Ajker Patrika

কাজী রোজী, কণ্ঠেই যিনি মুক্তিযোদ্ধা

আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৪: ৫৫
কাজী রোজী, কণ্ঠেই যিনি মুক্তিযোদ্ধা

বাতাসে ভেজা মাটির চেনা গন্ধ। ভোরে বৃষ্টি হয়েছিল, তাই এমন ভেজা রূপে সেজেছে চারদিক। এমন দিনে বসে আড্ডাটা ভালোই জমে; তা যদি হয় কবিতা আর গানের, তবে তো কথাই নেই! আর বুকের ভেতর যদি জাগে একাত্তরের শিহরণ? সেদিন গান, কবিতা আর একাত্তরের আড্ডায় মনে হচ্ছিল এখনই রণক্ষেত্রে নেমে যাই, গুঁড়িয়ে দিই রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের! মনে হবে না কেন, সাহস আর প্রেরণা হয়ে যে সামনে ছিলেন কাজী রোজী স্বয়ং। তিনি কবি এবং আরও অনেক কিছু। বলছি ২০১৪ সালের জুন মাসের একদিনের কথা। সেদিন প্রথমবারের মতো কবির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। সাংবাদিকতার শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আমি। ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টের জন্যই ছিল সেদিনের আয়োজন। 

আজ সেই দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। না, বয়স ও বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বিচারে তাঁর চলে যাওয়াকে ‘অবেলায়’ শব্দ দিয়ে ঠিক বাঁধা যাবে না। তবে কিছু মানুষ তো থাকেন, যাঁদের প্রস্থান মাত্রই ‘অবেলার ডাক’ বলে মনে হয়। মন বিষণ্ন হয়ে যায়। আর কী আশ্চর্য, সেই প্রথম সাক্ষাতের মতো তাঁর এই চলে যাওয়া দিনও কেমন মেদুর হয়ে আছে বৃষ্টির ছাঁটে। বসন্তের এই বৃষ্টি প্রস্তুতিহীন তো বটেই। তবু প্রশ্ন জাগে, এ কী কবি কাজী রোজীর প্রস্থানকে বিশেষ করে তুলতে প্রকৃতির কোনো আয়োজনও? সে যা-ই হোক, তাঁর প্রস্থান ও প্রথম সাক্ষাতের সঙ্গে এই সময়ের এমন মিলে যাওয়া—মনকে কেমন বিষাদে ভরিয়ে দেয়। সে বিষাদে ডুব দিয়ে মনে মনে খুঁড়ে চলি স্মৃতির প্রান্তর। 

সেদিন সকালে ভেজা প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে উপস্থিত হয়েছিলাম কাজী রোজীর ধানমন্ডির বাসায়। দেখে চিনতে পারলেন না। না চেনারই কথা। আগে কোনো দিন পরিচয় হয়নি তো! পরিচয় দিতেই খুশি হয়ে বললেন, ‘জানো, তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় আমিও সেই তরুণ বয়সে আছি।’ 

মানুষটাকে দেখেই বোঝা যায় যে কত ঝড়-তুফানের মোকাবিলা করে কত কঠিন একটা ব্যক্তিত্ব নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। অথচ হৃদয়টা যেন একদম শিশুর মতো। অল্প সময়ের মধ্যেই এমনভাবে আপন করে নিয়েছিলেন, যেন আমি তাঁর কত দিনের চেনা বন্ধু। এর মধ্যে কিছুটা মান-অভিমানের পর্বও সেরে নিয়েছিলেন। কেননা তাঁর পরিবেশন করা নাশতা খেতে দেরি করছিলাম! 

যা হোক, গল্প শুরু করেছিলেন তাঁর জীবনের কঠোর সংগ্রাম দিয়ে। ‘জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খেতে পারিনি, সেই থেকে আমার সংগ্রাম শুরু। আমি একাত্তরে সংগ্রাম করেছি, যুদ্ধ করেছি। কিন্তু অস্ত্র হাতে নিয়ে নয়। এ নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ আছে। তবে আমি ছিলাম শব্দসৈনিক। স্বাধীন বাংলা বেতারে আবৃত্তি করতাম। বেলাল মাহমুদের হাত ধরেই সেখানে যাওয়া। কিছু গান, কবিতা আর নাটকও লিখেছি।’ 

এভাবে নতুন করে নিজের পরিচয় দিয়ে চলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল স্মৃতিতে—‘যুদ্ধ শুরুর আগের কিছু কথা বলে নিই। আমরা থাকতাম মিরপুরে। আমার প্রতিবেশী ও বন্ধু ছিল মেহেরুন্নেসা। মিরপুরে ছিল বিহারিদের আস্তানা। সেখানে উর্দুভাষী অবাঙালিরা বাস করত। তারা বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করত। কারও ডিমের খাঁচা ভেঙে ফেলত, কারও পান-সিগারেটের দোকান ভেঙে ফেলত, এমনকি শিশু ও মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যেত। আমার চোখের সামনেই ঘটত এসব ঘটনা। আগে ভেবেছিলাম এদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করব। কিন্তু না, পরে চিন্তা করলাম এদের সঙ্গে ঠিকভাবে বসবাস হবে না। কারণ, আমরা বাঙালি, বাংলায় কথা বলি। আর ওদের ভাষা উর্দু। তখন আমরা কয়েকজন তরুণ এসবের প্রতিবাদ করতাম। আমাদের সঙ্গে বন্ধু মেহেরুন্নেসাও ছিল।’ 

সেসব স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতেই চলে এলেন অবধারিত সেই কালরাতে, যেখানে তাঁর প্রজন্মের সবাইকেই অন্তত একবার দাঁড়াতে হয় চুপচাপ, থমকে যেতে হয়, টানতে হয় দীর্ঘশ্বাস। বলতে থাকলেন, ‘২৫ মার্চ বিকেলে খবর পেলাম আমার বাসায় হামলা হবে। আমাকে মেরে ফেলা হবে। তখনো জানি না সেই রাত হতে চলেছে ভয়ংকর কালরাত। এর আগেও আমাকে বিহারিরা হত্যা করতে এসেছিল। কিন্তু পারেনি। আমাদের এক মামা ছিলেন। পাড়ার সবাই তাঁকে শহীদ মামা ডাকত। সেই শহীদ মামা আমাকে সেদিন বাঁচিয়েছিলেন। নইলে এই কাজী রোজীকে তোমরা দেখতে পেতে না।’ 

বিপদ টের পেয়ে রোজী চলে যান কলাবাগানে। বন্ধু মেহেরুন্নেসাকেও অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছিলেন। তিনি শোনেননি। রোজী বলছেন, ‘মেহেরকেও বলেছিলাম যে এখান (মিরপুর) থেকে অন্য কোথাও চলে যাও। কিন্তু ও বলেছিল, “কোথায় যাব, আমার তো পরিবার ছেড়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ” সেদিন আমি চলে গিয়েছিলাম কলাবাগানে আমার খালার বাসায়। এর দুদিন পর ২৭ মার্চ খবর পাই মেহেরুন্নেসাকে সপরিবারে কাদের মোল্লার নির্দেশে পাকিস্তানের দোসররা জবাই করে হত্যা করেছে। আমি ওঁকে বাঁচাতে পারলাম না।’ 

কবি বন্ধু মেহেরুন্নেসার কথা বলতে বলতে কাজী রোজীর বুক থেকে বেরিয়ে আসে অবধারিত দীর্ঘশ্বাস। পরক্ষণেই চোখে মুখে সতেজ হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘আমি কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সংগ্রাম করেছি। আমি সাক্ষ্য দিয়েছি। আমি কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। ২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে বলেছি আমি এ কথা। ওরা বারবার বলেছে, আপনি তো দেখেননি। আর আমি বারবার বলেছি, হ্যাঁ আমি দেখিনি, শুনেছি। কিন্তু আমি জানি কাদের মোল্লা কী করতে পারে।’ 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার পর যখন ২০১২ সালে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তখন বেশ হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু আশা ছাড়েননি কখনো। এ নিয়ে বলছিলেন, ‘সব টেলিভিশন চ্যানেল আর পত্রিকা আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল। আমি বলেছি, এই রায় আমার নয়, জনগণের নয়, দেশের নয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি আপিল হবে, রায় হবে। ঠিকই আপিল হয়েছে, ফাঁসির রায় হয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লৌহমানবের মতো সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন বলেই এই রায় কার্যকর হয়েছে।’ বলেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়েছিলেন, যেন কত বছরের ঋণ বহু কষ্টে শোধ করতে পারলেন। তার পর একটা প্রশান্তির হাসি হাসলেন। 

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অনেক হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে কাজী রোজীকে। কিন্তু তিনি কোনো কিছুরই পরোয়া করেননি। এমনকি সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও নিতে চাননি। 

২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অধিদপ্তর থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণের পর আবার ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সংসদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে যোগ দেন। অভিভূত কবি রোজী জানিয়েছিলেন, ‘আমি সংসদে যেতে পেরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’ সংসদে তিনি বাজেট নিয়ে নিজের লেখা কবিতাও আবৃত্তি করেছেন। বললেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি আবদার করেছেন তাঁর কাছে, সব সময় যেন তিনি কবিতা লিখে যান। 

বয়সী কিন্তু তারুণ্যদীপ্ত প্রাণোচ্ছল এই মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, তিনি তখন ২১ বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলেন। তাঁর ভাষায় বলি, ‘আমাকে দেখলে কি মনে হয় আমার ক্যানসার? আমি তো দিব্যি ভালো আছি।’ এভাবে ভালো থাকতে কেমন করে মানসিক শক্তি পাওয়া যায়, তা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে সব সময়। একা একা খারাপ লাগলে দৌড়ে পাশের বাড়িতে চলে যাবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করবে। এর চেয়ে আর বড় ওষুধ নাই।’ তিনিও নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন সাহিত্যে আর সংসদে, কখনো প্রতিবন্ধীদের মাঝে, আবার কখনো আদিবাসীদের সঙ্গে। এটাই ছিল তাঁর ক্যানসারের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার প্রেরণা। 

আর কবি পরিচয়, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কণ্ঠে শাণিত শব্দ নিয়ে যে যুদ্ধ, তার কথা এ সবের উল্লেখ এখন তো বাতুলতা। স্বাধীন বাংলা বেতারে কবিতা আবৃত্তি করে কত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের সাহস জুগিয়েছেন তিনি! লিখেছেন গান, কবিতা, নাটক, আর জীবনী। কত যে লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘পথ ঘাট মানুষের নাম’, ‘নষ্ট জোয়ার’, ‘ভালোবাসার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘মানুষের গল্প’, ‘খানিকটা গল্প তোমার’, ‘আমার পিরানের কোন মাপ নেই’, ‘লড়াই’, ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ ইত্যাদি। পেয়েছেন বহু সম্মাননা। আর ভালোবাসা, ভালোবাসা। সে ভালোবাসার জোরেই পাকিস্তানের দোসরদের শাস্তির দাবিতে সংগ্রাম করেছেন বহুদিন। বন্ধু কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যার দায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক বছর কাজ করেছেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। যুক্ত ছিলেন ডিজেবল রাইটস গ্রুপ, সাবা, লারা, জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে। বহু বছর কাজ করেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিবাসীদের নিয়েও। 

সেদিনের আলাপে তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নের পথে বাধা আসবেই, হোঁচট খাবেই। কিন্তু কখনো মুখ থুবড়ে পড়ে যেও না। কোনো পথই সরল নয়। পথে কাঁটা থাকবেই। সেই কাঁটা সরিয়ে সরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ এ যেন নিজের চলার পথেরই এক সারসংক্ষেপ তুলে ধরলেন তিনি মাত্র কয়েকটি শব্দে। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম এই মহিরুহের বচন-বুলি। আরও মুগ্ধ হয়ে গেলাম যখন আড্ডার শেষ মুহূর্তে এসে স্বাধীন বাংলা বেতারের এই শব্দ সৈনিকের ভরাট কণ্ঠে শুনছিলাম প্রতিবন্ধীদের নিয়ে লেখা নিজের একটি কবিতা। এখনো কানে বাজছে শেষ তিনটি বাক্য—
 ‘আমি: বাবা, রঙের শরীরে আলাদা গন্ধ থাকে। সে তো মানুষের চেয়ে কঠিন নয়! 
বাবা: তুই ঠিক বলেছিস-মানুষ ভয়াবহ কঠিন। 
আমি: আমি কঠিনেরে ভালোবাসিলাম বাবা।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

৬ হাজার কোটির কোম্পানি বেচে অবসর, একঘেঁয়েমিতে অতিষ্ঠ যুবক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
৩৫ বছর বয়সী ব্রিটিশ উদ্যোক্তা টম গ্রোগান। ছবি: ফরচুন ম্যাগাজিন
৩৫ বছর বয়সী ব্রিটিশ উদ্যোক্তা টম গ্রোগান। ছবি: ফরচুন ম্যাগাজিন

৩৫ বছর বয়সী টম গ্রোগান। ব্রিটিশ উদ্যোক্তা। এক দশক খেটে শুন্য থেকে গড়েছিলেন মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ডের ব্যবসা। সেই ব্যবসার বড় একটি অংশ বিক্রি করে দিয়ে গেলেন অবসরে। কিন্তু অল্প কদিনেই হাঁপিয়ে উঠে আবারও কাজে ফিরতে চাইছেন তিনি। কোটিপতি হয়েও অবসর তাঁকে সুখ দিতে পারছিল না বলে জানান গ্রোগান।

ফরচুন ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় চিকেন উইংস বিক্রেতা ব্র্যান্ড উইংসটপ ইউকে-র মালিক টম গ্রোগান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রাইভেট ইক্যুইটি প্রতিষ্ঠানের কাছে এর বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রি করে দেন তিনি। যার মূল্য ছিল ৬ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।

নির্মাণশ্রমিক হিসেবে ঘণ্টায় মাত্র ৫ পাউন্ড মজুরিতে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন গ্রোগান। এরপর একটা সময় নিজের ব্যবসা শুরুর চিন্তা করেন তিনি। টেক্সাসে একটি ‘কোল্ড ইমেইল’ পাঠানোর মধ্য দিয়ে কাজ শুরু করেন টম গ্রোগান। এরপর টানা ৫০ টিরও বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। কিন্তু ধৈর্য হারাননি তিনি। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে ৫৭টি রেস্টুরেন্ট চালু করতে সক্ষম হন এই উদ্যোক্তা। এই সফল যাত্রার পর একটা সময় তাঁর মনে হলো নিজেকে সময় দেওয়া যাক।

ব্যবসা বিক্রির পর জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা রেখে তিনি মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। অবসর জীবনের ফাঁকা সময় এখন তার কাছে এক নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

টম গ্রোগান বলেন, ‘সাত বছর ধরে আমার পুরো মন–মস্তিষ্ক শুধু একটা জিনিসেই ব্যস্ত ছিল। এই ব্যবসাকে সফল করা। প্রতিদিন সেই ভাবনাই মাথায় ঘুরতে থাকত। তারপর যখন লক্ষ্যটা অর্জন হয়ে গেল, এ যেন অবিশ্বাস্য। মনে হচ্ছিল, আচ্ছা এখন কাজ শেষ। কিন্তু এবার কী? আর টাকাও সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে না।’

এখন আবার কাজে ফেরার পরিকল্পনা করছেন গ্রোগান। তবে কী নিয়ে কাজ করবেন এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। শুধু বলেন, ‘সম্ভবত এটা খাবার বা পানীয় শিল্পে হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমাদের ভাবনাটা পুরো বদলাতে হবে। আমরা এখন আর ব্যবসা গড়ে তুলছি না। এখন আমরা অর্থ পরিচালনা করছি। আর এই দুটি সম্পূর্ণ আলাদা দক্ষতা। তাই আমাদের শিখতে হচ্ছে বিনিয়োগের জগৎ। আর্থিক উপকরণ, শেয়ার, বন্ড এসব নতুন আমাদের কাছে। তবে আমরা কৌশলগতভাবে সতর্ক থেকে এগোচ্ছি।’

অগাধ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বিলাসিতায় মেতে উঠছেন না টম গ্রোগান। এখনো ভাড়া বাসাতেই থাকছেন। সহ-প্রতিষ্ঠাতা হারম্যান সাহোতা ও সল লিউইনের সঙ্গে বসে ভাবছেন পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে।

তিনি বলেন, ‘এটা বিরক্তিকর। আমি সারাজীবন সাগর পাড়ে বসে কাটাতে পারি না। আমাদের মনের ব্যস্ততা দরকার, নিজেদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে হবে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার একটা উদ্দেশ্য দরকার, যেটা এখন আমাদের নেই।’

তবে গ্রোগানের মতো এমন শূন্যতা অনুভব এবং কাজের জন্য ক্ষুধার উদ্রেক অনেক সফল উদ্যোক্তার মধ্যেই দেখা গেছে। এয়ারবিএনবির সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান চেস্কিও তেমন এক উদাহরণ। কোম্পানির আইপিওর পর বিলিয়নিয়ার বনে গেলেও তিনিও একই রকম হতাশা অনুভব করেছিলেন।

চেস্কি ভেবেছিলেন সাফল্য তাঁকে ভালোবাসা দেবে, জীবনের সব কিছু ঠিক করে দেবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তিনি নিজের সেই মুহূর্তকে বর্ণনা করেছেন জীবনের ‘সবচেয়ে দুঃখের সময়গুলোর একটি’ হিসেবে।

চেস্কি বলেন, ‘পাহাড়ের নিচে থাকলে তোমার মনে আশা থাকে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, যখন তুমি চূড়ায় পৌঁছাও তখন দেখো, তুমি একা। চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন।’

এমন অভিজ্ঞতার কথা আগেও বলেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত উদ্যোক্তা সিদ্ধার্থ শঙ্কর। ৫০ কোটি ডলারে ব্যবসা বিক্রি করার পর মানসিক দিক থেকে কীভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, সেটি জানিয়েছিলেন তিনি।

এক সাক্ষাৎকারে শঙ্কর বলেন, কোম্পানি বিক্রির পর জীবনের পরিবর্তনটা ছিল কঠিন। ১৫ বছর টানা কাজের মধ্যে থাকার পর হঠাৎ নিয়মিত রুটিন হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরিবারের সবাই ভেবেছিল, এত টাকা পাওয়ার পর তাঁর জীবন আরও সুখের হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

তিনি মজা করে বলেন, ‘প্লে স্টেশন খেলা বা গলফ খেলারও একটা সীমা আছে।’ ভেতরে ভেতরে তিনি অনুভব করছিলেন এক গভীর শূন্যতা। উদ্যোক্তা জীবনের ছন্দ থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় সেই মানসিক শূন্যতা সামলানো কঠিন হয়ে ওঠে।

বাইরের স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক সাফল্য পেলেও জীবনের উদ্দেশ্য ও মানে হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সবচেয়ে দামির রেকর্ড ধরে রাখল ১৯৪৩ সালে বানানো হাতঘড়ি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ঘড়িটির দাম উঠেছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার সুইস ফ্রাঁ, যা প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলারের সমান। ছবি: এএফপি।
ঘড়িটির দাম উঠেছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার সুইস ফ্রাঁ, যা প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলারের সমান। ছবি: এএফপি।

১৯৪৩ সালে তৈরি একটি হাতঘড়ি বিশ্বের সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ল। এর আগে ২০১৬ সালে নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ে এই ঘড়িটি। এবার আরও বেশি দামে ঘড়িটি বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস।

ঘড়িটির দাম উঠেছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার সুইস ফ্রাঁ, যা প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলারের সমান। ২০১৬ সালে একই ঘড়ি বিক্রি হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ সুইস ফ্রাঁ দামে, অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ ডলারে।

ঘড়িটি হলো পাটেক ফিলিপ পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার ক্রোনোগ্রাফ রেফারেন্স ১৫১৮ মডেল। স্টেইনলেস স্টিলে তৈরি মাত্র চারটি ঘড়ির একটি এটি। স্বর্ণের ঘড়ির তুলনায় এমন স্টিলের ঘড়ি বিরল হওয়ায় এটি সংগ্রাহকদের কাছে আরও মূল্যবান।

২০১৬ সালে রিস্টওয়াচ হিসেবে ঘড়িটি বিশ্বে সর্বোচ্চ দামে বিক্রির রেকর্ড গড়েছিল। তবে ২০১৭ সালে হলিউড তারকা পল নিউম্যানের মালিকানাধীন রোলেক্স ডেটোনা ঘড়ি ১ কোটি ৭৮ লাখ ডলারে বিক্রি হয়ে সেই রেকর্ড ভেঙে দেয়।

২০১৯ সালে সেই রেকর্ড ভেঙে দেয় আরেকটি পাটেক ফিলিপ গ্র্যান্ডমাস্টার চাইম ঘড়ি, যা বিক্রি হয়েছিল ৩১ মিলিয়ন ডলারে।

নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস বলেছে, স্টেইনলেস স্টিলের ১৫১৮ মডেল আবারও প্রমাণ করল, এটি ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতঘড়িগুলোর একটি।

প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ঘড়িটি বিক্রি হতে সময় লেগেছে মাত্র ৯ মিনিটের একটু বেশি। এতে পাঁচজন ক্রেতা দরপত্রে অংশ নেন। শেষ পর্যন্ত টেলিফোনে যুক্ত এক ক্রেতার কাছে ঘড়িটি বিক্রি হয়।

জেনেভার হোটেল প্রেসিডেন্টে অনুষ্ঠিত নিলাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা সংগ্রাহক, ব্যবসায়ী ও ঘড়িনির্মাতা।

ফিলিপস জানায়, ১৫১৮ এমন একটি ঘড়ি, যা সংগ্রহ করতে পারলে একজন সংগ্রাহক মনে করতে পারেন, তিনি ঘড়ি সংগ্রহের জগতে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছেন।

১৯৪১ সালে বাজারে আসা এই মডেল ছিল বিশ্বের প্রথম ধারাবাহিকভাবে উৎপাদিত পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার ক্রোনোগ্রাফ।

পাটেক ফিলিপ প্রায় ২৮০টি ১৫১৮ মডেলের ঘড়ি উৎপাদন করেছিল। এর মধ্যে বেশিরভাগ হলুদ স্বর্ণে এবং প্রায় এক পঞ্চম অংশ গোল্ডের রঙের (রোজ গোল্ড)।

স্টেইনলেস স্টিলে বানানো মাত্র চারটি ঘড়ির কথা জানা যায়। সম্প্রতি বিক্রি হওয়া ঘড়িটি সেই চারটির মধ্যে প্রথম উৎপাদিত। কেন পাটেক ফিলিপ এই ঘড়িগুলো তৈরি করেছিল, তা আজও রহস্য।

নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস এটিকে আখ্যায়িত করেছে, ‘এটি প্রায় পৌরাণিক মর্যাদার একটি সময়যন্ত্র। এটি ইতিহাসের গুরুত্ব, নকশার শ্রেষ্ঠত্ব, যান্ত্রিক উদ্ভাবন এবং বিরলতার চূড়ান্ত সমন্বয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।’

দুই দিনের নিলামে মোট ২০৭টি লট বিক্রি হয়, যা ৬৬.৮ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ অতিক্রম করে। ফিলিপস জানায়, এটি কোনো ঘড়ি নিলামের জন্য সর্বোচ্চ মোট বিক্রির রেকর্ড।

৭২টি দেশে নিবন্ধিত ১ হাজার ৮৮৬ জন ক্রেতা নিলামে অংশ নিয়েছিলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এত সম্পদ দিয়ে কী করেন শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৭: ৫৬
প্রথম ৫০০ বিলিয়ন ডলারের (অর্ধ ট্রিলিয়ন) মালিক ইলন মাস্ক। ছবি: জেমিনি
প্রথম ৫০০ বিলিয়ন ডলারের (অর্ধ ট্রিলিয়ন) মালিক ইলন মাস্ক। ছবি: জেমিনি

ইলন মাস্ক। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো কারণে যার নাম আসে খবরের পাতায়। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বের ধনীদের তালিকায় শীর্ষ স্থান দখল করেন এই মার্কিন উদ্যোক্তা। আর ধনীদের তালিকায় তো এসেছেন বহুকাল আগে। সম্প্রতি ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন প্রথম ৫০০ বিলিয়ন ডলারের (অর্ধ ট্রিলিয়ন) মালিক হিসেবে।

এত অর্থ-সম্পদ দিয়ে ইলন মাস্ক কী করেন, এ নিয়ে অনেক জল্পনা চলে বছরজুড়েই। তিনি নতুন করে আরও একটি ঘোষণা দেন এবং আবারও উঠে আসে এই আলোচনা। তবুও মাস্কের দাবি, তাঁর জীবনযাপন বেশ সাধারণ এবং অনাড়ম্বর। ২০২১ সালে একবার মাস্ক জানান, টেক্সাসে যে ছোট্ট বাড়িটিতে তিনি থাকেন, সেটির মূল্য মাত্র ৫০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬১ লাখ টাকা)।

ইলন মাস্কের সাদামাটা জীবন নিয়ে তাঁর সাবেক সঙ্গীদের আলাপেও উঠে এসেছে।

ইলন মাস্কের তিন সন্তানের জননী সাবেক সঙ্গী কানাডিয়ান সঙ্গীতশিল্পী গ্রাইমস ২০২২ সালে ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, অনেকে যেমনটা মনে করেন আসলে তা নয়। মাস্ক বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন না। তিনি তেমন বেশি বিলাসিতার মধ্যে থাকেন না।

সাবেক সঙ্গী কানাডিয়ান সঙ্গীতশিল্পী গ্রাইমসের সঙ্গে ইলন মাস্ক। ছবি: সংগৃহীত
সাবেক সঙ্গী কানাডিয়ান সঙ্গীতশিল্পী গ্রাইমসের সঙ্গে ইলন মাস্ক। ছবি: সংগৃহীত

গ্রাইমস আরও বলেন, ‘তিনি মোটেও বিলিয়নিয়ারদের মতো থাকেন না। কখনো কখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের মতো জীবনযাপন করেন। একবার তো এমনও হয়েছিল, বিছানায় তাঁর (গ্রাইমসের) পাশটায় ম্যাট্রেসে গর্ত হয়ে যাওয়ার পরও মাস্ক নতুন একটা কিনতে রাজি হননি।’

জীবনযাপন সাধারণ হলেও কিছু ক্ষেত্রে মাস্কের খরচের খাতা বেশ ভারি।

মাস্কের গাড়ির প্রতি আকর্ষণ চোখে পড়ার মতো। তাঁর কাছে এমন গাড়িও আছে, যা সাবমেরিনে রূপ নিতে পারে। এছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত জেটবিমানগুলোর মূল্যও কয়েক কোটি ডলার।

এরপর তো ২০২২ সালে পুরো প্রযুক্তি মাধ্যম কাঁপিয়ে দিয়ে সেই ‘ছোট্ট খরচা’ করলেন। ৪৪ বিলিয়ন ডলারে কিনে ফেললেন টুইটার। তারপর এর নাম দিলেন ‘এক্স’। এই কেনাকাটা ‘মন চাইল, কিনলাম’ টাইপই ছিল তাঁর কাছে।

১০ কোটি ডলারে ৭ বছরে ৭টি বাড়ি

ইলন মাস্কের এক বিশাল রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য ছিল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাত বছরে প্রায় ১০ কোটি ডলার দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার অভিজাত এলাকা বেল-এয়ারে সাতটি বাড়ি কিনেছিলেন মাস্ক।

এগুলোতে ছিল টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল, ওয়াইন সেলার, ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। এমনকি বল রুমও ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ‘উইলি ওয়ঙ্কা’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত কিংবদন্তি অভিনেতা জিন ওয়াইল্ডারের র‍্যাঞ্চ হাউস।

বিখ্যাত কিংবদন্তি অভিনেতা জিন ওয়াইল্ডারের র‍্যাঞ্চ হাউস কিনেছিলেন ইলন মাস্ক। ছবি: আর্টনেট নিউজ
বিখ্যাত কিংবদন্তি অভিনেতা জিন ওয়াইল্ডারের র‍্যাঞ্চ হাউস কিনেছিলেন ইলন মাস্ক। ছবি: আর্টনেট নিউজ

তবে ২০২০ সালে এসে এই বিলাসবহুল বাড়ি কেনার ঝোঁক পাল্টে যায় মাস্কের। তিনি এক টুইটে জানান, প্রায় সব ভৌত সম্পদ বিক্রি করে দেবেন তিনি। আর কোনো বাড়ির মালিক থাকবেন না।

তিনি লেখেন, ‘আমার টাকার দরকার নেই। আমি নিজেকে মঙ্গল গ্রহ ও পৃথিবীর কাজে উৎসর্গ করছি। সম্পত্তি মানুষকে ভারী করে ফেলে।’

তবে তিনি একটি শর্তও দেন, অভিনেতা জিন ওয়াইল্ডারের বাড়িটি যেন ‘ধ্বংস না করা হয়’ এবং এর কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না।

ওয়াইল্ডারের ভাতিজা জর্ডান ওয়াকার-পার্লম্যানের কাছে তিন বেডরুমের ওই বাড়িটি বিক্রি করে দেন মাস্ক। বাড়িটি কেনার জন্য মাস্ক নিজেই ওয়াইল্ডারের ভাতিজাকে কয়েক মিলিয়ন ডলার ঋণ দেন। কিন্তু ওয়াকার-পার্লম্যান সময়মতো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছিলেন বলে ২০২৫ সালের জুনে বাড়িটির মালিকানা ফেরত নেন তিনি।

মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্স-এর প্রধান কার্যালয়ের কাছেই থাকেন ইলন মাস্ক। ছবি: এক্স।
মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্স-এর প্রধান কার্যালয়ের কাছেই থাকেন ইলন মাস্ক। ছবি: এক্স।

২০২১ সালে মাস্ক টুইট করে জানান, এখন থেকে তাঁর ‘প্রধান বাসস্থান’ টেক্সাসের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এক সাধারণ প্রিফ্যাব্রিকেটেড বাড়ি, যার দাম প্রায় ৫০ হাজার ডলার। তাঁর মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্স ওখান থেকেই পরিচালিত হয়। এই অঞ্চলটি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্টারবেস’ নামে পরিচিত।

মাস্ক বলেন, ‘এটা আসলেই দারুণ।’

এর পরের বছর মাস্ক আবার জানান, তাঁর নিজের নামে কোনো বাড়িই নেই। একে নিজের কম ভোগবাদী জীবনযাপনের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। যদিও তাঁর সম্পদের পরিমাণ বিপুল।

তিনি মার্কিন-কানাডিয়ান অলাভজনক মিডিয়া সংস্থা টেড-এর প্রধান ক্রিস অ্যান্ডারসনকে বলেন, ‘আমি বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতেই বেশি থাকি। যখন বে এরিয়ায় যাই, যেখানে টেসলার বেশিরভাগ ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ হয়, তখন বন্ধুদের বাড়ির ফাঁকা ঘরগুলোতে পালা করে থাকি।’

টেক্সাসে ৫০ হাজার ডলারে কেনা এই বাড়িটি মাস্কের একমাত্র বাড়ি। ছবি: ডেইলি মেইল।
টেক্সাসে ৫০ হাজার ডলারে কেনা এই বাড়িটি মাস্কের একমাত্র বাড়ি। ছবি: ডেইলি মেইল।

এই কথা আসলেই সত্যি। ২০১৫ সালে গুগলের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী ল্যারি পেজ লেখক অ্যাশলি ভ্যান্সকে বলেছিলেন, মাস্ককে ‘একরকম গৃহহীন’-ই বলা যায়।

ল্যারি পেজ আরও বলেন, “সে ই-মেইল করে বলে, ‘আজ রাতে কোথায় থাকব বুঝতে পারছি না। তোমার বাড়িতে আসতে পারি?’ ”

বছরের পর বছর ধরে জল্পনা চলছে, মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সম্পত্তি কিনছেন কিনা। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে টেক্সাসের ওই বাড়িটিই এখনো তাঁর একমাত্র বাড়ি হিসেবে পরিচিত।

মাস্কের সংগ্রহ যেন ঐতিহাসিক গাড়ির মেলা

ইলন মাস্ক বাড়ির পেছনে খরচ না করলেও গাড়ির ক্ষেত্রে বেশ উদার। টেসলার মালিক হিসেবে তাঁর বিরল ও ব্যতিক্রমধর্মী গাড়ির সংগ্রহ থাকা আশ্চর্যের কিছু নয়! তবে তাঁর কিছু গাড়ি একেবারেই সবার থেকে আলাদা।

মাস্কের সংগ্রহে ছিল ২০শ শতাব্দীর প্রথম সাশ্রয়ী মূল্যের গাড়ি হিসেবে পরিচিত ফোর্ড মডেল ‘টি’। গাড়ি শিল্পে এক ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটায় এই গাড়ি।

আরও ছিল ১৯৬৭ সালের জাগুয়ার ই-টাইপ রোডস্টার। এই গাড়িটির প্রতি নাকি শৈশব থেকেই মাস্কের আকর্ষণ। ১৯৯৭ সালের ম্যাকলারেন এফ ১ গাড়িটিও তাঁর সংগ্রহে ছিল। একবার দুর্ঘটনায় ভেঙে যায় গাড়িটি। বিপুল অর্থ ব্যয়ে মেরামত করেন তিনি। পরে অবশ্য বিক্রি করে দেন।

জেমস বন্ডের সিনেমা দ্য স্পাই হু লাভড মি-তে ব্যবহৃত ‘ওয়েট নেলি’ গাড়ি কিনেছিলেন মাস্ক। ছবি: অটোএভ্যুলুশন।
জেমস বন্ডের সিনেমা দ্য স্পাই হু লাভড মি-তে ব্যবহৃত ‘ওয়েট নেলি’ গাড়ি কিনেছিলেন মাস্ক। ছবি: অটোএভ্যুলুশন।

তাঁর আরেকটি বিখ্যাত গাড়ি হলো টেসলার প্রথম বাজারজাত করা টেসলা রোডস্টার। ২০১৮ সালে মাস্ক এই গাড়িটি মহাকাশে পাঠিয়েছিলেন।

১৯৭৭ সালের জেমস বন্ডের সিনেমা দ্য স্পাই হু লাভড মি-তে ব্যবহৃত ১৯৭৬ সালে বাজারে আসা লোটাস এসপ্রিৎ গাড়িটিও তাঁর সংগ্রহে ছিল। সিনেমায় ‘ওয়েট নেলি’ নামের এই গাড়িটি সাবমেরিনে রূপ নিতে পারত। মাস্ক ২০১৩ সালে প্রায় ১০ লাখ ডলারে নিলামে গাড়িটি কিনেছিলেন। সেই সাবমেরিনে রূপান্তরের ক্ষমতাটিকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার ইচ্ছে ছিল তাঁর।

আকাশ পথেও পিছিয়ে নন মাস্ক

উড়ালপথেও খরচ করতে ভালোবাসেন ইলন মাস্ক। তবে তাঁর দাবি, ‘এটি বিলাসিতা নয়—বরং কাজের প্রতি তাঁর নিবেদন।’

২০২২ সালে টেডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাস্ক বলেন, ‘আমি যদি উড়োজাহাজ ব্যবহার করি, যাতে আমার কাজের জন্য হাতে বেশি সময় পাই।’

মাস্কের সংগ্রহে আছে একাধিক গালফস্ট্রিম মডেলের ব্যক্তিগত জেট, যার প্রতিটির দাম কয়েক কোটি ডলার।

মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্পেসএক্স ও টেসলার অফিসগুলো পরিদর্শনে এবং আন্তর্জাতিক সফরে এই উড়োজাহাজগুলো ব্যবহার করেন।

দাতব্য কাজ নিয়ে আলোচিত-সমালোচিত ইলন মাস্ক

মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থার নথি অনুযায়ী, মাস্ক বিভিন্ন দাতব্য সংস্থাকে বিলিয়ন ডলারের শেয়ার দান করেছেন। প্রায় সময়ই নানা উদ্যোগে বহু মিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে তাঁর দানশীলতা নিয়ে সমালোচনাও আছে।

নিউইয়র্ক টাইমস গত বছর লিখেছিল, তাঁর দানের ধরন ‘অগোছালো এবং মূলত ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট’। এই দানের ধরন তাঁকে বিশাল কর-ছাড়ের সুযোগ দেয় এবং তাঁর ব্যবসাকেও সহায়তা করে।

তাঁর দাতব্য সংস্থা মাস্ক ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে বলা আছে, প্রতিষ্ঠানটি মানবজাতির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে।

তবে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, টানা তিন বছর ধরে ফাউন্ডেশনটি আইন অনুযায়ী যে পরিমাণ অর্থ দান করা প্রয়োজন, তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। পত্রিকাটি যে কর সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনা করেছে, তাতে দেখা গেছে, সংস্থাটির বেশিরভাগ অনুদানই গেছে মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলোতেই।

এ বিষয়ে মাস্ক ও তাঁর ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পায়নি নিউইয়র্ক টাইমস।

অতীতে দান ও সমাজসেবামূলক কাজ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মাস্ক প্রায়ই প্রচলিত দান পদ্ধতির বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

২০২২ সালে টেডের ক্রিস অ্যান্ডারসনকে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি ভালো কাজের আসল প্রভাব নিয়ে ভাবেন, শুধু বাহ্যিক ভাবমূর্তি নয়, তাহলে দানশীলতা আসলে অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়।’

মাস্ক বলেন, টেসলা টেকসই জ্বালানির প্রসার ঘটাচ্ছে, স্পেসএক্স মানবজাতির দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে, আর নিউরালিংক মস্তিষ্কজনিত আঘাত এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে সৃষ্ট অস্তিত্বগত ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করছে।

তাঁর ব্যবসাগুলোই মানবকল্যাণের এক ধরনের দান বলে মনে করেন ইলন মাস্ক। তিনি বলেন, ‘যদি দানশীলতার অর্থ হয় মানবতার প্রতি ভালোবাসা, তবে এগুলোই দানশীলতা।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

একেবারে মাখন!

সম্পাদকীয়
একেবারে মাখন!

‘হাজী মাখন বিরানী’ বা ‘হাজী মাখন পোলাও’—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাদের দোকান ওই দুইটাই; পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন লেনে। না, মাখন দিয়ে তাদের পোলাও বা বিরিয়ানি রান্না করা হয় না। প্রতিষ্ঠাতা আবদুল কাদেরের ছেলের নাম হাজী মাখন। তাঁর নামেই ব্যবসার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সত্তর বছরের বেশি আবদুল কাদেরের এই ব্যবসার বয়স। পঞ্চাশের দশক থেকে তিন প্রজন্ম ধরে চলছে পারিবারিক এই ব্যবসা। একসময় ১ পয়সা কি ২ পয়সায় এক প্লেট মাখন বিরিয়ানি খাওয়া যেত। এখন খেতে হলে শ দেড়েক টাকা তো লাগবেই। পোলাওয়ের চালের সঙ্গে গরুর মাংসের মাখো মাখো এই বিরিয়ানি খেতে কিন্তু একেবারেই মাখন!

ছবি: হাসান রাজা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত