদের দেশে জনসমাজের বৃহদাংশ এখনো পরিবেশ, এর ওপর চাপ ইত্যাদি খুব একটা বোঝেন বলে মনে হয় না। ফলে না-বুঝে, না-জেনে বন ও সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনাকে দায়িত্বশীলেরা নিজের মতো সাজিয়ে নিচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে জীববৈচিত্র্য। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘রাচেল কারসন’-এর উপন্যাস নিথর বসন্ত [silent spring]-র উদাহরণ দিয়েছেন।
সকলেই জানেন, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির সঙ্গে অমানবিকতার সম্পর্ক রয়েছে। তা হলে বোঝাই যায় বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে, প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে যারা সক্রিয় আছে, তারা অনিবার্যভাবেই মানবিক। যারা শুধু বাণিজ্য বোঝে, উৎপাদন বোঝে, তারা কখনো প্রকৃতির মূল্য দেয় না। এ ছাড়া বাস্তুতন্ত্রের সমতাও খেয়াল করে না। অথচ জীববৈচিত্র্য, জীবনচক্রের শৃঙ্খলে মানুষ পরস্পর সম্পর্কিত। যে ক্ষেত্রে উদ্ভিদ বা এই লতাগুল্ম এ সম্পর্ক রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জন্য বলা হয় এ প্রকৃতি ও মানুষ এক এবং অবিচ্ছিন্ন। ফলে এক অনিবার্য, চেতনার ঐক্য বিদ্যমান। যা থেকে আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারি না।
বিচ্ছিন্ন কর্মপ্রয়াসের ফলেই প্রকৃতির মধ্যে বিরূপ পরিস্থিতি ও অসংগতি তৈরি হয়। ‘যেখানে পাহাড় চিরে-খুঁড়ে গাছের আবাদ বানানো পাহাড়ের স্থিতি ও পরিবেশের জন্য বিপর্যয়ী হবে, তা তো বলাই বাহুল্য। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে দূরের পাহাড়টি দেখি। সেই গাঢ় নীল এখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সবটাই এখন খালি, ধসের চিহ্নও স্পষ্ট। গোটা ব্যাপারটা সম্পর্কে ভেবে কোনোই ইতিবাচক সম্ভাবনা আঁচ করতে পারি না। এই বিশাল এলাকা বনশূন্য হলে বন্য প্রাণী ও পাখিরা যাবে কোথায়? আমরা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা নিয়ে যত কথা বলি, কিন্তু কার্যত চলি উল্টো পথে। কেন এমনটি ঘটে? এই অসংগতির উৎস কোথায়?’ [২০১৩ (২): ৩৩৯]
একালে শিল্পায়ন ব্যতীত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাস্তবতা হলো শিল্পায়নে সাধারণ প্রকৃতির ওপর এর প্রভাব পড়বেই। যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রভাবের ফলে কৃষিকাঠামো, সংস্কৃতি ভেঙে ও বদলে গেছে। প্রকৃতি থেকে লুণ্ঠন বেড়েছে, কিন্তু তা রক্ষায় চেতনার উন্নতি হয়নি। তবে শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে আমরা পরিবেশ বিষয়ে একেবারে উদাসীন থেকে যাচ্ছি। ফলে পরিবেশদূষণ বিষয়ে যা কিছু আয়োজন চলছে, তা হচ্ছে সগৌরবে। এ প্রসঙ্গে বরি কমোনার বলেছেন, It is economic motivation that has impelled the sweeping anti-ecological changes in the technology of production that have occurred since the Second War. These changes have turned the nation’s factories, farms, vehicles, and shops into seed-beds of pollution; nitrates from fertilizer; phosphates from detergents; toxic residues from pesticides; smog and carcinogenic exhaust from vehicles; the growing list of toxic chemicals and the mounds of undegradable plastic containers, wrappings and gewgaws from the petrochemical industry.
প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি লক্ষ করেছেন, আমরা সমতলভূমি ছাড়িয়ে জলাভূমি পর্যন্ত লুণ্ঠনাক্রান্ত মানসিকতার প্রমাণ দেখছি। এখানে বন, পরিবেশ, জল, মৎস্য রক্ষা করতে কিছু দাপ্তরিক কর্মসূচি লক্ষণীয়, কিন্তু আন্তরিকতা একেবারে অনুপস্থিত। যেসব কাজে গভীর চিন্তা বা কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। অনেক ক্ষেত্রে মনোকালচারজাত উৎপাদন বা দ্রুত উৎপাদন ও বাজারে আর্থিক লোভলাভে অস্থির মানবসমাজ। এতে প্রাকৃতিক জলাভূমি, বনাঞ্চল ধ্বংস করছি নিরুদ্বিগ্ন। সেখানে পরিবেশের কী হলো বা হচ্ছে, এ বিষয়ে কারও কোনো চিন্তা একেবারে নেই। দ্বিজেন শর্মার পর্যবেক্ষণ হলো: ‘একদা পড়ে থাকা অগভীর বিস্তৃত জলাভূমিগুলো আর নেই, এগুলো চাষের আওতায় এসেছে, ছোট মাছের বংশবৃদ্ধিও এলাকা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অধিকন্তু রাসায়নিক সার, কীটঘ্ন ও বোরো ধানের খড় পচার সমস্যা তো রয়েছেই। তবে সবচেয়ে মারাত্মক একটি উপসর্গ জুটেছে প্রযুক্তি প্রসারের কল্যাণে পাম্প দিয়ে বড় বড় জলাশয়, নদী খাত শুকিয়ে মাছের ঝাড়বংশ উজাড় করে ফেলা। এটা আগে সম্ভব হতো না। এতে মাছই শুধু কমছে না, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও।’ [২০১৩ (২): ১৭৭]
বলা বাহুল্য, বাণিজ্যপুঁজির সচলতায় পরিবেশকে তত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন আসে, আত্মঘাতী উন্নয়ন কি খুব জরুরি? যেখানে পুরো ইকোসিস্টেমকে কোনো পাত্তাই দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু পৃথিবীর যে পরিস্থিতি লক্ষণীয়, তাতে তাঁর ধারণা, ‘হোমোসেপিয়েন্স শেষ পর্যন্ত একটি বিপন্ন প্রজাতিতে পর্যবসিত হতে পারে’। তাঁর পর্যবেক্ষণে আগে ঘটবে পৃথিবীগ্রহের ধ্বংস, একই সঙ্গে ঘটবে মানব প্রজাতির বিলুপ্তি। তিনি দেখেছেন, বিশ্বে ও দেশে প্রকৃতির সামূহিক বিনাশে অর্থমূল্য ভাবা হলেও ইকোমূল্য বিবেচনা করা হচ্ছে না। বন বা জলাভূমির বাস্তব্যতন্ত্র একটি জটিল তথা সমন্বিত সত্তা আর সেটা বদলানো আখেরে মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। বনের জীবসম্পদের গুরুত্ব ভৌত-মূল্যে কতটা নির্ধার্য? আপাতদৃষ্টে অপ্রয়োজনীয় একটি প্রজাতির সম্ভাব্য মূল্য আমরা কতটা জানি। যে গুল্ম এই মুহূর্তে একটি বর্জ্য আগাছামাত্র, তাতে কোনো দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ নেই কে বলতে পারে, তাতে থাকতে পারে এমন কিছু ‘জিন’, যা আমাদের ফসলকে জোগাতে পারে রোগ বা পতঙ্গের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা, বিরূপ পরিবেশে অব্যাহত উৎপাদনশীলতার সামর্থ্য।’ [২০১৩ (২): ২৭৬ ]
পরিবেশজনিত, জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা তৈরি করেছে নয়া পুঁজিবাদের বিবিধ প্রতিক্রিয়া। পুঁজির নানা ধরনের উপজাত বিষয়ের ক্রিয়ায় বিশ্বপ্রকৃতির নানা বিলয় ঘটছে। মানুষ প্রকৃতির বিরোধ যেন প্রকাশ্য এখন। জেনেবুঝে মানুষ প্রকৃতির বিরূপতাকে দিনে দিনে বাড়িয়ে দিয়েছে। পুঁজির কাঠামোর ওপর নয়া উদারবাদের বিষয় হলো ক্রম ভোগবাদের বিকাশ। নয়া উদারবাদের কৌশলই হলো উৎপাদনের বাইরে থাকা জনমানুষকে শুধুই কনজ্যুমার বানানো। এর ফলে পরিবেশ ও প্রকৃতি ক্রম বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এর প্রতিক্রিয়ায় মুক্তির কোনো আশ্বাসই এখন নেই। দ্বিজেন শর্মার পর্যবেক্ষণ হলো: পশ্চিমা বিশ্ব ‘নতুন নতুন পণ্যবস্তুর পর্যাপ্ত উৎপাদন ও যথেচ্ছ অপচয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি করে চলেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ, মেরুতুষার গলন, ওজোন স্তর ক্ষয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লন্ডন-নিউইয়র্ক-টোকিও ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা, জলবায়ুর সম্ভাব্য পরিবর্তনে কৃষির বিপর্যয় ইত্যাদি নিয়ে তারা তেমন ভাবিত নয়, যেন এসব সংকট মোকাবিলার মতো সামর্থ্য আছে।...করপোরেট সংস্থাগুলো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অর্থব্যয়ে অনিচ্ছুক। তারা হন্যে হয়ে তেল গ্যাস খুঁজছে, নতুন নতুন মারণাস্ত্র বানাচ্ছে, বশংবদ রাজনীতিকদের সাহায্যে বিশ্বায়নের নামে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ঘনীভূত করছে, তাতে একধরনের প্রকট নৃকেন্দ্রিকতা, সেখানে কোনো প্যারাডাইম খুবই শিফট খুবই কঠিন।’ [২০১৩ (২): ৩৪৮]
‘বিলম্বে হলেও যখন আমরা উদ্ভিদজগতের সত্যিকার মূল্য উপলব্ধি করছি, তখন যেন পরিবেশ পুনর্নির্মাণে আমাদের বিবেচনা শুধু উপযোগিতার কয়েকটি মাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, যেন সেখানে সৌন্দর্য, প্রেম ইত্যাদির মতো কিছু অধরা মাধুরীরও প্রবেশ ঘটে, যাতে জীবন পূর্ণতা পায়, উন্নয়ন বহুমুখী হতে পারে।’ [২০১৩ (২): ১৩০] সুতরাং দ্বিজেন শর্মা এ প্রকৃতির বর্ণনায় সৌন্দর্য উপস্থাপন করেননি। একীভূত ধারণায় বাস্তুতন্ত্রের সার্বিক যত্ন ও সংরক্ষণের দায় স্বীকার করেছেন। সত্য হলো, আমরা প্রকৃতিকে না দিয়ে নিচ্ছি কেবলই। এ ক্ষেত্রে তাঁর আহ্বান হলো, জুরাসিক যুগের বিপদ ডেকে আনার আগে এবং বৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব পালন করা কর্তব্য।
তথ্যসূত্র
দ্বিজেন শর্মা। ২০১৩। প্রকৃতিসমগ্র ২। ঢাকা: অনিন্দ্য প্রকাশ-২০১৩। প্রকৃতিসমগ্র ৩। ঢাকা: অনিন্দ্য প্রকাশ-২০১৯। জীবনস্মৃতি মধুময় জীবনের ধূলি।
ঢাকা: কথাপ্রকাশ
Ramchandra Guha.2014. Environmentalism A global history. Penguin
স্বপন নাথ

দ্বিজেন শর্মা-উত্তর পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্রচর্চা প্রসঙ্গে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এমনই একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। তাঁর অভিমত, যেভাবে দ্বিজেন শর্মাকে মূল্যায়নের কথা ছিল, সেভাবে করছি না। আসলেই আমরা তা করছি না। কারণ, তাঁর কাজের প্রয়োজন আমরা অনুধাবন করিনি। এ সমাজ সেই বোধ থেকে অনেক দূরে, তা স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই। সবাই জানেন, প্রকৃতির সঙ্গে মানবসমাজের সম্পর্কের ধারণা, জ্ঞান, বোধ জন্মে পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য থেকে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা থেকে। তৃতীয়ত, এর মূলে আছে নিরন্তর আত্মোপলব্ধি। নিয়তি হলো, এ তিনের অনুপস্থিতির ভূগোলে আমরা অবস্থান করছি। কারণ, প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে, তাদের অবস্থান, জীবনযাপন আমরা হিংসা করি। প্রাকৃতিক ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদে আনন্দ পাই, বিনাশে উৎসব করি। প্রকৃতির উপাদান সংহারকর্মকে আমরা পরম নির্ধারিত বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয়ের সমর্থন নিয়ে আমরা এ বিনাশকর্ম সম্পাদন করি। সোফিস্ট দার্শনিক, আঠারো-উনিশ-বিশ শতকের আলোকসম্পাত ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি উদ্ভূত চিন্তার কেন্দ্র হলো মানুষ। ফলে এর সমর্থন নিয়ে মানবসমাজের অবনমন ভাবনা এ প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। দখলি শক্তি ও ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন অসহিষ্ণুতার স্রোত প্রজন্মান্তরে ক্রিয়াশীল। এর আলোকে বিশ্বের উদ্ভিদ, প্রাণী ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আমরা গ্রাহ্য করি না। অস্বীকারের সংস্কৃতি আমাদের জীবনের সামগ্রিক আচারাদি ও মস্তিষ্ককে দখল করে নিয়েছে। ফলে দ্বিজেন শর্মা ব্যক্তি ও তার প্রকৃতি-পরিবেশ চিন্তার সঙ্গে দখলীকৃত, বৈরী সাংস্কৃতিক আবহ এবং চর্চা খাপ খাওয়ানো দুঃসাধ্য। কারণ হলো, সামষ্টিক আঁধারচর্চা অন্যতম অবলম্বন, সেখানে প্রকৃতি, পরিবেশচিন্তা একধরনের অপ্রত্যাশিত, অন্যায্য কর্ম বলে আমরা জানি। নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রথাগত শৃঙ্খলে বন্দী থাকতে পছন্দ করি। ওই সাংস্কৃতিক উপনিবেশে একজন ব্যক্তির রুচিবোধ ও জীবনের সারার্থ উপলব্ধি করি।
ফলে, এজাতীয় শৃঙ্খলিত ভাবাচারের সাংস্কৃতিক জীবনে বাস্তুতান্ত্রিক চিন্তা না থাকারই কথা। পরিণাম ও অবশেষে বন্দিত্বের আনন্দে দ্বিজেন শর্মার মতো ব্যক্তি সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং নামও ভুলে যাওয়া। যে প্রকৃতি পরিবেশ আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন, তাকেই আমরা ধ্বংস করছি। তা করতে যুক্তি, বাসনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের আয়োজন করি। এমন পরিস্থিতিতে দ্বিজেন শর্মার কথন, বয়ান ও কর্মতৎপরতা উচ্চারণের মানে হলো, নিজের বিরুদ্ধে যাওয়া। তিনি যা-কিছু বলেছেন, এর গুরুত্ব আমরা বুঝি না, বুঝতে চেষ্টাও করি না। আমাদের সবকিছু যেন ম্লান হতে শুরু করেছে, নিরর্থক হতে শুরু করেছে। পারিপার্শ্বিক গতির সঙ্গে অবস্থান করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি চারপাশ, মাটি ও প্রকৃতির গুরুত্ব, মূল্য। দ্বিজেন শর্মা কী কামনা করেছেন তাঁর জীবনচর্চা ও লেখালেখিতে। সারাটা জীবন তিনি কাটিয়েছেন প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে। তাঁর মনে, মননে, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে, চিন্তাভাবনায় কেবল ছিল নিসর্গ। ফলে চারপাশের পরিবেশদূষণ, বিপর্যয়ে তিনি খুব বিষণ্ন হতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন নিসর্গ সংরক্ষণ ও প্লানেটারি শৃঙ্খলার কথা।
স্মৃতিতে সতত নিসর্গ
জীবনের প্রয়োজনে একপর্যায়ে গেলেন সেকালের সোভিয়েত ইউনিয়নে। মস্কোতে অবস্থানকালে স্মরণ করেছেন বাল্য-কৈশোরে দেখা পাথারিয়া-মাধবকুণ্ডের নিসর্গ। যে প্রকৃতির আবহে নিজেকে নির্মাণ করেছেন। অবশ্য তাঁর মতো ব্যক্তির পক্ষে যা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ‘জলমর্মর নৈঃশব্দ্যের গভীরতা বাড়ায়। আমি বসেই থাকি। ভয়ের কিছু নেই। কাছেই খাসিয়াদের বাড়ি, পানের জুমখেত। তাদের বৌ-ঝিরা ছড়া থেকে জল নিচ্ছে।...বারুণীস্নানে লোকের ভিড়, দিগম্বর সন্ন্যাসী দেখার কৌতূহল, ভিনগাঁয়ের লোকদের সঙ্গে হঠাৎ দেখার চমক, পূজা-আর্চা, মায়ের আঁচল ধরে চৈত্রমেলায় ঘুরে বেড়ানো, পাগল করা বাঁশির সুর, ফেরিওয়ালার কাঁধের লাঠিতে গাঁথা সোলার পাখির ওড়াউড়ি, ময়রার দোকানের প্রলুব্ধকর সওদা...’ [২০১৩ (২): ১০৬]
প্রসঙ্গত দ্বিজেন শর্মার ‘জীবনস্মৃতি: মধুময় জীবনের ধূলি’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। পরিণত বয়সে যা কিছু সম্ভব স্মরণ করতে চেষ্টা করেছেন তিনি। স্মৃতিতর্পণের বিভিন্ন প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন শৈশব-কৈশোরের নানা কথা ও বিবরণ। যেসব বিবরণে উঠে এসেছে ব্যক্তিগত স্বপ্ন, প্রতিবেশী, সমন্বিত সহিষ্ণু জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, সোভিয়েত পর্ব, লেখাপড়ার নানা প্রসঙ্গ ও জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাঁর অর্জন বিসর্জনের কথা। এসবের মধ্যে রূপায়ণ করেছেন প্রকৃতি, বিশেষত বাস্তুতন্ত্রের সাথে তাঁর সম্পর্ক, বোঝাপড়া ও এ সম্পর্কের বাস্তবতা। লক্ষণীয় সেই কৈশোরেই প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক তিনি গড়ে তোলেন। কারণ, ওই সময়ে বিনোদন বা আনন্দ যা-ই বলি, এর সবকিছু ছিল প্রকৃতিকেন্দ্রিক। পূজা-পার্বণ, উৎসব উদ্যাপনের উপাদান সংগ্রহ ও তৈরি হতো প্রকৃতির উপকরণে। যান্ত্রিক জীবনযাপনের অনেক আয়োজন তখনো গ্রামে পৌঁছায়নি। যে কারণে সাধারণ মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। এ নিসর্গের প্রতি মানবসমাজ এক অধ্যাত্ম ভালোবাসা, প্রেম অনুভব করত। তাঁর বাড়ির কাছে অবস্থিত পাথারিয়া পাহাড়, অদূরে হাকালুকি হাওর, যে পর্যন্ত বিস্তৃত সমতল। ‘গ্রামের বুক চিরে বহমান ছোট নদীটির নাম নিকড়ি। শীতে হাঁটুজল, বর্ষায় প্রমত্তা, ঘূর্ণিসহ ঘোলাজলের প্রবল তোড়ে ভয়ঙ্করী।...আমরা নদীতে বড়শি ফেলতাম। বেছে নিতাম জুৎসই জায়গা, কাশবনের কাছে, তাতে বাসা বানাত লাল রঙের মুনিয়া, পেছনে মাঠ, পশ্চিমের আকাশ, তাতে অপরাহ্ণের রঙ। মৎসবতী নদী শূন্য হাতে ফেরাত না, ধরা পড়ত পুঁটি, টেংরা, গোলসা, বাইনের বাচ্চা।’ [শর্মা ২০১৯: ১৭]
আমরা জানি, পরম্পরায় শিমুলিয়াস্থ বাড়িটি কবিরাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল। সত্যিকারভাবে ছিল কবিরাজবাড়ি। এ বাড়ির চারদিকে সকালবেলা তাঁর বাবা খালি পায়ে হাঁটতেন, সাথে তিনিও। যত্ন নিতেন প্রকৃতির। কবিরাজির প্রয়োজনেই বাড়িতে অশোক, অর্জুন, আমলকী, হরীতকী, বয়ড়া, স্বর্ণচাপা, বকুল, নাগেশ্বর, আম্বলতম, শীতপুষ্পা শিমুল, কনকচাঁপা, কামিনী, টগর, শেফালী, কালো বসাক, ছাতিম, গোলাচি, কমলাগুঁড়ি, কন্টিকারি, বালা, বিশল্যকরনী, জয়পালসহ বিভিন্ন ধরনের ফলদ, বনজ ও ভেষজ গাছ, লতাগুল্ম আবাদ করতেন। যে কারণে তাঁকে আলাদাভাবে আর এসব বৃক্ষরাজির সঙ্গে পরিচয়ের প্রয়োজন পড়েনি বা পাঠ নিতে হয়নি। বাড়ির কাছের পাথারিয়া পাহাড় ছিল তখন বনারণ্য। সে সময় এ পাহাড়ি এলাকায় অন্য প্রাণীর সাথে বাঘও পাওয়া যেত। ‘পাথারিয়া পাহাড়ে ছিল নিবিড় ও গভীর অরণ্য। জনবসতি অতি নগণ্য। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই এলাকায় ফাঁদে-ধরা বাঘ ছাড়া কোনো বাঘ দেখিনি, একবার শুধু ছড়ার পারের বালুতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছিলাম। দূর ও কাছে থেকে অনেক বন্যজন্তু দেখেছি; শূকর, সজারু, বনরুই, মায়াহরিণ, গুলিবিদ্ধ সম্বর, সাধারণ বানরের দঙ্গল, হনুমান, উল্লুক, সম্ভবত রামকুত্তা এবং নানা জাতের সাপের সঙ্গে ভয়ঙ্কর শঙ্খচূড়। পাখির কোনো গনাগুনতি ছিল না।...’ [২০১৯: ৫২-৫৩]
পারিবারিক বাগানকর্মী শোভাবুড়ার কাছে শিখেছেন তির-ধনুক চালনা, পাখি শিকার। বনজ বৃক্ষরাজি আরও প্রাণিকুলের পরিচিতি জেনেছেন তাঁর কাছে। শোভাবুড়ার কাছেই দীক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতির, পাহাড়, রহস্যময় জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। শিখেছেন কীভাবে বন থেকে খাবার সংগ্রহ করা যায় পরিবেশের বিদ্যমানতা অক্ষুণ্ন রেখে। কারণ, ‘এই প্রকৃতিপুত্ররা চিরদিনই গরিব মানুষ, কিন্তু অশেষ ধৈর্যশীল। স্মর্তব্য, দুর্ভিক্ষে বনই তাদের বাঁচিয়ে রাখে।’ [২০১৯: ৫৫] যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন কখনো একাডেমিক প্রয়োজনে, কখনো মনের তাগিদে ঘুরে বেড়াতেন বৃক্ষ, ফুল, বাগান অথবা রমনা উদ্যান ও বলধা গার্ডেনে। খুঁজে নিয়েছেন জানা অজানা গাছের নমুনা। তাঁর কথায়, ‘এ এক রাজকীয় পরিবেশ শ্যামলিমা ঢাকার বিশাল চত্বর, মোগল স্থাপত্যের কার্জন হল, পরিপূর্ণ জলাশয়, সুশোভন বোটানিক গার্ডেন, লাল ইটের ছাত্রাবাস, রেসকোর্স, রমনাপার্ক সব মিলিয়ে এক স্বপ্নভূমি।’ [২০১৯: ৯৪]
শিক্ষাজীবন শেষ হলে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে চলে গেলেন বরিশাল বিএম কলেজে। সেখানেও তিনি তার সন্ধিৎসু মন খুঁজেছে নিজের পছন্দসই বাগান ও প্রকৃতি। তিনি পেয়েও গেলেন সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ। তিনি লিখেছেন, ‘দু’কামরার একটি আধা-পাকা টিনের ঘর, পেছনে কয়েকটি নারকেল গাছ, সামনে উঠান, তারপর নদীর মতো লম্বা একটি পুকুর, ওপারে বিস্তৃত ধানখেত, শেষে গ্রাম ও গোরস্থানের ওপরে অনেকগুলি শিরীষ গাছ। সূর্যোদয় সূর্যাস্ত শিরীষবনের ওপর রঙ ছড়াত, চেয়ে থাকতাম মুগ্ধ হয়ে। উঠানে লন বানালাম, পুকুরপারে লাগালাম নানা রঙের কলাবতী, এক পাশে কয়েকটি গোলাপ, ঘরের গা-ঘেঁষে জুঁইফুলের লতা, পুকুরে রক্তকমল ও রক্তপদ্ম। উত্তর পাশে একটি পোড়ো ভিটা ছিল, হয়তো এককালের রান্নাঘর, সেখানে উঠালাম গ্রীনহাউসের মতো কিছু-একটা, জড়ো করলাম কিছু অর্কিড, ক্যাকটাস ও টবের গাছ ফার্ন, ড্রাসিনা, পাতাবাহার।’ [২০১৯: ৯৭]
এভাবে যা করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। বিদেশে গিয়ে সন্ধান করেছেন বাগান, উদ্যান ও প্রকৃতির আবহ। তাঁর কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি করে তিনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করেছেন। বিশ্বের খ্যাত বিভিন্ন উদ্যান, বাগান, ভ্রমণ করেছেন এ বিষয়ে সাম্প্রতিক ধারণা অর্জনে। তিনি নিজে সোভিয়েত ইউনিয়নে বাসকালে বাগান তৈরি ও ফল চাষ করতেন। এমন স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘প্রত্যেক বাড়ির নিচের বাগানে মৌসুমি ফুল লাগাতাম। একটি নির্দিষ্ট নকশা ছিল; পেছনে লাল স্যালভিয়া, তারপর যথাক্রমে হলুদ ও গাঁদা, এরপর সাদা ও নীল লবেলিয়া। শেষে একফালি সরু বাঁকানো লন।...স্থায়ী বাগানটিও একসময় নজরকাড়া হয়ে উঠেছিল, ফুটেছিল প্রিমরোজ, বহুবর্ষজীবী ভার্বেনা, ব্লুবেল কয়েক জাতের লিলি। বুনো আপেল, নাশপাতি, চেরি গোলাপগোত্রের ফুলগুলিও চমৎকার।’ [২০১৯: ১৮৬]
নান্দনিক নিসর্গ
সারা বিশ্বে পুঁজির বিকাশ ধাবমান। ফলে এ পরিস্থিতিতে শিল্পায়ন, রিয়েল এস্টেট বাণিজ্য এবং একই সঙ্গে সৌন্দর্যভাবনা খুব জটিল। দ্বিজেন শর্মা একালের যাবতীয় চারিত্র্যকে অস্বীকার না করেও ইকোলজির কথা বলেছেন। সব সময়ই তিনি অনুভব করতেন প্রকৃতির মায়া। ঢাকা মহানগরের গাছপালার প্রজাতি, নাম ও পরিচিতি নিয়ে চমৎকার বই হলো শ্যামলী নিসর্গ। এর পেছনে তাঁর কথা হলো, ঢাকা শহরের পুরোনো অনেক গাছই এখন দেখা যায় না। এর মধ্যে আবার নতুন নতুন গাছ সংযোজিত হয়েছে। এসব গাছগাছালি নিয়ে এ গ্রন্থ রচিত। বৃক্ষ পরিচিতির প্রতিটি শিরোনামেই রয়েছে খ্যাতিমান লেখকদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি। যেমন,
১. কাঁটাতে আমার অপরাধ আছে
দোষ নাহি মোর ফুলে,
কাঁটা, ওগো প্রিয়, থাক্ মোর কাছে,
ফুল তুমি নিয়ো তুলে। [ক্যাকটাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০১৩ (৩): ৯৪]
২. নব কুসুম্ব পুষ্পবরণ সিঁন্দুরসম রাঙা
অগুন প্রবল পবনে দ্বিগুণ জ্বলে
ব্যাকুল অনল অটবীলতারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে
ধরনীতে ঘিরি দাহ করে পলে পলে। [কুসুম, স্লিচেরা ওলিওসা, কালিদাস ২০১৯: ১৬০]
এভাবে পরিচিতি বর্ণনার কারণ হলো সহজ ও সরলভাবে উদ্ভিদজগৎকে উপস্থাপন। তিনি জানেন, বৈজ্ঞানিক নামসহ ও নিছক একাডেমিক ভাষা ও বৃক্ষবিজ্ঞানের পরিভাষায় বিবরণ দিলে এসব কেউ পাঠ করবে না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমত: সাধারণ পাঠকের কাছে বার্তা পৌঁছানো, দ্বিতীয়ত: পরিবেশ, বাস্তুবিদ্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। বস্তুত সাধারণ পাঠক যেভাবে দ্বিজেন শর্মার রচনাকে গ্রহণ করেছে, তা বিস্ময়কর। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, সাধারণত উদ্ভিদবিদ্যা, বাস্তুতন্ত্রবিষয়ক কোনো লেখা তত্ত্ব পাঠ করতে মানুষ অনাগ্রহী। দ্বিজেন শর্মা তাঁর লেখা ও তৎপরতার মাধ্যমে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি ও আন্দোলন তৈরি করতে সক্ষম হন। যে ক্ষেত্রে কেউ কোনো বিরোধ মনে করেনি বা আহত বোধ করেনি। আবার যেকোনো পাখি-ফুল-বৃক্ষ বন্দনায়ও তাঁর সৃষ্ট সহজবোধ্য, আকর্ষণীয় ভাষা প্রয়োগ লক্ষণীয়। যে বর্ণনায় ঋতুবৈচিত্র্য, সমকালিক প্রকৃতির আবহ ও নিসর্গের প্রতি মায়া সৃষ্টিতেও যে ভাষা আন্দোলিত করে। যেমন, ‘‘কদম বর্ষার দূত: এই নিবিড় অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম। কোনো বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় যখন ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ ফোটে, দমকা হাওয়ায় একঝলক গন্ধ জানালা গলিয়ে ঘরের স্তব্ধতাকে চকিত করে, আমরা তখনই বর্ষার সুগভীর আহ্বানের অর্থ উপলব্ধি করি। কী নিবিড়, কী প্রগাঢ় আর আর দূরবাহী এই সুগন্ধ! বিশাল এই তরুর অজস্র প্রস্ফুটনের গন্ধমদির বর্ষার ভেজা বাতাস আমাদের মনে যে মধুর অনুরণন তোলে, তার তুলনা নেই। কদম আমাদের অনুপম প্রকৃতির আত্মজ। বর্ণে-গন্ধে-সৌন্দর্যে কদম এ দেশের রূপসী তরুর প্রথমদের অন্যতম।’ ‘তা ছাড়াও বাংলাদেশের নিজস্ব বৃক্ষরাজির পরিচয় দিতে লিখেছেন ভিন্ন প্রবন্ধ ‘বাংলার তরুলতা’। এমন শনাক্তির কাজে তাঁকে ঘুরতে হয়েছে দেশের নানা প্রান্ত।
প্রয়োজনীয় বাগান ও উদ্যান
বাগান, জঙ্গল ও উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো ছিল তাঁর নেশা। দেশ, বিদেশে যেখানেই গেছেন, সেখানেই তিনি সংশ্লিষ্ট বনভূমি, বাগান ও উদ্যান অবলোকনের চেষ্টা করেছেন। কারণ, একালে যান্ত্রিক জীবনের বাড়াবাড়ি, বা শিল্পোন্নয়নের তাড়না বনভূমি ও বাগানের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। ফলে আগের মতো কেউ বাগান নির্মাণে স্থিত নয়। যে কারণে তিনি বাগানকে বলেছেন নকশাবদ্ধ শিল্পকর্ম। যেখানে অনেকেই বাগান তৈরিতে ভূমি, স্থান ও পরিমিতি অনুযায়ী বাগানের জ্যামিতিক নকশা সুপারিশ করে থাকেন। ফলে, গাছ লাগালেই বাগান হয় না। লক্ষণীয়, বাগানের সৌন্দর্যে পরিমিত বর্ণপরিকল্প, প্রাকপ্রস্তুতি, গাছ ও ফুল লাগানো, সার প্রয়োগ, সেচ, গাছ বা ফুলের অসুখ হলে যত্ন ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমন্বিত পরিকল্পনা ও জানাবোঝার প্রতিফলনে নান্দনিক বাগান তৈরি করা যায়।
উপসর্গ যা-ই থাক, বাগান ও উদ্যান তৈরিতে মানুষ সব সময়ই ক্রিয়াশীল। এর মৌল কারণ হলো প্রকৃতির সাথে মানবসমাজের গোপন সম্পর্ক। এ সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। পুরোনো কাল থেকেই উদ্যান তৈরির প্রতি মানুষের উদ্যোগ লক্ষণীয়। কিন্তু তা প্রকাশে অনেকেই দ্বিধান্বিত। মানুষের কারণেই এ জীবজগতের অনেক কিছুই ধ্বংস হয়েছে, এখনো হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য যে, মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতে দ্বিজেন শর্মা লক্ষ করেছেন বন ধ্বংসের মাত্রা। প্রতিবছর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় ১ কোটি ২০ লাখ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে।
অতএব বাস্তুতন্ত্রকে বজায় রাখতে গেলে যা যা করা দরকার, তা হলো চারপাশের প্রতিবেশকে তার মতো বজায় রাখা। বস্তুত এ উপমহাদেশে উদ্ভিদজগতের তথ্য সংগ্রহ, বাগান ও উদ্যান নির্মাণের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। এর আলোকেই তিনি বাগান সৃষ্টিতে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। চারপাশে ধ্বংস ও বিনাশের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে সংরক্ষণমুখী সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। লক্ষণীয় এখন শখের তাগিদে শুধু বাগানের প্রতি আগ্রহী নয়। মানবসমাজের সার্বিক বিবেচনায় এখন বৃক্ষরোপণে সবাই মনোযোগী। সংরক্ষণের প্রযোজনীয়তা বিষয়ে তাঁর কথা হলো: ‘(১) ভবিষ্যৎ ব্যবহারের পক্ষে বাছাইয়ের অধিকার তথা জিনভান্ডার অক্ষুণ্ন রাখা, (২) বৈজ্ঞানিক রেকর্ডগুলো না হারানো, (৩) উত্তরাধিকার অটুট রাখা অর্থাৎ শিক্ষামূলক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ও রোমান্টিক উপাদানগুলো টিকিয়ে রাখা, (৪) বৈচিত্র্যের ধারণা লালন, (৫) মানুষ ও সহায় সম্পদের মধ্যকার অতিগুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলো না খোয়ানো।’ [২০১৩ (২) : ৬৮]
গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি, আবহাওয়া, মাটি বিবেচনায় বৃক্ষরোপণ ও বাগান করা প্রয়োজন। সড়ক, মহাসড়কের ঢালু জমিতে গাছ লাগানোতেও তাঁর সুপারিশ হলো, ‘মহাসড়কের পাশে গ্রামের শিশুদের জন্য জাম-আমলকী-জাতীয় ছোট ছোট ফলের গাছ লাগানো উচিত।’ পরিবেশ রক্ষা ও প্রয়োজনের তাগিদে তিনি বন ও উদ্যানের প্রতি খুব আকৃষ্ট ছিলেন। যেখানেই গেছেন, সেখানের উদ্যান ও বাগানের বিষয়ে তিনি ছিলেন আগ্রহী। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখেছেন, ‘কানাডা ও স্পেনের বাগানে গুরুত্ব পেয়েছে তাদের নিজ নিসর্গ। মার্কিন বাগানে সমন্বিত হয়েছে বনভূমি ও কাঠব্যবসা। মিসর ও ইতালির বাগানে আছে ঐতিহ্যবাহী পুরাদ্রব্যসম্ভার। গ্রিস তার বাগানে নিজ নিসর্গের সঙ্গে যোগ করেছে মহাকাব্যবর্ণিত গাছপালা। চীন ও জাপান এনেছে নিজস্ব উদ্যানশৈলী। অস্ট্রেলিয়ার বৈশিষ্ট্য হলো তার ‘নিজস্ব উদ্ভিদসম্ভার’ [২০১৩ (২): ১২১]
তিনি লক্ষ করেছেন এখানে বাগানের বিষয়ে উদাসীনতা। কোনো ডিজাইন বা নকশার কেউ তোয়াক্কা করে না। বাগান হিসেবে যেনতেন গাছ লাগালেই হলো। বৃক্ষ নিধন করে আবার বৃক্ষরোপণের কথা বলে তাড়াহুড়ো বাগান করার একধরনের মানসিকতা লক্ষণীয়। মূলত এগুলো ‘না-বন না-বাগান’। বাগানের ক্ষেত্রে ইকোসিস্টেমের দিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে না। যেমন একসময় বাংলাদেশে গণহারে লাগানো হয়েছে ইউক্যালিপটাস, চাষ করা হয়েছে মনোকালাচারের মাছ। এতে মাটি ও আবহাওয়ার দিকে নজর রাখা হয়নি। এ সমস্যা আরও বেড়েছে দারিদ্র্যের কারণে। এ ক্ষেত্রে জলাভূমি ও বনভূমি রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। যাতে মানুষ মনে করে এর মালিকানায় তার সংশ্লিষ্টতা আছে। একই সঙ্গে উপলব্ধি করতে হয়, বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে এ প্রকৃতির বিকল্প নেই। বাগান, বনাঞ্চল, উদ্যান নির্মাণে দেশ ও বিদেশে মনোকালচার বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা তার অভিমত নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া নগর ও শহরে বৃক্ষ নির্মাণে প্রচলিত ধারণাকে তিনি তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছেন। যা অবশ্যই পরিবেশ সংরক্ষণের সহায়ক নয়, যদিও বলা হয় সহায়ক বা প্রচার করা হয়। আরেকটি বৈশিষ্ট্য দেখা গেল, বন বিভাগের আচরণ ও এই মনোকালচারের বদৌলতে। লক্ষণীয়, বোটানিক গার্ডেন, ইকোপার্ক, সংরক্ষিত বন—সবই বন বিভাগের অধীনে নিয়ে যাওয়া। ‘আমাদের বোটানিক গার্ডেন কীভাবে বন বিভাগের দখলভুক্ত হলো, সে এক রহস্য। কাজটা তো তাদের নয়। বোটানিক গার্ডেন কার্যত একটি একাডেমি, একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তাতে থাকবে হার্বেরিয়াম, মিউজিয়াম, গবেষণাগার ও লাইব্রেরি। এটি পরিচালনা করবেন উদ্ভিদবিদ ও উদ্যানবিদেরা।’ [২০১৩ (২): ২৭০]
এর মধ্যে তিনি ইতিবাচক কিছু কাজ বিশ্বব্যাপী লক্ষ করেছেন। মানুষ যেখানে শূন্য জায়গা পাচ্ছে, সেখানে বৃক্ষ রোপণ করছে বা বাগান তৈরি করছে। আমাদের দেশেও জীববৈচিত্র্য রক্ষার তাগিদে বনায়ন, সংরক্ষণের কর্মসূচি চলমান রয়েছে। তবে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এসব ইকোপার্ক, বন ও উদ্যান না লাগছে গবেষক ও শিক্ষার্থীদের কাজে, না লাগছে পরিবেশ রক্ষার কাজে। শুধু সীমাবদ্ধ হয়ে আছে বিনোদন ও অর্থ সঞ্চয়ের প্রয়োজনে। ইকোপার্কের নামে যা করা হচ্ছে, এর পরিণাম কী দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘কৈশোর থেকে দেখা আমার অতিচেনা অরণ্যনিসর্গের সঙ্গে এ সবই বড় বেমানান। বাড়ির পথ ধরি। হাঁটতে হাঁটতে অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত বন, ইকোপার্কের কথা ভাবি। এগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। যতটুকু জানি, এগুলোর কোনোটাতেই বিদ্যমান গাছপালার বাইরে অন্য কিছু লাগানো যায় না। অথচ এখন বড়ই প্রয়োজন দেশি বৃক্ষের এক বা একাধিক একক সংগ্রহ গড়ে তোলা। কাজটি বোটানিক গার্ডেনেরও এক্তিয়ারভুক্ত নয়।...কিন্তু আমি নিশ্চিত, ইতোমধ্যে এসব বনাঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে অনেক প্রজাতির গাছগাছালি, লতাগুল্ম। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।’ [২০১৩ (২): ২২৪]
বাস্তুতন্ত্রের বোঝাপড়া
জীবন বাস্তবতা থেকে তিনি উচ্চারণ করেছেন পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্র রক্ষার তাগিদ। প্রকৃতির সাথে মানবসমাজকে জড়িয়ে রাখার সহজ ও সাবলীল পন্থা হলো শিশু কৈশোর থেকে প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক রচনা করা। যা তিনি নিজে উপলব্ধি করেছেন। তিনি এর বর্ণনাও দিয়েছেন। তাঁর বাড়ির কাছে পাথারিয়া পাহাড়ে যেতে যেতে লক্ষ করতেন বুনো শূকরের চলাফেরা, বানরের লাফ, বনমোরগের ডাকাডাকি, বিচিত্র পাখির ওড়াউড়ি। যা থেকে তিনি প্রথমত পাখিসমাজের সঙ্গে পরিচিত হন। বাস্তুতন্ত্রের আলোচনায় বলেছেন প্রাসঙ্গিক অস্তিত্ব ও অভিযোজন প্রক্রিয়ার কথা। ফলে ‘অস্তিত্বের সংগ্রাম’ প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসেছেন। এ প্রসঙ্গ প্রধান হয়ে ওঠার কারণ হলো মানুষের দখলদারির আলোকে প্রকৃতি দখল, নিয়ন্ত্রণ। একই সঙ্গে অতিমাত্রায় প্রকৃতির ব্যবহার থেকে এখন প্রকৃতির বিকল্প হওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করি। এ দৃষ্টিভঙ্গি মূলত প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে। আমাদের দেশে জনসমাজের বৃহদাংশ এখনো পরিবেশ, এর ওপর চাপ ইত্যাদি খুব একটা বোঝেন বলে মনে হয় না। ফলে না-বুঝে, না-জেনে বন ও সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনাকে দায়িত্বশীলেরা নিজের মতো সাজিয়ে নিচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে জীববৈচিত্র্য। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘রাচেল কারসন’-এর উপন্যাস নিথর বসন্ত [silent spring]-র উদাহরণ দিয়েছেন।
সকলেই জানেন, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির সঙ্গে অমানবিকতার সম্পর্ক রয়েছে। তা হলে বোঝাই যায় বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে, প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে যারা সক্রিয় আছে, তারা অনিবার্যভাবেই মানবিক। যারা শুধু বাণিজ্য বোঝে, উৎপাদন বোঝে, তারা কখনো প্রকৃতির মূল্য দেয় না। এ ছাড়া বাস্তুতন্ত্রের সমতাও খেয়াল করে না। অথচ জীববৈচিত্র্য, জীবনচক্রের শৃঙ্খলে মানুষ পরস্পর সম্পর্কিত। যে ক্ষেত্রে উদ্ভিদ বা এই লতাগুল্ম এ সম্পর্ক রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জন্য বলা হয় এ প্রকৃতি ও মানুষ এক এবং অবিচ্ছিন্ন। ফলে এক অনিবার্য, চেতনার ঐক্য বিদ্যমান। যা থেকে আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারি না।
বিচ্ছিন্ন কর্মপ্রয়াসের ফলেই প্রকৃতির মধ্যে বিরূপ পরিস্থিতি ও অসংগতি তৈরি হয়। ‘যেখানে পাহাড় চিরে-খুঁড়ে গাছের আবাদ বানানো পাহাড়ের স্থিতি ও পরিবেশের জন্য বিপর্যয়ী হবে, তা তো বলাই বাহুল্য। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে দূরের পাহাড়টি দেখি। সেই গাঢ় নীল এখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সবটাই এখন খালি, ধসের চিহ্নও স্পষ্ট। গোটা ব্যাপারটা সম্পর্কে ভেবে কোনোই ইতিবাচক সম্ভাবনা আঁচ করতে পারি না। এই বিশাল এলাকা বনশূন্য হলে বন্য প্রাণী ও পাখিরা যাবে কোথায়? আমরা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা নিয়ে যত কথা বলি, কিন্তু কার্যত চলি উল্টো পথে। কেন এমনটি ঘটে? এই অসংগতির উৎস কোথায়?’ [২০১৩ (২): ৩৩৯]
একালে শিল্পায়ন ব্যতীত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাস্তবতা হলো শিল্পায়নে সাধারণ প্রকৃতির ওপর এর প্রভাব পড়বেই। যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রভাবের ফলে কৃষিকাঠামো, সংস্কৃতি ভেঙে ও বদলে গেছে। প্রকৃতি থেকে লুণ্ঠন বেড়েছে, কিন্তু তা রক্ষায় চেতনার উন্নতি হয়নি। তবে শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে আমরা পরিবেশ বিষয়ে একেবারে উদাসীন থেকে যাচ্ছি। ফলে পরিবেশদূষণ বিষয়ে যা কিছু আয়োজন চলছে, তা হচ্ছে সগৌরবে। এ প্রসঙ্গে বরি কমোনার বলেছেন, It is economic motivation that has impelled the sweeping anti-ecological changes in the technology of production that have occurred since the Second War. These changes have turned the nation’s factories, farms, vehicles, and shops into seed-beds of pollution; nitrates from fertilizer; phosphates from detergents; toxic residues from pesticides; smog and carcinogenic exhaust from vehicles; the growing list of toxic chemicals and the mounds of undegradable plastic containers, wrappings and gewgaws from the petrochemical industry.
প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি লক্ষ করেছেন, আমরা সমতলভূমি ছাড়িয়ে জলাভূমি পর্যন্ত লুণ্ঠনাক্রান্ত মানসিকতার প্রমাণ দেখছি। এখানে বন, পরিবেশ, জল, মৎস্য রক্ষা করতে কিছু দাপ্তরিক কর্মসূচি লক্ষণীয়, কিন্তু আন্তরিকতা একেবারে অনুপস্থিত। যেসব কাজে গভীর চিন্তা বা কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। অনেক ক্ষেত্রে মনোকালচারজাত উৎপাদন বা দ্রুত উৎপাদন ও বাজারে আর্থিক লোভলাভে অস্থির মানবসমাজ। এতে প্রাকৃতিক জলাভূমি, বনাঞ্চল ধ্বংস করছি নিরুদ্বিগ্ন। সেখানে পরিবেশের কী হলো বা হচ্ছে, এ বিষয়ে কারও কোনো চিন্তা একেবারে নেই। দ্বিজেন শর্মার পর্যবেক্ষণ হলো: ‘একদা পড়ে থাকা অগভীর বিস্তৃত জলাভূমিগুলো আর নেই, এগুলো চাষের আওতায় এসেছে, ছোট মাছের বংশবৃদ্ধিও এলাকা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অধিকন্তু রাসায়নিক সার, কীটঘ্ন ও বোরো ধানের খড় পচার সমস্যা তো রয়েছেই। তবে সবচেয়ে মারাত্মক একটি উপসর্গ জুটেছে প্রযুক্তি প্রসারের কল্যাণে পাম্প দিয়ে বড় বড় জলাশয়, নদী খাত শুকিয়ে মাছের ঝাড়বংশ উজাড় করে ফেলা। এটা আগে সম্ভব হতো না। এতে মাছই শুধু কমছে না, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও।’ [২০১৩ (২): ১৭৭]
বলা বাহুল্য, বাণিজ্যপুঁজির সচলতায় পরিবেশকে তত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন আসে, আত্মঘাতী উন্নয়ন কি খুব জরুরি? যেখানে পুরো ইকোসিস্টেমকে কোনো পাত্তাই দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু পৃথিবীর যে পরিস্থিতি লক্ষণীয়, তাতে তাঁর ধারণা, ‘হোমোসেপিয়েন্স শেষ পর্যন্ত একটি বিপন্ন প্রজাতিতে পর্যবসিত হতে পারে’। তাঁর পর্যবেক্ষণে আগে ঘটবে পৃথিবীগ্রহের ধ্বংস, একই সঙ্গে ঘটবে মানব প্রজাতির বিলুপ্তি। তিনি দেখেছেন, বিশ্বে ও দেশে প্রকৃতির সামূহিক বিনাশে অর্থমূল্য ভাবা হলেও ইকোমূল্য বিবেচনা করা হচ্ছে না। বন বা জলাভূমির বাস্তব্যতন্ত্র একটি জটিল তথা সমন্বিত সত্তা আর সেটা বদলানো আখেরে মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। বনের জীবসম্পদের গুরুত্ব ভৌত-মূল্যে কতটা নির্ধার্য? আপাতদৃষ্টে অপ্রয়োজনীয় একটি প্রজাতির সম্ভাব্য মূল্য আমরা কতটা জানি। যে গুল্ম এই মুহূর্তে একটি বর্জ্য আগাছামাত্র, তাতে কোনো দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ নেই কে বলতে পারে, তাতে থাকতে পারে এমন কিছু ‘জিন’, যা আমাদের ফসলকে জোগাতে পারে রোগ বা পতঙ্গের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা, বিরূপ পরিবেশে অব্যাহত উৎপাদনশীলতার সামর্থ্য।’ [২০১৩ (২): ২৭৬ ]
পরিবেশজনিত, জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা তৈরি করেছে নয়া পুঁজিবাদের বিবিধ প্রতিক্রিয়া। পুঁজির নানা ধরনের উপজাত বিষয়ের ক্রিয়ায় বিশ্বপ্রকৃতির নানা বিলয় ঘটছে। মানুষ প্রকৃতির বিরোধ যেন প্রকাশ্য এখন। জেনেবুঝে মানুষ প্রকৃতির বিরূপতাকে দিনে দিনে বাড়িয়ে দিয়েছে। পুঁজির কাঠামোর ওপর নয়া উদারবাদের বিষয় হলো ক্রম ভোগবাদের বিকাশ। নয়া উদারবাদের কৌশলই হলো উৎপাদনের বাইরে থাকা জনমানুষকে শুধুই কনজ্যুমার বানানো। এর ফলে পরিবেশ ও প্রকৃতি ক্রম বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এর প্রতিক্রিয়ায় মুক্তির কোনো আশ্বাসই এখন নেই। দ্বিজেন শর্মার পর্যবেক্ষণ হলো: পশ্চিমা বিশ্ব ‘নতুন নতুন পণ্যবস্তুর পর্যাপ্ত উৎপাদন ও যথেচ্ছ অপচয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি করে চলেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ, মেরুতুষার গলন, ওজোন স্তর ক্ষয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লন্ডন-নিউইয়র্ক-টোকিও ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা, জলবায়ুর সম্ভাব্য পরিবর্তনে কৃষির বিপর্যয় ইত্যাদি নিয়ে তারা তেমন ভাবিত নয়, যেন এসব সংকট মোকাবিলার মতো সামর্থ্য আছে।...করপোরেট সংস্থাগুলো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অর্থব্যয়ে অনিচ্ছুক। তারা হন্যে হয়ে তেল গ্যাস খুঁজছে, নতুন নতুন মারণাস্ত্র বানাচ্ছে, বশংবদ রাজনীতিকদের সাহায্যে বিশ্বায়নের নামে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ঘনীভূত করছে, তাতে একধরনের প্রকট নৃকেন্দ্রিকতা, সেখানে কোনো প্যারাডাইম খুবই শিফট খুবই কঠিন।’ [২০১৩ (২): ৩৪৮]
‘বিলম্বে হলেও যখন আমরা উদ্ভিদজগতের সত্যিকার মূল্য উপলব্ধি করছি, তখন যেন পরিবেশ পুনর্নির্মাণে আমাদের বিবেচনা শুধু উপযোগিতার কয়েকটি মাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, যেন সেখানে সৌন্দর্য, প্রেম ইত্যাদির মতো কিছু অধরা মাধুরীরও প্রবেশ ঘটে, যাতে জীবন পূর্ণতা পায়, উন্নয়ন বহুমুখী হতে পারে।’ [২০১৩ (২): ১৩০] সুতরাং দ্বিজেন শর্মা এ প্রকৃতির বর্ণনায় সৌন্দর্য উপস্থাপন করেননি। একীভূত ধারণায় বাস্তুতন্ত্রের সার্বিক যত্ন ও সংরক্ষণের দায় স্বীকার করেছেন। সত্য হলো, আমরা প্রকৃতিকে না দিয়ে নিচ্ছি কেবলই। এ ক্ষেত্রে তাঁর আহ্বান হলো, জুরাসিক যুগের বিপদ ডেকে আনার আগে এবং বৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব পালন করা কর্তব্য।
তথ্যসূত্র
দ্বিজেন শর্মা। ২০১৩। প্রকৃতিসমগ্র ২। ঢাকা: অনিন্দ্য প্রকাশ-২০১৩। প্রকৃতিসমগ্র ৩। ঢাকা: অনিন্দ্য প্রকাশ-২০১৯। জীবনস্মৃতি মধুময় জীবনের ধূলি।
ঢাকা: কথাপ্রকাশ
Ramchandra Guha.2014. Environmentalism A global history. Penguin

দ্বিজেন শর্মা-উত্তর পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্রচর্চা প্রসঙ্গে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এমনই একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। তাঁর অভিমত, যেভাবে দ্বিজেন শর্মাকে মূল্যায়নের কথা ছিল, সেভাবে করছি না। আসলেই আমরা তা করছি না। কারণ, তাঁর কাজের প্রয়োজন আমরা অনুধাবন করিনি। এ সমাজ সেই বোধ থেকে অনেক দূরে, তা স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই। সবাই জানেন, প্রকৃতির সঙ্গে মানবসমাজের সম্পর্কের ধারণা, জ্ঞান, বোধ জন্মে পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য থেকে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা থেকে। তৃতীয়ত, এর মূলে আছে নিরন্তর আত্মোপলব্ধি। নিয়তি হলো, এ তিনের অনুপস্থিতির ভূগোলে আমরা অবস্থান করছি। কারণ, প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে, তাদের অবস্থান, জীবনযাপন আমরা হিংসা করি। প্রাকৃতিক ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদে আনন্দ পাই, বিনাশে উৎসব করি। প্রকৃতির উপাদান সংহারকর্মকে আমরা পরম নির্ধারিত বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয়ের সমর্থন নিয়ে আমরা এ বিনাশকর্ম সম্পাদন করি। সোফিস্ট দার্শনিক, আঠারো-উনিশ-বিশ শতকের আলোকসম্পাত ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি উদ্ভূত চিন্তার কেন্দ্র হলো মানুষ। ফলে এর সমর্থন নিয়ে মানবসমাজের অবনমন ভাবনা এ প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। দখলি শক্তি ও ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন অসহিষ্ণুতার স্রোত প্রজন্মান্তরে ক্রিয়াশীল। এর আলোকে বিশ্বের উদ্ভিদ, প্রাণী ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আমরা গ্রাহ্য করি না। অস্বীকারের সংস্কৃতি আমাদের জীবনের সামগ্রিক আচারাদি ও মস্তিষ্ককে দখল করে নিয়েছে। ফলে দ্বিজেন শর্মা ব্যক্তি ও তার প্রকৃতি-পরিবেশ চিন্তার সঙ্গে দখলীকৃত, বৈরী সাংস্কৃতিক আবহ এবং চর্চা খাপ খাওয়ানো দুঃসাধ্য। কারণ হলো, সামষ্টিক আঁধারচর্চা অন্যতম অবলম্বন, সেখানে প্রকৃতি, পরিবেশচিন্তা একধরনের অপ্রত্যাশিত, অন্যায্য কর্ম বলে আমরা জানি। নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রথাগত শৃঙ্খলে বন্দী থাকতে পছন্দ করি। ওই সাংস্কৃতিক উপনিবেশে একজন ব্যক্তির রুচিবোধ ও জীবনের সারার্থ উপলব্ধি করি।
ফলে, এজাতীয় শৃঙ্খলিত ভাবাচারের সাংস্কৃতিক জীবনে বাস্তুতান্ত্রিক চিন্তা না থাকারই কথা। পরিণাম ও অবশেষে বন্দিত্বের আনন্দে দ্বিজেন শর্মার মতো ব্যক্তি সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং নামও ভুলে যাওয়া। যে প্রকৃতি পরিবেশ আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন, তাকেই আমরা ধ্বংস করছি। তা করতে যুক্তি, বাসনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের আয়োজন করি। এমন পরিস্থিতিতে দ্বিজেন শর্মার কথন, বয়ান ও কর্মতৎপরতা উচ্চারণের মানে হলো, নিজের বিরুদ্ধে যাওয়া। তিনি যা-কিছু বলেছেন, এর গুরুত্ব আমরা বুঝি না, বুঝতে চেষ্টাও করি না। আমাদের সবকিছু যেন ম্লান হতে শুরু করেছে, নিরর্থক হতে শুরু করেছে। পারিপার্শ্বিক গতির সঙ্গে অবস্থান করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি চারপাশ, মাটি ও প্রকৃতির গুরুত্ব, মূল্য। দ্বিজেন শর্মা কী কামনা করেছেন তাঁর জীবনচর্চা ও লেখালেখিতে। সারাটা জীবন তিনি কাটিয়েছেন প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে। তাঁর মনে, মননে, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে, চিন্তাভাবনায় কেবল ছিল নিসর্গ। ফলে চারপাশের পরিবেশদূষণ, বিপর্যয়ে তিনি খুব বিষণ্ন হতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন নিসর্গ সংরক্ষণ ও প্লানেটারি শৃঙ্খলার কথা।
স্মৃতিতে সতত নিসর্গ
জীবনের প্রয়োজনে একপর্যায়ে গেলেন সেকালের সোভিয়েত ইউনিয়নে। মস্কোতে অবস্থানকালে স্মরণ করেছেন বাল্য-কৈশোরে দেখা পাথারিয়া-মাধবকুণ্ডের নিসর্গ। যে প্রকৃতির আবহে নিজেকে নির্মাণ করেছেন। অবশ্য তাঁর মতো ব্যক্তির পক্ষে যা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ‘জলমর্মর নৈঃশব্দ্যের গভীরতা বাড়ায়। আমি বসেই থাকি। ভয়ের কিছু নেই। কাছেই খাসিয়াদের বাড়ি, পানের জুমখেত। তাদের বৌ-ঝিরা ছড়া থেকে জল নিচ্ছে।...বারুণীস্নানে লোকের ভিড়, দিগম্বর সন্ন্যাসী দেখার কৌতূহল, ভিনগাঁয়ের লোকদের সঙ্গে হঠাৎ দেখার চমক, পূজা-আর্চা, মায়ের আঁচল ধরে চৈত্রমেলায় ঘুরে বেড়ানো, পাগল করা বাঁশির সুর, ফেরিওয়ালার কাঁধের লাঠিতে গাঁথা সোলার পাখির ওড়াউড়ি, ময়রার দোকানের প্রলুব্ধকর সওদা...’ [২০১৩ (২): ১০৬]
প্রসঙ্গত দ্বিজেন শর্মার ‘জীবনস্মৃতি: মধুময় জীবনের ধূলি’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। পরিণত বয়সে যা কিছু সম্ভব স্মরণ করতে চেষ্টা করেছেন তিনি। স্মৃতিতর্পণের বিভিন্ন প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন শৈশব-কৈশোরের নানা কথা ও বিবরণ। যেসব বিবরণে উঠে এসেছে ব্যক্তিগত স্বপ্ন, প্রতিবেশী, সমন্বিত সহিষ্ণু জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, সোভিয়েত পর্ব, লেখাপড়ার নানা প্রসঙ্গ ও জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাঁর অর্জন বিসর্জনের কথা। এসবের মধ্যে রূপায়ণ করেছেন প্রকৃতি, বিশেষত বাস্তুতন্ত্রের সাথে তাঁর সম্পর্ক, বোঝাপড়া ও এ সম্পর্কের বাস্তবতা। লক্ষণীয় সেই কৈশোরেই প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক তিনি গড়ে তোলেন। কারণ, ওই সময়ে বিনোদন বা আনন্দ যা-ই বলি, এর সবকিছু ছিল প্রকৃতিকেন্দ্রিক। পূজা-পার্বণ, উৎসব উদ্যাপনের উপাদান সংগ্রহ ও তৈরি হতো প্রকৃতির উপকরণে। যান্ত্রিক জীবনযাপনের অনেক আয়োজন তখনো গ্রামে পৌঁছায়নি। যে কারণে সাধারণ মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। এ নিসর্গের প্রতি মানবসমাজ এক অধ্যাত্ম ভালোবাসা, প্রেম অনুভব করত। তাঁর বাড়ির কাছে অবস্থিত পাথারিয়া পাহাড়, অদূরে হাকালুকি হাওর, যে পর্যন্ত বিস্তৃত সমতল। ‘গ্রামের বুক চিরে বহমান ছোট নদীটির নাম নিকড়ি। শীতে হাঁটুজল, বর্ষায় প্রমত্তা, ঘূর্ণিসহ ঘোলাজলের প্রবল তোড়ে ভয়ঙ্করী।...আমরা নদীতে বড়শি ফেলতাম। বেছে নিতাম জুৎসই জায়গা, কাশবনের কাছে, তাতে বাসা বানাত লাল রঙের মুনিয়া, পেছনে মাঠ, পশ্চিমের আকাশ, তাতে অপরাহ্ণের রঙ। মৎসবতী নদী শূন্য হাতে ফেরাত না, ধরা পড়ত পুঁটি, টেংরা, গোলসা, বাইনের বাচ্চা।’ [শর্মা ২০১৯: ১৭]
আমরা জানি, পরম্পরায় শিমুলিয়াস্থ বাড়িটি কবিরাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল। সত্যিকারভাবে ছিল কবিরাজবাড়ি। এ বাড়ির চারদিকে সকালবেলা তাঁর বাবা খালি পায়ে হাঁটতেন, সাথে তিনিও। যত্ন নিতেন প্রকৃতির। কবিরাজির প্রয়োজনেই বাড়িতে অশোক, অর্জুন, আমলকী, হরীতকী, বয়ড়া, স্বর্ণচাপা, বকুল, নাগেশ্বর, আম্বলতম, শীতপুষ্পা শিমুল, কনকচাঁপা, কামিনী, টগর, শেফালী, কালো বসাক, ছাতিম, গোলাচি, কমলাগুঁড়ি, কন্টিকারি, বালা, বিশল্যকরনী, জয়পালসহ বিভিন্ন ধরনের ফলদ, বনজ ও ভেষজ গাছ, লতাগুল্ম আবাদ করতেন। যে কারণে তাঁকে আলাদাভাবে আর এসব বৃক্ষরাজির সঙ্গে পরিচয়ের প্রয়োজন পড়েনি বা পাঠ নিতে হয়নি। বাড়ির কাছের পাথারিয়া পাহাড় ছিল তখন বনারণ্য। সে সময় এ পাহাড়ি এলাকায় অন্য প্রাণীর সাথে বাঘও পাওয়া যেত। ‘পাথারিয়া পাহাড়ে ছিল নিবিড় ও গভীর অরণ্য। জনবসতি অতি নগণ্য। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই এলাকায় ফাঁদে-ধরা বাঘ ছাড়া কোনো বাঘ দেখিনি, একবার শুধু ছড়ার পারের বালুতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছিলাম। দূর ও কাছে থেকে অনেক বন্যজন্তু দেখেছি; শূকর, সজারু, বনরুই, মায়াহরিণ, গুলিবিদ্ধ সম্বর, সাধারণ বানরের দঙ্গল, হনুমান, উল্লুক, সম্ভবত রামকুত্তা এবং নানা জাতের সাপের সঙ্গে ভয়ঙ্কর শঙ্খচূড়। পাখির কোনো গনাগুনতি ছিল না।...’ [২০১৯: ৫২-৫৩]
পারিবারিক বাগানকর্মী শোভাবুড়ার কাছে শিখেছেন তির-ধনুক চালনা, পাখি শিকার। বনজ বৃক্ষরাজি আরও প্রাণিকুলের পরিচিতি জেনেছেন তাঁর কাছে। শোভাবুড়ার কাছেই দীক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতির, পাহাড়, রহস্যময় জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। শিখেছেন কীভাবে বন থেকে খাবার সংগ্রহ করা যায় পরিবেশের বিদ্যমানতা অক্ষুণ্ন রেখে। কারণ, ‘এই প্রকৃতিপুত্ররা চিরদিনই গরিব মানুষ, কিন্তু অশেষ ধৈর্যশীল। স্মর্তব্য, দুর্ভিক্ষে বনই তাদের বাঁচিয়ে রাখে।’ [২০১৯: ৫৫] যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন কখনো একাডেমিক প্রয়োজনে, কখনো মনের তাগিদে ঘুরে বেড়াতেন বৃক্ষ, ফুল, বাগান অথবা রমনা উদ্যান ও বলধা গার্ডেনে। খুঁজে নিয়েছেন জানা অজানা গাছের নমুনা। তাঁর কথায়, ‘এ এক রাজকীয় পরিবেশ শ্যামলিমা ঢাকার বিশাল চত্বর, মোগল স্থাপত্যের কার্জন হল, পরিপূর্ণ জলাশয়, সুশোভন বোটানিক গার্ডেন, লাল ইটের ছাত্রাবাস, রেসকোর্স, রমনাপার্ক সব মিলিয়ে এক স্বপ্নভূমি।’ [২০১৯: ৯৪]
শিক্ষাজীবন শেষ হলে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে চলে গেলেন বরিশাল বিএম কলেজে। সেখানেও তিনি তার সন্ধিৎসু মন খুঁজেছে নিজের পছন্দসই বাগান ও প্রকৃতি। তিনি পেয়েও গেলেন সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ। তিনি লিখেছেন, ‘দু’কামরার একটি আধা-পাকা টিনের ঘর, পেছনে কয়েকটি নারকেল গাছ, সামনে উঠান, তারপর নদীর মতো লম্বা একটি পুকুর, ওপারে বিস্তৃত ধানখেত, শেষে গ্রাম ও গোরস্থানের ওপরে অনেকগুলি শিরীষ গাছ। সূর্যোদয় সূর্যাস্ত শিরীষবনের ওপর রঙ ছড়াত, চেয়ে থাকতাম মুগ্ধ হয়ে। উঠানে লন বানালাম, পুকুরপারে লাগালাম নানা রঙের কলাবতী, এক পাশে কয়েকটি গোলাপ, ঘরের গা-ঘেঁষে জুঁইফুলের লতা, পুকুরে রক্তকমল ও রক্তপদ্ম। উত্তর পাশে একটি পোড়ো ভিটা ছিল, হয়তো এককালের রান্নাঘর, সেখানে উঠালাম গ্রীনহাউসের মতো কিছু-একটা, জড়ো করলাম কিছু অর্কিড, ক্যাকটাস ও টবের গাছ ফার্ন, ড্রাসিনা, পাতাবাহার।’ [২০১৯: ৯৭]
এভাবে যা করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। বিদেশে গিয়ে সন্ধান করেছেন বাগান, উদ্যান ও প্রকৃতির আবহ। তাঁর কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি করে তিনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করেছেন। বিশ্বের খ্যাত বিভিন্ন উদ্যান, বাগান, ভ্রমণ করেছেন এ বিষয়ে সাম্প্রতিক ধারণা অর্জনে। তিনি নিজে সোভিয়েত ইউনিয়নে বাসকালে বাগান তৈরি ও ফল চাষ করতেন। এমন স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘প্রত্যেক বাড়ির নিচের বাগানে মৌসুমি ফুল লাগাতাম। একটি নির্দিষ্ট নকশা ছিল; পেছনে লাল স্যালভিয়া, তারপর যথাক্রমে হলুদ ও গাঁদা, এরপর সাদা ও নীল লবেলিয়া। শেষে একফালি সরু বাঁকানো লন।...স্থায়ী বাগানটিও একসময় নজরকাড়া হয়ে উঠেছিল, ফুটেছিল প্রিমরোজ, বহুবর্ষজীবী ভার্বেনা, ব্লুবেল কয়েক জাতের লিলি। বুনো আপেল, নাশপাতি, চেরি গোলাপগোত্রের ফুলগুলিও চমৎকার।’ [২০১৯: ১৮৬]
নান্দনিক নিসর্গ
সারা বিশ্বে পুঁজির বিকাশ ধাবমান। ফলে এ পরিস্থিতিতে শিল্পায়ন, রিয়েল এস্টেট বাণিজ্য এবং একই সঙ্গে সৌন্দর্যভাবনা খুব জটিল। দ্বিজেন শর্মা একালের যাবতীয় চারিত্র্যকে অস্বীকার না করেও ইকোলজির কথা বলেছেন। সব সময়ই তিনি অনুভব করতেন প্রকৃতির মায়া। ঢাকা মহানগরের গাছপালার প্রজাতি, নাম ও পরিচিতি নিয়ে চমৎকার বই হলো শ্যামলী নিসর্গ। এর পেছনে তাঁর কথা হলো, ঢাকা শহরের পুরোনো অনেক গাছই এখন দেখা যায় না। এর মধ্যে আবার নতুন নতুন গাছ সংযোজিত হয়েছে। এসব গাছগাছালি নিয়ে এ গ্রন্থ রচিত। বৃক্ষ পরিচিতির প্রতিটি শিরোনামেই রয়েছে খ্যাতিমান লেখকদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি। যেমন,
১. কাঁটাতে আমার অপরাধ আছে
দোষ নাহি মোর ফুলে,
কাঁটা, ওগো প্রিয়, থাক্ মোর কাছে,
ফুল তুমি নিয়ো তুলে। [ক্যাকটাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০১৩ (৩): ৯৪]
২. নব কুসুম্ব পুষ্পবরণ সিঁন্দুরসম রাঙা
অগুন প্রবল পবনে দ্বিগুণ জ্বলে
ব্যাকুল অনল অটবীলতারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে
ধরনীতে ঘিরি দাহ করে পলে পলে। [কুসুম, স্লিচেরা ওলিওসা, কালিদাস ২০১৯: ১৬০]
এভাবে পরিচিতি বর্ণনার কারণ হলো সহজ ও সরলভাবে উদ্ভিদজগৎকে উপস্থাপন। তিনি জানেন, বৈজ্ঞানিক নামসহ ও নিছক একাডেমিক ভাষা ও বৃক্ষবিজ্ঞানের পরিভাষায় বিবরণ দিলে এসব কেউ পাঠ করবে না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমত: সাধারণ পাঠকের কাছে বার্তা পৌঁছানো, দ্বিতীয়ত: পরিবেশ, বাস্তুবিদ্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। বস্তুত সাধারণ পাঠক যেভাবে দ্বিজেন শর্মার রচনাকে গ্রহণ করেছে, তা বিস্ময়কর। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, সাধারণত উদ্ভিদবিদ্যা, বাস্তুতন্ত্রবিষয়ক কোনো লেখা তত্ত্ব পাঠ করতে মানুষ অনাগ্রহী। দ্বিজেন শর্মা তাঁর লেখা ও তৎপরতার মাধ্যমে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি ও আন্দোলন তৈরি করতে সক্ষম হন। যে ক্ষেত্রে কেউ কোনো বিরোধ মনে করেনি বা আহত বোধ করেনি। আবার যেকোনো পাখি-ফুল-বৃক্ষ বন্দনায়ও তাঁর সৃষ্ট সহজবোধ্য, আকর্ষণীয় ভাষা প্রয়োগ লক্ষণীয়। যে বর্ণনায় ঋতুবৈচিত্র্য, সমকালিক প্রকৃতির আবহ ও নিসর্গের প্রতি মায়া সৃষ্টিতেও যে ভাষা আন্দোলিত করে। যেমন, ‘‘কদম বর্ষার দূত: এই নিবিড় অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম। কোনো বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় যখন ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ ফোটে, দমকা হাওয়ায় একঝলক গন্ধ জানালা গলিয়ে ঘরের স্তব্ধতাকে চকিত করে, আমরা তখনই বর্ষার সুগভীর আহ্বানের অর্থ উপলব্ধি করি। কী নিবিড়, কী প্রগাঢ় আর আর দূরবাহী এই সুগন্ধ! বিশাল এই তরুর অজস্র প্রস্ফুটনের গন্ধমদির বর্ষার ভেজা বাতাস আমাদের মনে যে মধুর অনুরণন তোলে, তার তুলনা নেই। কদম আমাদের অনুপম প্রকৃতির আত্মজ। বর্ণে-গন্ধে-সৌন্দর্যে কদম এ দেশের রূপসী তরুর প্রথমদের অন্যতম।’ ‘তা ছাড়াও বাংলাদেশের নিজস্ব বৃক্ষরাজির পরিচয় দিতে লিখেছেন ভিন্ন প্রবন্ধ ‘বাংলার তরুলতা’। এমন শনাক্তির কাজে তাঁকে ঘুরতে হয়েছে দেশের নানা প্রান্ত।
প্রয়োজনীয় বাগান ও উদ্যান
বাগান, জঙ্গল ও উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো ছিল তাঁর নেশা। দেশ, বিদেশে যেখানেই গেছেন, সেখানেই তিনি সংশ্লিষ্ট বনভূমি, বাগান ও উদ্যান অবলোকনের চেষ্টা করেছেন। কারণ, একালে যান্ত্রিক জীবনের বাড়াবাড়ি, বা শিল্পোন্নয়নের তাড়না বনভূমি ও বাগানের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। ফলে আগের মতো কেউ বাগান নির্মাণে স্থিত নয়। যে কারণে তিনি বাগানকে বলেছেন নকশাবদ্ধ শিল্পকর্ম। যেখানে অনেকেই বাগান তৈরিতে ভূমি, স্থান ও পরিমিতি অনুযায়ী বাগানের জ্যামিতিক নকশা সুপারিশ করে থাকেন। ফলে, গাছ লাগালেই বাগান হয় না। লক্ষণীয়, বাগানের সৌন্দর্যে পরিমিত বর্ণপরিকল্প, প্রাকপ্রস্তুতি, গাছ ও ফুল লাগানো, সার প্রয়োগ, সেচ, গাছ বা ফুলের অসুখ হলে যত্ন ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমন্বিত পরিকল্পনা ও জানাবোঝার প্রতিফলনে নান্দনিক বাগান তৈরি করা যায়।
উপসর্গ যা-ই থাক, বাগান ও উদ্যান তৈরিতে মানুষ সব সময়ই ক্রিয়াশীল। এর মৌল কারণ হলো প্রকৃতির সাথে মানবসমাজের গোপন সম্পর্ক। এ সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। পুরোনো কাল থেকেই উদ্যান তৈরির প্রতি মানুষের উদ্যোগ লক্ষণীয়। কিন্তু তা প্রকাশে অনেকেই দ্বিধান্বিত। মানুষের কারণেই এ জীবজগতের অনেক কিছুই ধ্বংস হয়েছে, এখনো হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য যে, মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতে দ্বিজেন শর্মা লক্ষ করেছেন বন ধ্বংসের মাত্রা। প্রতিবছর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় ১ কোটি ২০ লাখ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে।
অতএব বাস্তুতন্ত্রকে বজায় রাখতে গেলে যা যা করা দরকার, তা হলো চারপাশের প্রতিবেশকে তার মতো বজায় রাখা। বস্তুত এ উপমহাদেশে উদ্ভিদজগতের তথ্য সংগ্রহ, বাগান ও উদ্যান নির্মাণের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। এর আলোকেই তিনি বাগান সৃষ্টিতে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। চারপাশে ধ্বংস ও বিনাশের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে সংরক্ষণমুখী সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। লক্ষণীয় এখন শখের তাগিদে শুধু বাগানের প্রতি আগ্রহী নয়। মানবসমাজের সার্বিক বিবেচনায় এখন বৃক্ষরোপণে সবাই মনোযোগী। সংরক্ষণের প্রযোজনীয়তা বিষয়ে তাঁর কথা হলো: ‘(১) ভবিষ্যৎ ব্যবহারের পক্ষে বাছাইয়ের অধিকার তথা জিনভান্ডার অক্ষুণ্ন রাখা, (২) বৈজ্ঞানিক রেকর্ডগুলো না হারানো, (৩) উত্তরাধিকার অটুট রাখা অর্থাৎ শিক্ষামূলক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ও রোমান্টিক উপাদানগুলো টিকিয়ে রাখা, (৪) বৈচিত্র্যের ধারণা লালন, (৫) মানুষ ও সহায় সম্পদের মধ্যকার অতিগুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলো না খোয়ানো।’ [২০১৩ (২) : ৬৮]
গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি, আবহাওয়া, মাটি বিবেচনায় বৃক্ষরোপণ ও বাগান করা প্রয়োজন। সড়ক, মহাসড়কের ঢালু জমিতে গাছ লাগানোতেও তাঁর সুপারিশ হলো, ‘মহাসড়কের পাশে গ্রামের শিশুদের জন্য জাম-আমলকী-জাতীয় ছোট ছোট ফলের গাছ লাগানো উচিত।’ পরিবেশ রক্ষা ও প্রয়োজনের তাগিদে তিনি বন ও উদ্যানের প্রতি খুব আকৃষ্ট ছিলেন। যেখানেই গেছেন, সেখানের উদ্যান ও বাগানের বিষয়ে তিনি ছিলেন আগ্রহী। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখেছেন, ‘কানাডা ও স্পেনের বাগানে গুরুত্ব পেয়েছে তাদের নিজ নিসর্গ। মার্কিন বাগানে সমন্বিত হয়েছে বনভূমি ও কাঠব্যবসা। মিসর ও ইতালির বাগানে আছে ঐতিহ্যবাহী পুরাদ্রব্যসম্ভার। গ্রিস তার বাগানে নিজ নিসর্গের সঙ্গে যোগ করেছে মহাকাব্যবর্ণিত গাছপালা। চীন ও জাপান এনেছে নিজস্ব উদ্যানশৈলী। অস্ট্রেলিয়ার বৈশিষ্ট্য হলো তার ‘নিজস্ব উদ্ভিদসম্ভার’ [২০১৩ (২): ১২১]
তিনি লক্ষ করেছেন এখানে বাগানের বিষয়ে উদাসীনতা। কোনো ডিজাইন বা নকশার কেউ তোয়াক্কা করে না। বাগান হিসেবে যেনতেন গাছ লাগালেই হলো। বৃক্ষ নিধন করে আবার বৃক্ষরোপণের কথা বলে তাড়াহুড়ো বাগান করার একধরনের মানসিকতা লক্ষণীয়। মূলত এগুলো ‘না-বন না-বাগান’। বাগানের ক্ষেত্রে ইকোসিস্টেমের দিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে না। যেমন একসময় বাংলাদেশে গণহারে লাগানো হয়েছে ইউক্যালিপটাস, চাষ করা হয়েছে মনোকালাচারের মাছ। এতে মাটি ও আবহাওয়ার দিকে নজর রাখা হয়নি। এ সমস্যা আরও বেড়েছে দারিদ্র্যের কারণে। এ ক্ষেত্রে জলাভূমি ও বনভূমি রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। যাতে মানুষ মনে করে এর মালিকানায় তার সংশ্লিষ্টতা আছে। একই সঙ্গে উপলব্ধি করতে হয়, বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে এ প্রকৃতির বিকল্প নেই। বাগান, বনাঞ্চল, উদ্যান নির্মাণে দেশ ও বিদেশে মনোকালচার বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা তার অভিমত নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া নগর ও শহরে বৃক্ষ নির্মাণে প্রচলিত ধারণাকে তিনি তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছেন। যা অবশ্যই পরিবেশ সংরক্ষণের সহায়ক নয়, যদিও বলা হয় সহায়ক বা প্রচার করা হয়। আরেকটি বৈশিষ্ট্য দেখা গেল, বন বিভাগের আচরণ ও এই মনোকালচারের বদৌলতে। লক্ষণীয়, বোটানিক গার্ডেন, ইকোপার্ক, সংরক্ষিত বন—সবই বন বিভাগের অধীনে নিয়ে যাওয়া। ‘আমাদের বোটানিক গার্ডেন কীভাবে বন বিভাগের দখলভুক্ত হলো, সে এক রহস্য। কাজটা তো তাদের নয়। বোটানিক গার্ডেন কার্যত একটি একাডেমি, একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তাতে থাকবে হার্বেরিয়াম, মিউজিয়াম, গবেষণাগার ও লাইব্রেরি। এটি পরিচালনা করবেন উদ্ভিদবিদ ও উদ্যানবিদেরা।’ [২০১৩ (২): ২৭০]
এর মধ্যে তিনি ইতিবাচক কিছু কাজ বিশ্বব্যাপী লক্ষ করেছেন। মানুষ যেখানে শূন্য জায়গা পাচ্ছে, সেখানে বৃক্ষ রোপণ করছে বা বাগান তৈরি করছে। আমাদের দেশেও জীববৈচিত্র্য রক্ষার তাগিদে বনায়ন, সংরক্ষণের কর্মসূচি চলমান রয়েছে। তবে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এসব ইকোপার্ক, বন ও উদ্যান না লাগছে গবেষক ও শিক্ষার্থীদের কাজে, না লাগছে পরিবেশ রক্ষার কাজে। শুধু সীমাবদ্ধ হয়ে আছে বিনোদন ও অর্থ সঞ্চয়ের প্রয়োজনে। ইকোপার্কের নামে যা করা হচ্ছে, এর পরিণাম কী দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘কৈশোর থেকে দেখা আমার অতিচেনা অরণ্যনিসর্গের সঙ্গে এ সবই বড় বেমানান। বাড়ির পথ ধরি। হাঁটতে হাঁটতে অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত বন, ইকোপার্কের কথা ভাবি। এগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। যতটুকু জানি, এগুলোর কোনোটাতেই বিদ্যমান গাছপালার বাইরে অন্য কিছু লাগানো যায় না। অথচ এখন বড়ই প্রয়োজন দেশি বৃক্ষের এক বা একাধিক একক সংগ্রহ গড়ে তোলা। কাজটি বোটানিক গার্ডেনেরও এক্তিয়ারভুক্ত নয়।...কিন্তু আমি নিশ্চিত, ইতোমধ্যে এসব বনাঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে অনেক প্রজাতির গাছগাছালি, লতাগুল্ম। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।’ [২০১৩ (২): ২২৪]
বাস্তুতন্ত্রের বোঝাপড়া
জীবন বাস্তবতা থেকে তিনি উচ্চারণ করেছেন পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্র রক্ষার তাগিদ। প্রকৃতির সাথে মানবসমাজকে জড়িয়ে রাখার সহজ ও সাবলীল পন্থা হলো শিশু কৈশোর থেকে প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক রচনা করা। যা তিনি নিজে উপলব্ধি করেছেন। তিনি এর বর্ণনাও দিয়েছেন। তাঁর বাড়ির কাছে পাথারিয়া পাহাড়ে যেতে যেতে লক্ষ করতেন বুনো শূকরের চলাফেরা, বানরের লাফ, বনমোরগের ডাকাডাকি, বিচিত্র পাখির ওড়াউড়ি। যা থেকে তিনি প্রথমত পাখিসমাজের সঙ্গে পরিচিত হন। বাস্তুতন্ত্রের আলোচনায় বলেছেন প্রাসঙ্গিক অস্তিত্ব ও অভিযোজন প্রক্রিয়ার কথা। ফলে ‘অস্তিত্বের সংগ্রাম’ প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসেছেন। এ প্রসঙ্গ প্রধান হয়ে ওঠার কারণ হলো মানুষের দখলদারির আলোকে প্রকৃতি দখল, নিয়ন্ত্রণ। একই সঙ্গে অতিমাত্রায় প্রকৃতির ব্যবহার থেকে এখন প্রকৃতির বিকল্প হওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করি। এ দৃষ্টিভঙ্গি মূলত প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে। আমাদের দেশে জনসমাজের বৃহদাংশ এখনো পরিবেশ, এর ওপর চাপ ইত্যাদি খুব একটা বোঝেন বলে মনে হয় না। ফলে না-বুঝে, না-জেনে বন ও সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনাকে দায়িত্বশীলেরা নিজের মতো সাজিয়ে নিচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে জীববৈচিত্র্য। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘রাচেল কারসন’-এর উপন্যাস নিথর বসন্ত [silent spring]-র উদাহরণ দিয়েছেন।
সকলেই জানেন, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির সঙ্গে অমানবিকতার সম্পর্ক রয়েছে। তা হলে বোঝাই যায় বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে, প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে যারা সক্রিয় আছে, তারা অনিবার্যভাবেই মানবিক। যারা শুধু বাণিজ্য বোঝে, উৎপাদন বোঝে, তারা কখনো প্রকৃতির মূল্য দেয় না। এ ছাড়া বাস্তুতন্ত্রের সমতাও খেয়াল করে না। অথচ জীববৈচিত্র্য, জীবনচক্রের শৃঙ্খলে মানুষ পরস্পর সম্পর্কিত। যে ক্ষেত্রে উদ্ভিদ বা এই লতাগুল্ম এ সম্পর্ক রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জন্য বলা হয় এ প্রকৃতি ও মানুষ এক এবং অবিচ্ছিন্ন। ফলে এক অনিবার্য, চেতনার ঐক্য বিদ্যমান। যা থেকে আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারি না।
বিচ্ছিন্ন কর্মপ্রয়াসের ফলেই প্রকৃতির মধ্যে বিরূপ পরিস্থিতি ও অসংগতি তৈরি হয়। ‘যেখানে পাহাড় চিরে-খুঁড়ে গাছের আবাদ বানানো পাহাড়ের স্থিতি ও পরিবেশের জন্য বিপর্যয়ী হবে, তা তো বলাই বাহুল্য। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে দূরের পাহাড়টি দেখি। সেই গাঢ় নীল এখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সবটাই এখন খালি, ধসের চিহ্নও স্পষ্ট। গোটা ব্যাপারটা সম্পর্কে ভেবে কোনোই ইতিবাচক সম্ভাবনা আঁচ করতে পারি না। এই বিশাল এলাকা বনশূন্য হলে বন্য প্রাণী ও পাখিরা যাবে কোথায়? আমরা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা নিয়ে যত কথা বলি, কিন্তু কার্যত চলি উল্টো পথে। কেন এমনটি ঘটে? এই অসংগতির উৎস কোথায়?’ [২০১৩ (২): ৩৩৯]
একালে শিল্পায়ন ব্যতীত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাস্তবতা হলো শিল্পায়নে সাধারণ প্রকৃতির ওপর এর প্রভাব পড়বেই। যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রভাবের ফলে কৃষিকাঠামো, সংস্কৃতি ভেঙে ও বদলে গেছে। প্রকৃতি থেকে লুণ্ঠন বেড়েছে, কিন্তু তা রক্ষায় চেতনার উন্নতি হয়নি। তবে শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে আমরা পরিবেশ বিষয়ে একেবারে উদাসীন থেকে যাচ্ছি। ফলে পরিবেশদূষণ বিষয়ে যা কিছু আয়োজন চলছে, তা হচ্ছে সগৌরবে। এ প্রসঙ্গে বরি কমোনার বলেছেন, It is economic motivation that has impelled the sweeping anti-ecological changes in the technology of production that have occurred since the Second War. These changes have turned the nation’s factories, farms, vehicles, and shops into seed-beds of pollution; nitrates from fertilizer; phosphates from detergents; toxic residues from pesticides; smog and carcinogenic exhaust from vehicles; the growing list of toxic chemicals and the mounds of undegradable plastic containers, wrappings and gewgaws from the petrochemical industry.
প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি লক্ষ করেছেন, আমরা সমতলভূমি ছাড়িয়ে জলাভূমি পর্যন্ত লুণ্ঠনাক্রান্ত মানসিকতার প্রমাণ দেখছি। এখানে বন, পরিবেশ, জল, মৎস্য রক্ষা করতে কিছু দাপ্তরিক কর্মসূচি লক্ষণীয়, কিন্তু আন্তরিকতা একেবারে অনুপস্থিত। যেসব কাজে গভীর চিন্তা বা কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। অনেক ক্ষেত্রে মনোকালচারজাত উৎপাদন বা দ্রুত উৎপাদন ও বাজারে আর্থিক লোভলাভে অস্থির মানবসমাজ। এতে প্রাকৃতিক জলাভূমি, বনাঞ্চল ধ্বংস করছি নিরুদ্বিগ্ন। সেখানে পরিবেশের কী হলো বা হচ্ছে, এ বিষয়ে কারও কোনো চিন্তা একেবারে নেই। দ্বিজেন শর্মার পর্যবেক্ষণ হলো: ‘একদা পড়ে থাকা অগভীর বিস্তৃত জলাভূমিগুলো আর নেই, এগুলো চাষের আওতায় এসেছে, ছোট মাছের বংশবৃদ্ধিও এলাকা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অধিকন্তু রাসায়নিক সার, কীটঘ্ন ও বোরো ধানের খড় পচার সমস্যা তো রয়েছেই। তবে সবচেয়ে মারাত্মক একটি উপসর্গ জুটেছে প্রযুক্তি প্রসারের কল্যাণে পাম্প দিয়ে বড় বড় জলাশয়, নদী খাত শুকিয়ে মাছের ঝাড়বংশ উজাড় করে ফেলা। এটা আগে সম্ভব হতো না। এতে মাছই শুধু কমছে না, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও।’ [২০১৩ (২): ১৭৭]
বলা বাহুল্য, বাণিজ্যপুঁজির সচলতায় পরিবেশকে তত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন আসে, আত্মঘাতী উন্নয়ন কি খুব জরুরি? যেখানে পুরো ইকোসিস্টেমকে কোনো পাত্তাই দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু পৃথিবীর যে পরিস্থিতি লক্ষণীয়, তাতে তাঁর ধারণা, ‘হোমোসেপিয়েন্স শেষ পর্যন্ত একটি বিপন্ন প্রজাতিতে পর্যবসিত হতে পারে’। তাঁর পর্যবেক্ষণে আগে ঘটবে পৃথিবীগ্রহের ধ্বংস, একই সঙ্গে ঘটবে মানব প্রজাতির বিলুপ্তি। তিনি দেখেছেন, বিশ্বে ও দেশে প্রকৃতির সামূহিক বিনাশে অর্থমূল্য ভাবা হলেও ইকোমূল্য বিবেচনা করা হচ্ছে না। বন বা জলাভূমির বাস্তব্যতন্ত্র একটি জটিল তথা সমন্বিত সত্তা আর সেটা বদলানো আখেরে মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। বনের জীবসম্পদের গুরুত্ব ভৌত-মূল্যে কতটা নির্ধার্য? আপাতদৃষ্টে অপ্রয়োজনীয় একটি প্রজাতির সম্ভাব্য মূল্য আমরা কতটা জানি। যে গুল্ম এই মুহূর্তে একটি বর্জ্য আগাছামাত্র, তাতে কোনো দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ নেই কে বলতে পারে, তাতে থাকতে পারে এমন কিছু ‘জিন’, যা আমাদের ফসলকে জোগাতে পারে রোগ বা পতঙ্গের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা, বিরূপ পরিবেশে অব্যাহত উৎপাদনশীলতার সামর্থ্য।’ [২০১৩ (২): ২৭৬ ]
পরিবেশজনিত, জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা তৈরি করেছে নয়া পুঁজিবাদের বিবিধ প্রতিক্রিয়া। পুঁজির নানা ধরনের উপজাত বিষয়ের ক্রিয়ায় বিশ্বপ্রকৃতির নানা বিলয় ঘটছে। মানুষ প্রকৃতির বিরোধ যেন প্রকাশ্য এখন। জেনেবুঝে মানুষ প্রকৃতির বিরূপতাকে দিনে দিনে বাড়িয়ে দিয়েছে। পুঁজির কাঠামোর ওপর নয়া উদারবাদের বিষয় হলো ক্রম ভোগবাদের বিকাশ। নয়া উদারবাদের কৌশলই হলো উৎপাদনের বাইরে থাকা জনমানুষকে শুধুই কনজ্যুমার বানানো। এর ফলে পরিবেশ ও প্রকৃতি ক্রম বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এর প্রতিক্রিয়ায় মুক্তির কোনো আশ্বাসই এখন নেই। দ্বিজেন শর্মার পর্যবেক্ষণ হলো: পশ্চিমা বিশ্ব ‘নতুন নতুন পণ্যবস্তুর পর্যাপ্ত উৎপাদন ও যথেচ্ছ অপচয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি করে চলেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ, মেরুতুষার গলন, ওজোন স্তর ক্ষয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লন্ডন-নিউইয়র্ক-টোকিও ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা, জলবায়ুর সম্ভাব্য পরিবর্তনে কৃষির বিপর্যয় ইত্যাদি নিয়ে তারা তেমন ভাবিত নয়, যেন এসব সংকট মোকাবিলার মতো সামর্থ্য আছে।...করপোরেট সংস্থাগুলো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অর্থব্যয়ে অনিচ্ছুক। তারা হন্যে হয়ে তেল গ্যাস খুঁজছে, নতুন নতুন মারণাস্ত্র বানাচ্ছে, বশংবদ রাজনীতিকদের সাহায্যে বিশ্বায়নের নামে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ঘনীভূত করছে, তাতে একধরনের প্রকট নৃকেন্দ্রিকতা, সেখানে কোনো প্যারাডাইম খুবই শিফট খুবই কঠিন।’ [২০১৩ (২): ৩৪৮]
‘বিলম্বে হলেও যখন আমরা উদ্ভিদজগতের সত্যিকার মূল্য উপলব্ধি করছি, তখন যেন পরিবেশ পুনর্নির্মাণে আমাদের বিবেচনা শুধু উপযোগিতার কয়েকটি মাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, যেন সেখানে সৌন্দর্য, প্রেম ইত্যাদির মতো কিছু অধরা মাধুরীরও প্রবেশ ঘটে, যাতে জীবন পূর্ণতা পায়, উন্নয়ন বহুমুখী হতে পারে।’ [২০১৩ (২): ১৩০] সুতরাং দ্বিজেন শর্মা এ প্রকৃতির বর্ণনায় সৌন্দর্য উপস্থাপন করেননি। একীভূত ধারণায় বাস্তুতন্ত্রের সার্বিক যত্ন ও সংরক্ষণের দায় স্বীকার করেছেন। সত্য হলো, আমরা প্রকৃতিকে না দিয়ে নিচ্ছি কেবলই। এ ক্ষেত্রে তাঁর আহ্বান হলো, জুরাসিক যুগের বিপদ ডেকে আনার আগে এবং বৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব পালন করা কর্তব্য।
তথ্যসূত্র
দ্বিজেন শর্মা। ২০১৩। প্রকৃতিসমগ্র ২। ঢাকা: অনিন্দ্য প্রকাশ-২০১৩। প্রকৃতিসমগ্র ৩। ঢাকা: অনিন্দ্য প্রকাশ-২০১৯। জীবনস্মৃতি মধুময় জীবনের ধূলি।
ঢাকা: কথাপ্রকাশ
Ramchandra Guha.2014. Environmentalism A global history. Penguin

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

দ্বিজেন শর্মা-উত্তর পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্রচর্চা প্রসঙ্গে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এমনই একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। তাঁর অভিমত, যেভাবে দ্বিজেন শর্মাকে মূল্যায়নের কথা ছিল, সেভাবে করছি না। আসলেই আমরা তা করছি না। কারণ, তাঁর কাজের প্রয়োজন আমরা অনুধাবন করিনি। এ সমাজ সেই বোধ থেকে অনেক দূরে, তা স
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

দ্বিজেন শর্মা-উত্তর পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্রচর্চা প্রসঙ্গে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এমনই একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। তাঁর অভিমত, যেভাবে দ্বিজেন শর্মাকে মূল্যায়নের কথা ছিল, সেভাবে করছি না। আসলেই আমরা তা করছি না। কারণ, তাঁর কাজের প্রয়োজন আমরা অনুধাবন করিনি। এ সমাজ সেই বোধ থেকে অনেক দূরে, তা স
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

দ্বিজেন শর্মা-উত্তর পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্রচর্চা প্রসঙ্গে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এমনই একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। তাঁর অভিমত, যেভাবে দ্বিজেন শর্মাকে মূল্যায়নের কথা ছিল, সেভাবে করছি না। আসলেই আমরা তা করছি না। কারণ, তাঁর কাজের প্রয়োজন আমরা অনুধাবন করিনি। এ সমাজ সেই বোধ থেকে অনেক দূরে, তা স
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

দ্বিজেন শর্মা-উত্তর পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্রচর্চা প্রসঙ্গে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এমনই একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। তাঁর অভিমত, যেভাবে দ্বিজেন শর্মাকে মূল্যায়নের কথা ছিল, সেভাবে করছি না। আসলেই আমরা তা করছি না। কারণ, তাঁর কাজের প্রয়োজন আমরা অনুধাবন করিনি। এ সমাজ সেই বোধ থেকে অনেক দূরে, তা স
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫