বিভুরঞ্জন সরকার
প্রতিদিন সূর্য ওঠে, শিশুরা ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যায়। ব্যাগে বই-খাতার ফাঁকে ছোট ছোট স্বপ্ন থাকে—কেউ হবে বৈজ্ঞানিক, কেউ বলে ‘আমি পাইলট হব’, কারও চোখে ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছা। কেউ কারও প্রিয় বন্ধু, কেউ ভাইয়ের মতো, কেউ স্কুলে প্রথম হয়ে মা-বাবার গর্ব হবে বলে শপথ করে। কিন্তু আজ...সব ভুলে গিয়ে শুধু একটাই প্রশ্ন আমাদের হৃদয় ঝাঁজরা করে দিচ্ছে, কেন এমন হলো? নিষ্পাপ শিশুদের পুড়িয়ে দিল কোন পাপ? কার পাপ?
২১ জুলাই দুপুরটা যে এমন ভয়াবহ হবে, সেটা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী-শিক্ষক কেউই কল্পনাও করেননি। আকাশে বিমান উড়লেও ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারও চোখ কৌতূহলী হয়ে ওঠে না। কারণ বিমানবন্দরের কাছে হওয়ায় অনেক বিমান ওঠানামা নিয়মিত দেখে অভ্যস্ত হওয়ায় কৌতূহল নিবৃত্ত হয়েছে। কিন্তু ২১ জুলাই বেলা ১টার পর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছেলেমেয়েরা, যারা ক্লাসরুমের বাইরে ছিল, তাদের কেউ কেউ দেখতে পায় আকাশ থেকে আগুন নেমে আসছে। জুলাইয়ের শেষ দিকের সোমবারের দুপুরটা ছিল একেবারেই সাধারণ। কারও ক্লাস শেষ হওয়ায় বাড়ি যাওয়ার অপেক্ষায়, কেউ বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলছে, কারও কারও আবার ক্লাসও চলছিল। বিমানের শব্দে সচরাচর যাদের চোখ আকাশের দিকে ওঠে না, তারাই হকচকিয়ে গেল একটি বিমানের গর্জে ওঠার শব্দে। আকাশে উড়ে যাওয়ার কথা যে বিমানের, সেই বিমান মুহূর্তেই তার গতিপথ বদলে গোত্তা খেয়ে পড়ল মাইলস্টোনের প্রাঙ্গণে। এরপর একটা বিকট শব্দ, বিস্ফোরণ, আগুন। ছোটাছুটি। হাহাকার। আর্তনাদ। কান্না। শেষ হয়ে গেল কয়েকটি জীবন, চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেল মা-বাবা আর সন্তানের, শিক্ষক আর তাঁর ছাত্রের মাঝে। আহত ও দগ্ধদের আর্তনাদে রাজধানীর বাতাস ভারী। রাজধানীর এক আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিণত হলো শোকস্তব্ধ শ্মশানে।
এ দৃশ্য কোনো চলচ্চিত্রের নয়, কোনো সাহিত্যিক কল্পনার ভরকেন্দ্রও নয়—এটা বাস্তবতা। একদম নির্মম, হৃদয়বিদারক বাস্তবতা। যে বাস্তবতায় যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ে একটি স্কুলের ভবনের ওপর, যেখানে শিশুরা ছিল নিরাপদ আশ্রয়ে। পরদিন জাতি শোক পালন করল, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হলো। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এসব আনুষ্ঠানিকতা কি পরিবারগুলোর হাহাকার মুছে দিতে পারে? যে মা সকালবেলা সন্তানের টিফিন বেঁধে দিয়েছিলেন, দুপুরেই তাঁর বুকে গাঁথা হলো মৃত্যুসংবাদ—তাঁর শোকের কি কোনো রাষ্ট্রীয় জবাব আছে?
এই তো কিছুদিন আগেই আমরা দেখেছি ভারতের আহমেদাবাদে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা। কিন্তু এবার ঘটল আমাদের দেশেই। এ রকম নির্মমতা এ দেশের ইতিহাসে বিরল। নিহতদের অনেকেই শিক্ষার্থী, যারা যুদ্ধের কথা জানে পাঠ্যবইয়ে, বিমানকে চেনে শুধুই টয় প্লেন আর ছবি দেখে। অথচ তাদের শেষ মুহূর্তটি কেটেছে দগ্ধ শরীর নিয়ে, ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায়। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্যুর ছায়া নেমে এল তাদের ওপর, যারা নিজেরা হয়তো কখনো আকাশে ওড়ার কল্পনাও করেনি।
বিমানটি ছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান, যা প্রশিক্ষণকালীন উড্ডয়নের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে। পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম ছিলেন নতুন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁর প্রথম একক উড্ডয়ন ছিল এটি। যান্ত্রিক ত্রুটির আশঙ্কা প্রবলভাবে উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিমানটি কি উড্ডয়নের আগে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল? আন্তর্জাতিক আইনে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও একজন নবীন পাইলটকে দিয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর দিয়ে উড্ডয়ন করানো হলো কেন? এটা কি দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত ছিল? প্রযুক্তি, নিরাপত্তা এবং নীতিগত দায় কার?
‘জেটটা আমার চোখের সামনেই ভেঙে পড়েছে, মাত্র ১০ ফুট দূরে... আমি শুধু আগুন আর ধোঁয়া দেখেছি’ বলে জানিয়েছেন এক শিক্ষার্থী। এক অভিভাবক কাঁদছিলেন স্কুলের গেটের বাইরে: ‘ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও।’
এক অভিভাবিকা চিৎকার করে বলছিলেন, ‘স্কুল তো নিরাপদ আশ্রয় হওয়ার কথা ছিল, সেটা কীভাবে মৃত্যুফাঁদ হয়ে গেল?’
এ ধরনের অনেকের বক্তব্য আর কান্না এখন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। হাসপাতালের বারান্দায় বসে কেউ কাঁদছেন, কেউ কেবিনে ছুটে যাচ্ছেন, কেউ চিকিৎসকের পেছনে হাঁটছেন—এ দৃশ্য যেন একটি জাতির উদ্ধারকাজ ও নিরাপত্তাব্যবস্থার অসহায়ত্বের দলিল।
বাংলাদেশে এমন দুর্ঘটনা নতুন নয়। গত ৩৪ বছরে প্রশিক্ষণ ও রুটিন অভিযানে ৩২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে বিমানবাহিনীর বিভিন্ন মডেলের বিমান নিয়ে। গড়ে প্রতিবছর একটি করে বিমান দুর্ঘটনায় পড়ছে। এর মধ্যে তিনবার চীনের তৈরি এফ-৭ সিরিজের বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন এই বিমানগুলো বারবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে? চীন কি মানসম্পন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ দিয়ে বিমানগুলো সরবরাহ করেছে? তার নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে? যে যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো কি আগাম শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না?
বলা হচ্ছে, পাইলট তৌকির ইসলাম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন বিমানটিকে জনবসতির বাইরে নিয়ে যেতে। এমন আত্মত্যাগ একজন সৈনিকের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হলেও এটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এসব সতর্কতা তো উড্ডয়নের আগের বিষয়। নিরাপত্তাব্যবস্থা, প্রটোকল আর প্রযুক্তিগত সতর্কতা যথেষ্ট থাকলে ওড়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিল কীভাবে? একজন নবীন পাইলট জীবন দিয়ে দায়িত্ববোধের প্রমাণ দিলেন বটে, কিন্তু তাঁর জীবন দেওয়ায় কি অন্যদের অবহেলার দায় ঘোচে?
আরও ভয়ংকর হলো ঘটনাস্থল। কেন একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, যেখানে স্কুল, কলেজ, আবাসিক ভবন, হাসপাতাল—সবই আছে, তার ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান ওড়ানো হচ্ছে? আবার এই প্রশ্নও করতে হয়, বিমানবন্দরের আশপাশে নির্ধারিত এলাকার মধ্যে বহুতল স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি কেন দেওয়া হলো? আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষণ বা পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের জন্য নির্ধারিত এলাকা থাকে, যেখানে মানুষের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি নেই। বাংলাদেশে কেন এর ব্যত্যয় ঘটে? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি এটা জানে না?
প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের জন্য যদি এখন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তাহলে প্রশ্ন আসে, কে দেবে সেই মায়ের কোলের শূন্যতার মূল্য? কে ফিরিয়ে দেবে সেই শিক্ষার্থীর সহপাঠীকে, যে এখনো জানে না কেন তার পাশে বসার জায়গাটি খালি? রাষ্ট্র যদি চিরন্তন অভ্যস্ততার মতো ঘুরে দাঁড়ায় ‘তদন্ত কমিটি’ আর ‘রুটিন বিবৃতি’ দিয়ে, তবে শোক নয়, ক্ষোভ জমে উঠবে জাতির হৃদয়ে।
এ দুর্ঘটনা আবার প্রমাণ করল, আমরা যতই উন্নয়ন, প্রযুক্তি আর আধুনিকতার বুলি আওড়াই, ততটাই পিছিয়ে নিরাপত্তা, মানবিক মূল্যবোধ আর জবাবদিহির জায়গায়। উন্নত দেশগুলোতে একটিমাত্র সামান্য দুর্ঘটনার পরই পুরো বাহিনী কেঁপে ওঠে, পুরো ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশে? দুর্ঘটনার পর শোক দিবস পালিত হয়, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, আর তারপর মানুষ সব ভুলে যায়। এমনটাই যেন চিরন্তন চিত্র।
বিমানবাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এখন শুধু প্রতিরক্ষার প্রশ্ন নয়, এটা জাতীয় নিরাপত্তা ও নৈতিকতার প্রশ্ন। যুদ্ধবিমান একধরনের শক্তির প্রতীক, আর প্রশিক্ষণ তার ভবিষ্যতের পাথেয়। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণ যদি বেসামরিক শিশু ও নিরপরাধ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, তাহলে তার নাম কি ‘প্রশিক্ষণ’, না ‘অভিশাপ’?
আমরা বারবার শুনি, ‘এটা নিছক দুর্ঘটনা, ইচ্ছাকৃত নয়।’ কিন্তু বারবার এই একই দুর্ঘটনা হলে সেটাকে আর দুর্ঘটনা বলা যায় না, সেটা হয়ে যায় অবহেলার ফল। ৩৪ বছরে ৩২টি দুর্ঘটনা মানে প্রায় প্রতিবছর আমরা প্রস্তুত থাকি আরেকটি কান্নার জন্য? প্রস্তুত থাকি আরও অনেক মায়ের বুক খালি হওয়ার সংবাদ পাওয়ার জন্য? এটা কি রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি নয়?
এ ঘটনার দায় একা বিমানবাহিনী কিংবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নয়। দায় রাষ্ট্রের, সমাজের, আমাদের সবার। কারণ আমরা এসব ঘটনা ভুলে যেতে শিখে গেছি। আমরা জানি ‘তদন্ত চলছে’, ‘পাইলট বীরত্ব দেখিয়েছেন’, ‘সরকার সহানুভূতিশীল’—এসব বাক্য আমাদের সান্ত্বনা দেয়, প্রতিবাদের শক্তি কেড়ে নেয়। দুর্ঘটনাস্থল কোনো বুলেটপ্রুফ অপারেশনক্ষেত্র ছিল না, এটা ছিল একটি স্কুল, ছিল অসংখ্য শিশু-কিশোর। প্রশিক্ষণের জন্য একটি যুদ্ধবিমান, যেটা আকাশে ওড়ার কথা ছিল গৌরব নিয়ে, সেটা বিধ্বস্ত হলো মাথা নুইয়ে। বিমান হলো গতির প্রতীক। সেই বিমান যেন মানুষের জীবনে চির যতি টেনে দেওয়ার উপকরণ না হয়।
এখন প্রয়োজন আত্মসমালোচনা। প্রয়োজন সাহসিকতার সঙ্গে স্বীকার করা যে আমাদের ব্যবস্থায় গলদ আছে। প্রয়োজন পুরো বিষয়টি পুনর্মূল্যায়নের, যেখানে প্রতিটি যুদ্ধবিমান রক্ষণাবেক্ষণ হবে আন্তর্জাতিক মানে, প্রতিটি উড্ডয়নের আগে পর্যবেক্ষণ করা হবে প্রযুক্তিগতভাবে, আর প্রশিক্ষণ হবে জনবসতিহীন এলাকায়।
প্রিয় শিক্ষার্থী, আজ তোমাদের জন্য কান্না থামে না। তোমরা ঘুমিয়ে আছো, অথচ তোমাদের জন্য এই জাতি জেগে আছে ভেজা চোখে। মাইলস্টোন স্কুলে যে বেদনার বর্ণরেখা আঁকা হয়েছে, তা শুধু একটি স্কুলের নয়, তা এ দেশের প্রতিটি শিশুর মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছে। আজ এই শহর, এই দেশ, এই আকাশ—সবাই নীরব শ্রদ্ধা জানাচ্ছে সেই কচি প্রাণগুলোর প্রতি, যাদের জীবন থেমে গেছে ঠিক তখনই, যখন জীবন কেবল শুরু হচ্ছিল।
শোক প্রকাশের ভাষা আজ আমাদের নেই। আজ শুধু বলি—ক্ষমা করো আমাদের। আমরা তোমাদের রক্ষা করতে পারিনি। তোমাদের চোখে যে স্বপ্ন ছিল, তা যেন অন্তত এই ধ্বংসের মাটির ভেতরেও একটি নতুন দিশা দেখায়। যেন এই শোক আমাদের ঘুম না ভাঙার দায়ে না ফেলে, বরং জাগিয়ে রাখে।
প্রতিদিন সূর্য ওঠে, শিশুরা ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যায়। ব্যাগে বই-খাতার ফাঁকে ছোট ছোট স্বপ্ন থাকে—কেউ হবে বৈজ্ঞানিক, কেউ বলে ‘আমি পাইলট হব’, কারও চোখে ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছা। কেউ কারও প্রিয় বন্ধু, কেউ ভাইয়ের মতো, কেউ স্কুলে প্রথম হয়ে মা-বাবার গর্ব হবে বলে শপথ করে। কিন্তু আজ...সব ভুলে গিয়ে শুধু একটাই প্রশ্ন আমাদের হৃদয় ঝাঁজরা করে দিচ্ছে, কেন এমন হলো? নিষ্পাপ শিশুদের পুড়িয়ে দিল কোন পাপ? কার পাপ?
২১ জুলাই দুপুরটা যে এমন ভয়াবহ হবে, সেটা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী-শিক্ষক কেউই কল্পনাও করেননি। আকাশে বিমান উড়লেও ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারও চোখ কৌতূহলী হয়ে ওঠে না। কারণ বিমানবন্দরের কাছে হওয়ায় অনেক বিমান ওঠানামা নিয়মিত দেখে অভ্যস্ত হওয়ায় কৌতূহল নিবৃত্ত হয়েছে। কিন্তু ২১ জুলাই বেলা ১টার পর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছেলেমেয়েরা, যারা ক্লাসরুমের বাইরে ছিল, তাদের কেউ কেউ দেখতে পায় আকাশ থেকে আগুন নেমে আসছে। জুলাইয়ের শেষ দিকের সোমবারের দুপুরটা ছিল একেবারেই সাধারণ। কারও ক্লাস শেষ হওয়ায় বাড়ি যাওয়ার অপেক্ষায়, কেউ বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলছে, কারও কারও আবার ক্লাসও চলছিল। বিমানের শব্দে সচরাচর যাদের চোখ আকাশের দিকে ওঠে না, তারাই হকচকিয়ে গেল একটি বিমানের গর্জে ওঠার শব্দে। আকাশে উড়ে যাওয়ার কথা যে বিমানের, সেই বিমান মুহূর্তেই তার গতিপথ বদলে গোত্তা খেয়ে পড়ল মাইলস্টোনের প্রাঙ্গণে। এরপর একটা বিকট শব্দ, বিস্ফোরণ, আগুন। ছোটাছুটি। হাহাকার। আর্তনাদ। কান্না। শেষ হয়ে গেল কয়েকটি জীবন, চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেল মা-বাবা আর সন্তানের, শিক্ষক আর তাঁর ছাত্রের মাঝে। আহত ও দগ্ধদের আর্তনাদে রাজধানীর বাতাস ভারী। রাজধানীর এক আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিণত হলো শোকস্তব্ধ শ্মশানে।
এ দৃশ্য কোনো চলচ্চিত্রের নয়, কোনো সাহিত্যিক কল্পনার ভরকেন্দ্রও নয়—এটা বাস্তবতা। একদম নির্মম, হৃদয়বিদারক বাস্তবতা। যে বাস্তবতায় যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ে একটি স্কুলের ভবনের ওপর, যেখানে শিশুরা ছিল নিরাপদ আশ্রয়ে। পরদিন জাতি শোক পালন করল, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হলো। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এসব আনুষ্ঠানিকতা কি পরিবারগুলোর হাহাকার মুছে দিতে পারে? যে মা সকালবেলা সন্তানের টিফিন বেঁধে দিয়েছিলেন, দুপুরেই তাঁর বুকে গাঁথা হলো মৃত্যুসংবাদ—তাঁর শোকের কি কোনো রাষ্ট্রীয় জবাব আছে?
এই তো কিছুদিন আগেই আমরা দেখেছি ভারতের আহমেদাবাদে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা। কিন্তু এবার ঘটল আমাদের দেশেই। এ রকম নির্মমতা এ দেশের ইতিহাসে বিরল। নিহতদের অনেকেই শিক্ষার্থী, যারা যুদ্ধের কথা জানে পাঠ্যবইয়ে, বিমানকে চেনে শুধুই টয় প্লেন আর ছবি দেখে। অথচ তাদের শেষ মুহূর্তটি কেটেছে দগ্ধ শরীর নিয়ে, ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায়। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্যুর ছায়া নেমে এল তাদের ওপর, যারা নিজেরা হয়তো কখনো আকাশে ওড়ার কল্পনাও করেনি।
বিমানটি ছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান, যা প্রশিক্ষণকালীন উড্ডয়নের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে। পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম ছিলেন নতুন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁর প্রথম একক উড্ডয়ন ছিল এটি। যান্ত্রিক ত্রুটির আশঙ্কা প্রবলভাবে উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিমানটি কি উড্ডয়নের আগে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল? আন্তর্জাতিক আইনে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও একজন নবীন পাইলটকে দিয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর দিয়ে উড্ডয়ন করানো হলো কেন? এটা কি দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত ছিল? প্রযুক্তি, নিরাপত্তা এবং নীতিগত দায় কার?
‘জেটটা আমার চোখের সামনেই ভেঙে পড়েছে, মাত্র ১০ ফুট দূরে... আমি শুধু আগুন আর ধোঁয়া দেখেছি’ বলে জানিয়েছেন এক শিক্ষার্থী। এক অভিভাবক কাঁদছিলেন স্কুলের গেটের বাইরে: ‘ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও।’
এক অভিভাবিকা চিৎকার করে বলছিলেন, ‘স্কুল তো নিরাপদ আশ্রয় হওয়ার কথা ছিল, সেটা কীভাবে মৃত্যুফাঁদ হয়ে গেল?’
এ ধরনের অনেকের বক্তব্য আর কান্না এখন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। হাসপাতালের বারান্দায় বসে কেউ কাঁদছেন, কেউ কেবিনে ছুটে যাচ্ছেন, কেউ চিকিৎসকের পেছনে হাঁটছেন—এ দৃশ্য যেন একটি জাতির উদ্ধারকাজ ও নিরাপত্তাব্যবস্থার অসহায়ত্বের দলিল।
বাংলাদেশে এমন দুর্ঘটনা নতুন নয়। গত ৩৪ বছরে প্রশিক্ষণ ও রুটিন অভিযানে ৩২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে বিমানবাহিনীর বিভিন্ন মডেলের বিমান নিয়ে। গড়ে প্রতিবছর একটি করে বিমান দুর্ঘটনায় পড়ছে। এর মধ্যে তিনবার চীনের তৈরি এফ-৭ সিরিজের বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন এই বিমানগুলো বারবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে? চীন কি মানসম্পন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ দিয়ে বিমানগুলো সরবরাহ করেছে? তার নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে? যে যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো কি আগাম শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না?
বলা হচ্ছে, পাইলট তৌকির ইসলাম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন বিমানটিকে জনবসতির বাইরে নিয়ে যেতে। এমন আত্মত্যাগ একজন সৈনিকের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হলেও এটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এসব সতর্কতা তো উড্ডয়নের আগের বিষয়। নিরাপত্তাব্যবস্থা, প্রটোকল আর প্রযুক্তিগত সতর্কতা যথেষ্ট থাকলে ওড়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিল কীভাবে? একজন নবীন পাইলট জীবন দিয়ে দায়িত্ববোধের প্রমাণ দিলেন বটে, কিন্তু তাঁর জীবন দেওয়ায় কি অন্যদের অবহেলার দায় ঘোচে?
আরও ভয়ংকর হলো ঘটনাস্থল। কেন একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, যেখানে স্কুল, কলেজ, আবাসিক ভবন, হাসপাতাল—সবই আছে, তার ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান ওড়ানো হচ্ছে? আবার এই প্রশ্নও করতে হয়, বিমানবন্দরের আশপাশে নির্ধারিত এলাকার মধ্যে বহুতল স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি কেন দেওয়া হলো? আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষণ বা পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের জন্য নির্ধারিত এলাকা থাকে, যেখানে মানুষের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি নেই। বাংলাদেশে কেন এর ব্যত্যয় ঘটে? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি এটা জানে না?
প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের জন্য যদি এখন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তাহলে প্রশ্ন আসে, কে দেবে সেই মায়ের কোলের শূন্যতার মূল্য? কে ফিরিয়ে দেবে সেই শিক্ষার্থীর সহপাঠীকে, যে এখনো জানে না কেন তার পাশে বসার জায়গাটি খালি? রাষ্ট্র যদি চিরন্তন অভ্যস্ততার মতো ঘুরে দাঁড়ায় ‘তদন্ত কমিটি’ আর ‘রুটিন বিবৃতি’ দিয়ে, তবে শোক নয়, ক্ষোভ জমে উঠবে জাতির হৃদয়ে।
এ দুর্ঘটনা আবার প্রমাণ করল, আমরা যতই উন্নয়ন, প্রযুক্তি আর আধুনিকতার বুলি আওড়াই, ততটাই পিছিয়ে নিরাপত্তা, মানবিক মূল্যবোধ আর জবাবদিহির জায়গায়। উন্নত দেশগুলোতে একটিমাত্র সামান্য দুর্ঘটনার পরই পুরো বাহিনী কেঁপে ওঠে, পুরো ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশে? দুর্ঘটনার পর শোক দিবস পালিত হয়, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, আর তারপর মানুষ সব ভুলে যায়। এমনটাই যেন চিরন্তন চিত্র।
বিমানবাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এখন শুধু প্রতিরক্ষার প্রশ্ন নয়, এটা জাতীয় নিরাপত্তা ও নৈতিকতার প্রশ্ন। যুদ্ধবিমান একধরনের শক্তির প্রতীক, আর প্রশিক্ষণ তার ভবিষ্যতের পাথেয়। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণ যদি বেসামরিক শিশু ও নিরপরাধ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, তাহলে তার নাম কি ‘প্রশিক্ষণ’, না ‘অভিশাপ’?
আমরা বারবার শুনি, ‘এটা নিছক দুর্ঘটনা, ইচ্ছাকৃত নয়।’ কিন্তু বারবার এই একই দুর্ঘটনা হলে সেটাকে আর দুর্ঘটনা বলা যায় না, সেটা হয়ে যায় অবহেলার ফল। ৩৪ বছরে ৩২টি দুর্ঘটনা মানে প্রায় প্রতিবছর আমরা প্রস্তুত থাকি আরেকটি কান্নার জন্য? প্রস্তুত থাকি আরও অনেক মায়ের বুক খালি হওয়ার সংবাদ পাওয়ার জন্য? এটা কি রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি নয়?
এ ঘটনার দায় একা বিমানবাহিনী কিংবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নয়। দায় রাষ্ট্রের, সমাজের, আমাদের সবার। কারণ আমরা এসব ঘটনা ভুলে যেতে শিখে গেছি। আমরা জানি ‘তদন্ত চলছে’, ‘পাইলট বীরত্ব দেখিয়েছেন’, ‘সরকার সহানুভূতিশীল’—এসব বাক্য আমাদের সান্ত্বনা দেয়, প্রতিবাদের শক্তি কেড়ে নেয়। দুর্ঘটনাস্থল কোনো বুলেটপ্রুফ অপারেশনক্ষেত্র ছিল না, এটা ছিল একটি স্কুল, ছিল অসংখ্য শিশু-কিশোর। প্রশিক্ষণের জন্য একটি যুদ্ধবিমান, যেটা আকাশে ওড়ার কথা ছিল গৌরব নিয়ে, সেটা বিধ্বস্ত হলো মাথা নুইয়ে। বিমান হলো গতির প্রতীক। সেই বিমান যেন মানুষের জীবনে চির যতি টেনে দেওয়ার উপকরণ না হয়।
এখন প্রয়োজন আত্মসমালোচনা। প্রয়োজন সাহসিকতার সঙ্গে স্বীকার করা যে আমাদের ব্যবস্থায় গলদ আছে। প্রয়োজন পুরো বিষয়টি পুনর্মূল্যায়নের, যেখানে প্রতিটি যুদ্ধবিমান রক্ষণাবেক্ষণ হবে আন্তর্জাতিক মানে, প্রতিটি উড্ডয়নের আগে পর্যবেক্ষণ করা হবে প্রযুক্তিগতভাবে, আর প্রশিক্ষণ হবে জনবসতিহীন এলাকায়।
প্রিয় শিক্ষার্থী, আজ তোমাদের জন্য কান্না থামে না। তোমরা ঘুমিয়ে আছো, অথচ তোমাদের জন্য এই জাতি জেগে আছে ভেজা চোখে। মাইলস্টোন স্কুলে যে বেদনার বর্ণরেখা আঁকা হয়েছে, তা শুধু একটি স্কুলের নয়, তা এ দেশের প্রতিটি শিশুর মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছে। আজ এই শহর, এই দেশ, এই আকাশ—সবাই নীরব শ্রদ্ধা জানাচ্ছে সেই কচি প্রাণগুলোর প্রতি, যাদের জীবন থেমে গেছে ঠিক তখনই, যখন জীবন কেবল শুরু হচ্ছিল।
শোক প্রকাশের ভাষা আজ আমাদের নেই। আজ শুধু বলি—ক্ষমা করো আমাদের। আমরা তোমাদের রক্ষা করতে পারিনি। তোমাদের চোখে যে স্বপ্ন ছিল, তা যেন অন্তত এই ধ্বংসের মাটির ভেতরেও একটি নতুন দিশা দেখায়। যেন এই শোক আমাদের ঘুম না ভাঙার দায়ে না ফেলে, বরং জাগিয়ে রাখে।
গত বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। তাদের শাসন আমলে একটি নতুন অর্থবছরেরও সূচনা হয়েছে। আজ বছর পেরিয়ে অনেকেই পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন—অর্জন কতটুকু, ব্যর্থতা কোথায় এবং অন্তরায় কী কী? এমন একটি হিসাব-নিকাশ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় দিকনির্দেশনা দি
১৫ ঘণ্টা আগেআমরা যেন এক কদম সামনে বাড়লে পিছিয়ে পড়ি আরও দশ কদম। তখন সেই এক কদম এগিয়ে যাওয়াকে বড্ড ম্লান মনে হয়। গত প্রায় এক দশক ধরেই ঢাকার বায়ু ও পরিবেশ দূষণের শিকার। এখনো আমরা শীর্ষ বা এর আশপাশে অবস্থান করছি। এত সংস্কার কমিটি হলো, শুনেছি পরিবেশ উন্নয়নের জন্যও নাকি কমিটি গঠিত হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে কোনোটিরই কি কো
১৫ ঘণ্টা আগেবাসটা ধাক্কা দিয়েছে এক শিক্ষার্থীকে, শিক্ষার্থী করেছে তার প্রতিবাদ। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাসের চালক, চালকের সহকারী ও অন্য কর্মীরা শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়েছে বাসে। ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে পিটিয়েছে। বাসের যাত্রীরা প্রশ্ন করেছে, কিন্তু ‘চোর’কে পেটানো হচ্ছে বলা হলে তারা নির্বিকার বসে থেকেছে আসনে। চোর হলেও যে তাকে পু
১৫ ঘণ্টা আগেযে রকম পরিস্থিতিতে দেশ চলছে, তাতে দেশের জনগণের স্বস্তিতে থাকার কোনো কারণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ৫ আগস্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় সেই অস্বস্তি থেকে বের হয়ে আসার আপাতত একটা পথের দিশা পাওয়া গেল। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা এই ভাষণ দেওয়ার আগে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে...
২ দিন আগে