Ajker Patrika

যা ঘটছে তা ‘বিরক্তিকর ও উদ্বেগজনক’

জাতীয় নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে এনসিপি। ছবি: ফোকাস বাংলা
জাতীয় নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে এনসিপি। ছবি: ফোকাস বাংলা

সহজ কথা বলা যেমন সহজ নয়, তেমনি সহজ নয় আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিষয়ে একমত হওয়া। আমাদের দেশে যত মাথা, তত মত—যে যার মতে অটল, নিজের বক্তব্যে অনড়। ফলে এখানে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই যেন যুদ্ধ জয়ের সমান। রাজনীতি তো আর গণিতের সূত্র নয়, যেখানে সবাই একই জবাব মেনে নেবে; এখানে আবেগ, স্বার্থ, বিশ্বাস আর ভিন্নমত একসঙ্গে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে থাকে। এখানে সবাই নিজের মতের বাদ্যযন্ত্র বাজায়, অন্যের সুমধুর সংগীত শোনারও ধৈর্য রাখে না। মতের এ মিছিল কখনো এগোয় না, শুধু জট পাকায়। সিদ্ধান্ত নয়, বিভক্তিই যেন আমাদের প্রিয় খেলা। তাই রাজনীতিতে একটিমাত্র লক্ষ্য ঠিক করতে করতেই সময় ফুরায়, শক্তি ক্ষয় হয় আর জাতি এগোনোর বদলে বারবার পিছিয়ে পড়ে।

চব্বিশের আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে ভালোর দিকে পরিবর্তনের যে আশা জেগেছিল, সাত-আট মাসের মধ্যেই তা ফিকে হতে শুরু করেছে। নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ধোঁয়াশা না কমে বাড়ছে। সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য—দিল্লি বহুত দূরের মতো। দেশে সত্যি কী ঘটছে, কী ঘটতে চলেছে, তা নিয়ে কারও কাছ থেকেই পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। তবে অস্বস্তিকর নানা গুজব কান পাতলেই শোনা যায়। তথ্যের চেয়ে অপতথ্যের ছড়াছড়ি লক্ষ করা যায়।

এর মধ্যেই কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে এখনো মানুষ মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের জন্য ভালো সমাধান। তারা বলছে না অন্তর্বর্তী সরকারকে যেতে দাও। আজ আমাদের নির্বাচন। কেউ তা বলেনি।’

এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এখনো অবিচল আস্থা রয়েছে বলে তিনি মনে করছেন। মানুষ এই সরকারের পরিবর্তন চাচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে মানুষের তেমন মাথাব্যথা নেই। ড. ইউনূসের সরকার ৫ বছর থাকা দরকার বলে যে প্রচারণা কোনো কোনো মহল থেকে শুরু হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য তাকেই বাতাস দিল কি না, সে প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে উঠছে।

কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি থেকে মনে হয়, তাঁরা ড. ইউনূসের সরকারকে অনির্দিষ্টকাল সময় দিতে চান না। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অস্থিতিশীল উল্লেখ করে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে ‘সবকিছু সমাধান করা’ সম্ভব নয়। এ কারণে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া দরকার।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হচ্ছে বিএনপি, যারা জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে। যারা রাজনৈতিক দল হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাস্তায় লড়াই করেছে, আমাদের সঙ্গে যারা রাস্তায় ছিল, ইতিমধ্যে প্রায় ৫০টি দল পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেছে, ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের জন্য।’

বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য ‘গত ১৬ বছরের যুদ্ধ ছিল’ উল্লেখ করে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যেই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে, তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, জবাবদিহি থাকবে, সেটা যেই সরকারই হোক।’

জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগের দলগতভাবে বিচার, দলটির নিবন্ধন বাতিল ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের ব্যাপারেও বিএনপি এবং সরকার সমর্থকদের মধ্যে বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে। ২৮ এপ্রিল বিক্ষোভ সমাবেশ ও মশাল মিছিল করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সমাবেশ থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন এনসিপির নেতারা।

শেখ হাসিনা ও সহযোগীদের বিচার ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘এটা জনগণের ব্যাপার, জনগণ যদি চায় শুধু আওয়ামী লীগ নয়, যেকোনো রাজনৈতিক দল সেটা নিষিদ্ধ হবে কি হবে না, তাতে জনগণের দায়িত্ব রয়েছে।’ তিনি এটাও বলেছেন যে ‘আমরা খুব ভালোভাবে চাই যে সিরিয়াসলি চাই, যারা গণহত্যার সাথে জড়িত শেখ হাসিনাসহ যাঁরা, তাঁদের প্রত্যেককে অতি দ্রুত বিচারের আওতায় এনে ন্যায় বিচার করতে হবে, সুষ্ঠু বিচার করতে হবে।’ তিনি বলেছেন, ‘আমরা মনে করি, বিচারকাজ বিচারকাজের মতো চলবে। নির্বাচন নির্বাচনের মতো চলবে।’

বিএনপি এবং তার মিত্ররা এখনো ডিসেম্বরের মধ্যেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি থেকে একচুলও পিছু হটেনি। আমীর খসরু পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে শুধু বিএনপি নয়, দেশের আরও প্রায় ৫০টি রাজনৈতিক দল একই দাবিতে ঐক্যবদ্ধ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি যদি এই দাবি নিয়ে দৃঢ় থাকে এবং মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বজায় রাখতে পারে, তবে আগামী দিনের রাজনীতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।

দুই.

বর্তমানে মামলা ও হয়রানি প্রসঙ্গেও দেশে কানাঘুষা ও আলোচনা কম হচ্ছে না। সম্প্রতি জনপ্রিয় অভিনেতা ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধেও একটি হত্য মামলা দায়ের হয়েছে। এই মামলা নিয়েও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। খোদ সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, ‘ইরেশ যাকেরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। জুলাই আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। ফলে এটা ডিপলি ট্রাবলিং অ্যান্ড ডিপলি ডিস্টার্বিং (খুবই বিরক্তিকর ও উদ্বেগজনক)।’

সংস্কৃতি উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘মামলা করেছেন একজন, এটি রাষ্ট্রপক্ষের মামলা নয়। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, মামলা করার স্বাধীনতা সবার আছে। সেই স্বাধীনতার কেউ অপব্যবহারও করছেন।’

এখানে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী মূলত বলতে চেয়েছেন, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে, হয়তো কোনো ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলাগুলো করছে। তিনি পুলিশ প্রশাসনের সঠিক তদন্তের ওপর ভরসা রাখার আহ্বান জানান। বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, পুলিশ এটার সঠিক তদন্ত করবে। যেটা সত্য, সেটার পক্ষে থাকবে, যেটা মিথ্যা, সেটা বাতিল করবে।’

ঢালাও মামলার বিষয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের আইনে কোথাও তো মামলা করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা দেওয়া নেই। যে যার মতো মামলা করছে। এখানে অনেক হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে, বিদ্বেষমূলক মামলা হচ্ছে, অন্যের জায়গাজমি দখল, ব্যবসা দখল করার জন্য মামলা হচ্ছে। এগুলো অত্যন্ত আনফরচুনেট (দুর্ভাগ্যজনক), অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। মামলা করে ফেলার পর পুলিশ-আদালত প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিকার দেওয়ার চেষ্টা করছি। যখন এত বেশি লোককে আসামি করা হয়, এত মামলা করা হয়, আমাদের জন্যও কঠিন হয়ে যায়।’

আসিফ নজরুলের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে বর্তমান সরকারও মামলার অপব্যবহারকে পুরোপুরি সমর্থন করে না। বরং প্রশাসনকে বলা হয়েছে মামলা গ্রহণের আগে বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করতে। তবে বাস্তবে এসব নির্দেশনা কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।

বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থাহীনতা যে

বাড়ছে, সেটারও ইঙ্গিত মেলে। যদি মামলার সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ে এবং প্রশাসন নিরপেক্ষতা হারায়, তাহলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল না হয়ে পারে না। আওয়ামী আমলের স্বেচ্ছাচারিতার ধারা এখনো অব্যাহত থাকলে আগস্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে

আসলে কী পরিবর্তন হলো?

আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের আদালতে গিয়েও যে হামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা নিয়েও মানুষের মনে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজিরার সময় একদল হামলাকারীর দ্বারা আক্রান্ত হন, তাঁকে কিল-ঘুষি মারা হয়। আদালত চত্বরে যখন এমন ঘটনা ঘটে, তখন সেটি আইনের শাসনের জন্য খুব ভালো সংকেত বহন করে না। এটি শুধু একজন ব্যক্তির ওপর হামলার ঘটনা নয়, এটি বাংলাদেশের বিচারিক প্রক্রিয়ার নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতাকেও প্রকাশ করে। যদি একজন সাবেক আইনমন্ত্রী আদালতের ভেতরে নিরাপদ না থাকেন, তাহলে সাধারণ নাগরিকেরা কতটা নিরাপদ—এমন প্রশ্ন অবধারিতভাবেই ওঠে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা দেশে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা আরও কমিয়ে দেবে। পাশাপাশি, এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নতুন মাত্রা প্রকাশ করে, যা ভবিষ্যতে আরও সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।

বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ যে রাজনৈতিকভাবে কিছুটা অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ দেশের মানুষের প্রত্যাশা

খুবই সাধারণ—একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সেই লক্ষ্যেই সব পক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট এখন আর কেবল দলীয় সংকট নয়, এটি রাষ্ট্রীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন কেবল একটি ইভেন্ট নয়, এটি জনগণের আস্থা ফেরানোর, ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতা গড়ে তোলা এবং গণতন্ত্রের পথ সুগম করার বড় সুযোগ। যদি এই সুযোগ নষ্ট হয়, তাহলে যে ক্ষতি হবে, তা কয়েক দশকেও পূরণ করা কঠিন হবে।

আজ প্রয়োজন উদারতা, দূরদৃষ্টি ও সাহস। ভুল করলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণই তাদের রায় দিয়ে দেবে—কে জনগণের কথা শুনল, আর কে নিজের শক্তির মোহে সব হারাল। তাই নির্বাচন নিয়ে কোনো টালবাহানা কাম্য নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত