Ajker Patrika

রাশেদ ও ভাজা ডিমের গল্প

জাহীদ রেজা নূর
রাশেদ ও ভাজা ডিমের গল্প

টাউন হল বাজারের পথে সরু গলিপথ পার হওয়ার সময় ভাজা ডিমের গন্ধে মন ভরে যায়। দেখতে পাই, এক তরুণ পরোটা বেলে চলেছে। এক কিশোর পরোটা, ডাল আর ডিম ভাজা প্লেটে নিয়ে সামনের বেঞ্চিতে রাখছে। উঁচু বেঞ্চির ঠিক পেছনে নিচু বেঞ্চিতে বসেছে কয়েকজন। রসনা বিলাসের জন্য তৈরি হচ্ছে তারা। তিনজনের বেশি বসার উপায় নেই। তাই ক্ষুধার্ত দু–একজন অপেক্ষা করছে বেঞ্চি খালি হওয়ার আশায়।

পরিত্যক্ত কনডেনসড মিল্কের কৌটায় একটু পেঁয়াজ, একটু মরিচ আর লবণ দিয়ে বেশ খানিকক্ষণ নেড়েচেড়ে ডিমটা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বড় তাওয়ার তপ্ত তেলে। তারই এক পাশে ভাজা হচ্ছে পরোটা। একটা হাঁড়িতে রয়েছে ডাল, মৃদু আঁচে তা গরম হচ্ছে।

ডিমের এই ঘ্রাণ নাকে এলেই ফিরে যাই শৈশবে। কাছে–ধারের কোনো কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসত ডিম ভাজার ঘ্রাণ। সে সময় ঘ্রাণে অর্ধভোজনই ছিল প্রায় প্রতিদিনের নিয়তি। মনে হতো, বড় হওয়ার পর যখন অঢেল টাকার মালিক হব, তখন প্রতিদিন একটা করে ডিম খাব। কল্পনাতেও একটি আস্ত ডিমের বেশি কিছু ভাবতে পারতাম না। 
ডিমকে তখন মামলেট নামে ডাকা হলে সে পেয়ে যেত আভিজাত্যের মর্যাদা।

টাউন হলের রাস্তার ধারে দেয়াল ঘেঁষে তৈরি করা ছাদহীন রেস্তোরাঁয় পরোটা বানাতে ব্যস্ত ছিল রাশেদ। একটু আগেই তার নাম জেনে নেওয়া হয়েছে। মুখে মাস্ক নেই। কেন নেই—এ প্রশ্ন করায় যে উত্তরগুলো আসে, তার কোনো কোনোটি অধ্যাত্মবাদের তুঙ্গ ছোঁয়, কোনোটি দার্শনিকতার সঙ্গে মিতালি পাতায়, কোনো কোনোটি মরমি সংগীতের নির্যাসে পরিণত হয়।

‘আপনার দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ডিম ভাজার ঘ্রাণ পাই। মাঝে মাঝেই খেতে ইচ্ছে করে।’ রাশেদকে বলি। 
উত্তরে দেখি শুধু রাশেদের হাসি।

‘কয় বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছেন?’

‘আট বছর।’

‘কী কী তৈরি করেন?’

‘এই ভাজাভুজি। পুরিটুরি আর কী।’

‘ব্যবসা কেমন চলছে?’

‘ব্যবসা যেমন চলে আর কী!’

‘সেটা কেমন?’

‘মোটামুটি ভালো।’

‘মানুষ খায়? খেতে আসে?’

‘মানুষ হালকাপাতলা। আহে না। ভয় পায়।’

‘আপনার বাড়ি কই?’

‘দ্যাশের বাড়ি বরিশাল।’

সহযোগী ছোট ছেলেটা বারবার ক্যামেরার সামনে দিয়ে ঘুরছিল। ও যেন ভিডিওতে থাকে, তা নিশ্চিত করতে চাইছিল। ওর দৃপ্ত পদচারণায় রাশেদের সাক্ষাৎকারে ব্যাঘাত ঘটছিল। কিন্তু তাতে ওর কিছুই আসে যায় না। মাঝেমধ্যেই কারণে–অকারণে ক্যামেরার সামনে এসে ক্যামেরার দিকেই ও রাখছিল চোখ।

এবার একটু দার্শনিক প্রশ্ন করার সময় হয়। জিজ্ঞেস করি, ‘এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে জীবনে, যা মনে দাগ কেটেছে?’

‘আমাদের জীবনে কোনো ঘটনা দাগ–টাগ কাটে না।’ বলল রাশেদ। কথাটা খুব রুক্ষ শোনালেও ও আসলে বলেছিল খুবই নরম গলায়। একটু অপরাধী কণ্ঠে। যদি এক–আধটু বলার মতো ঘটনা থাকত, তাহলে ওর ভালোই লাগত বোধ হয়।

রাশেদ যোগ করে, ‘কিছুই এখানে ঘটে না। একই রকম প্রতিদিন।’

জীবনটা ওর একঘেয়ে নাকি?

‘কখন এখানে আসেন, কখন বাড়ি ফেরেন?’

‘অনেক সকালে আসি, রাত দশটায় বাড়ি ফিরি।’

‘সারা দিন এখানে থাকেন?’

‘বাজারে লোক থাকে সব সময়। খুব খারাপ নাই।’

‘বাড়িতে কে কে আছে?’

‘বাড়িতে বাবা–মা। বরিশালে। আর এখানে আমরা দুজন আর দুই ছেলে মেয়ে।’

‘ওদের নাম কী? বয়স কত?’

‘সাত আর নয়। রায়হান আর মরিয়ম।’

বিষম মেজাজ খারাপ হয় আমার। যে মানুষের দুটি ফুটফুটে সন্তান রয়েছে বাড়িতে, সে কিনা তার পুরোটা দিন আর রাতের বড় একটা অংশ কাটিয়ে দিচ্ছে বাজারে! বাচ্চাদের ব্যাপারে কোনো নজর নেই তার? দিনের পর দিন ছুটিহীন এক অদ্ভুত জীবন কাটিয়ে যাচ্ছে রাশেদ! টাকাটাই সব হলো? এটা একটা জীবন নাকি! 
এসব রাগের প্রকাশ যখন করব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই রাশেদ যা বলল, তাতে আমার মন হয়ে ওঠে মরূদ্যান।

রাশেদ তখন বলছেন, ‘বাচ্চাগুলারে না দেইখ্যা থাকতে পারি না। বারবার বাড়ি গিয়া দেইখ্যা আসি। ওগো লগে গল্প করি। তখন এই পোলাটা দোকান দেখে।’
এ কথা বলে সামনে ঘুরতে থাকা কিশোরটাকে দেখিয়ে দেয় রাশেদ। সে ছেলেটি তখন তাওয়া থেকে একটি ভাজা ডিম উঠিয়ে প্লেটে রাখছে। সেই সুঘ্রাণে ভাসতে ভাসতে ফিরে আসি নিজ গন্তব্যে। 

বিষয়:

ব্যবসা
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সাবেক সিইসি নূরুল হুদার গলায় ‘জুতার মালা’ দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

ইরানের পতন হলে, এরপরই রাশিয়া—অভিমত রুশ বিশ্লেষকদের

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর মোদির সঙ্গে ইরানের প্রেসিডেন্টের ফোনালাপ

অনেক দেশ ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র দিতে প্রস্তুত, দাবি পুতিনের শীর্ষ সহযোগীর

মার্কিন হামলার পর ইসরায়েলে ‘খোররামশহর-৪’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত