জাহীদ রেজা নূর

আমার সামনেই ছিল অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনের তালিকা, আমি সেগুলো দ্রুতগতিতে ‘প্যারিস নরম্যান্ডি’ পত্রিকা থেকে লিখে নিচ্ছিলাম। এই তালিকা থেকে আমার কোনো নির্দিষ্ট চাওয়া-পাওয়া নেই। বলে রাখি, সে সময় গাড়ি আর রেফ্রিজারেটরের সংখ্যা ছিল খুব কম। সে সময় বিজ্ঞাপন-তারকা ছিল ‘লাক্স’ সাবান। নব্বই দশকের কম্পিউটার, ওভেন, হিমায়িত খাবার রাখার বাক্সের চেয়ে তা বেশি আকর্ষণীয় ছিল না। পণ্যের বণ্টন পণ্য প্রাপ্তির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ’৫২ সালে কারও কারও বাড়িতে বেসিনও ছিল না, আবার কারও কারও বাড়িতে অপরিহার্য ছিল বাথটাব। এটাই হচ্ছে তখনকার অবস্থা। এখনো তো কেউ কেউ পোশাকের জন্য বেছে নেয় ফ্রগি, কেউ কেউ বেছে নেয় অ্যাগনেস বি। পত্রিকা একসঙ্গে ধরে রাখে বিভিন্ন যুগের সেরা লক্ষণগুলোকেই।
আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যে শব্দগুলো দিয়ে আমি নিজেকে এবং অন্যকে চিনতাম, সে শব্দগুলো খুঁজে বের করা, যে শব্দগুলোকে সে সময় মনে হয়েছিল খুবই সাধারণ এবং অগ্রহণযোগ্য। অথবা মনে হয়েছিল একেবারেই অসম্ভব কিছু। কিন্তু আমি তো এখন ’৯৫-এ বাস করা এক নারী, যে কিনা ’৫২-এর সেই কিশোরী হিসেবে পুনর্জন্ম নিতে পারবে না কখনো, যে কিনা চেনে শুধু নিজের ছোট্ট শহরটিকে, চেনে নিজের পরিবারকে, স্কুলটাকে এবং যার শব্দভান্ডারে শব্দের সংখ্যা নিতান্তই কম। তখন আমি সেই কিশোরীটা—যার সামনে রয়েছে পুরোটা জীবন। নিজের জীবনের সবকিছুই তো আর সত্যি সত্যি মনে রাখা যায় না।
আমার শৈশবের দিনগুলোকে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই সেই সময়ের নিয়মকানুন, আচার-ব্যবহার, বিশ্বাস, সে সময়ের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলো, আমাদের স্কুলে, পরিবারে, শহরতলিতে মান্য করা রীতিগুলোকে স্মরণে আনতে হবে—সেগুলোই আসলে আমার জীবনকে গড়ে নিয়েছে, প্রশ্নহীনভাবে আমার অস্তিত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমি যে আমার মতো হলাম, তার সবকিছুই আমাকে মনে করে দেখতে হবে: আঞ্চলিক ভাষা, ধর্মীয় ধারণা, বাবা-মার বলা কথায় ব্যবহৃত শব্দাবলি, শরীর ও আশপাশের বস্তু থেকে খাপ খাওয়ানো তাদের অঙ্গভঙ্গি, মেয়েদের ম্যাগাজিনে পড়া উপন্যাস ‘পেটিট ইকো দ্য লা ফ্যাশন’ বা ‘ভিয়েনে দ্য শোমের’। এসব ভিন্ন ভিন্ন শব্দের কোনো কোনোটি এখনো আমার জীবন থেকে অর্থ হারিয়ে ফেলেনি—এবং সে শব্দগুলোই সেই ভয়ংকর দৃশ্যটি ঘিরে তৈরি করেছিল এর প্রেক্ষাপট, যা বারো বছর বয়সী একটি মেয়ের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল এবং মেয়েটি একদিন মনে করল, আতঙ্কে সে পাগল হয়ে গেছে।
তাহলে বলি। যা দাঁড়াচ্ছে, তা কোনো কারণেই একটি কল্পনার আশ্রয়ে গড়ে ওঠা কোনো ছোটগল্প হবে না। বাস্তবতার ছোঁয়াহীন কোনো গল্প এটা নয়। আমি শুধু কাগজে আমার শৈশবের ছবি আঁকতে চাই না, বরং আমি জীবনের নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সে ছবিটি দেখতে চাই, যে ছবিটি তার আলোকে পরিষ্কার হয়ে উঠতে পারে। সংক্ষেপে, আমি সেভাবেই নিজের জীবনটি দেখতে চাই, যেভাবে দেখে একজন নৃতাত্ত্বিক।
(এটা অবশ্য বলার কোনো প্রয়োজনই ছিল না, কিন্তু আমি চাই আমার কাজকে একদম স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে, নইলে আমি কাজটা করে উঠতে পারব না।)
আমি হয়তো আমার শৈশবের নিত্য কথামালা ও দৈনন্দিন জীবনের প্রেক্ষাপটে ওই ভয়ংকর দৃশ্যটি তুলে ধরার চেষ্টা করব। অথবা এমনও হতে পারে, আমাকে চালিত করবে উন্মত্ত—প্রতারক কোনো শক্তি, যাকে মনে হতে পারে আমার অচেনা গসপেলের মতোই অভিশপ্ত। এমন এক অভিশাপ, যা আমাকে ভুডু আচারধর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মেনে নিন এবং পাঠ করুন: ইহা আমার দেহ, যাহা আপনার নিকট অর্পণ করা হইবে, ইহা আমার রক্তপূর্ণ বাটি, যাহা আপনার এবং আরও অনেকের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইবে।
১৯৫২ সালের জুন মাসের আগে অবধি আমি কোনো দিন আমার শহর ছেড়ে আর কোথাও যাইনি। আমার শহরটাকে সবখানে একটু ধোঁয়াশাঘেরা অদ্ভুত নামে ডাকা হয়, অথচ সেই নামটিই সবার কাছে পরিচিত, ‘কো অঞ্চল’। এটাকে আমরা ‘এখানে’ বলে থাকি। এই শহর দাঁড়িয়ে আছে সেন নদীর ডান পারে, লে হাভরে ও রুয়ান শহর দুটোর মাঝখানে এর অবস্থান। এবং এই দুই শহরের পর আর কী আছে, তা আমার একেবারেই জানা নেই। আসলে এরপর যা আছে, তা হলো ফ্রান্সের বাকি অংশ, আসলে রয়েছে বাদবাকি পুরো পৃথিবীটা। এই অজানা জায়গা সম্পর্কে ‘সেখানে’ শব্দটি ব্যবহার করি আমরা। আর সে শব্দ ব্যবহার করার সময় দিগন্তের দিকে এমনভাবে হাত নাড়া হয়, যা দেখে মনে হবে, এ এক উদাসীনতার প্রকাশ কিংবা ওই বাদবাকি পৃথিবী সম্পর্কে জানার কোনো উপায় নেই বলেই এমনটা করা হচ্ছে। আমাদের শহর থেকে কেউই আমাদের দেশের রাজধানীমুখো হবে না। তখনই তারা রাজধানীমুখো হবে, যখন কোনো ট্যুরিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যাবে অথবা নিশ্চিতভাবেই প্যারিসে তাদের কোনো কাছের মানুষ আছে, যারা সেখানে তার দায়িত্ব নেবে। ট্রামে করে নিজ এলাকার মেলায় যাওয়ার চেয়ে মেট্রোতে করে চলাচল করা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, মেট্রোতে উঠতে হলে দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতি প্রয়োজন। সবাই বিশ্বাস করে, যেখানে সবাই অচেনা, সেখানে যাওয়া ঠিক নয়। আর সেখানে গেলেই আনন্দ লাগবে, যেখানে মানুষ যখন ইচ্ছে যেতে পারে।
আমাদের ‘এখানে’ শব্দটি দিয়ে আমরা আমাদের পাশের সেই দুটো শহর লা হাভরে ও রুয়ানকেও নির্ভয়ে বোঝাই, আমাদের পরিবারগুলোয় প্রায়ই এই শহর দুটি নিয়ে কথা হয়। আমাদের শহরের অনেক শ্রমিক রেলকারে করে কাজে যায়। রুয়ান শহরটি আমাদের শহরের বেশি কাছে, তুলনামূলকভাবে শহরটা বড়। এখানে দোকানপাট রয়েছে, সর্বরোগের চিকিৎসকেরা আছেন, কয়েকটি সিনেমা হল আছে, ইনডোর সুইমিং পুল আছে, সেখানে সাঁতার শেখা যায়, সেঁ রোমেঁ নামে মেলা আছে—পুরো নভেম্বরজুড়েই যে মেলাটি বসে, আছে ট্রাম, চা-খানা, আছে হাসপাতাল, যেখানে মানুষের শরীরে জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়। এখানে ইলেকট্রিক শক দেওয়া অথবা বিষনাশক কোর্সেরও ব্যবস্থা আছে।
আমাদের শহর থেকে কেউই ভুলেও রুয়ান শহরে যাবে না, যদি সে সেখানে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ না করে। মা আমাকে বছরে দুবার রুয়ানে নিয়ে যেত। সেখানে গিয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে আমার চোখ পরীক্ষা করাতো আর নতুন চশমা বানিয়ে দিত। আর সেই সুবাদে মা সেখান থেকে কসমেটিকস আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে আনত, যেগুলো আমাদের শহরে পাওয়া যেত না। এই রুয়ান শহরটিকে আমরা ‘নিজের ঘর’ বলে মনে করতাম না, কারণ এই শহরের কেউই আমাদের পরিচিতজন ছিল না। এ শহরে যারা বসবাস করে, তারা আমাদের শহরের লোকেদের চেয়ে ভালো কাপড়চোপড় পরে, তাদের কথায় আঞ্চলিকতার টান আমাদের চেয়ে কম।
রুয়ানে এলেই আমরা বুঝতে পারতাম, কোথায় কোথায় আমরা পিছিয়ে আছি। বুদ্ধিতে, যোগাযোগ করার ক্ষমতায়, কথা বলার পারঙ্গমতায়, সামগ্রিক অগ্রসরমানতায় আমাদের দুর্বলতা ছিল।
১৯৫২ সালে আমি আমার শহরের বাইরে নিজেকে কল্পনাও করিনি। আমাকে যারা ‘আনি’ নামে চিনত, শুধু তাদের দোকানে, তাদের বাড়িতে যাওয়ার মধ্যেই আমার চলাচল ছিল সীমাবদ্ধ। অন্য পৃথিবীর কোনো কিশোরের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হওয়ার সুযোগই ছিল না। সে সময় আমার সকল ভাবনা ছিল আমার ছোট শহরটিকে ঘিরে। এই শহরের স্কুল, গির্জা, ফ্যাশনেবল কাপড়ের দোকানঘর এবং উৎসব ছিল আমার নিজের। ল হাভরে ও রুয়ানের মাঝখানে সাত হাজার মানুষের এই শহরটি ছিল পৃথিবীতে একমাত্র জায়গা, যার প্রায় সব মানুষ সম্পর্কে আমরা বলতে পারতাম, কোথায় কার বাড়ি, কার কজন ছেলেমেয়ে, কে কোথায় কাজ করে। আমরা মুখস্থ বলতে পারতাম গির্জার সময়সূচি, লেরুয়া সিনেমা হলে কটার সময় কোন সিনেমার শো আছে, কোনটা সেরা পেস্ট্রিশপ কিংবা কোন কসাইয়ের কাছ থেকে মাংস কিনলে সে মাপে কম চুরি করবে। এই শহরেই জন্মেছে আমার বাবা আর মা, কাছের কোনো গ্রামেই জন্মেছিল তাদের বাবা মা, এবং তাদেরও বাবা-মা। পৃথিবীতে কোথাও আর কোনো জায়গা নেই, যে জায়গাটিকে আমি এই শহরটির মতো এ রকম আপন করে চিনে নিতে পারি। আমি জানি, আমাদের পাশের বাড়িতে পঞ্চাশ বছর আগে কারা থাকত এবং স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার কিশোরী মা কাদের কাছ থেকে পাউরুটি কিনে আনতেন। রাস্তাঘাটে চলাচল করতে গিয়ে এমন নারী বা পুরুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়, যাদের কারও কারও সঙ্গে একটুর জন্য বাবা বা মায়ের এনগেজমেন্ট হয়নি। এরপরই কেবল বাবা আর মায়ের দেখা হয়েছে। যাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, তাদের বলি ‘আগন্তুক’।
আমরা তাদের অতীত সম্পর্কে জানি না, তারাও আমাদের অতীত সম্পর্কে কিছু জানে না। ব্রিটেনবাসী, মার্সেলবাসী, স্প্যানিশ, যেকোনো লোক, যারা আমাদের ভাষায় কথা বলে না, তারা সবাই আমাদের চোখে ‘বিদেশি’।
(অন্যান্য উপন্যাসে আমি যেভাবে এই শহরের নাম করেছি, এখানে তার দরকার নেই। কারণ রুয়ান বা ল হাভরে থেকে রেলগাড়ি চেপে কিংবা ১৫ নম্বর হাইওয়ে দিয়ে যেখানে পৌঁছানো যায়, এখানে মানচিত্রে স্থান পাওয়া সেই ভৌগোলিক স্থান হিসেবে শহরটাকে দেখানো হচ্ছে না, এটা না হয় থাকুক নামহীন আমার জন্মশহর হিসেবে, যার কাছে ফিরলে আমি হতাশা আর বিষণ্নতায় ভুগতে থাকি, আর তা আমার সব ভাবনা আর স্মৃতিকে গ্রাস করে নেয়।)
চল্লিশের দশকে জার্মান বাহিনীর আক্রমণের পর আগুনে পোড়া নগরের কেন্দ্রস্থলে নরম্যান্ডির মতোই পরে বোমা হামলা হয়, সেখানেই পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। সবকিছুই একের পর এক সাজানো আছে: নির্মাণকাজ চলছে, খালি জায়গাও আছে পাশে, ইটের নতুন ত্রিতল ভবন গড়ে উঠেছে, যার প্রথম তলায় জায়গা করে নিয়েছে ফ্যাশনেবল দোকানপাট, আর পাশেই রয়েছে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ব্যারাক আর পুরোনো ভবন: মেয়র ভবন, সিনেমা হল লেরুয়া, পোস্ট অফিস, মার্কেটের প্যাভিলিয়ন। গির্জাটা পুড়ে গিয়েছিল এবং এর নিচে তৈরি হয়েছিল ক্লাব, যা মেয়র ভবনের চত্বরের সঙ্গে জায়গা ভাগ করে নিয়েছিল। ধার্মিক মানুষ সেখানে এসে হাজির হয়, সাধারণ মানুষেরা বসে সেই স্টলগুলোয় অথবা গ্যালারিতে।
কেন্দ্রীয় সড়ক থেকে অ্যাসফাল্টে গড়া রাস্তা বা ফুটপাত ছড়িয়ে গেছে চারদিকে, ইট আর পাথরে গড়া ব্যক্তিগত বাড়িগুলো সুবিন্যস্ত হয়ে লুকিয়ে আছে প্রাচীরের আড়ালে এবং সেখানে গড়ে উঠেছে নোটারি পাবলিক, ডাক্তারখানা, বড় চাকুরেদের বাড়ি। একটু দূরেই রয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি স্কুল। এ জায়গাটাকে অবশ্য ঠিক শহরের কেন্দ্র বলা যাবে না, তবে একে শহরতলি বলারও কোনো কারণ নেই।
এরপর রয়েছে শহরতলি, যেখানকার বাসিন্দারা শহরের কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার কালে বলে, ‘শহরে যাই’ কিংবা শহরের নাম করে বলে ‘অমুক শহরে যাই।’ তবে সত্যের খাতিরে বলতে হয় শহরের কেন্দ্র আর শহরতলির মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো সীমানা নেই। তবে এখানে এসে শেষ হয়েছে ফুটপাত, বেশির ভাগ বাড়িই কাদালেপা কুঁড়ে (দু-তিনটা ঘর তাতে, পানির ব্যবস্থা নেই, টয়লেট আছে বাড়ি থেকে কিছু দূরে আর বাড়ির সঙ্গে রয়েছে বাগান)। দোকানপাট অনেক দূরে দূরে, তবে ঐতিহ্যবাহী মুদির দোকান, কফি কর্নার রয়েছে এই শহরতলিতে, যাকে ‘গ্রাম’ বলা যায়। তবে সবাই জানে, এসব দোকানে যেতে হলে ভারী জুতো কিংবা ভালো পোশাক পরার দরকার নেই। কেন্দ্র থেকে যতই দূরে যাওয়া, ততই প্রাসাদোপম বাড়ির সংখ্যা কমতে থাকে, একসময় শুধু মাটির কুঁড়ের দেখা পাওয়া যায়। শহরের প্রান্তে এসে রাস্তাগুলো হয়ে গেছে কাঁচা রাস্তা। বৃষ্টি হলেই সে রাস্তায় কাদা জমে। আর ঠিক এর পেছন থেকেই শুরু হয়েছে খামারবাড়িগুলি—এখান থেকেই আসলে গ্রামের শুরু।
(চলবে)
আরও পড়ুন:

আমার সামনেই ছিল অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনের তালিকা, আমি সেগুলো দ্রুতগতিতে ‘প্যারিস নরম্যান্ডি’ পত্রিকা থেকে লিখে নিচ্ছিলাম। এই তালিকা থেকে আমার কোনো নির্দিষ্ট চাওয়া-পাওয়া নেই। বলে রাখি, সে সময় গাড়ি আর রেফ্রিজারেটরের সংখ্যা ছিল খুব কম। সে সময় বিজ্ঞাপন-তারকা ছিল ‘লাক্স’ সাবান। নব্বই দশকের কম্পিউটার, ওভেন, হিমায়িত খাবার রাখার বাক্সের চেয়ে তা বেশি আকর্ষণীয় ছিল না। পণ্যের বণ্টন পণ্য প্রাপ্তির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ’৫২ সালে কারও কারও বাড়িতে বেসিনও ছিল না, আবার কারও কারও বাড়িতে অপরিহার্য ছিল বাথটাব। এটাই হচ্ছে তখনকার অবস্থা। এখনো তো কেউ কেউ পোশাকের জন্য বেছে নেয় ফ্রগি, কেউ কেউ বেছে নেয় অ্যাগনেস বি। পত্রিকা একসঙ্গে ধরে রাখে বিভিন্ন যুগের সেরা লক্ষণগুলোকেই।
আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যে শব্দগুলো দিয়ে আমি নিজেকে এবং অন্যকে চিনতাম, সে শব্দগুলো খুঁজে বের করা, যে শব্দগুলোকে সে সময় মনে হয়েছিল খুবই সাধারণ এবং অগ্রহণযোগ্য। অথবা মনে হয়েছিল একেবারেই অসম্ভব কিছু। কিন্তু আমি তো এখন ’৯৫-এ বাস করা এক নারী, যে কিনা ’৫২-এর সেই কিশোরী হিসেবে পুনর্জন্ম নিতে পারবে না কখনো, যে কিনা চেনে শুধু নিজের ছোট্ট শহরটিকে, চেনে নিজের পরিবারকে, স্কুলটাকে এবং যার শব্দভান্ডারে শব্দের সংখ্যা নিতান্তই কম। তখন আমি সেই কিশোরীটা—যার সামনে রয়েছে পুরোটা জীবন। নিজের জীবনের সবকিছুই তো আর সত্যি সত্যি মনে রাখা যায় না।
আমার শৈশবের দিনগুলোকে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই সেই সময়ের নিয়মকানুন, আচার-ব্যবহার, বিশ্বাস, সে সময়ের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলো, আমাদের স্কুলে, পরিবারে, শহরতলিতে মান্য করা রীতিগুলোকে স্মরণে আনতে হবে—সেগুলোই আসলে আমার জীবনকে গড়ে নিয়েছে, প্রশ্নহীনভাবে আমার অস্তিত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমি যে আমার মতো হলাম, তার সবকিছুই আমাকে মনে করে দেখতে হবে: আঞ্চলিক ভাষা, ধর্মীয় ধারণা, বাবা-মার বলা কথায় ব্যবহৃত শব্দাবলি, শরীর ও আশপাশের বস্তু থেকে খাপ খাওয়ানো তাদের অঙ্গভঙ্গি, মেয়েদের ম্যাগাজিনে পড়া উপন্যাস ‘পেটিট ইকো দ্য লা ফ্যাশন’ বা ‘ভিয়েনে দ্য শোমের’। এসব ভিন্ন ভিন্ন শব্দের কোনো কোনোটি এখনো আমার জীবন থেকে অর্থ হারিয়ে ফেলেনি—এবং সে শব্দগুলোই সেই ভয়ংকর দৃশ্যটি ঘিরে তৈরি করেছিল এর প্রেক্ষাপট, যা বারো বছর বয়সী একটি মেয়ের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল এবং মেয়েটি একদিন মনে করল, আতঙ্কে সে পাগল হয়ে গেছে।
তাহলে বলি। যা দাঁড়াচ্ছে, তা কোনো কারণেই একটি কল্পনার আশ্রয়ে গড়ে ওঠা কোনো ছোটগল্প হবে না। বাস্তবতার ছোঁয়াহীন কোনো গল্প এটা নয়। আমি শুধু কাগজে আমার শৈশবের ছবি আঁকতে চাই না, বরং আমি জীবনের নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সে ছবিটি দেখতে চাই, যে ছবিটি তার আলোকে পরিষ্কার হয়ে উঠতে পারে। সংক্ষেপে, আমি সেভাবেই নিজের জীবনটি দেখতে চাই, যেভাবে দেখে একজন নৃতাত্ত্বিক।
(এটা অবশ্য বলার কোনো প্রয়োজনই ছিল না, কিন্তু আমি চাই আমার কাজকে একদম স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে, নইলে আমি কাজটা করে উঠতে পারব না।)
আমি হয়তো আমার শৈশবের নিত্য কথামালা ও দৈনন্দিন জীবনের প্রেক্ষাপটে ওই ভয়ংকর দৃশ্যটি তুলে ধরার চেষ্টা করব। অথবা এমনও হতে পারে, আমাকে চালিত করবে উন্মত্ত—প্রতারক কোনো শক্তি, যাকে মনে হতে পারে আমার অচেনা গসপেলের মতোই অভিশপ্ত। এমন এক অভিশাপ, যা আমাকে ভুডু আচারধর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মেনে নিন এবং পাঠ করুন: ইহা আমার দেহ, যাহা আপনার নিকট অর্পণ করা হইবে, ইহা আমার রক্তপূর্ণ বাটি, যাহা আপনার এবং আরও অনেকের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইবে।
১৯৫২ সালের জুন মাসের আগে অবধি আমি কোনো দিন আমার শহর ছেড়ে আর কোথাও যাইনি। আমার শহরটাকে সবখানে একটু ধোঁয়াশাঘেরা অদ্ভুত নামে ডাকা হয়, অথচ সেই নামটিই সবার কাছে পরিচিত, ‘কো অঞ্চল’। এটাকে আমরা ‘এখানে’ বলে থাকি। এই শহর দাঁড়িয়ে আছে সেন নদীর ডান পারে, লে হাভরে ও রুয়ান শহর দুটোর মাঝখানে এর অবস্থান। এবং এই দুই শহরের পর আর কী আছে, তা আমার একেবারেই জানা নেই। আসলে এরপর যা আছে, তা হলো ফ্রান্সের বাকি অংশ, আসলে রয়েছে বাদবাকি পুরো পৃথিবীটা। এই অজানা জায়গা সম্পর্কে ‘সেখানে’ শব্দটি ব্যবহার করি আমরা। আর সে শব্দ ব্যবহার করার সময় দিগন্তের দিকে এমনভাবে হাত নাড়া হয়, যা দেখে মনে হবে, এ এক উদাসীনতার প্রকাশ কিংবা ওই বাদবাকি পৃথিবী সম্পর্কে জানার কোনো উপায় নেই বলেই এমনটা করা হচ্ছে। আমাদের শহর থেকে কেউই আমাদের দেশের রাজধানীমুখো হবে না। তখনই তারা রাজধানীমুখো হবে, যখন কোনো ট্যুরিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যাবে অথবা নিশ্চিতভাবেই প্যারিসে তাদের কোনো কাছের মানুষ আছে, যারা সেখানে তার দায়িত্ব নেবে। ট্রামে করে নিজ এলাকার মেলায় যাওয়ার চেয়ে মেট্রোতে করে চলাচল করা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, মেট্রোতে উঠতে হলে দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতি প্রয়োজন। সবাই বিশ্বাস করে, যেখানে সবাই অচেনা, সেখানে যাওয়া ঠিক নয়। আর সেখানে গেলেই আনন্দ লাগবে, যেখানে মানুষ যখন ইচ্ছে যেতে পারে।
আমাদের ‘এখানে’ শব্দটি দিয়ে আমরা আমাদের পাশের সেই দুটো শহর লা হাভরে ও রুয়ানকেও নির্ভয়ে বোঝাই, আমাদের পরিবারগুলোয় প্রায়ই এই শহর দুটি নিয়ে কথা হয়। আমাদের শহরের অনেক শ্রমিক রেলকারে করে কাজে যায়। রুয়ান শহরটি আমাদের শহরের বেশি কাছে, তুলনামূলকভাবে শহরটা বড়। এখানে দোকানপাট রয়েছে, সর্বরোগের চিকিৎসকেরা আছেন, কয়েকটি সিনেমা হল আছে, ইনডোর সুইমিং পুল আছে, সেখানে সাঁতার শেখা যায়, সেঁ রোমেঁ নামে মেলা আছে—পুরো নভেম্বরজুড়েই যে মেলাটি বসে, আছে ট্রাম, চা-খানা, আছে হাসপাতাল, যেখানে মানুষের শরীরে জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়। এখানে ইলেকট্রিক শক দেওয়া অথবা বিষনাশক কোর্সেরও ব্যবস্থা আছে।
আমাদের শহর থেকে কেউই ভুলেও রুয়ান শহরে যাবে না, যদি সে সেখানে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ না করে। মা আমাকে বছরে দুবার রুয়ানে নিয়ে যেত। সেখানে গিয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে আমার চোখ পরীক্ষা করাতো আর নতুন চশমা বানিয়ে দিত। আর সেই সুবাদে মা সেখান থেকে কসমেটিকস আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে আনত, যেগুলো আমাদের শহরে পাওয়া যেত না। এই রুয়ান শহরটিকে আমরা ‘নিজের ঘর’ বলে মনে করতাম না, কারণ এই শহরের কেউই আমাদের পরিচিতজন ছিল না। এ শহরে যারা বসবাস করে, তারা আমাদের শহরের লোকেদের চেয়ে ভালো কাপড়চোপড় পরে, তাদের কথায় আঞ্চলিকতার টান আমাদের চেয়ে কম।
রুয়ানে এলেই আমরা বুঝতে পারতাম, কোথায় কোথায় আমরা পিছিয়ে আছি। বুদ্ধিতে, যোগাযোগ করার ক্ষমতায়, কথা বলার পারঙ্গমতায়, সামগ্রিক অগ্রসরমানতায় আমাদের দুর্বলতা ছিল।
১৯৫২ সালে আমি আমার শহরের বাইরে নিজেকে কল্পনাও করিনি। আমাকে যারা ‘আনি’ নামে চিনত, শুধু তাদের দোকানে, তাদের বাড়িতে যাওয়ার মধ্যেই আমার চলাচল ছিল সীমাবদ্ধ। অন্য পৃথিবীর কোনো কিশোরের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হওয়ার সুযোগই ছিল না। সে সময় আমার সকল ভাবনা ছিল আমার ছোট শহরটিকে ঘিরে। এই শহরের স্কুল, গির্জা, ফ্যাশনেবল কাপড়ের দোকানঘর এবং উৎসব ছিল আমার নিজের। ল হাভরে ও রুয়ানের মাঝখানে সাত হাজার মানুষের এই শহরটি ছিল পৃথিবীতে একমাত্র জায়গা, যার প্রায় সব মানুষ সম্পর্কে আমরা বলতে পারতাম, কোথায় কার বাড়ি, কার কজন ছেলেমেয়ে, কে কোথায় কাজ করে। আমরা মুখস্থ বলতে পারতাম গির্জার সময়সূচি, লেরুয়া সিনেমা হলে কটার সময় কোন সিনেমার শো আছে, কোনটা সেরা পেস্ট্রিশপ কিংবা কোন কসাইয়ের কাছ থেকে মাংস কিনলে সে মাপে কম চুরি করবে। এই শহরেই জন্মেছে আমার বাবা আর মা, কাছের কোনো গ্রামেই জন্মেছিল তাদের বাবা মা, এবং তাদেরও বাবা-মা। পৃথিবীতে কোথাও আর কোনো জায়গা নেই, যে জায়গাটিকে আমি এই শহরটির মতো এ রকম আপন করে চিনে নিতে পারি। আমি জানি, আমাদের পাশের বাড়িতে পঞ্চাশ বছর আগে কারা থাকত এবং স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার কিশোরী মা কাদের কাছ থেকে পাউরুটি কিনে আনতেন। রাস্তাঘাটে চলাচল করতে গিয়ে এমন নারী বা পুরুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়, যাদের কারও কারও সঙ্গে একটুর জন্য বাবা বা মায়ের এনগেজমেন্ট হয়নি। এরপরই কেবল বাবা আর মায়ের দেখা হয়েছে। যাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, তাদের বলি ‘আগন্তুক’।
আমরা তাদের অতীত সম্পর্কে জানি না, তারাও আমাদের অতীত সম্পর্কে কিছু জানে না। ব্রিটেনবাসী, মার্সেলবাসী, স্প্যানিশ, যেকোনো লোক, যারা আমাদের ভাষায় কথা বলে না, তারা সবাই আমাদের চোখে ‘বিদেশি’।
(অন্যান্য উপন্যাসে আমি যেভাবে এই শহরের নাম করেছি, এখানে তার দরকার নেই। কারণ রুয়ান বা ল হাভরে থেকে রেলগাড়ি চেপে কিংবা ১৫ নম্বর হাইওয়ে দিয়ে যেখানে পৌঁছানো যায়, এখানে মানচিত্রে স্থান পাওয়া সেই ভৌগোলিক স্থান হিসেবে শহরটাকে দেখানো হচ্ছে না, এটা না হয় থাকুক নামহীন আমার জন্মশহর হিসেবে, যার কাছে ফিরলে আমি হতাশা আর বিষণ্নতায় ভুগতে থাকি, আর তা আমার সব ভাবনা আর স্মৃতিকে গ্রাস করে নেয়।)
চল্লিশের দশকে জার্মান বাহিনীর আক্রমণের পর আগুনে পোড়া নগরের কেন্দ্রস্থলে নরম্যান্ডির মতোই পরে বোমা হামলা হয়, সেখানেই পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। সবকিছুই একের পর এক সাজানো আছে: নির্মাণকাজ চলছে, খালি জায়গাও আছে পাশে, ইটের নতুন ত্রিতল ভবন গড়ে উঠেছে, যার প্রথম তলায় জায়গা করে নিয়েছে ফ্যাশনেবল দোকানপাট, আর পাশেই রয়েছে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ব্যারাক আর পুরোনো ভবন: মেয়র ভবন, সিনেমা হল লেরুয়া, পোস্ট অফিস, মার্কেটের প্যাভিলিয়ন। গির্জাটা পুড়ে গিয়েছিল এবং এর নিচে তৈরি হয়েছিল ক্লাব, যা মেয়র ভবনের চত্বরের সঙ্গে জায়গা ভাগ করে নিয়েছিল। ধার্মিক মানুষ সেখানে এসে হাজির হয়, সাধারণ মানুষেরা বসে সেই স্টলগুলোয় অথবা গ্যালারিতে।
কেন্দ্রীয় সড়ক থেকে অ্যাসফাল্টে গড়া রাস্তা বা ফুটপাত ছড়িয়ে গেছে চারদিকে, ইট আর পাথরে গড়া ব্যক্তিগত বাড়িগুলো সুবিন্যস্ত হয়ে লুকিয়ে আছে প্রাচীরের আড়ালে এবং সেখানে গড়ে উঠেছে নোটারি পাবলিক, ডাক্তারখানা, বড় চাকুরেদের বাড়ি। একটু দূরেই রয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি স্কুল। এ জায়গাটাকে অবশ্য ঠিক শহরের কেন্দ্র বলা যাবে না, তবে একে শহরতলি বলারও কোনো কারণ নেই।
এরপর রয়েছে শহরতলি, যেখানকার বাসিন্দারা শহরের কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার কালে বলে, ‘শহরে যাই’ কিংবা শহরের নাম করে বলে ‘অমুক শহরে যাই।’ তবে সত্যের খাতিরে বলতে হয় শহরের কেন্দ্র আর শহরতলির মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো সীমানা নেই। তবে এখানে এসে শেষ হয়েছে ফুটপাত, বেশির ভাগ বাড়িই কাদালেপা কুঁড়ে (দু-তিনটা ঘর তাতে, পানির ব্যবস্থা নেই, টয়লেট আছে বাড়ি থেকে কিছু দূরে আর বাড়ির সঙ্গে রয়েছে বাগান)। দোকানপাট অনেক দূরে দূরে, তবে ঐতিহ্যবাহী মুদির দোকান, কফি কর্নার রয়েছে এই শহরতলিতে, যাকে ‘গ্রাম’ বলা যায়। তবে সবাই জানে, এসব দোকানে যেতে হলে ভারী জুতো কিংবা ভালো পোশাক পরার দরকার নেই। কেন্দ্র থেকে যতই দূরে যাওয়া, ততই প্রাসাদোপম বাড়ির সংখ্যা কমতে থাকে, একসময় শুধু মাটির কুঁড়ের দেখা পাওয়া যায়। শহরের প্রান্তে এসে রাস্তাগুলো হয়ে গেছে কাঁচা রাস্তা। বৃষ্টি হলেই সে রাস্তায় কাদা জমে। আর ঠিক এর পেছন থেকেই শুরু হয়েছে খামারবাড়িগুলি—এখান থেকেই আসলে গ্রামের শুরু।
(চলবে)
আরও পড়ুন:
জাহীদ রেজা নূর

আমার সামনেই ছিল অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনের তালিকা, আমি সেগুলো দ্রুতগতিতে ‘প্যারিস নরম্যান্ডি’ পত্রিকা থেকে লিখে নিচ্ছিলাম। এই তালিকা থেকে আমার কোনো নির্দিষ্ট চাওয়া-পাওয়া নেই। বলে রাখি, সে সময় গাড়ি আর রেফ্রিজারেটরের সংখ্যা ছিল খুব কম। সে সময় বিজ্ঞাপন-তারকা ছিল ‘লাক্স’ সাবান। নব্বই দশকের কম্পিউটার, ওভেন, হিমায়িত খাবার রাখার বাক্সের চেয়ে তা বেশি আকর্ষণীয় ছিল না। পণ্যের বণ্টন পণ্য প্রাপ্তির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ’৫২ সালে কারও কারও বাড়িতে বেসিনও ছিল না, আবার কারও কারও বাড়িতে অপরিহার্য ছিল বাথটাব। এটাই হচ্ছে তখনকার অবস্থা। এখনো তো কেউ কেউ পোশাকের জন্য বেছে নেয় ফ্রগি, কেউ কেউ বেছে নেয় অ্যাগনেস বি। পত্রিকা একসঙ্গে ধরে রাখে বিভিন্ন যুগের সেরা লক্ষণগুলোকেই।
আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যে শব্দগুলো দিয়ে আমি নিজেকে এবং অন্যকে চিনতাম, সে শব্দগুলো খুঁজে বের করা, যে শব্দগুলোকে সে সময় মনে হয়েছিল খুবই সাধারণ এবং অগ্রহণযোগ্য। অথবা মনে হয়েছিল একেবারেই অসম্ভব কিছু। কিন্তু আমি তো এখন ’৯৫-এ বাস করা এক নারী, যে কিনা ’৫২-এর সেই কিশোরী হিসেবে পুনর্জন্ম নিতে পারবে না কখনো, যে কিনা চেনে শুধু নিজের ছোট্ট শহরটিকে, চেনে নিজের পরিবারকে, স্কুলটাকে এবং যার শব্দভান্ডারে শব্দের সংখ্যা নিতান্তই কম। তখন আমি সেই কিশোরীটা—যার সামনে রয়েছে পুরোটা জীবন। নিজের জীবনের সবকিছুই তো আর সত্যি সত্যি মনে রাখা যায় না।
আমার শৈশবের দিনগুলোকে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই সেই সময়ের নিয়মকানুন, আচার-ব্যবহার, বিশ্বাস, সে সময়ের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলো, আমাদের স্কুলে, পরিবারে, শহরতলিতে মান্য করা রীতিগুলোকে স্মরণে আনতে হবে—সেগুলোই আসলে আমার জীবনকে গড়ে নিয়েছে, প্রশ্নহীনভাবে আমার অস্তিত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমি যে আমার মতো হলাম, তার সবকিছুই আমাকে মনে করে দেখতে হবে: আঞ্চলিক ভাষা, ধর্মীয় ধারণা, বাবা-মার বলা কথায় ব্যবহৃত শব্দাবলি, শরীর ও আশপাশের বস্তু থেকে খাপ খাওয়ানো তাদের অঙ্গভঙ্গি, মেয়েদের ম্যাগাজিনে পড়া উপন্যাস ‘পেটিট ইকো দ্য লা ফ্যাশন’ বা ‘ভিয়েনে দ্য শোমের’। এসব ভিন্ন ভিন্ন শব্দের কোনো কোনোটি এখনো আমার জীবন থেকে অর্থ হারিয়ে ফেলেনি—এবং সে শব্দগুলোই সেই ভয়ংকর দৃশ্যটি ঘিরে তৈরি করেছিল এর প্রেক্ষাপট, যা বারো বছর বয়সী একটি মেয়ের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল এবং মেয়েটি একদিন মনে করল, আতঙ্কে সে পাগল হয়ে গেছে।
তাহলে বলি। যা দাঁড়াচ্ছে, তা কোনো কারণেই একটি কল্পনার আশ্রয়ে গড়ে ওঠা কোনো ছোটগল্প হবে না। বাস্তবতার ছোঁয়াহীন কোনো গল্প এটা নয়। আমি শুধু কাগজে আমার শৈশবের ছবি আঁকতে চাই না, বরং আমি জীবনের নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সে ছবিটি দেখতে চাই, যে ছবিটি তার আলোকে পরিষ্কার হয়ে উঠতে পারে। সংক্ষেপে, আমি সেভাবেই নিজের জীবনটি দেখতে চাই, যেভাবে দেখে একজন নৃতাত্ত্বিক।
(এটা অবশ্য বলার কোনো প্রয়োজনই ছিল না, কিন্তু আমি চাই আমার কাজকে একদম স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে, নইলে আমি কাজটা করে উঠতে পারব না।)
আমি হয়তো আমার শৈশবের নিত্য কথামালা ও দৈনন্দিন জীবনের প্রেক্ষাপটে ওই ভয়ংকর দৃশ্যটি তুলে ধরার চেষ্টা করব। অথবা এমনও হতে পারে, আমাকে চালিত করবে উন্মত্ত—প্রতারক কোনো শক্তি, যাকে মনে হতে পারে আমার অচেনা গসপেলের মতোই অভিশপ্ত। এমন এক অভিশাপ, যা আমাকে ভুডু আচারধর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মেনে নিন এবং পাঠ করুন: ইহা আমার দেহ, যাহা আপনার নিকট অর্পণ করা হইবে, ইহা আমার রক্তপূর্ণ বাটি, যাহা আপনার এবং আরও অনেকের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইবে।
১৯৫২ সালের জুন মাসের আগে অবধি আমি কোনো দিন আমার শহর ছেড়ে আর কোথাও যাইনি। আমার শহরটাকে সবখানে একটু ধোঁয়াশাঘেরা অদ্ভুত নামে ডাকা হয়, অথচ সেই নামটিই সবার কাছে পরিচিত, ‘কো অঞ্চল’। এটাকে আমরা ‘এখানে’ বলে থাকি। এই শহর দাঁড়িয়ে আছে সেন নদীর ডান পারে, লে হাভরে ও রুয়ান শহর দুটোর মাঝখানে এর অবস্থান। এবং এই দুই শহরের পর আর কী আছে, তা আমার একেবারেই জানা নেই। আসলে এরপর যা আছে, তা হলো ফ্রান্সের বাকি অংশ, আসলে রয়েছে বাদবাকি পুরো পৃথিবীটা। এই অজানা জায়গা সম্পর্কে ‘সেখানে’ শব্দটি ব্যবহার করি আমরা। আর সে শব্দ ব্যবহার করার সময় দিগন্তের দিকে এমনভাবে হাত নাড়া হয়, যা দেখে মনে হবে, এ এক উদাসীনতার প্রকাশ কিংবা ওই বাদবাকি পৃথিবী সম্পর্কে জানার কোনো উপায় নেই বলেই এমনটা করা হচ্ছে। আমাদের শহর থেকে কেউই আমাদের দেশের রাজধানীমুখো হবে না। তখনই তারা রাজধানীমুখো হবে, যখন কোনো ট্যুরিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যাবে অথবা নিশ্চিতভাবেই প্যারিসে তাদের কোনো কাছের মানুষ আছে, যারা সেখানে তার দায়িত্ব নেবে। ট্রামে করে নিজ এলাকার মেলায় যাওয়ার চেয়ে মেট্রোতে করে চলাচল করা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, মেট্রোতে উঠতে হলে দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতি প্রয়োজন। সবাই বিশ্বাস করে, যেখানে সবাই অচেনা, সেখানে যাওয়া ঠিক নয়। আর সেখানে গেলেই আনন্দ লাগবে, যেখানে মানুষ যখন ইচ্ছে যেতে পারে।
আমাদের ‘এখানে’ শব্দটি দিয়ে আমরা আমাদের পাশের সেই দুটো শহর লা হাভরে ও রুয়ানকেও নির্ভয়ে বোঝাই, আমাদের পরিবারগুলোয় প্রায়ই এই শহর দুটি নিয়ে কথা হয়। আমাদের শহরের অনেক শ্রমিক রেলকারে করে কাজে যায়। রুয়ান শহরটি আমাদের শহরের বেশি কাছে, তুলনামূলকভাবে শহরটা বড়। এখানে দোকানপাট রয়েছে, সর্বরোগের চিকিৎসকেরা আছেন, কয়েকটি সিনেমা হল আছে, ইনডোর সুইমিং পুল আছে, সেখানে সাঁতার শেখা যায়, সেঁ রোমেঁ নামে মেলা আছে—পুরো নভেম্বরজুড়েই যে মেলাটি বসে, আছে ট্রাম, চা-খানা, আছে হাসপাতাল, যেখানে মানুষের শরীরে জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়। এখানে ইলেকট্রিক শক দেওয়া অথবা বিষনাশক কোর্সেরও ব্যবস্থা আছে।
আমাদের শহর থেকে কেউই ভুলেও রুয়ান শহরে যাবে না, যদি সে সেখানে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ না করে। মা আমাকে বছরে দুবার রুয়ানে নিয়ে যেত। সেখানে গিয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে আমার চোখ পরীক্ষা করাতো আর নতুন চশমা বানিয়ে দিত। আর সেই সুবাদে মা সেখান থেকে কসমেটিকস আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে আনত, যেগুলো আমাদের শহরে পাওয়া যেত না। এই রুয়ান শহরটিকে আমরা ‘নিজের ঘর’ বলে মনে করতাম না, কারণ এই শহরের কেউই আমাদের পরিচিতজন ছিল না। এ শহরে যারা বসবাস করে, তারা আমাদের শহরের লোকেদের চেয়ে ভালো কাপড়চোপড় পরে, তাদের কথায় আঞ্চলিকতার টান আমাদের চেয়ে কম।
রুয়ানে এলেই আমরা বুঝতে পারতাম, কোথায় কোথায় আমরা পিছিয়ে আছি। বুদ্ধিতে, যোগাযোগ করার ক্ষমতায়, কথা বলার পারঙ্গমতায়, সামগ্রিক অগ্রসরমানতায় আমাদের দুর্বলতা ছিল।
১৯৫২ সালে আমি আমার শহরের বাইরে নিজেকে কল্পনাও করিনি। আমাকে যারা ‘আনি’ নামে চিনত, শুধু তাদের দোকানে, তাদের বাড়িতে যাওয়ার মধ্যেই আমার চলাচল ছিল সীমাবদ্ধ। অন্য পৃথিবীর কোনো কিশোরের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হওয়ার সুযোগই ছিল না। সে সময় আমার সকল ভাবনা ছিল আমার ছোট শহরটিকে ঘিরে। এই শহরের স্কুল, গির্জা, ফ্যাশনেবল কাপড়ের দোকানঘর এবং উৎসব ছিল আমার নিজের। ল হাভরে ও রুয়ানের মাঝখানে সাত হাজার মানুষের এই শহরটি ছিল পৃথিবীতে একমাত্র জায়গা, যার প্রায় সব মানুষ সম্পর্কে আমরা বলতে পারতাম, কোথায় কার বাড়ি, কার কজন ছেলেমেয়ে, কে কোথায় কাজ করে। আমরা মুখস্থ বলতে পারতাম গির্জার সময়সূচি, লেরুয়া সিনেমা হলে কটার সময় কোন সিনেমার শো আছে, কোনটা সেরা পেস্ট্রিশপ কিংবা কোন কসাইয়ের কাছ থেকে মাংস কিনলে সে মাপে কম চুরি করবে। এই শহরেই জন্মেছে আমার বাবা আর মা, কাছের কোনো গ্রামেই জন্মেছিল তাদের বাবা মা, এবং তাদেরও বাবা-মা। পৃথিবীতে কোথাও আর কোনো জায়গা নেই, যে জায়গাটিকে আমি এই শহরটির মতো এ রকম আপন করে চিনে নিতে পারি। আমি জানি, আমাদের পাশের বাড়িতে পঞ্চাশ বছর আগে কারা থাকত এবং স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার কিশোরী মা কাদের কাছ থেকে পাউরুটি কিনে আনতেন। রাস্তাঘাটে চলাচল করতে গিয়ে এমন নারী বা পুরুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়, যাদের কারও কারও সঙ্গে একটুর জন্য বাবা বা মায়ের এনগেজমেন্ট হয়নি। এরপরই কেবল বাবা আর মায়ের দেখা হয়েছে। যাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, তাদের বলি ‘আগন্তুক’।
আমরা তাদের অতীত সম্পর্কে জানি না, তারাও আমাদের অতীত সম্পর্কে কিছু জানে না। ব্রিটেনবাসী, মার্সেলবাসী, স্প্যানিশ, যেকোনো লোক, যারা আমাদের ভাষায় কথা বলে না, তারা সবাই আমাদের চোখে ‘বিদেশি’।
(অন্যান্য উপন্যাসে আমি যেভাবে এই শহরের নাম করেছি, এখানে তার দরকার নেই। কারণ রুয়ান বা ল হাভরে থেকে রেলগাড়ি চেপে কিংবা ১৫ নম্বর হাইওয়ে দিয়ে যেখানে পৌঁছানো যায়, এখানে মানচিত্রে স্থান পাওয়া সেই ভৌগোলিক স্থান হিসেবে শহরটাকে দেখানো হচ্ছে না, এটা না হয় থাকুক নামহীন আমার জন্মশহর হিসেবে, যার কাছে ফিরলে আমি হতাশা আর বিষণ্নতায় ভুগতে থাকি, আর তা আমার সব ভাবনা আর স্মৃতিকে গ্রাস করে নেয়।)
চল্লিশের দশকে জার্মান বাহিনীর আক্রমণের পর আগুনে পোড়া নগরের কেন্দ্রস্থলে নরম্যান্ডির মতোই পরে বোমা হামলা হয়, সেখানেই পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। সবকিছুই একের পর এক সাজানো আছে: নির্মাণকাজ চলছে, খালি জায়গাও আছে পাশে, ইটের নতুন ত্রিতল ভবন গড়ে উঠেছে, যার প্রথম তলায় জায়গা করে নিয়েছে ফ্যাশনেবল দোকানপাট, আর পাশেই রয়েছে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ব্যারাক আর পুরোনো ভবন: মেয়র ভবন, সিনেমা হল লেরুয়া, পোস্ট অফিস, মার্কেটের প্যাভিলিয়ন। গির্জাটা পুড়ে গিয়েছিল এবং এর নিচে তৈরি হয়েছিল ক্লাব, যা মেয়র ভবনের চত্বরের সঙ্গে জায়গা ভাগ করে নিয়েছিল। ধার্মিক মানুষ সেখানে এসে হাজির হয়, সাধারণ মানুষেরা বসে সেই স্টলগুলোয় অথবা গ্যালারিতে।
কেন্দ্রীয় সড়ক থেকে অ্যাসফাল্টে গড়া রাস্তা বা ফুটপাত ছড়িয়ে গেছে চারদিকে, ইট আর পাথরে গড়া ব্যক্তিগত বাড়িগুলো সুবিন্যস্ত হয়ে লুকিয়ে আছে প্রাচীরের আড়ালে এবং সেখানে গড়ে উঠেছে নোটারি পাবলিক, ডাক্তারখানা, বড় চাকুরেদের বাড়ি। একটু দূরেই রয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি স্কুল। এ জায়গাটাকে অবশ্য ঠিক শহরের কেন্দ্র বলা যাবে না, তবে একে শহরতলি বলারও কোনো কারণ নেই।
এরপর রয়েছে শহরতলি, যেখানকার বাসিন্দারা শহরের কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার কালে বলে, ‘শহরে যাই’ কিংবা শহরের নাম করে বলে ‘অমুক শহরে যাই।’ তবে সত্যের খাতিরে বলতে হয় শহরের কেন্দ্র আর শহরতলির মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো সীমানা নেই। তবে এখানে এসে শেষ হয়েছে ফুটপাত, বেশির ভাগ বাড়িই কাদালেপা কুঁড়ে (দু-তিনটা ঘর তাতে, পানির ব্যবস্থা নেই, টয়লেট আছে বাড়ি থেকে কিছু দূরে আর বাড়ির সঙ্গে রয়েছে বাগান)। দোকানপাট অনেক দূরে দূরে, তবে ঐতিহ্যবাহী মুদির দোকান, কফি কর্নার রয়েছে এই শহরতলিতে, যাকে ‘গ্রাম’ বলা যায়। তবে সবাই জানে, এসব দোকানে যেতে হলে ভারী জুতো কিংবা ভালো পোশাক পরার দরকার নেই। কেন্দ্র থেকে যতই দূরে যাওয়া, ততই প্রাসাদোপম বাড়ির সংখ্যা কমতে থাকে, একসময় শুধু মাটির কুঁড়ের দেখা পাওয়া যায়। শহরের প্রান্তে এসে রাস্তাগুলো হয়ে গেছে কাঁচা রাস্তা। বৃষ্টি হলেই সে রাস্তায় কাদা জমে। আর ঠিক এর পেছন থেকেই শুরু হয়েছে খামারবাড়িগুলি—এখান থেকেই আসলে গ্রামের শুরু।
(চলবে)
আরও পড়ুন:

আমার সামনেই ছিল অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনের তালিকা, আমি সেগুলো দ্রুতগতিতে ‘প্যারিস নরম্যান্ডি’ পত্রিকা থেকে লিখে নিচ্ছিলাম। এই তালিকা থেকে আমার কোনো নির্দিষ্ট চাওয়া-পাওয়া নেই। বলে রাখি, সে সময় গাড়ি আর রেফ্রিজারেটরের সংখ্যা ছিল খুব কম। সে সময় বিজ্ঞাপন-তারকা ছিল ‘লাক্স’ সাবান। নব্বই দশকের কম্পিউটার, ওভেন, হিমায়িত খাবার রাখার বাক্সের চেয়ে তা বেশি আকর্ষণীয় ছিল না। পণ্যের বণ্টন পণ্য প্রাপ্তির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ’৫২ সালে কারও কারও বাড়িতে বেসিনও ছিল না, আবার কারও কারও বাড়িতে অপরিহার্য ছিল বাথটাব। এটাই হচ্ছে তখনকার অবস্থা। এখনো তো কেউ কেউ পোশাকের জন্য বেছে নেয় ফ্রগি, কেউ কেউ বেছে নেয় অ্যাগনেস বি। পত্রিকা একসঙ্গে ধরে রাখে বিভিন্ন যুগের সেরা লক্ষণগুলোকেই।
আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যে শব্দগুলো দিয়ে আমি নিজেকে এবং অন্যকে চিনতাম, সে শব্দগুলো খুঁজে বের করা, যে শব্দগুলোকে সে সময় মনে হয়েছিল খুবই সাধারণ এবং অগ্রহণযোগ্য। অথবা মনে হয়েছিল একেবারেই অসম্ভব কিছু। কিন্তু আমি তো এখন ’৯৫-এ বাস করা এক নারী, যে কিনা ’৫২-এর সেই কিশোরী হিসেবে পুনর্জন্ম নিতে পারবে না কখনো, যে কিনা চেনে শুধু নিজের ছোট্ট শহরটিকে, চেনে নিজের পরিবারকে, স্কুলটাকে এবং যার শব্দভান্ডারে শব্দের সংখ্যা নিতান্তই কম। তখন আমি সেই কিশোরীটা—যার সামনে রয়েছে পুরোটা জীবন। নিজের জীবনের সবকিছুই তো আর সত্যি সত্যি মনে রাখা যায় না।
আমার শৈশবের দিনগুলোকে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই সেই সময়ের নিয়মকানুন, আচার-ব্যবহার, বিশ্বাস, সে সময়ের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলো, আমাদের স্কুলে, পরিবারে, শহরতলিতে মান্য করা রীতিগুলোকে স্মরণে আনতে হবে—সেগুলোই আসলে আমার জীবনকে গড়ে নিয়েছে, প্রশ্নহীনভাবে আমার অস্তিত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমি যে আমার মতো হলাম, তার সবকিছুই আমাকে মনে করে দেখতে হবে: আঞ্চলিক ভাষা, ধর্মীয় ধারণা, বাবা-মার বলা কথায় ব্যবহৃত শব্দাবলি, শরীর ও আশপাশের বস্তু থেকে খাপ খাওয়ানো তাদের অঙ্গভঙ্গি, মেয়েদের ম্যাগাজিনে পড়া উপন্যাস ‘পেটিট ইকো দ্য লা ফ্যাশন’ বা ‘ভিয়েনে দ্য শোমের’। এসব ভিন্ন ভিন্ন শব্দের কোনো কোনোটি এখনো আমার জীবন থেকে অর্থ হারিয়ে ফেলেনি—এবং সে শব্দগুলোই সেই ভয়ংকর দৃশ্যটি ঘিরে তৈরি করেছিল এর প্রেক্ষাপট, যা বারো বছর বয়সী একটি মেয়ের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল এবং মেয়েটি একদিন মনে করল, আতঙ্কে সে পাগল হয়ে গেছে।
তাহলে বলি। যা দাঁড়াচ্ছে, তা কোনো কারণেই একটি কল্পনার আশ্রয়ে গড়ে ওঠা কোনো ছোটগল্প হবে না। বাস্তবতার ছোঁয়াহীন কোনো গল্প এটা নয়। আমি শুধু কাগজে আমার শৈশবের ছবি আঁকতে চাই না, বরং আমি জীবনের নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সে ছবিটি দেখতে চাই, যে ছবিটি তার আলোকে পরিষ্কার হয়ে উঠতে পারে। সংক্ষেপে, আমি সেভাবেই নিজের জীবনটি দেখতে চাই, যেভাবে দেখে একজন নৃতাত্ত্বিক।
(এটা অবশ্য বলার কোনো প্রয়োজনই ছিল না, কিন্তু আমি চাই আমার কাজকে একদম স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে, নইলে আমি কাজটা করে উঠতে পারব না।)
আমি হয়তো আমার শৈশবের নিত্য কথামালা ও দৈনন্দিন জীবনের প্রেক্ষাপটে ওই ভয়ংকর দৃশ্যটি তুলে ধরার চেষ্টা করব। অথবা এমনও হতে পারে, আমাকে চালিত করবে উন্মত্ত—প্রতারক কোনো শক্তি, যাকে মনে হতে পারে আমার অচেনা গসপেলের মতোই অভিশপ্ত। এমন এক অভিশাপ, যা আমাকে ভুডু আচারধর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মেনে নিন এবং পাঠ করুন: ইহা আমার দেহ, যাহা আপনার নিকট অর্পণ করা হইবে, ইহা আমার রক্তপূর্ণ বাটি, যাহা আপনার এবং আরও অনেকের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইবে।
১৯৫২ সালের জুন মাসের আগে অবধি আমি কোনো দিন আমার শহর ছেড়ে আর কোথাও যাইনি। আমার শহরটাকে সবখানে একটু ধোঁয়াশাঘেরা অদ্ভুত নামে ডাকা হয়, অথচ সেই নামটিই সবার কাছে পরিচিত, ‘কো অঞ্চল’। এটাকে আমরা ‘এখানে’ বলে থাকি। এই শহর দাঁড়িয়ে আছে সেন নদীর ডান পারে, লে হাভরে ও রুয়ান শহর দুটোর মাঝখানে এর অবস্থান। এবং এই দুই শহরের পর আর কী আছে, তা আমার একেবারেই জানা নেই। আসলে এরপর যা আছে, তা হলো ফ্রান্সের বাকি অংশ, আসলে রয়েছে বাদবাকি পুরো পৃথিবীটা। এই অজানা জায়গা সম্পর্কে ‘সেখানে’ শব্দটি ব্যবহার করি আমরা। আর সে শব্দ ব্যবহার করার সময় দিগন্তের দিকে এমনভাবে হাত নাড়া হয়, যা দেখে মনে হবে, এ এক উদাসীনতার প্রকাশ কিংবা ওই বাদবাকি পৃথিবী সম্পর্কে জানার কোনো উপায় নেই বলেই এমনটা করা হচ্ছে। আমাদের শহর থেকে কেউই আমাদের দেশের রাজধানীমুখো হবে না। তখনই তারা রাজধানীমুখো হবে, যখন কোনো ট্যুরিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যাবে অথবা নিশ্চিতভাবেই প্যারিসে তাদের কোনো কাছের মানুষ আছে, যারা সেখানে তার দায়িত্ব নেবে। ট্রামে করে নিজ এলাকার মেলায় যাওয়ার চেয়ে মেট্রোতে করে চলাচল করা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, মেট্রোতে উঠতে হলে দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতি প্রয়োজন। সবাই বিশ্বাস করে, যেখানে সবাই অচেনা, সেখানে যাওয়া ঠিক নয়। আর সেখানে গেলেই আনন্দ লাগবে, যেখানে মানুষ যখন ইচ্ছে যেতে পারে।
আমাদের ‘এখানে’ শব্দটি দিয়ে আমরা আমাদের পাশের সেই দুটো শহর লা হাভরে ও রুয়ানকেও নির্ভয়ে বোঝাই, আমাদের পরিবারগুলোয় প্রায়ই এই শহর দুটি নিয়ে কথা হয়। আমাদের শহরের অনেক শ্রমিক রেলকারে করে কাজে যায়। রুয়ান শহরটি আমাদের শহরের বেশি কাছে, তুলনামূলকভাবে শহরটা বড়। এখানে দোকানপাট রয়েছে, সর্বরোগের চিকিৎসকেরা আছেন, কয়েকটি সিনেমা হল আছে, ইনডোর সুইমিং পুল আছে, সেখানে সাঁতার শেখা যায়, সেঁ রোমেঁ নামে মেলা আছে—পুরো নভেম্বরজুড়েই যে মেলাটি বসে, আছে ট্রাম, চা-খানা, আছে হাসপাতাল, যেখানে মানুষের শরীরে জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়। এখানে ইলেকট্রিক শক দেওয়া অথবা বিষনাশক কোর্সেরও ব্যবস্থা আছে।
আমাদের শহর থেকে কেউই ভুলেও রুয়ান শহরে যাবে না, যদি সে সেখানে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ না করে। মা আমাকে বছরে দুবার রুয়ানে নিয়ে যেত। সেখানে গিয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে আমার চোখ পরীক্ষা করাতো আর নতুন চশমা বানিয়ে দিত। আর সেই সুবাদে মা সেখান থেকে কসমেটিকস আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে আনত, যেগুলো আমাদের শহরে পাওয়া যেত না। এই রুয়ান শহরটিকে আমরা ‘নিজের ঘর’ বলে মনে করতাম না, কারণ এই শহরের কেউই আমাদের পরিচিতজন ছিল না। এ শহরে যারা বসবাস করে, তারা আমাদের শহরের লোকেদের চেয়ে ভালো কাপড়চোপড় পরে, তাদের কথায় আঞ্চলিকতার টান আমাদের চেয়ে কম।
রুয়ানে এলেই আমরা বুঝতে পারতাম, কোথায় কোথায় আমরা পিছিয়ে আছি। বুদ্ধিতে, যোগাযোগ করার ক্ষমতায়, কথা বলার পারঙ্গমতায়, সামগ্রিক অগ্রসরমানতায় আমাদের দুর্বলতা ছিল।
১৯৫২ সালে আমি আমার শহরের বাইরে নিজেকে কল্পনাও করিনি। আমাকে যারা ‘আনি’ নামে চিনত, শুধু তাদের দোকানে, তাদের বাড়িতে যাওয়ার মধ্যেই আমার চলাচল ছিল সীমাবদ্ধ। অন্য পৃথিবীর কোনো কিশোরের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হওয়ার সুযোগই ছিল না। সে সময় আমার সকল ভাবনা ছিল আমার ছোট শহরটিকে ঘিরে। এই শহরের স্কুল, গির্জা, ফ্যাশনেবল কাপড়ের দোকানঘর এবং উৎসব ছিল আমার নিজের। ল হাভরে ও রুয়ানের মাঝখানে সাত হাজার মানুষের এই শহরটি ছিল পৃথিবীতে একমাত্র জায়গা, যার প্রায় সব মানুষ সম্পর্কে আমরা বলতে পারতাম, কোথায় কার বাড়ি, কার কজন ছেলেমেয়ে, কে কোথায় কাজ করে। আমরা মুখস্থ বলতে পারতাম গির্জার সময়সূচি, লেরুয়া সিনেমা হলে কটার সময় কোন সিনেমার শো আছে, কোনটা সেরা পেস্ট্রিশপ কিংবা কোন কসাইয়ের কাছ থেকে মাংস কিনলে সে মাপে কম চুরি করবে। এই শহরেই জন্মেছে আমার বাবা আর মা, কাছের কোনো গ্রামেই জন্মেছিল তাদের বাবা মা, এবং তাদেরও বাবা-মা। পৃথিবীতে কোথাও আর কোনো জায়গা নেই, যে জায়গাটিকে আমি এই শহরটির মতো এ রকম আপন করে চিনে নিতে পারি। আমি জানি, আমাদের পাশের বাড়িতে পঞ্চাশ বছর আগে কারা থাকত এবং স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার কিশোরী মা কাদের কাছ থেকে পাউরুটি কিনে আনতেন। রাস্তাঘাটে চলাচল করতে গিয়ে এমন নারী বা পুরুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়, যাদের কারও কারও সঙ্গে একটুর জন্য বাবা বা মায়ের এনগেজমেন্ট হয়নি। এরপরই কেবল বাবা আর মায়ের দেখা হয়েছে। যাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, তাদের বলি ‘আগন্তুক’।
আমরা তাদের অতীত সম্পর্কে জানি না, তারাও আমাদের অতীত সম্পর্কে কিছু জানে না। ব্রিটেনবাসী, মার্সেলবাসী, স্প্যানিশ, যেকোনো লোক, যারা আমাদের ভাষায় কথা বলে না, তারা সবাই আমাদের চোখে ‘বিদেশি’।
(অন্যান্য উপন্যাসে আমি যেভাবে এই শহরের নাম করেছি, এখানে তার দরকার নেই। কারণ রুয়ান বা ল হাভরে থেকে রেলগাড়ি চেপে কিংবা ১৫ নম্বর হাইওয়ে দিয়ে যেখানে পৌঁছানো যায়, এখানে মানচিত্রে স্থান পাওয়া সেই ভৌগোলিক স্থান হিসেবে শহরটাকে দেখানো হচ্ছে না, এটা না হয় থাকুক নামহীন আমার জন্মশহর হিসেবে, যার কাছে ফিরলে আমি হতাশা আর বিষণ্নতায় ভুগতে থাকি, আর তা আমার সব ভাবনা আর স্মৃতিকে গ্রাস করে নেয়।)
চল্লিশের দশকে জার্মান বাহিনীর আক্রমণের পর আগুনে পোড়া নগরের কেন্দ্রস্থলে নরম্যান্ডির মতোই পরে বোমা হামলা হয়, সেখানেই পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। সবকিছুই একের পর এক সাজানো আছে: নির্মাণকাজ চলছে, খালি জায়গাও আছে পাশে, ইটের নতুন ত্রিতল ভবন গড়ে উঠেছে, যার প্রথম তলায় জায়গা করে নিয়েছে ফ্যাশনেবল দোকানপাট, আর পাশেই রয়েছে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ব্যারাক আর পুরোনো ভবন: মেয়র ভবন, সিনেমা হল লেরুয়া, পোস্ট অফিস, মার্কেটের প্যাভিলিয়ন। গির্জাটা পুড়ে গিয়েছিল এবং এর নিচে তৈরি হয়েছিল ক্লাব, যা মেয়র ভবনের চত্বরের সঙ্গে জায়গা ভাগ করে নিয়েছিল। ধার্মিক মানুষ সেখানে এসে হাজির হয়, সাধারণ মানুষেরা বসে সেই স্টলগুলোয় অথবা গ্যালারিতে।
কেন্দ্রীয় সড়ক থেকে অ্যাসফাল্টে গড়া রাস্তা বা ফুটপাত ছড়িয়ে গেছে চারদিকে, ইট আর পাথরে গড়া ব্যক্তিগত বাড়িগুলো সুবিন্যস্ত হয়ে লুকিয়ে আছে প্রাচীরের আড়ালে এবং সেখানে গড়ে উঠেছে নোটারি পাবলিক, ডাক্তারখানা, বড় চাকুরেদের বাড়ি। একটু দূরেই রয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি স্কুল। এ জায়গাটাকে অবশ্য ঠিক শহরের কেন্দ্র বলা যাবে না, তবে একে শহরতলি বলারও কোনো কারণ নেই।
এরপর রয়েছে শহরতলি, যেখানকার বাসিন্দারা শহরের কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার কালে বলে, ‘শহরে যাই’ কিংবা শহরের নাম করে বলে ‘অমুক শহরে যাই।’ তবে সত্যের খাতিরে বলতে হয় শহরের কেন্দ্র আর শহরতলির মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো সীমানা নেই। তবে এখানে এসে শেষ হয়েছে ফুটপাত, বেশির ভাগ বাড়িই কাদালেপা কুঁড়ে (দু-তিনটা ঘর তাতে, পানির ব্যবস্থা নেই, টয়লেট আছে বাড়ি থেকে কিছু দূরে আর বাড়ির সঙ্গে রয়েছে বাগান)। দোকানপাট অনেক দূরে দূরে, তবে ঐতিহ্যবাহী মুদির দোকান, কফি কর্নার রয়েছে এই শহরতলিতে, যাকে ‘গ্রাম’ বলা যায়। তবে সবাই জানে, এসব দোকানে যেতে হলে ভারী জুতো কিংবা ভালো পোশাক পরার দরকার নেই। কেন্দ্র থেকে যতই দূরে যাওয়া, ততই প্রাসাদোপম বাড়ির সংখ্যা কমতে থাকে, একসময় শুধু মাটির কুঁড়ের দেখা পাওয়া যায়। শহরের প্রান্তে এসে রাস্তাগুলো হয়ে গেছে কাঁচা রাস্তা। বৃষ্টি হলেই সে রাস্তায় কাদা জমে। আর ঠিক এর পেছন থেকেই শুরু হয়েছে খামারবাড়িগুলি—এখান থেকেই আসলে গ্রামের শুরু।
(চলবে)
আরও পড়ুন:

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

আমার সামনেই ছিল অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনের তালিকা, আমি সেগুলো দ্রুতগতিতে ‘প্যারিস নরম্যান্ডি’ পত্রিকা থেকে লিখে নিচ্ছিলাম। এই তালিকা থেকে আমার কোনো নির্দিষ্ট চাওয়া-পাওয়া নেই...
০১ নভেম্বর ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

আমার সামনেই ছিল অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনের তালিকা, আমি সেগুলো দ্রুতগতিতে ‘প্যারিস নরম্যান্ডি’ পত্রিকা থেকে লিখে নিচ্ছিলাম। এই তালিকা থেকে আমার কোনো নির্দিষ্ট চাওয়া-পাওয়া নেই...
০১ নভেম্বর ২০২২
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

আমার সামনেই ছিল অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনের তালিকা, আমি সেগুলো দ্রুতগতিতে ‘প্যারিস নরম্যান্ডি’ পত্রিকা থেকে লিখে নিচ্ছিলাম। এই তালিকা থেকে আমার কোনো নির্দিষ্ট চাওয়া-পাওয়া নেই...
০১ নভেম্বর ২০২২
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

আমার সামনেই ছিল অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনের তালিকা, আমি সেগুলো দ্রুতগতিতে ‘প্যারিস নরম্যান্ডি’ পত্রিকা থেকে লিখে নিচ্ছিলাম। এই তালিকা থেকে আমার কোনো নির্দিষ্ট চাওয়া-পাওয়া নেই...
০১ নভেম্বর ২০২২
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫