Ajker Patrika

ফরেন পলিসির নিবন্ধ /যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের ইতিহাস: পরিণতিতে পাঁচবার অর্থনৈতিক মন্দা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আজকের দিনে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা এত স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, যা আগে খুব কমই দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। জবাবে বেইজিং মার্কিন পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক কার্যত স্থবির হয়ে গেছে।

এর ফলাফল ও প্রভাব এখনো সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। সামনে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা আসতে পারে। এমনকি চীন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড কেনা বন্ধও করে দিতে পারে। অন্যান্য দেশ নতুন মার্কিন শুল্ক থেকে ৯০ দিনের জন্য ছাড় পেয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই শুল্ক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। তবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীরা তাঁদের ক্রয় ও বিনিয়োগের পরিকল্পনা করতে দ্বিধায় ভুগছেন। ওয়াশিংটনের বারবার নীতি পরিবর্তন নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা ঘুরছে খুব ধীরে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল আমদানি করা সব পণ্যের ওপর নতুন ও কঠোর শুল্ক আরোপের ঘোষণা করার পরই বোঝা গেল, পরিস্থিতি কত দ্রুত খারাপ হতে পারে। কয়েক দিনের মধ্যেই আর্থিক বাজার থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে গেছে।

বিনিয়োগকারীরা মার্কিন ডলারে আস্থা হারিয়েছেন ও মার্কিন বন্ড বিক্রি করে অর্থ সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। এতে আর্থিক বিপর্যয়ের সংকেত দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্প কিংবা চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং কেউই ছাড় দিতে রাজি নন। আর তাই এই সংঘাত বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটে রূপ নেওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বাণিজ্য যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতির বেশ কিছু নজির রয়েছে। উনিশ শতকের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ছয়টি অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা বলতে ছয় বা তার বেশি ত্রৈমাসিক পর্যন্ত টানা অর্থনৈতিক সংকোচন বোঝানো হয়। যদিও এর কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই।

এই ছয়টি মন্দার মধ্যে পাঁচটি সরাসরি শুল্ক এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে হয়েছিল, অথবা এগুলোর কারণে মন্দা পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপের দিকে গিয়েছিল। নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ধ্বংসাত্মক হবে—যদি না কেউ তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং এটি ঠেকিয়ে দেয়।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এক শক্তিশালী চালিকাশক্তি হলো ‘কম্পারেটিভ অ্যাডভান্টেজেস’ বা ‘তুলনামূলক সুবিধা’। এর মাধ্যমে কোনো দেশ গম উৎপাদন, কাপড় তৈরি বা সফটওয়্যার কোডিংয়ের মতো বিশেষায়িত দক্ষতা অর্জন করে লাভবান হতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে এসব পণ্যের ব্যবসার মাধ্যমে প্রতিটি দেশ তাদের সীমিত সম্পদকে সেসব জিনিস উৎপাদনে ব্যবহার করতে পারে যা তাদের কৃষক, খনি শ্রমিক ও কারিগর সবচেয়ে কম খরচে তৈরি করতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে সবাই উপকৃত হয়।

এই তত্ত্বটি বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। ১৮৪৬ সালে যখন মহাদেশব্যাপী ‘আলুর দুর্ভিক্ষ’ যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রকে খাদ্যপণ্যের অবাধ বাণিজ্য চালু করতে বাধ্য করে, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যাপক সমৃদ্ধি আসে। এ সময় অবশ্য কিছু গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইউরোপের ভূস্বামীরা অভিযোগ করেন যে, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে।

তাদের অভিযোগের ভিত্তি ছিল—রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পশ্চিমাঞ্চলের উর্বর সমভূমি এত সস্তায় গম উৎপাদন করত যে ইউরোপে কৃষিজমির দামই কমে যায়। ফলে ব্রিটেন ও ইউরোপের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ শহরের দিকে যাত্রা করে, যা নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ঢেউ সৃষ্টি করে।

অবশ্যই, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বড় এবং শক্তিশালী অর্থনীতি অভিন্ন বাজার মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রভাব খাটাতে পারে। তারা মুদ্রা বিনিময় হার নিজেদের রপ্তানির পক্ষে নিতে পারে। আবার বিশেষ কোনো বাণিজ্যকে সুবিধা দিতে ভর্তুকি দিতে পারে। যেমন—গম বাদ দিয়ে ভুট্টা, টেক্সটাইলের চেয়ে কম্পিউটার চিপস অথবা চালের চেয়ে টেক্সটাইলকে তারা সুবিধা দিতে পারে।

পরিবেশ ও শ্রম আইনও বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে, যা অনেক সময় অপ্রত্যাশিত হয়। বড় দেশের মনোপলিস্ট বা একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা প্রায়ই বিভিন্ন নিয়মকানুন ও শুল্কের পক্ষে থাকেন। এর মাধ্যমে তারা প্রতিযোগিতা এড়িয়ে নিজেদের মূল্যবান সম্পদ আরও বাড়াতে পারেন।

একসময়ের ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বাণিজ্য যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বহু শতাব্দী ধরে ব্রিটেন তার উপনিবেশগুলোর বাণিজ্যকে নিজ দেশের প্রয়োজনে গড়ে তুলেছিল। নিউইয়র্ক, মেরিল্যান্ড ও সাউথ ক্যারোলিনার উপনিবেশগুলো থেকে আশা করা হতো যে, তারা ভার্জিনিয়া এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে দাস-শ্রমিক নির্ভর তামাক ও চিনির খামারগুলোর জন্য আটা ও চাল সরবরাহ করবে।

ব্রিটেন উপনিবেশগুলোকে নিজেদের বস্ত্র, লোহা ও কাগজ তৈরি করতে বাধা দিয়েছে। উপনিবেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর ব্রিটেনের ক্রমবর্ধমান বিধিনিষেধ শেষ পর্যন্ত আমেরিকান বিপ্লবের দিকে ধাবিত করে। শুরু থেকেই, ব্রিটিশ কনফেডারেশন আর্টিকেলস এবং পরে দেশটির সংবিধান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দ্রুত বা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে এমন নির্বাহী পদক্ষেপ সীমিত করার চেষ্টা করেছিল। রাজস্ব বিলগুলো হাউসে উত্থাপন করা হতো, সিনেটের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ভেটোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

আমেরিকার প্রথম অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয় ১৮১৬ সালে। এর কারণ ছিল ব্রিটেন। ব্রিটেন তখন নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে জিতেছিল। জয়ের পর ব্রিটেন বিপুল পরিমাণে উলের পোশাক বাজারে ছাড়ে। এই কাপড়গুলো মূলত ইউরোপের সৈন্য ও নাবিকদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।

এটি ছিল ব্রিটেনের প্রথম সেনা ও নৌবাহিনীর উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রির ঘটনা। আমেরিকার ব্যবসায়ী ও পশম উৎপাদনকারীরা এত সস্তা পশমের কাপড় দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বন্ধ করতে কংগ্রেসের কাছে অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধে, ১৮১৭ সালের মার্চে কংগ্রেস একটি আইন পাস করে। আইনের নাম ছিল ‘নেভিগেশন অ্যাক্ট’। এই আইন ব্রিটিশ জাহাজ এবং সস্তা পণ্য আসা বন্ধ করে দেয়।

জবাবে, মে মাসে ব্রিটেনও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। তারাও একটি আদেশ জারি করে। এই আদেশের ফলে মার্কিন জাহাজগুলো ব্রিটেনের ক্যারিবিয়ান উপনিবেশে শস্য সরবরাহ করতে পারত না। ফলে, মার্কিন কৃষকেরা গুরুত্বপূর্ণ বাজার হারান। এই বাজারে তারা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করে আসছিলেন। ১৮১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গমের দাম ৫০ শতাংশ কমে যায়। কৃষকেরা জমির বন্ধকি ঋণ পরিশোধ করতে পারছিলেন না। এই ঋণ তারা ইউএস ল্যান্ড অফিস থেকে নিয়েছিলেন। কৃষকেরা মুদি দোকানগুলোতে দেনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। ফলে গ্রামের দোকানগুলোও সরবরাহকারী বণিকদের পাওনা মেটাতে পারেনি।

১৮১৯ সালে মার্কিন অর্থনীতিতে রীতিমতো আতঙ্ক শুরু হয় এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বাজারকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মার্কিনরা কানাডায় গম চোরাচালান করে নিজেদের রক্ষা করে। সেখানে টরন্টো ও মন্ট্রিয়লের মিল মালিকেরা সেই গম দিয়ে ব্রিটিশদের জন্য আটা তৈরি করত। সেই আটা আবার ক্যারিবীয় এলাকায় বিক্রি করা হতো।

ভার্জিনিয়া, জর্জিয়া ও সাউথ ক্যারোলাইনার মতো অঙ্গরাজ্যগুলো কেবল গম ও ধান উৎপাদন ছেড়ে দাসভিত্তিক তুলা উৎপাদনে যাওয়ার মাধ্যমে উন্নতি লাভ করে। এক দশকের মধ্যে ইঙ্গ-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ ক্যারিবীয় দ্বীপের কৃষি খামারগুলোতে খাদ্য সরবরাহের খরচ এত বাড়িয়ে দেয় যে, সেখানকার দাস মালিকেরা ক্রীতদাসদের ক্ষতিপূরণসহ দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার জন্য ব্রিটেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিপরীতে, ১৮১৭ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা পাস হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের শস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে তুলা উৎপাদন আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর সঙ্গে দাসপ্রথারও বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে এর পরের মন্দা শুরু হয় মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের দ্রুত নির্বাহী পদক্ষেপের কারণে। ১৮১৯ সালের মহামন্দার পর থেকে দীর্ঘ সময়ের ক্রেডিট চেইন বা ঋণ শৃঙ্খল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে তুলার আবাদ সম্প্রসারণে অর্থায়ন করে আসছিল।

সেকেন্ড ব্যাংক অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস এবং ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত সাতটি ব্রিটিশ ব্যাংক ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ধার করত। এরপর তারা ‘বিল অব এক্সচেঞ্জ’ ইস্যু করত। এর মাধ্যমে ছোট, আঞ্চলিক মার্কিন ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়া হতো। এই ব্যাংকগুলো আবার দক্ষিণাঞ্চলের ওপরের অংশের দাস ব্যবসায়ীদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিত। দাস ব্যবসায়ীরা ভার্জিনিয়া ও সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে দাস কিনত এবং জর্জিয়া, মিসিসিপি ও লুইজিয়ানার তুলার খামারে বিক্রি করত। সুদের হার ব্যাংক অব ইংল্যান্ড নির্ধারণ করত। ফলে লন্ডনে সুদের হার সামান্য বৃদ্ধি পেলে নিউ অরলিন্সে দাস মালিকদের জমি বা দাস কেনা অসম্ভব হয়ে পড়ত।

প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বিশ্বাস করতেন, সেকেন্ড ব্যাংক এবং সেভেন সিস্টারস তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি ১৮৩৪ ও ১৮৩৬ সালে বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এই আদেশগুলোর লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ঋণের ওপর থেকে দাস মালিকদের নির্ভরতা কমানো।

এক আদেশে জ্যাকসন যুক্তরাষ্ট্রের সেকেন্ড ব্যাংক থেকে সরকারি আমানত তুলে নেন। সেই অর্থ তাঁর রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি পছন্দের ব্যাংকে জমা দেন। অন্য এক আদেশে কৃষকদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাদের বন্ধকি অর্থ ইউএস ল্যান্ড অফিসে পরিশোধ করতে নিষেধ করা হয়। এর ফলে কৃষকদের বাধ্য হয়ে স্বর্ণ ব্যবহার করতে হয়, যা সেই সময়ের মুদ্রা ছিল। এই পদক্ষেপের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের দাস মালিকেরা লাভবান হয়। এসব মালিকদের উত্তর জর্জিয়া ও উত্তর ক্যারোলাইনায় সোনার খনি ছিল। তবে, হঠাৎ করে সোনার চাহিদা বেড়ে গেলেও সরবরাহ অনেক কম ছিল।

এই অবস্থায় ব্যাংক অব ইংল্যান্ড দেখতে পায়, তাদের সোনা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তারা ব্যাংক রেট তথা সুদহার বাড়াল। একই সঙ্গে তারা কিছু সময়ের জন্য ‘সেভেন সিস্টার্সকে’ আন্তর্জাতিক লেনদেন থেকে বিচ্ছিন্ন করল। এর ফলস্বরূপ ১৮৩৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফের মহামন্দা শুরু হলো।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে জমিদারেরা ঋণ পরিশোধ না করে পালিয়ে গেল। তারা চাষের জমি ফেলে ক্রীতদাসদের নিয়ে (তৎকালীন) টেক্সাসের স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে চলে গেল। সেখানে তারা ঋণদাতাদের হাত থেকে বেঁচে যায়। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল। উৎপাদনকারীরা দেউলিয়া হয়ে গেল। পাঁচ বছরের মধ্যে সাতটি মার্কিন অঙ্গরাজ্য আন্তর্জাতিকভাবে ইস্যু করা বন্ডের অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলো।

এর পরের মহামন্দা শুরু হয় ১৮৭৩ সালে। এই অর্থনৈতিক মন্দা আন্তর্জাতিক পণ্যের দামের আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে হয়েছিল। তবে এর জন্য তড়িঘড়ি করে শুল্ক আরোপ করা হয়নি। কিন্তু ১৮৯৩ সালের মন্দার ক্ষেত্রে তেমনটা বলা যাবে না। ১৮৯০ সালে মার্কিন হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস আইন প্রণয়নের নিয়ম সংশোধন করে। এর ফলে কংগ্রেস অপ্রত্যাশিতভাবে কার্যকর ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সুযোগে রিপাবলিকানরা ১৮৯০ সালের ম্যাককিনলে ট্যারিফ অ্যাক্ট পাস করে।

এই আইনে বিদেশে তৈরি পণ্যের আমদানির ওপর শুল্ক ৩৮ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করে। একই সঙ্গে আধা-পরিশোধিত চিনির ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হয়। চিনি রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য এটি বিশাল পার্থক্য তৈরি করে দেয়। কারণ সে সময় আপেল, স্যামন ও গরুর মাংসের মতো খাদ্য সংরক্ষণে চিনি ব্যবহার করা হতো।

তবে, বেশি শুল্ক আরোপের ফলে প্রায়শই যা হয়—তেমনিভাবে মার্কিন রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। দুই বছরের মধ্যে এটি প্রায় মার্কিন ট্রেজারির সোনা শেষ করে ফেলে। এর ফলে বিদেশি ঋণদাতারা মার্কিন বন্ড বিক্রি করতে শুরু করে, বিশেষ করে রেল কোম্পানিগুলোর বন্ড। ঋণগ্রহীতারা আশঙ্কা করেছিল যে, ট্রেজারিতে সোনা না থাকলে ওয়াশিংটন মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণমান ত্যাগ করবে। তখন বন্ডের অর্থ হয়তো দুর্বল মার্কিন মুদ্রায় পরিশোধ করা হবে।

এরপর, ১৯৩০–এর দশকের মহামন্দায় স্মুট-হাওলি শুল্ক আইন বড় ভূমিকা রেখেছিল। যদিও কিছু অর্থনীতি ঐতিহাসিক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা সরবরাহ, শেয়ারবাজারে তেজ–মন্দা চক্র এবং ইউরোপের অমীমাংসিত যুদ্ধকালীন ঋণ—এর প্রধান কারণ ছিল। উনিশ শতকের একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। তবে শুধু বলব, শুল্কে দ্রুত পরিবর্তন বিশ্বকে বদলে দেয়। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এমন পরিবর্তন আনে, যার প্রভাব মোকাবিলা করতে বহু বছর লেগে যায় এবং এর ফলস্বরূপ অপ্রত্যাশিত ঘটনার একটি দীর্ঘ ধারা তৈরি হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গত দুই শতাব্দীর মহামন্দা–মন্দার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু ধারণা পেতে পারি। বর্তমানে ট্রাম্প আরোপিত শুল্ক অনেক কোম্পানিকে তাদের পূর্বনির্ধারিত চুক্তি থেকে সরে আসতে বাধ্য করবে। উনিশ শতকে কৃষক, গ্রামের দোকানদার, বণিক এবং দাস ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা গিয়েছিল।

পিটসবার্গভিত্তিক উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী কোম্পানি হাউমেট এরই মধ্যেই ‘ফোর্স ম্যাজিউর’ বা নিজেদের এমন অবস্থানে ঘোষণা করেছে যেখানে কেউ তাদের জোর করে চুক্তি পরিপালনে বাধ্য করতে পারবে না। তারা শুল্কের কারণে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে।

চীনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা করা বিভিন্ন খাতের আরও অনেক কোম্পানি সম্ভবত এখন চুক্তি বাতিল করবে, কারণ শুল্ক কার্যকর হতে শুরু করেছে। এসব কোম্পানির বাতিল করা অনেক লেনদেনই ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়। এই ঋণের বেশির ভাগই ব্যাংক, হেজ ফান্ড, বিমা কোম্পানি এবং অন্যান্য আর্থিক মধ্যস্থতাকারীদের কাছে থাকে। এর কিছু ঋণ আবার অসংখ্য বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করা হয়। শেয়ারবাজার ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে খুব দ্রুত সক্ষম। তবে এর চেয়ে অনেক বড় এবং জটিল ঋণবাজার, এটি দ্রুত ধাক্কা সামলাতে পারে না। যারা ২০০৮ সালের সংকটের কথা মনে রেখেছেন, তারা এটা জানেন। ২০০৮ সালে ফেডারেল রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত বন্ড কিনেছিল। এর মাধ্যমে তারা জমে যাওয়া বাজারে তারল্য ফিরিয়ে এনেছিল।

যদিও আমি কেবলই একজন ইতিহাসবিদ, তবে আমার বিশ্বাস ফেডারেল রিজার্ভ (মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক) এ পর্যন্ত যে বিশৃঙ্খলা দেখেছে তা সামাল দিতে পারবে। তবে চীন–মার্কিন বাণিজ্য স্থগিতের সম্পূর্ণ প্রভাব আমাদের এখনো মোকাবিলা করতে হবে। এ ছাড়া, বিশ্বের বাকি অংশের ওপর ৯০ দিনের স্থগিতাদেশের পরে কী হবে তা এখনো অস্পষ্ট।

যদি কংগ্রেস শুল্কের ওপর তার সাংবিধানিক অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে না পারে এবং যদি মার্কিন বাণিজ্যনীতি নির্ধারণের ক্ষমতা একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়—যেমনটা ১৮৩০–এর দশকে অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের ক্ষেত্রে ছিল—তাহলে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক মন্দার ফলে সৃষ্ট তারল্য সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে না, যে মন্দার আশঙ্কা আমি করছি।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার ইতিহাসের অধ্যাপক স্কট রেনল্ডস নেলসন

অনুবাদ করেছেন: আজকের পত্রিকার সহ–সম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৪২
খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত
খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের সঙ্গে নতুন করে বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে—এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক তৎপরতা। দেশটির পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটির এক গোপন বৈঠকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত ব্রিফ করেছেন।

হিব্রু ভাষার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম মারিভের খবরে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে এক সামরিক প্রতিনিধি সংসদ সদস্যদের জানান, তেহরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং হামলার সক্ষমতা পুরোপুরি পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। আইডিএফের আশঙ্কা, আগের মতোই ইরান একযোগে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে।

গত এক মাসে পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা নিয়ে সতর্কবার্তা জোরালো হয়েছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের ও কিছু বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উভয় পক্ষ দ্রুত সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, পরোক্ষ বা প্রক্সি ফ্রন্ট বিস্তৃত করছে এবং কূটনৈতিক পথ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যুদ্ধের ঝুঁকি প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বর্তমান উত্তেজনার একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির (জেসিপিওএ) মেয়াদ শেষ হওয়া। চলতি বছরের অক্টোবরে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। ফলে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তেহরানের দাবি অনুযায়ী তারা উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সব মজুত ধ্বংস করেছে। কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা মনে করেন, এর একটি অংশ গোপনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে—তাদের মতে, ইরানে ইসরায়েলের আরেকটি হামলা ‘হবে কি না’ এটা প্রশ্ন নয়, হামলা ‘কবে হবে’—সেটাই বড় প্রশ্ন। ইসরায়েলের দৃষ্টিতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। তেল আবিবের এই মনোভাব সামরিক হামলার সম্ভাবনাকে প্রায় অনিবার্য করে তুলছে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক সংকট বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রকল্পের পরিচালক আলি ভায়েজ জানান, তাঁর ইরানি সূত্র অনুযায়ী দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলো দিনে ২৪ ঘণ্টাই চালু আছে। তাঁর ভাষায়, নতুন কোনো সংঘাত হলে ইরান আগের মতো ১২ দিনে ৫০০টি নয়, বরং একযোগে ২ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলো এখনো অমীমাংসিত থাকায় সংঘাতের একটি চক্রাকার ধারা তৈরি হয়েছে, যেখানে উত্তেজনা প্রায় কাঠামোগতভাবেই অনিবার্য। ইরানের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা তথাকথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ (যার মধ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক মিত্র ও গোষ্ঠী রয়েছে) গত জুনে ১২ দিনের যুদ্ধে এবং বিশেষ করে গত বছর সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের পর বড় ধাক্কা খেয়েছে। তবু ইরানের হাতে এখনো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক রসদ রয়েছে। যেমন—ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ (হুতি), লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া। এসব শক্তির মাধ্যমে তেহরান এখনো এক ধরনের অপ্রতিসম প্রতিরোধ সক্ষমতা ধরে রেখেছে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম কার্সরইনফোর বরাতে জানা যায়, দেশটির নিরাপত্তা সংস্থার এক শীর্ষ সূত্রের দাবি—ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ ২০২৯ সালের জানুয়ারির আগে ইরানে শাসক পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখেছে ইসরায়েল। সূত্রটি জানায়, ইরান একদিকে যেমন ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষা স্থাপনাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে নজরদারিতে রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আরেকটি সামরিক সংঘাত এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ইরান নাতানজের দক্ষিণে ‘পিকঅ্যাক্স মাউন্টেন’ নামে একটি নতুন ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মূল উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ করছে। সেখানে এখনো আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পরিদর্শকদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি।

এই প্রেক্ষাপটে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তেহরান শান্তি ও সংলাপ চায়, তবে চাপের কাছে মাথা নত করবে না, পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিও পরিত্যাগ করবে না। তাঁর মতে, এসব কর্মসূচি জাতীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি বহুপক্ষীয় আলোচনায় ফেরার আগ্রহ দেখালেও শর্ত দিয়েছেন—‘ইরানের বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে’।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বাধলে যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও তাতে জড়াবে?

গেল নভেম্বরের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেন, জুনে ইরানে ইসরায়েলি হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সম্পৃক্ত ছিল। বিষয়টি এত দিন হোয়াইট হাউস অস্বীকার করে আসছিল। ওই সময় ট্রাম্প আরও বলেন, ওয়াশিংটন চাইলে তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতেও প্রস্তুত।

ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। সেখানে ট্রাম্প আবার বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি চায় এবং ওয়াশিংটন আলোচনায় প্রস্তুত। একই দিনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা কামাল খারাজি জানান, পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ইরান, তবে প্রথম পদক্ষেপ ওয়াশিংটনকেই নিতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আলোচনার বাইরে, কারণ এটি জাতীয় প্রতিরোধের মূল স্তম্ভ। কেবল পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েই সীমিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে, তাও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন না হলে।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চান না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক চাপে আরেকটি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু ইসরায়েল এই পরিস্থিতিকে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে দেখছে। ইসরায়েল চাচ্ছে, তারা এই সুযোগে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা স্থায়ীভাবে ধ্বংস করে দেবে।

সব মিলিয়ে, তেহরান আশাবাদী কথাবার্তায় ভরসা করছে না। ইরানি কূটনীতিকদের ধারণা, ইসরায়েল আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি উপেক্ষা করেই সামরিক পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। তাদের মতে, ইসরায়েল হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রকে যেকোনোভাবে সংঘাতে টেনে আনার চেষ্টা করবে—যদিও ট্রাম্প নতুন যুদ্ধ এড়াতে চান।

যুক্তরাষ্ট্র চাক বা না চাক, পরিস্থিতির চাপে তাকে শেষ পর্যন্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে। আর যদি ইরান ইসরায়েলি হামলার জবাবে আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে ওয়াশিংটনের সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত এসে দাঁড়াবে—হস্তক্ষেপ করবে, নাকি নিয়ন্ত্রণ হারাবে। ইরান অবশ্য স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—তারা ধ্বংসের ভয় পায় না এবং সর্বাত্মক যুদ্ধে নামলে ‘ইসরায়েলকেও সঙ্গে নিয়ে ডুববে’।

আরটি থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৫
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানকে এফ–১৬ যুদ্ধবিমান আধুনিকীকরণের প্রযুক্তি দিয়ে ভারতের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানকে এফ–১৬ যুদ্ধবিমান আধুনিকীকরণের প্রযুক্তি দিয়ে ভারতের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানের কাছে ৬৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার মূল্যের উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক পার্টস বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই প্যাকেজটি পাকিস্তানের কাছে থাকা এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলোর আধুনিকীকরণের জন্য দেওয়া হয়েছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার আবহে এই চুক্তি সম্পন্ন হলো।

মনে রাখা দরকার, এ বছরের মে মাসে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক হামলার পর দুই দেশের মধ্যে পাঁচ দিনের সংঘাত বাধে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও আরও মার্কিন অস্ত্র কেনার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের কী চুক্তি হলো

ব্রাসেলসভিত্তিক থিংকট্যাংক আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রবীণ দোন্থি জানান, এই অনুমোদনটি মূলত ২০২২ সালের এক রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তির অংশ। এই চুক্তির লক্ষ্য পাকিস্তানের এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের বহরকে কার্যক্ষম রাখা। তিনি বলেন, ‘এই এফ-১৬ চুক্তিটি বৃহত্তর যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ কারণে কিছুটা দেরি হলেও প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দেখানো পথেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসনও এটিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। দুই পক্ষই এই অঞ্চলে যৌথ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে এই যুদ্ধবিমানগুলোর উপযোগিতার ওপর জোর দেয়।’

সর্বশেষ এই চুক্তি নতুন কোনো যুদ্ধবিমান বিক্রির জন্য নয়, বরং পাকিস্তানের হাতে থাকা এফ-১৬ বহরের জন্য প্রযুক্তি বিক্রি এবং সেগুলোর আধুনিকীকরণের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রর প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা সহযোগিতা সংস্থা (ডিএসসিএ) ৪ ডিসেম্বর দেশটির কংগ্রেসে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়ে চুক্তিটি নিশ্চিত করে।

ধারণা করা হয়, পাকিস্তানের কাছে ৭০ থেকে ৮০টি কার্যক্ষম এফ-১৬ বিমান আছে। এর মধ্যে কিছু পুরোনো কিন্তু পরে আধুনিক করে তোলা ‘ব্লক-১৫’ মডেল, জর্ডানের কাছ থেকে পাওয়া কিছু এফ-১৬ এবং কিছু নতুন ‘ব্লক ৫২+’ মডেলের বিমান রয়েছে।

এই প্যাকেজে আছে—উন্নত ফ্লাইট অপারেশন ও বিমানের ইলেকট্রনিক সিস্টেমের জন্য হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার আপডেট। অ্যাডভান্সড আইডেনটিফিকেশন ফ্রেন্ড অর ফো (আইএফএফ) সিস্টেম, যা পাইলটদের শত্রু বিমান থেকে মিত্র বিমান শনাক্ত করতে সাহায্য করে। নেভিগেশন আপগ্রেড, খুচরা পার্টস ও মেরামত সুবিধা।

এফ-১৬-এর সাপোর্ট ও আপগ্রেডের জন্য ৬৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম (এমডিই) দেওয়া হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ৯২টি লিংক-১৬ সিস্টেম। এই লিংক-১৬ একটি সুরক্ষিত সামরিক ট্যাকটিক্যাল ডেটা লিংক নেটওয়ার্ক, যার মাধ্যমে সামরিক বিমান, জাহাজ এবং স্থলবাহিনীর মধ্যে খুদে বার্তা বা ছবির মাধ্যমে রিয়েল টাইম বা তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করা যায়।

বিক্রির জন্য অনুমোদিত অন্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামগুলোর মধ্যে রয়েছে ছয়টি এমকে-৮২ ৫০০-পাউন্ড সাধারণ বোমার কাভার। এগুলো বিস্ফোরক ছাড়া কংক্রিট বা বালু দিয়ে পূর্ণ থাকে এবং প্রশিক্ষণ বা পরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়। এমকে-৮২ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি আনগাইডেড বোমা, যা নিখুঁত-নির্দেশনা দেওয়া অস্ত্রের ওয়ারহেড হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

এফ-১৬ যুদ্ধবিমান কী

এফ-১৬ যুদ্ধবিমানটি এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন বা ভাইপার নামেও পরিচিত। এটি এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দ্বারা আকাশপথে যুদ্ধ ও আকাশ থেকে ভূমিতে আক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রথমে এটি তৈরি করেছিল জেনারেল ডাইনামিকস নামে একটি মার্কিন কোম্পানি। বর্তমানে এটি উৎপাদন করে লকহিড মার্টিন।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ দিকে সোভিয়েত মিকোয়ান-গুরেভিচ (মিগ) বিমানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য এটিকে তৈরি করা হয়। এটি প্রথম উড্ডয়ন করে ১৯৭৪ সালে। লকহিড মার্টিনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এফ-১৬ এখন বিশ্বের ২৯টি দেশে ব্যবহৃত অন্যতম বহুল ব্যবহৃত যুদ্ধবিমান। পাকিস্তান ছাড়াও ইউক্রেন, তুরস্ক, ইসরায়েল, মিশর, পোল্যান্ড, গ্রিস, তাইওয়ান, চিলি, সিঙ্গাপুর, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস ও নরওয়ের মতো দেশগুলো এফ-১৬ ব্যবহার করে।

ভারত-পাকিস্তানের মে মাসের সংঘাতে এফ-১৬-এর ভূমিকা কী ছিল

এপ্রিলের ২২ তারিখে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। হামলার দায় স্বীকার করে ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) ’ নামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। নয়াদিল্লির অভিযোগ, এর সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তাইয়্যেবার যোগসূত্র আছে। তবে ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

পেহেলগাম হামলার পর নয়াদিল্লি ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে নামিয়ে আনে এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু নদের পানি ভাগাভাগি নিশ্চিত করার সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করে। ৭ মে ভারত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ৯টি জায়গায় আঘাত হানে। ইসলামাবাদের দাবি, এসব হামলায় বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। এরপরের তিন দিন দুই দেশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে একে অপরের সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে আকাশপথে তীব্র সংঘাত চালায়।

পাকিস্তানের এয়ার ভাইস মার্শাল আওরঙ্গজেব আহমেদের ভাষ্যমতে, এই আকাশযুদ্ধে পাকিস্তান ৪২টি ‘হাই-টেক বিমান’ ব্যবহার করেছিল, যার মধ্যে এফ-১৬ ছাড়াও চীনের তৈরি জেএফ-১৭ ও জে-১০ বিমান ছিল। অবশেষে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ১০ মে একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়।

পাকিস্তানকে এফ-১৬-এর প্রযুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র কি ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে

হ্যাঁ, কয়েকটি কারণে। পাকিস্তানের এফ-১৬ আপগ্রেডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রর এই অনুমোদন এমন এক সময় এল, যখন ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকে তাদের থেকে আরও অস্ত্র কিনতে চাপ দিচ্ছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স তিন ভারতীয় কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, গত আগস্টে নয়াদিল্লি মার্কিন অস্ত্র ও বিমান কেনার পরিকল্পনা স্থগিত করে। এর ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের ওয়াশিংটন সফরের কথা ছিল, যেখানে তিনি কিছু অস্ত্র কেনার কথা ঘোষণা করতে পারতেন। সেই সফরটি বাতিল হয়ে যায়।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেও সম্প্রতি উত্তেজনা বিরাজ করছে। গত ৬ আগস্ট ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের আমদানি করা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছিলেন। এর আগে থেকেই ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বহাল ছিল। ফলে মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। ভারতকে রাশিয়া থেকে সস্তা অপরিশোধিত তেল কেনার শাস্তি হিসেবে এই শুল্ক আরোপ করা হয়।

ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে এই শুল্কের ঘোষণা দিয়ে লেখেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক কার্যকলাপ অব্যাহত থাকায় এটি একটি ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ এবং তাই রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের শীর্ষ ক্রেতা ভারতের ওপর বর্ধিত শুল্ক আরোপ করা ‘প্রয়োজনীয় ও যথাযথ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি দেখছি যে ভারত সরকার বর্তমানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাশিয়ান ফেডারেশনের তেল আমদানি করছে।’

যদিও যুক্তরাষ্ট্রর চাপের ফলস্বরূপ ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা সামান্য কমিয়েছে, তবে নয়াদিল্লি মস্কো থেকে কেনা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। রাশিয়া থেকে তেল কেনার ক্ষেত্রে চীনের পর ভারতই দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা। গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে রাশিয়া-ভারত বার্ষিক দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সেখানে বলেন, ‘ভারতকে জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন চালান সরবরাহ করতে রাশিয়া প্রস্তুত।’

পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকীকরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই সর্বশেষ চুক্তি ঘোষণার ফলে ভারত সন্তুষ্ট হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রবীণ দোন্থি জানান, আগে থেকেই পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, যার আওতায় পাকিস্তানের এফ-১৬ বহরের রক্ষণাবেক্ষণ করা নিয়ে নয়াদিল্লি আপত্তি জানিয়েছিল। ভারতের দাবি, এফ-১৬ বিমান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়।

দোন্থি বলেন, ‘ওয়াশিংটন এবার আগেভাগেই বলে দিয়েছে যে এই বিক্রির ফলে অঞ্চলের মৌলিক সামরিক ভারসাম্যের পরিবর্তন হবে না।’

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘এখানে ভারতের দিকটি বেশি অতিরঞ্জিত করে দেখা উচিত নয়। কেউ কেউ এটিকে হয়তো ওয়াশিংটনের সর্বশেষ কৌশল হিসেবে দেখতে পারে, পাকিস্তানের প্রতি উদারতা দেখিয়ে ভারতকে বাণিজ্য আলোচনায় আরও ছাড় দিতে চাপ দেওয়া।’

তবে তিনি আরও যোগ করেন, এই চুক্তির ‘একটি নিজস্ব যুক্তি আছে, যা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।’ কুগেলম্যানের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটি মূলত পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত বিমানগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির অধীনে এক স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। এটি ভারতের সঙ্গে অব্যাহত, যদিও কম উদার মার্কিন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার পাশাপাশি বিদ্যমান।

যুক্তরাষ্ট্রের এই অনুমোদন পাকিস্তানকে কতটা শক্তিশালী করবে

কুগেলম্যান জানান, এই প্যাকেজটি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘এটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানকে দেওয়া অন্যতম উদার নিরাপত্তা সহায়তা প্যাকেজ। প্রায় ৭০ কোটি ডলারকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।’ এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতায় ট্রাম্প প্রশাসন যে গুরুত্ব দিচ্ছে, তার ইঙ্গিত বহন করে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের পুনরুত্থান নিয়ে আলোচনায় সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও অন্যান্য বাণিজ্যিক সুযোগগুলোই বেশি শিরোনামে আসে। কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা, যার ব্যাপ্তি সামান্য হলেও এই প্রশাসনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’

তবে দোন্থি মনে করিয়ে দেন, যুক্তরাষ্ট্রর এই সর্বশেষ প্যাকেজটি পাকিস্তানকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত তার বহর রক্ষণাবেক্ষণে সাহায্য করবে বটে, কিন্তু ২০২০ সাল থেকে পাকিস্তানের ৮০ শতাংশের বেশি অস্ত্র সরবরাহ করেছে চীন। সুইডিশ থিংকট্যাংক সিআইপিআরআইয়ের এই বছরের একটি প্রতিবেদনেও এই পরিসংখ্যানের সমর্থন পাওয়া যায়।

দোন্থি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে মে মাসের সংঘাতে পাকিস্তান চীনের তৈরি জে-১০ বিমান ব্যবহার করেছিল। ইসলামাবাদ ওয়াশিংটন ও বেইজিং—উভয় পক্ষ থেকেই সুবিধা নিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে।’


আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পাচারে যুক্ত থাকার অভিযোগে গত বুধবার মার্কিন বাহিনী ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছাকাছি অভিযান চালিয়ে একটি তেল ট্যাংকার জব্দ করেছে। ট্যাংকারে ভেনেজুয়েলা ও ইরানের তেল বহন করা হচ্ছিল বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। এই ঘটনার পর ভেনেজুয়েলার তেল বহনের অভিযোগের আরও ছয়টি জাহাজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।

জাহাজ ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী, প্রথম ট্যাংকারটির অবস্থান (লোকেশন) গোপন করার বা মিথ্যা তথ্য দেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি নিশ্চিত করেছেন, জব্দ হওয়া জাহাজটির নাম ‘স্কিপার’। তাঁর দাবি, এটি ভেনেজুয়েলা এবং ইরানের নিষেধাজ্ঞা ভুক্ত অপরিশোধিত তেল পরিবহনে ব্যবহৃত ক্রুড অয়েল ট্যাংকার।

আন্তর্জাতিক সমুদ্র চুক্তি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট টনেজের চেয়ে বেশি ওজনের সব জাহাজেই স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (এআইএস) থাকা বাধ্যতামূলক, যা জাহাজের অবস্থান নিয়মিতভাবে সম্প্রচার করে। কিন্তু ‘স্কিপার’-এর গতিবিধির পাবলিক রেকর্ড হয় অসম্পূর্ণ অথবা বিভ্রান্তিকর। জব্দ হওয়ার আগে এটি গত ৭ নভেম্বর থেকে তার অবস্থান প্রকাশ করেনি।

মেরিন অ্যানালিটিক্স ফার্ম কেপ্লার (Kpler) জানিয়েছে, ‘স্কিপার’-এর অবস্থান গোপন করার (স্পুফিং) দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জানা যায়, ২০২২ সালে যখন জাহাজটি ‘আদিশা’ (Adisa) নামে চলছিল, তখন মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ এটিকে একটি ‘আন্তর্জাতিক তেল পাচার নেটওয়ার্কের’ অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘স্কিপার’ ঘন ঘন ট্র্যাকারকে মিথ্যা তথ্য দিত। যেমন, এআইএস সিস্টেমে জাহাজটি ৭ ও ৮ জুলাই ইরাকের বসরা অয়েল টার্মিনালে অবস্থান দেখালেও, টার্মিনাল রিপোর্টে এর কোনো রেকর্ড ছিল না। উল্টো কেপ্লার জানিয়েছে, সেই সময়েই ট্যাংকারটি ইরানের খার্গ দ্বীপ থেকে অপরিশোধিত তেল বোঝাই করছিল। এ ছাড়া, ২৮ অক্টোবর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাহাজটি এআইএস-এ সম্পূর্ণ ভুল সংকেত পাঠাচ্ছিল, যা এর আসল অবস্থানকে প্রতিফলিত করেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘স্কিপার’ সম্ভবত ‘ডার্ক ফ্লিট’ নামক বিশ্বব্যাপী তেলবাহী ট্যাংকারের একটি নেটওয়ার্কের অংশ। এই নেটওয়ার্কটি মালিকানা, পরিচয় এবং ভ্রমণ ইতিহাস গোপন করে তেলের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কাজ করে।

যদিও ‘স্কিপার’ গায়ানার পতাকা ব্যবহার করে যাত্রা করছিল, কিন্তু গায়ানা সরকার দ্রুত বিবৃতি দিয়ে জানায় যে ২০ বছর বয়সী এই ট্যাংকারটি তাদের দেশে নিবন্ধিত নয় এবং এটি ‘অবৈধভাবে গায়ানার পতাকা ব্যবহার করছিল’। জাহাজটির নিবন্ধিত মালিক হিসেবে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ-ভিত্তিক ‘ট্রাইটন নেভিগেশন করপোরেশন’-এর নাম রয়েছে। তবে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ জানিয়েছে, এই ট্রাইটন করপোরেশনকে একজন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত রুশ জ্বালানি ধনকুবের ভিক্তর আর্তেমভ তাঁর বৈশ্বিক ‘তেল পাচার নেটওয়ার্ক’ পরিচালনার জন্য ব্যবহার করতেন।

ভেনেজুয়েলার তেল মজুত বিশ্বের বৃহত্তম হলেও, মাদুরোর প্রশাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সাল থেকে দেশটির তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ‘স্কিপার’ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করত। কেপ্লার বিশ্লেষকেরা জানান, ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দর থেকে প্রায় ১ দশমিক ১ মিলিয়ন (১১ লাখ) ব্যারেল মেরে ক্রুড তেল বোঝাই করেছিল এবং গন্তব্য হিসেবে কিউবার নাম উল্লেখ করেছিল।

১১ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে এটি পূর্বে যাত্রা করে একটি ‘শিপ-টু-শিপ ট্রান্সফার’ সম্পন্ন করে। এটির কার্গো পরে চীনেও ‘ভুয়া ঘোষিত’ হয়েছিল। মার্কিন অভিযানের মাত্র কয়েক দিন আগে, ৭ ডিসেম্বরে এটি ভেনেজুয়েলা উপকূলের কাছে অন্য একটি জাহাজের সঙ্গে স্থানান্তরে জড়িত ছিল বলে স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়। বেলজিয়ামের নৌবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট ফ্রেডেরিক ভ্যান লোকারেন জানান, এই ধরনের স্থানান্তর আইনত অবৈধ না হলেও, তা ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ এবং সাধারণত নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্যই করা হয়।

‘স্কিপার’ সর্বশেষ ৭ নভেম্বর তার অবস্থান ঘোষণা করে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যায়। মার্কিন অভিযানে ১০ ডিসেম্বর এর অবস্থান পুনরায় দৃশ্যমান হয়। এই অন্তর্বর্তী সময়ে, ১৮ নভেম্বর স্যাটেলাইট চিত্রগুলো নিশ্চিত করছে যে ট্যাংকারটি ভেনেজুয়েলার হোসে বন্দরে ছিল।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত