Ajker Patrika

ফুটবলে দুজন বেঁধেছে হৃদয়

নাজিম আল শমষের, ঢাকা
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২২: ০৩
ফুটবলে দুজন বেঁধেছে হৃদয়

মাঠে তিনি এখনো ‘স্যার’। মনের অজান্তে তাই ভুলে এখনো মাহবুবুর রহমানকে ‘লিটু স্যার’ বলে সম্বোধন করেন মাহমুদা আক্তার। সংসারে এই নিয়ে বেশ ভালোই খুনসুটি হয় দুজনের। প্রথম শ্রেণিতে পড়া ছোট মেয়ে মাইমুনা রাইসাও এখন মাকে দেখে বাবাকে ডাকে ‘লিটু স্যার’ বলে!

বাফুফে ভবনের দোতলায় বসে কথাটা বলতে বলতে হাসিতে ফেটে পড়েন বাংলাদেশের নারী ফুটবলের সবার প্রিয় ‘কোচ’ দম্পতি মাহবুবুর রহমান লিটু ও মাহমুদা আক্তার। এক যুগ আগে দুজনের সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের। পেশাদারি সম্পর্ক এখনো আছে। মাঠে, অনুশীলনে মাহবুবুরকে ‘স্যার’ বলে ডাকেন মাহমুদা। এককালের গুরু এখন মাহমুদার সারা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। এক যুগ আগে এই দীর্ঘ পথচলা শুরু হয়েছিল কাকতালীয়ভাবে ফেব্রুয়ারি মাসেই!

২০১০ সাফের পর সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন মাহমুদা। সেই ছবি থেকেই শুরু দুজনের পথ চলার। কোচ মাহবুবুরের সঙ্গে শিষ্য মাহমুদার ছবিটা দেখে বেশ মনে ধরেছিল মাহবুবুরের বড় বোনের। এরপর নারায়ণগঞ্জের মেয়ে মাহমুদার পরিবারে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠানো। সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসার সম্পর্কে বাঁধা পড়লেন মাহবুবুর-মাহমুদা।

গুরু থেকে স্বামী, সংসারের শুরুটা কেমন ছিল দুজনের? লাজুক অভিব্যক্তিতে মাহমুদা বললেন, ‘যাঁকে আমি আগে ২৪ ঘণ্টা স্যার ডাকতাম, তিনিই এখন আমার স্বামী। মাঠে এখনো কিন্তু তাঁকে আমি লিটু স্যার বলে ডাকি। খুব কম সময়ই তাঁকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছি। কেন জানি, আমার এই শব্দটা আসে না (হাসি)!’ পাশে বসা লিটু দিলেন মজার তথ্য, ‘মাকে দেখে আমাদের ছোট মেয়েও আমাকে ডাকে এই যে লিটু স্যার, এদিকে আসেন (হাসি)!’

ফুটবল ছেড়ে স্বামীর মতোই কোচিংকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন মাহমুদা। এএফসি ‘বি’ লাইসেন্স পেয়েছেন মাহবুবুর, ‘সি’ লাইসেন্স মাহমুদার। বাংলাদেশের নারী দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের সহকারী হিসেবে দায়িত্বে আছেন এই দম্পতি। দক্ষিণ এশিয়ায় আজ বাংলাদেশের নারী ফুটবলের যে শ্রেষ্ঠত্ব, সেটির অন্যতম কারিগর মাহবুবুর-মাহমুদা দম্পতি। নারী ফুটবলকে গড়তে গিয়ে নিজেদের স্বপ্নের সংসার গড়া হয়নি দুজনের। 

বড় মেয়ে মায়মুনা পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, ছোট মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে। দুই মেয়েকে নারায়ণগঞ্জে নানিবাড়িতে রেখে কখনো পল্টনে, আবার কখনো বাফুফে ক্যাম্পের অস্থায়ী সংসার তাঁদের। কাকডাকা ভোরে শুরু হয় নারী ফুটবলারদের নিয়ে অনুশীলন। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে রাতে হয়তো অল্প সময় পান নিজেদের মতো করে সময় কাটানোর।

ফুটবলের স্বার্থে নিজের একটা গোছানো সংসারের স্বপ্ন ত্যাগ করেছেন মাহমুদা। খানিকটা আক্ষেপ নিয়েই তিনি বললেন, ‘অনেক সময় মনে হয় মেয়েদের যে সময়টা প্রাপ্য ছিল, সেটা তাদের দিতে পারছি না। আমার বড় মেয়ের বয়স যখন ৫ বছর, তখন থেকেই সে দূরে। ছোট মেয়েকে তিন মাস বয়সে দূরে রেখে বি-লাইসেন্সে অংশ নিতে হয়েছে। সেও এখন দূরে।’ 

মেয়েদের কাছে না পাওয়ার আক্ষেপ বাবা মাহবুবুরেরও। ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাঁকে। এই ১ ফেব্রুয়ারি হারিয়েছেন মাকে। মা হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন ডাগআউটে। দেশকে জিতিয়েছেন অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের শিরোপা। এত ত্যাগের পর নিজেদের স্বপ্নের সংসার গড়তে না পারার দুঃখ ভুলে যান নারী দলের সহকারী কোচ মাহবুবুর, ‘মেয়েরা যখন দেশকে সাফল্য এনে দেয়, তখন নিজেরাও তৃপ্ত হই। দেশের মানুষের হাসি দেখে সব কষ্টের কথা ভুলে যাই। আমাদের মেয়েরাও গর্বিত এই সাফল্য দেখে।’

আজ ভালোবাসা দিবস। কিন্তু নিজেদের ভালোবাসাকে ত্যাগ করে দুই সেশনে অনুশীলনে ব্যস্ত থাকতে হবে মাহবুবুর-মাহমুদা দম্পতিকে। ফুটবলকে ভালোবেসে মাঠেই ভালোবাসা দিবসের আনন্দ খুঁজে পাবেন তাঁরা। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত