
রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রুমিন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং যুক্তরাজ্যের লিংকনস্ইন থেকে ব্যারিস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার।
বিভুরঞ্জন সরকার

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। আপনি কি মনে করেন, বিএনপির জন্য সহসাই কোনো সন্তোষজনক খবর আসবে?
আমরা দীর্ঘ ১৫ বছর এমন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছিলাম, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তর সরকারি দলের হুকুমে চলত। দেশে স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান বলতে কিছু ছিল না। মানুষ তার ন্যূনতম নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার পর্যন্ত প্রয়োগ করতে পারেনি। নির্বাচনের কোনো অধিকার তখন ছিল না। স্থানীয় থেকে জাতীয়—সব নির্বাচনই ছিল কারচুপিতে পূর্ণ। দীর্ঘ ১৫ বছর ভোটাধিকারবঞ্চিত মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আশা করে ৫ আগস্টের এই পটপরিবর্তনের পর তারা তাদের পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নিতে পারবে, উৎসবমুখর পরিবেশে আবার একটি নির্বাচন হবে, যেখানে কোনো ভীতি বা চাপ থাকবে না। বিএনপি যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক জনমুখী রাজনৈতিক দল, তাই মানুষের এই প্রত্যাশার কথাই বিএনপি বারবার তুলে ধরেছে। শেষ যে সংলাপ হলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে, যেখানে বিএনপি বারবার নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়েছে, সেখানেও কিন্তু সরকার থেকে স্পষ্ট কিছু জানানো হলো না। এখানেই বিএনপির অস্বস্তি এবং অসন্তোষ। বিএনপি মহাসচিব আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে অনির্বাচিত সরকার বেশি দিন থাকলে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা বৃদ্ধি পাবে।
আমরা যখন সংলাপের কথা বলি, সেটা হচ্ছে একটি অন্তর্গত রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির প্রক্রিয়া, কিন্তু বর্তমান সরকার সেটিকে বরাবরই সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে। মহাসচিব সাহেবের অসন্তুষ্টি আসলে বিএনপির পক্ষ থেকে জনগণের হতাশা ও ক্ষোভের প্রতিধ্বনি। আমরা আশাবাদী হতে চাই, কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর প্রতারণার ইতিহাস আমাদের বাস্তববাদী করে তুলেছে।
বিএনপি এখনো ২০০১ সালের শাসনকালকে সোনালি সময় হিসেবে তুলে ধরে, অথচ সেই সময়ই দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার অভিযোগ ওঠে—আপনি কি একে সৎভাবে ব্যাখ্যা করতে প্রস্তুত?
একটি শাসনকালকে বিচার করতে গেলে তাকে সময়ের বাস্তবতায় দেখতে হয়। ২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি, যোগাযোগব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, রপ্তানিতে সাফল্য, নারীর উন্নয়ন, শিক্ষায় অগ্রগতি, অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকা—এসব বাস্তব অগ্রগতি ছিল। তখন আজকের মতো হাজার কোটি টাকা পাচার হয়নি, ঋণের নামে ব্যাংক খালি করা হয়নি, সরকারদলীয় মানুষজন শতকোটি টাকার মালিক হয়নি, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দলীয় ক্যাডারদের মতো আচরণ করেনি। হ্যাঁ, কিছু অভিযোগও ছিল, সেটি সব সরকারের বিরুদ্ধেই থাকে।
আমরা এসব বিষয় এড়িয়ে যাইনি। দলীয়ভাবে আমরা একাধিকবার আত্মসমালোচনা করেছি, এমনকি সেটিই ছিল আমাদের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তি। কিন্তু আমরা কি পরবর্তী সরকারের সময়ের রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, গুম, নিপীড়নের মাত্রার সঙ্গে তুলনা করছি? রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়েই বিরোধী নেতাদের গায়েব করে দেওয়া হয়—সেটি কি সেই সময়ও হয়েছিল? অতএব, সোনালি সময় বলার পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি তুলনামূলকভাবে কার্যকর প্রশাসনের কথা বলা, তা একেবারে নিখুঁত নয়।
আপনাদের আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি এখন কী—জনগণের ক্ষোভ, না দলীয় দিকনির্দেশনার অভাব?
আন্দোলনের মূল শক্তি হচ্ছে জনগণের আকাঙ্ক্ষা—ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জীবনের নিরাপত্তা, দ্রব্যমূল্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। বিএনপি একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে মানুষের এই চাওয়ার সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে।
দিকনির্দেশনার অভাব নয়, বরং আমাদের প্রতিটি ধাপ—নির্বাচন বর্জন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক তৎপরতা—সবই ছিল পরিকল্পিত। তবে আমাদের সংগঠনের ওপর যেভাবে গত ১৫ বছরে একতরফাভাবে আঘাত এসেছে—নেতা-কর্মীদের হত্যা, গুম, মামলা, জেল—তার প্রভাব তো থাকবেই। বিএনপি আগেও জনগণের শক্তিতে শক্তিশালী ছিল, এখনো তা-ই।
বিএনপির কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত যে সাংগঠনিক শূন্যতা দেখা যাচ্ছে, এটা কি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার ফল, নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা?
বিএনপির কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত কোথাও সাংগঠনিক শূন্যতা আছে, আমি সেটি একেবারেই মনে করি না। তবে হ্যাঁ, দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনের মধ্যে থাকা যে একটি প্রভাব ফেলেছে, তা সত্যি। তবে আরও গভীর কারণ আছে—যেমন প্রত্যেক নেতাকে হয়রানি করা, মিথ্যা মামলা দেওয়া, কারান্তরীণ রাখা, গুম করা, এলাকাছাড়া করা, এমনকি হত্যা করা। কিন্তু এত অত্যাচারের পরও বিএনপি ভাঙেনি বরং আগের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কারণ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিরলসভাবে দলকে শক্তিশালী করতে কাজ করে গেছেন।
আপনি আইনজীবী সমাজে প্রভাবশালী, কিন্তু বার কাউন্সিল নির্বাচনেও বিএনপি প্যানেল অনেক সময় পরাজিত হয়—এই ব্যর্থতা কী বলছে? দলের জনপ্রিয়তার, না কৌশলের অভাব?
বার কাউন্সিল নির্বাচনকে এখন আর পেশাজীবীদের অবাধ প্রতিযোগিতা বলা যায় না। সেখানে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ, ভোটার তালিকা নিয়ে কারচুপি, নির্বাচনী পরিবেশে একতরফা আচরণ—এ সবই বড় কারণ। শুধু জনপ্রিয়তার বা কৌশলের অভাব দিয়ে বিচার করলে বাস্তব পরিস্থিতি অবমূল্যায়ন হবে। আমরা অনেক সময় বার কাউন্সিল নির্বাচনেও সরকারপন্থীদের হাতে প্রশাসনিক সুবিধার কারণে হারি, তবে অনেক
সময় জয়ও পাই। এর মানে এই নয় যে বিএনপির জনপ্রিয়তা হারিয়ে গেছে, বরং এর মানে হচ্ছে—আমরা একটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছি।
তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের জন্য আপনার বক্তব্য কী? আপনি কি মনে করেন তিনি এখনো বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ‘নির্ভরযোগ্য’ নেতা?
তারেক রহমান শুধু একজন রাজনীতিক নন, তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান, একজন রাজনৈতিক দর্শন বহনকারী নেতা। তিনি দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত সবার প্রাণের নেতা, আস্থার প্রতীক। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি ছিল, উন্নয়নমুখী চিন্তা ছিল। এরপর গত ১৫ বছর রাজনৈতিক নির্যাতনের মুখে থেকে দল পরিচালনা করে আসা একটি বিরল দৃঢ়তার নিদর্শন। তাঁর নেতৃত্বে আমরা একটা গণতান্ত্রিক রূপরেখা তৈরি করেছি। যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা রাজনীতিকে শুধু অতীত দিয়ে বিচার করছেন, বর্তমান নেতৃত্বগুণ বা ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেখছেন না। আমি বিশ্বাস করি, তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি আস্থা, যুক্তিনির্ভর নেতৃত্বের প্রতীক।
আন্দোলন আর নির্বাচন—দুটো পথেই যখন বারবার ধাক্কা খাচ্ছে বিএনপি, তখন কি ‘রাজনৈতিক পুনর্গঠন’-এর চিন্তা করার সময় আসেনি?
আমরা ‘পুনর্গঠন’ শব্দটা একেবারে এড়িয়ে যাইনি। আমরা বুঝি যে একটি দলকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তাই আমরা দীর্ঘদিন ধরে নীতিনির্ধারক সভাগুলোতে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। ইতিমধ্যে জাতীয় স্থায়ী কমিটির গঠনেও পরিবর্তন এসেছে, তৃণমূলে পুনর্গঠনের কাজ চলছে। তবে এটা আমরা বিশ্বাস করি না যে নির্বাচনে না যেতে পারা মানেই ব্যর্থতা। যেখানে নির্বাচন মানে আগে থেকে লেখা ফলাফলের ঘোষণা, সেখানে অংশগ্রহণের প্রশ্নই আসে না। রাজনৈতিক পুনর্গঠন মানে নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দেওয়া নয়, বরং নতুন কৌশল, নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সামাজিক জোট গড়ার সময় এসেছে, সেটি আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি।
আপনি বরাবরই যুক্তির মানুষ, কিন্তু আপনার দলে এখন অনেক আবেগতাড়িত বক্তব্যপ্রবণ নেতা—এই মেরুকরণ নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন কি না?
রাজনীতি মানেই আবেগ ও যুক্তির সম্মিলন। কখনো কখনো আবেগের ভাষা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে, আবার কখনো কেবল যুক্তি দিয়ে পথ দেখাতে হয়। তবে আবেগ যদি বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, সেটি অবশ্যই সমস্যা। আমি সব সময়ই যুক্তিবাদী অবস্থান নিয়েছি এবং মনে করি আমাদের বক্তব্যে ভারসাম্য থাকা জরুরি। আমাদের দলেও এ নিয়ে আলোচনার জায়গা রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বারবার সতর্ক করেছেন অতি আবেগপ্রবণ না হয়ে ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য দিতে। তবে রাজনৈতিক দল মানেই মতের ভিন্নতা থাকবে। আমি উদ্বিগ্ন নই, বরং আমি আশা করি এই বৈচিত্র্য আমাদের দলকে আরও শক্তিশালী করবে।
বিএনপির রাজনীতিকে অনেকে ‘নেতিবাচক’ বলছেন—শুধু সরকারের বিরোধিতা নয়, জনগণের সামনে কি ইতিবাচক রূপরেখা তুলে ধরছেন আপনারা?
আমরা শুধু সরকারের বিরোধিতা করি—এই কথাটি বিভ্রান্তিকর। আমরাই ২০১৬ সালে প্রথম সংস্কারের কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার—এগুলো বিএনপিই প্রথম বলে। আমরা গত কয়েক বছরে ‘ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ’ গঠনের ৩১ দফা রূপরেখা দিয়েছি, অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা দিয়েছি, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন—এসব বিষয়ে পরিকল্পনা পেশ করেছি। ইতিবাচক রাজনীতি মানে শুধু বাহারি শব্দ নয়, জনসম্পৃক্ত বাস্তব পরিকল্পনা। আমরা সেটাই করছি।
দেশে যখন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠার কথা বলা হচ্ছে, তখন বিএনপির ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখছেন? আদৌ কি নিজেকে আদর্শিকভাবে আপডেট করছে দলটি?
বিকল্প শক্তি গড়ার কথা নতুন নয়। বহু বছর ধরেই কিছু মিডিয়া, এনজিও, আন্তর্জাতিক শক্তি এই কথাটি বলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই বিকল্প কারা? আদর্শ, ইতিহাস, আন্দোলনের ভিত্তি ছাড়া কোনো দল বিকল্প হয় না। বিএনপি একটি জাতীয় ঐতিহ্য বহনকারী দল, যেটি জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে। আমরা এখন নতুন প্রজন্মকে জায়গা দিতে চাই, তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চাই, সুশাসনের নতুন আদর্শ গড়তে চাই। আমরা অবশ্যই আপডেট হচ্ছি, তবে নিজের শিকড় ভুলে নয়।
ব্যক্তি রুমিন ফারহানা হিসেবে আপনি নারী রাজনীতিকদের নেতৃত্বে কী ধরনের ভবিষ্যৎ দেখছেন বিএনপির রাজনীতিতে?
আমি মনে করি, বিএনপিই একমাত্র দল, যেখানে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী, একজন নারী সংসদ নেতা, নারী আইনজীবী ও পেশাজীবী নেত্রীরা প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছেন। আমি নিজেও যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সেটা দলের নারীবান্ধব কাঠামোর ফল। বিএনপি ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যায় নারী নেতৃত্ব তৈরি করবে—শুধু সংখ্যা নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে নারী থাকবে। রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে থেকেও নারী নেতৃত্বে আমরা সাহস, যুক্তি এবং সৌজন্যের চর্চা রাখতে চাই।
বিএনপি আজ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি জন-আকাঙ্ক্ষার নাম। দমন-পীড়ন, গুম-খুন, হয়রানি—সব পেরিয়ে আজ আমরা গণতন্ত্রের সংগ্রামে দাঁড়িয়ে আছি। আমি বিশ্বাস করি, কোনো ত্বরিত সমাধান নয়, একটি দীর্ঘ সময়ের রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের সূচনা করতে হবে এবং সেই পথেই বিএনপি জনগণের সঙ্গে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনার মাধ্যমে আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও আমার শুভেচ্ছা।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। আপনি কি মনে করেন, বিএনপির জন্য সহসাই কোনো সন্তোষজনক খবর আসবে?
আমরা দীর্ঘ ১৫ বছর এমন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছিলাম, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তর সরকারি দলের হুকুমে চলত। দেশে স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান বলতে কিছু ছিল না। মানুষ তার ন্যূনতম নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার পর্যন্ত প্রয়োগ করতে পারেনি। নির্বাচনের কোনো অধিকার তখন ছিল না। স্থানীয় থেকে জাতীয়—সব নির্বাচনই ছিল কারচুপিতে পূর্ণ। দীর্ঘ ১৫ বছর ভোটাধিকারবঞ্চিত মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আশা করে ৫ আগস্টের এই পটপরিবর্তনের পর তারা তাদের পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নিতে পারবে, উৎসবমুখর পরিবেশে আবার একটি নির্বাচন হবে, যেখানে কোনো ভীতি বা চাপ থাকবে না। বিএনপি যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক জনমুখী রাজনৈতিক দল, তাই মানুষের এই প্রত্যাশার কথাই বিএনপি বারবার তুলে ধরেছে। শেষ যে সংলাপ হলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে, যেখানে বিএনপি বারবার নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়েছে, সেখানেও কিন্তু সরকার থেকে স্পষ্ট কিছু জানানো হলো না। এখানেই বিএনপির অস্বস্তি এবং অসন্তোষ। বিএনপি মহাসচিব আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে অনির্বাচিত সরকার বেশি দিন থাকলে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা বৃদ্ধি পাবে।
আমরা যখন সংলাপের কথা বলি, সেটা হচ্ছে একটি অন্তর্গত রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির প্রক্রিয়া, কিন্তু বর্তমান সরকার সেটিকে বরাবরই সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে। মহাসচিব সাহেবের অসন্তুষ্টি আসলে বিএনপির পক্ষ থেকে জনগণের হতাশা ও ক্ষোভের প্রতিধ্বনি। আমরা আশাবাদী হতে চাই, কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর প্রতারণার ইতিহাস আমাদের বাস্তববাদী করে তুলেছে।
বিএনপি এখনো ২০০১ সালের শাসনকালকে সোনালি সময় হিসেবে তুলে ধরে, অথচ সেই সময়ই দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার অভিযোগ ওঠে—আপনি কি একে সৎভাবে ব্যাখ্যা করতে প্রস্তুত?
একটি শাসনকালকে বিচার করতে গেলে তাকে সময়ের বাস্তবতায় দেখতে হয়। ২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি, যোগাযোগব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, রপ্তানিতে সাফল্য, নারীর উন্নয়ন, শিক্ষায় অগ্রগতি, অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকা—এসব বাস্তব অগ্রগতি ছিল। তখন আজকের মতো হাজার কোটি টাকা পাচার হয়নি, ঋণের নামে ব্যাংক খালি করা হয়নি, সরকারদলীয় মানুষজন শতকোটি টাকার মালিক হয়নি, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দলীয় ক্যাডারদের মতো আচরণ করেনি। হ্যাঁ, কিছু অভিযোগও ছিল, সেটি সব সরকারের বিরুদ্ধেই থাকে।
আমরা এসব বিষয় এড়িয়ে যাইনি। দলীয়ভাবে আমরা একাধিকবার আত্মসমালোচনা করেছি, এমনকি সেটিই ছিল আমাদের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তি। কিন্তু আমরা কি পরবর্তী সরকারের সময়ের রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, গুম, নিপীড়নের মাত্রার সঙ্গে তুলনা করছি? রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়েই বিরোধী নেতাদের গায়েব করে দেওয়া হয়—সেটি কি সেই সময়ও হয়েছিল? অতএব, সোনালি সময় বলার পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি তুলনামূলকভাবে কার্যকর প্রশাসনের কথা বলা, তা একেবারে নিখুঁত নয়।
আপনাদের আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি এখন কী—জনগণের ক্ষোভ, না দলীয় দিকনির্দেশনার অভাব?
আন্দোলনের মূল শক্তি হচ্ছে জনগণের আকাঙ্ক্ষা—ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জীবনের নিরাপত্তা, দ্রব্যমূল্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। বিএনপি একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে মানুষের এই চাওয়ার সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে।
দিকনির্দেশনার অভাব নয়, বরং আমাদের প্রতিটি ধাপ—নির্বাচন বর্জন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক তৎপরতা—সবই ছিল পরিকল্পিত। তবে আমাদের সংগঠনের ওপর যেভাবে গত ১৫ বছরে একতরফাভাবে আঘাত এসেছে—নেতা-কর্মীদের হত্যা, গুম, মামলা, জেল—তার প্রভাব তো থাকবেই। বিএনপি আগেও জনগণের শক্তিতে শক্তিশালী ছিল, এখনো তা-ই।
বিএনপির কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত যে সাংগঠনিক শূন্যতা দেখা যাচ্ছে, এটা কি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার ফল, নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা?
বিএনপির কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত কোথাও সাংগঠনিক শূন্যতা আছে, আমি সেটি একেবারেই মনে করি না। তবে হ্যাঁ, দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনের মধ্যে থাকা যে একটি প্রভাব ফেলেছে, তা সত্যি। তবে আরও গভীর কারণ আছে—যেমন প্রত্যেক নেতাকে হয়রানি করা, মিথ্যা মামলা দেওয়া, কারান্তরীণ রাখা, গুম করা, এলাকাছাড়া করা, এমনকি হত্যা করা। কিন্তু এত অত্যাচারের পরও বিএনপি ভাঙেনি বরং আগের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কারণ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিরলসভাবে দলকে শক্তিশালী করতে কাজ করে গেছেন।
আপনি আইনজীবী সমাজে প্রভাবশালী, কিন্তু বার কাউন্সিল নির্বাচনেও বিএনপি প্যানেল অনেক সময় পরাজিত হয়—এই ব্যর্থতা কী বলছে? দলের জনপ্রিয়তার, না কৌশলের অভাব?
বার কাউন্সিল নির্বাচনকে এখন আর পেশাজীবীদের অবাধ প্রতিযোগিতা বলা যায় না। সেখানে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ, ভোটার তালিকা নিয়ে কারচুপি, নির্বাচনী পরিবেশে একতরফা আচরণ—এ সবই বড় কারণ। শুধু জনপ্রিয়তার বা কৌশলের অভাব দিয়ে বিচার করলে বাস্তব পরিস্থিতি অবমূল্যায়ন হবে। আমরা অনেক সময় বার কাউন্সিল নির্বাচনেও সরকারপন্থীদের হাতে প্রশাসনিক সুবিধার কারণে হারি, তবে অনেক
সময় জয়ও পাই। এর মানে এই নয় যে বিএনপির জনপ্রিয়তা হারিয়ে গেছে, বরং এর মানে হচ্ছে—আমরা একটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছি।
তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের জন্য আপনার বক্তব্য কী? আপনি কি মনে করেন তিনি এখনো বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ‘নির্ভরযোগ্য’ নেতা?
তারেক রহমান শুধু একজন রাজনীতিক নন, তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান, একজন রাজনৈতিক দর্শন বহনকারী নেতা। তিনি দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত সবার প্রাণের নেতা, আস্থার প্রতীক। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি ছিল, উন্নয়নমুখী চিন্তা ছিল। এরপর গত ১৫ বছর রাজনৈতিক নির্যাতনের মুখে থেকে দল পরিচালনা করে আসা একটি বিরল দৃঢ়তার নিদর্শন। তাঁর নেতৃত্বে আমরা একটা গণতান্ত্রিক রূপরেখা তৈরি করেছি। যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা রাজনীতিকে শুধু অতীত দিয়ে বিচার করছেন, বর্তমান নেতৃত্বগুণ বা ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেখছেন না। আমি বিশ্বাস করি, তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি আস্থা, যুক্তিনির্ভর নেতৃত্বের প্রতীক।
আন্দোলন আর নির্বাচন—দুটো পথেই যখন বারবার ধাক্কা খাচ্ছে বিএনপি, তখন কি ‘রাজনৈতিক পুনর্গঠন’-এর চিন্তা করার সময় আসেনি?
আমরা ‘পুনর্গঠন’ শব্দটা একেবারে এড়িয়ে যাইনি। আমরা বুঝি যে একটি দলকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তাই আমরা দীর্ঘদিন ধরে নীতিনির্ধারক সভাগুলোতে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। ইতিমধ্যে জাতীয় স্থায়ী কমিটির গঠনেও পরিবর্তন এসেছে, তৃণমূলে পুনর্গঠনের কাজ চলছে। তবে এটা আমরা বিশ্বাস করি না যে নির্বাচনে না যেতে পারা মানেই ব্যর্থতা। যেখানে নির্বাচন মানে আগে থেকে লেখা ফলাফলের ঘোষণা, সেখানে অংশগ্রহণের প্রশ্নই আসে না। রাজনৈতিক পুনর্গঠন মানে নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দেওয়া নয়, বরং নতুন কৌশল, নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সামাজিক জোট গড়ার সময় এসেছে, সেটি আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি।
আপনি বরাবরই যুক্তির মানুষ, কিন্তু আপনার দলে এখন অনেক আবেগতাড়িত বক্তব্যপ্রবণ নেতা—এই মেরুকরণ নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন কি না?
রাজনীতি মানেই আবেগ ও যুক্তির সম্মিলন। কখনো কখনো আবেগের ভাষা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে, আবার কখনো কেবল যুক্তি দিয়ে পথ দেখাতে হয়। তবে আবেগ যদি বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, সেটি অবশ্যই সমস্যা। আমি সব সময়ই যুক্তিবাদী অবস্থান নিয়েছি এবং মনে করি আমাদের বক্তব্যে ভারসাম্য থাকা জরুরি। আমাদের দলেও এ নিয়ে আলোচনার জায়গা রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বারবার সতর্ক করেছেন অতি আবেগপ্রবণ না হয়ে ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য দিতে। তবে রাজনৈতিক দল মানেই মতের ভিন্নতা থাকবে। আমি উদ্বিগ্ন নই, বরং আমি আশা করি এই বৈচিত্র্য আমাদের দলকে আরও শক্তিশালী করবে।
বিএনপির রাজনীতিকে অনেকে ‘নেতিবাচক’ বলছেন—শুধু সরকারের বিরোধিতা নয়, জনগণের সামনে কি ইতিবাচক রূপরেখা তুলে ধরছেন আপনারা?
আমরা শুধু সরকারের বিরোধিতা করি—এই কথাটি বিভ্রান্তিকর। আমরাই ২০১৬ সালে প্রথম সংস্কারের কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার—এগুলো বিএনপিই প্রথম বলে। আমরা গত কয়েক বছরে ‘ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ’ গঠনের ৩১ দফা রূপরেখা দিয়েছি, অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা দিয়েছি, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন—এসব বিষয়ে পরিকল্পনা পেশ করেছি। ইতিবাচক রাজনীতি মানে শুধু বাহারি শব্দ নয়, জনসম্পৃক্ত বাস্তব পরিকল্পনা। আমরা সেটাই করছি।
দেশে যখন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠার কথা বলা হচ্ছে, তখন বিএনপির ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখছেন? আদৌ কি নিজেকে আদর্শিকভাবে আপডেট করছে দলটি?
বিকল্প শক্তি গড়ার কথা নতুন নয়। বহু বছর ধরেই কিছু মিডিয়া, এনজিও, আন্তর্জাতিক শক্তি এই কথাটি বলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই বিকল্প কারা? আদর্শ, ইতিহাস, আন্দোলনের ভিত্তি ছাড়া কোনো দল বিকল্প হয় না। বিএনপি একটি জাতীয় ঐতিহ্য বহনকারী দল, যেটি জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে। আমরা এখন নতুন প্রজন্মকে জায়গা দিতে চাই, তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চাই, সুশাসনের নতুন আদর্শ গড়তে চাই। আমরা অবশ্যই আপডেট হচ্ছি, তবে নিজের শিকড় ভুলে নয়।
ব্যক্তি রুমিন ফারহানা হিসেবে আপনি নারী রাজনীতিকদের নেতৃত্বে কী ধরনের ভবিষ্যৎ দেখছেন বিএনপির রাজনীতিতে?
আমি মনে করি, বিএনপিই একমাত্র দল, যেখানে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী, একজন নারী সংসদ নেতা, নারী আইনজীবী ও পেশাজীবী নেত্রীরা প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছেন। আমি নিজেও যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সেটা দলের নারীবান্ধব কাঠামোর ফল। বিএনপি ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যায় নারী নেতৃত্ব তৈরি করবে—শুধু সংখ্যা নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে নারী থাকবে। রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে থেকেও নারী নেতৃত্বে আমরা সাহস, যুক্তি এবং সৌজন্যের চর্চা রাখতে চাই।
বিএনপি আজ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি জন-আকাঙ্ক্ষার নাম। দমন-পীড়ন, গুম-খুন, হয়রানি—সব পেরিয়ে আজ আমরা গণতন্ত্রের সংগ্রামে দাঁড়িয়ে আছি। আমি বিশ্বাস করি, কোনো ত্বরিত সমাধান নয়, একটি দীর্ঘ সময়ের রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের সূচনা করতে হবে এবং সেই পথেই বিএনপি জনগণের সঙ্গে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনার মাধ্যমে আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও আমার শুভেচ্ছা।

রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রুমিন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং যুক্তরাজ্যের লিংকনস্ইন থেকে ব্যারিস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার।
বিভুরঞ্জন সরকার

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। আপনি কি মনে করেন, বিএনপির জন্য সহসাই কোনো সন্তোষজনক খবর আসবে?
আমরা দীর্ঘ ১৫ বছর এমন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছিলাম, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তর সরকারি দলের হুকুমে চলত। দেশে স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান বলতে কিছু ছিল না। মানুষ তার ন্যূনতম নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার পর্যন্ত প্রয়োগ করতে পারেনি। নির্বাচনের কোনো অধিকার তখন ছিল না। স্থানীয় থেকে জাতীয়—সব নির্বাচনই ছিল কারচুপিতে পূর্ণ। দীর্ঘ ১৫ বছর ভোটাধিকারবঞ্চিত মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আশা করে ৫ আগস্টের এই পটপরিবর্তনের পর তারা তাদের পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নিতে পারবে, উৎসবমুখর পরিবেশে আবার একটি নির্বাচন হবে, যেখানে কোনো ভীতি বা চাপ থাকবে না। বিএনপি যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক জনমুখী রাজনৈতিক দল, তাই মানুষের এই প্রত্যাশার কথাই বিএনপি বারবার তুলে ধরেছে। শেষ যে সংলাপ হলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে, যেখানে বিএনপি বারবার নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়েছে, সেখানেও কিন্তু সরকার থেকে স্পষ্ট কিছু জানানো হলো না। এখানেই বিএনপির অস্বস্তি এবং অসন্তোষ। বিএনপি মহাসচিব আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে অনির্বাচিত সরকার বেশি দিন থাকলে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা বৃদ্ধি পাবে।
আমরা যখন সংলাপের কথা বলি, সেটা হচ্ছে একটি অন্তর্গত রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির প্রক্রিয়া, কিন্তু বর্তমান সরকার সেটিকে বরাবরই সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে। মহাসচিব সাহেবের অসন্তুষ্টি আসলে বিএনপির পক্ষ থেকে জনগণের হতাশা ও ক্ষোভের প্রতিধ্বনি। আমরা আশাবাদী হতে চাই, কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর প্রতারণার ইতিহাস আমাদের বাস্তববাদী করে তুলেছে।
বিএনপি এখনো ২০০১ সালের শাসনকালকে সোনালি সময় হিসেবে তুলে ধরে, অথচ সেই সময়ই দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার অভিযোগ ওঠে—আপনি কি একে সৎভাবে ব্যাখ্যা করতে প্রস্তুত?
একটি শাসনকালকে বিচার করতে গেলে তাকে সময়ের বাস্তবতায় দেখতে হয়। ২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি, যোগাযোগব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, রপ্তানিতে সাফল্য, নারীর উন্নয়ন, শিক্ষায় অগ্রগতি, অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকা—এসব বাস্তব অগ্রগতি ছিল। তখন আজকের মতো হাজার কোটি টাকা পাচার হয়নি, ঋণের নামে ব্যাংক খালি করা হয়নি, সরকারদলীয় মানুষজন শতকোটি টাকার মালিক হয়নি, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দলীয় ক্যাডারদের মতো আচরণ করেনি। হ্যাঁ, কিছু অভিযোগও ছিল, সেটি সব সরকারের বিরুদ্ধেই থাকে।
আমরা এসব বিষয় এড়িয়ে যাইনি। দলীয়ভাবে আমরা একাধিকবার আত্মসমালোচনা করেছি, এমনকি সেটিই ছিল আমাদের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তি। কিন্তু আমরা কি পরবর্তী সরকারের সময়ের রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, গুম, নিপীড়নের মাত্রার সঙ্গে তুলনা করছি? রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়েই বিরোধী নেতাদের গায়েব করে দেওয়া হয়—সেটি কি সেই সময়ও হয়েছিল? অতএব, সোনালি সময় বলার পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি তুলনামূলকভাবে কার্যকর প্রশাসনের কথা বলা, তা একেবারে নিখুঁত নয়।
আপনাদের আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি এখন কী—জনগণের ক্ষোভ, না দলীয় দিকনির্দেশনার অভাব?
আন্দোলনের মূল শক্তি হচ্ছে জনগণের আকাঙ্ক্ষা—ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জীবনের নিরাপত্তা, দ্রব্যমূল্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। বিএনপি একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে মানুষের এই চাওয়ার সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে।
দিকনির্দেশনার অভাব নয়, বরং আমাদের প্রতিটি ধাপ—নির্বাচন বর্জন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক তৎপরতা—সবই ছিল পরিকল্পিত। তবে আমাদের সংগঠনের ওপর যেভাবে গত ১৫ বছরে একতরফাভাবে আঘাত এসেছে—নেতা-কর্মীদের হত্যা, গুম, মামলা, জেল—তার প্রভাব তো থাকবেই। বিএনপি আগেও জনগণের শক্তিতে শক্তিশালী ছিল, এখনো তা-ই।
বিএনপির কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত যে সাংগঠনিক শূন্যতা দেখা যাচ্ছে, এটা কি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার ফল, নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা?
বিএনপির কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত কোথাও সাংগঠনিক শূন্যতা আছে, আমি সেটি একেবারেই মনে করি না। তবে হ্যাঁ, দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনের মধ্যে থাকা যে একটি প্রভাব ফেলেছে, তা সত্যি। তবে আরও গভীর কারণ আছে—যেমন প্রত্যেক নেতাকে হয়রানি করা, মিথ্যা মামলা দেওয়া, কারান্তরীণ রাখা, গুম করা, এলাকাছাড়া করা, এমনকি হত্যা করা। কিন্তু এত অত্যাচারের পরও বিএনপি ভাঙেনি বরং আগের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কারণ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিরলসভাবে দলকে শক্তিশালী করতে কাজ করে গেছেন।
আপনি আইনজীবী সমাজে প্রভাবশালী, কিন্তু বার কাউন্সিল নির্বাচনেও বিএনপি প্যানেল অনেক সময় পরাজিত হয়—এই ব্যর্থতা কী বলছে? দলের জনপ্রিয়তার, না কৌশলের অভাব?
বার কাউন্সিল নির্বাচনকে এখন আর পেশাজীবীদের অবাধ প্রতিযোগিতা বলা যায় না। সেখানে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ, ভোটার তালিকা নিয়ে কারচুপি, নির্বাচনী পরিবেশে একতরফা আচরণ—এ সবই বড় কারণ। শুধু জনপ্রিয়তার বা কৌশলের অভাব দিয়ে বিচার করলে বাস্তব পরিস্থিতি অবমূল্যায়ন হবে। আমরা অনেক সময় বার কাউন্সিল নির্বাচনেও সরকারপন্থীদের হাতে প্রশাসনিক সুবিধার কারণে হারি, তবে অনেক
সময় জয়ও পাই। এর মানে এই নয় যে বিএনপির জনপ্রিয়তা হারিয়ে গেছে, বরং এর মানে হচ্ছে—আমরা একটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছি।
তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের জন্য আপনার বক্তব্য কী? আপনি কি মনে করেন তিনি এখনো বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ‘নির্ভরযোগ্য’ নেতা?
তারেক রহমান শুধু একজন রাজনীতিক নন, তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান, একজন রাজনৈতিক দর্শন বহনকারী নেতা। তিনি দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত সবার প্রাণের নেতা, আস্থার প্রতীক। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি ছিল, উন্নয়নমুখী চিন্তা ছিল। এরপর গত ১৫ বছর রাজনৈতিক নির্যাতনের মুখে থেকে দল পরিচালনা করে আসা একটি বিরল দৃঢ়তার নিদর্শন। তাঁর নেতৃত্বে আমরা একটা গণতান্ত্রিক রূপরেখা তৈরি করেছি। যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা রাজনীতিকে শুধু অতীত দিয়ে বিচার করছেন, বর্তমান নেতৃত্বগুণ বা ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেখছেন না। আমি বিশ্বাস করি, তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি আস্থা, যুক্তিনির্ভর নেতৃত্বের প্রতীক।
আন্দোলন আর নির্বাচন—দুটো পথেই যখন বারবার ধাক্কা খাচ্ছে বিএনপি, তখন কি ‘রাজনৈতিক পুনর্গঠন’-এর চিন্তা করার সময় আসেনি?
আমরা ‘পুনর্গঠন’ শব্দটা একেবারে এড়িয়ে যাইনি। আমরা বুঝি যে একটি দলকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তাই আমরা দীর্ঘদিন ধরে নীতিনির্ধারক সভাগুলোতে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। ইতিমধ্যে জাতীয় স্থায়ী কমিটির গঠনেও পরিবর্তন এসেছে, তৃণমূলে পুনর্গঠনের কাজ চলছে। তবে এটা আমরা বিশ্বাস করি না যে নির্বাচনে না যেতে পারা মানেই ব্যর্থতা। যেখানে নির্বাচন মানে আগে থেকে লেখা ফলাফলের ঘোষণা, সেখানে অংশগ্রহণের প্রশ্নই আসে না। রাজনৈতিক পুনর্গঠন মানে নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দেওয়া নয়, বরং নতুন কৌশল, নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সামাজিক জোট গড়ার সময় এসেছে, সেটি আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি।
আপনি বরাবরই যুক্তির মানুষ, কিন্তু আপনার দলে এখন অনেক আবেগতাড়িত বক্তব্যপ্রবণ নেতা—এই মেরুকরণ নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন কি না?
রাজনীতি মানেই আবেগ ও যুক্তির সম্মিলন। কখনো কখনো আবেগের ভাষা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে, আবার কখনো কেবল যুক্তি দিয়ে পথ দেখাতে হয়। তবে আবেগ যদি বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, সেটি অবশ্যই সমস্যা। আমি সব সময়ই যুক্তিবাদী অবস্থান নিয়েছি এবং মনে করি আমাদের বক্তব্যে ভারসাম্য থাকা জরুরি। আমাদের দলেও এ নিয়ে আলোচনার জায়গা রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বারবার সতর্ক করেছেন অতি আবেগপ্রবণ না হয়ে ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য দিতে। তবে রাজনৈতিক দল মানেই মতের ভিন্নতা থাকবে। আমি উদ্বিগ্ন নই, বরং আমি আশা করি এই বৈচিত্র্য আমাদের দলকে আরও শক্তিশালী করবে।
বিএনপির রাজনীতিকে অনেকে ‘নেতিবাচক’ বলছেন—শুধু সরকারের বিরোধিতা নয়, জনগণের সামনে কি ইতিবাচক রূপরেখা তুলে ধরছেন আপনারা?
আমরা শুধু সরকারের বিরোধিতা করি—এই কথাটি বিভ্রান্তিকর। আমরাই ২০১৬ সালে প্রথম সংস্কারের কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার—এগুলো বিএনপিই প্রথম বলে। আমরা গত কয়েক বছরে ‘ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ’ গঠনের ৩১ দফা রূপরেখা দিয়েছি, অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা দিয়েছি, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন—এসব বিষয়ে পরিকল্পনা পেশ করেছি। ইতিবাচক রাজনীতি মানে শুধু বাহারি শব্দ নয়, জনসম্পৃক্ত বাস্তব পরিকল্পনা। আমরা সেটাই করছি।
দেশে যখন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠার কথা বলা হচ্ছে, তখন বিএনপির ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখছেন? আদৌ কি নিজেকে আদর্শিকভাবে আপডেট করছে দলটি?
বিকল্প শক্তি গড়ার কথা নতুন নয়। বহু বছর ধরেই কিছু মিডিয়া, এনজিও, আন্তর্জাতিক শক্তি এই কথাটি বলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই বিকল্প কারা? আদর্শ, ইতিহাস, আন্দোলনের ভিত্তি ছাড়া কোনো দল বিকল্প হয় না। বিএনপি একটি জাতীয় ঐতিহ্য বহনকারী দল, যেটি জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে। আমরা এখন নতুন প্রজন্মকে জায়গা দিতে চাই, তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চাই, সুশাসনের নতুন আদর্শ গড়তে চাই। আমরা অবশ্যই আপডেট হচ্ছি, তবে নিজের শিকড় ভুলে নয়।
ব্যক্তি রুমিন ফারহানা হিসেবে আপনি নারী রাজনীতিকদের নেতৃত্বে কী ধরনের ভবিষ্যৎ দেখছেন বিএনপির রাজনীতিতে?
আমি মনে করি, বিএনপিই একমাত্র দল, যেখানে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী, একজন নারী সংসদ নেতা, নারী আইনজীবী ও পেশাজীবী নেত্রীরা প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছেন। আমি নিজেও যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সেটা দলের নারীবান্ধব কাঠামোর ফল। বিএনপি ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যায় নারী নেতৃত্ব তৈরি করবে—শুধু সংখ্যা নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে নারী থাকবে। রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে থেকেও নারী নেতৃত্বে আমরা সাহস, যুক্তি এবং সৌজন্যের চর্চা রাখতে চাই।
বিএনপি আজ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি জন-আকাঙ্ক্ষার নাম। দমন-পীড়ন, গুম-খুন, হয়রানি—সব পেরিয়ে আজ আমরা গণতন্ত্রের সংগ্রামে দাঁড়িয়ে আছি। আমি বিশ্বাস করি, কোনো ত্বরিত সমাধান নয়, একটি দীর্ঘ সময়ের রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের সূচনা করতে হবে এবং সেই পথেই বিএনপি জনগণের সঙ্গে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনার মাধ্যমে আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও আমার শুভেচ্ছা।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। আপনি কি মনে করেন, বিএনপির জন্য সহসাই কোনো সন্তোষজনক খবর আসবে?
আমরা দীর্ঘ ১৫ বছর এমন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছিলাম, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তর সরকারি দলের হুকুমে চলত। দেশে স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান বলতে কিছু ছিল না। মানুষ তার ন্যূনতম নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার পর্যন্ত প্রয়োগ করতে পারেনি। নির্বাচনের কোনো অধিকার তখন ছিল না। স্থানীয় থেকে জাতীয়—সব নির্বাচনই ছিল কারচুপিতে পূর্ণ। দীর্ঘ ১৫ বছর ভোটাধিকারবঞ্চিত মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আশা করে ৫ আগস্টের এই পটপরিবর্তনের পর তারা তাদের পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নিতে পারবে, উৎসবমুখর পরিবেশে আবার একটি নির্বাচন হবে, যেখানে কোনো ভীতি বা চাপ থাকবে না। বিএনপি যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক জনমুখী রাজনৈতিক দল, তাই মানুষের এই প্রত্যাশার কথাই বিএনপি বারবার তুলে ধরেছে। শেষ যে সংলাপ হলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে, যেখানে বিএনপি বারবার নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়েছে, সেখানেও কিন্তু সরকার থেকে স্পষ্ট কিছু জানানো হলো না। এখানেই বিএনপির অস্বস্তি এবং অসন্তোষ। বিএনপি মহাসচিব আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে অনির্বাচিত সরকার বেশি দিন থাকলে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা বৃদ্ধি পাবে।
আমরা যখন সংলাপের কথা বলি, সেটা হচ্ছে একটি অন্তর্গত রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির প্রক্রিয়া, কিন্তু বর্তমান সরকার সেটিকে বরাবরই সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে। মহাসচিব সাহেবের অসন্তুষ্টি আসলে বিএনপির পক্ষ থেকে জনগণের হতাশা ও ক্ষোভের প্রতিধ্বনি। আমরা আশাবাদী হতে চাই, কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর প্রতারণার ইতিহাস আমাদের বাস্তববাদী করে তুলেছে।
বিএনপি এখনো ২০০১ সালের শাসনকালকে সোনালি সময় হিসেবে তুলে ধরে, অথচ সেই সময়ই দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার অভিযোগ ওঠে—আপনি কি একে সৎভাবে ব্যাখ্যা করতে প্রস্তুত?
একটি শাসনকালকে বিচার করতে গেলে তাকে সময়ের বাস্তবতায় দেখতে হয়। ২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি, যোগাযোগব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, রপ্তানিতে সাফল্য, নারীর উন্নয়ন, শিক্ষায় অগ্রগতি, অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকা—এসব বাস্তব অগ্রগতি ছিল। তখন আজকের মতো হাজার কোটি টাকা পাচার হয়নি, ঋণের নামে ব্যাংক খালি করা হয়নি, সরকারদলীয় মানুষজন শতকোটি টাকার মালিক হয়নি, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দলীয় ক্যাডারদের মতো আচরণ করেনি। হ্যাঁ, কিছু অভিযোগও ছিল, সেটি সব সরকারের বিরুদ্ধেই থাকে।
আমরা এসব বিষয় এড়িয়ে যাইনি। দলীয়ভাবে আমরা একাধিকবার আত্মসমালোচনা করেছি, এমনকি সেটিই ছিল আমাদের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তি। কিন্তু আমরা কি পরবর্তী সরকারের সময়ের রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, গুম, নিপীড়নের মাত্রার সঙ্গে তুলনা করছি? রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়েই বিরোধী নেতাদের গায়েব করে দেওয়া হয়—সেটি কি সেই সময়ও হয়েছিল? অতএব, সোনালি সময় বলার পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি তুলনামূলকভাবে কার্যকর প্রশাসনের কথা বলা, তা একেবারে নিখুঁত নয়।
আপনাদের আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি এখন কী—জনগণের ক্ষোভ, না দলীয় দিকনির্দেশনার অভাব?
আন্দোলনের মূল শক্তি হচ্ছে জনগণের আকাঙ্ক্ষা—ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জীবনের নিরাপত্তা, দ্রব্যমূল্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। বিএনপি একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে মানুষের এই চাওয়ার সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে।
দিকনির্দেশনার অভাব নয়, বরং আমাদের প্রতিটি ধাপ—নির্বাচন বর্জন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক তৎপরতা—সবই ছিল পরিকল্পিত। তবে আমাদের সংগঠনের ওপর যেভাবে গত ১৫ বছরে একতরফাভাবে আঘাত এসেছে—নেতা-কর্মীদের হত্যা, গুম, মামলা, জেল—তার প্রভাব তো থাকবেই। বিএনপি আগেও জনগণের শক্তিতে শক্তিশালী ছিল, এখনো তা-ই।
বিএনপির কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত যে সাংগঠনিক শূন্যতা দেখা যাচ্ছে, এটা কি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার ফল, নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা?
বিএনপির কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত কোথাও সাংগঠনিক শূন্যতা আছে, আমি সেটি একেবারেই মনে করি না। তবে হ্যাঁ, দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনের মধ্যে থাকা যে একটি প্রভাব ফেলেছে, তা সত্যি। তবে আরও গভীর কারণ আছে—যেমন প্রত্যেক নেতাকে হয়রানি করা, মিথ্যা মামলা দেওয়া, কারান্তরীণ রাখা, গুম করা, এলাকাছাড়া করা, এমনকি হত্যা করা। কিন্তু এত অত্যাচারের পরও বিএনপি ভাঙেনি বরং আগের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কারণ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিরলসভাবে দলকে শক্তিশালী করতে কাজ করে গেছেন।
আপনি আইনজীবী সমাজে প্রভাবশালী, কিন্তু বার কাউন্সিল নির্বাচনেও বিএনপি প্যানেল অনেক সময় পরাজিত হয়—এই ব্যর্থতা কী বলছে? দলের জনপ্রিয়তার, না কৌশলের অভাব?
বার কাউন্সিল নির্বাচনকে এখন আর পেশাজীবীদের অবাধ প্রতিযোগিতা বলা যায় না। সেখানে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ, ভোটার তালিকা নিয়ে কারচুপি, নির্বাচনী পরিবেশে একতরফা আচরণ—এ সবই বড় কারণ। শুধু জনপ্রিয়তার বা কৌশলের অভাব দিয়ে বিচার করলে বাস্তব পরিস্থিতি অবমূল্যায়ন হবে। আমরা অনেক সময় বার কাউন্সিল নির্বাচনেও সরকারপন্থীদের হাতে প্রশাসনিক সুবিধার কারণে হারি, তবে অনেক
সময় জয়ও পাই। এর মানে এই নয় যে বিএনপির জনপ্রিয়তা হারিয়ে গেছে, বরং এর মানে হচ্ছে—আমরা একটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছি।
তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের জন্য আপনার বক্তব্য কী? আপনি কি মনে করেন তিনি এখনো বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ‘নির্ভরযোগ্য’ নেতা?
তারেক রহমান শুধু একজন রাজনীতিক নন, তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান, একজন রাজনৈতিক দর্শন বহনকারী নেতা। তিনি দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত সবার প্রাণের নেতা, আস্থার প্রতীক। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি ছিল, উন্নয়নমুখী চিন্তা ছিল। এরপর গত ১৫ বছর রাজনৈতিক নির্যাতনের মুখে থেকে দল পরিচালনা করে আসা একটি বিরল দৃঢ়তার নিদর্শন। তাঁর নেতৃত্বে আমরা একটা গণতান্ত্রিক রূপরেখা তৈরি করেছি। যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা রাজনীতিকে শুধু অতীত দিয়ে বিচার করছেন, বর্তমান নেতৃত্বগুণ বা ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেখছেন না। আমি বিশ্বাস করি, তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি আস্থা, যুক্তিনির্ভর নেতৃত্বের প্রতীক।
আন্দোলন আর নির্বাচন—দুটো পথেই যখন বারবার ধাক্কা খাচ্ছে বিএনপি, তখন কি ‘রাজনৈতিক পুনর্গঠন’-এর চিন্তা করার সময় আসেনি?
আমরা ‘পুনর্গঠন’ শব্দটা একেবারে এড়িয়ে যাইনি। আমরা বুঝি যে একটি দলকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তাই আমরা দীর্ঘদিন ধরে নীতিনির্ধারক সভাগুলোতে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। ইতিমধ্যে জাতীয় স্থায়ী কমিটির গঠনেও পরিবর্তন এসেছে, তৃণমূলে পুনর্গঠনের কাজ চলছে। তবে এটা আমরা বিশ্বাস করি না যে নির্বাচনে না যেতে পারা মানেই ব্যর্থতা। যেখানে নির্বাচন মানে আগে থেকে লেখা ফলাফলের ঘোষণা, সেখানে অংশগ্রহণের প্রশ্নই আসে না। রাজনৈতিক পুনর্গঠন মানে নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দেওয়া নয়, বরং নতুন কৌশল, নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সামাজিক জোট গড়ার সময় এসেছে, সেটি আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি।
আপনি বরাবরই যুক্তির মানুষ, কিন্তু আপনার দলে এখন অনেক আবেগতাড়িত বক্তব্যপ্রবণ নেতা—এই মেরুকরণ নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন কি না?
রাজনীতি মানেই আবেগ ও যুক্তির সম্মিলন। কখনো কখনো আবেগের ভাষা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে, আবার কখনো কেবল যুক্তি দিয়ে পথ দেখাতে হয়। তবে আবেগ যদি বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, সেটি অবশ্যই সমস্যা। আমি সব সময়ই যুক্তিবাদী অবস্থান নিয়েছি এবং মনে করি আমাদের বক্তব্যে ভারসাম্য থাকা জরুরি। আমাদের দলেও এ নিয়ে আলোচনার জায়গা রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বারবার সতর্ক করেছেন অতি আবেগপ্রবণ না হয়ে ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য দিতে। তবে রাজনৈতিক দল মানেই মতের ভিন্নতা থাকবে। আমি উদ্বিগ্ন নই, বরং আমি আশা করি এই বৈচিত্র্য আমাদের দলকে আরও শক্তিশালী করবে।
বিএনপির রাজনীতিকে অনেকে ‘নেতিবাচক’ বলছেন—শুধু সরকারের বিরোধিতা নয়, জনগণের সামনে কি ইতিবাচক রূপরেখা তুলে ধরছেন আপনারা?
আমরা শুধু সরকারের বিরোধিতা করি—এই কথাটি বিভ্রান্তিকর। আমরাই ২০১৬ সালে প্রথম সংস্কারের কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার—এগুলো বিএনপিই প্রথম বলে। আমরা গত কয়েক বছরে ‘ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ’ গঠনের ৩১ দফা রূপরেখা দিয়েছি, অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা দিয়েছি, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন—এসব বিষয়ে পরিকল্পনা পেশ করেছি। ইতিবাচক রাজনীতি মানে শুধু বাহারি শব্দ নয়, জনসম্পৃক্ত বাস্তব পরিকল্পনা। আমরা সেটাই করছি।
দেশে যখন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠার কথা বলা হচ্ছে, তখন বিএনপির ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখছেন? আদৌ কি নিজেকে আদর্শিকভাবে আপডেট করছে দলটি?
বিকল্প শক্তি গড়ার কথা নতুন নয়। বহু বছর ধরেই কিছু মিডিয়া, এনজিও, আন্তর্জাতিক শক্তি এই কথাটি বলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই বিকল্প কারা? আদর্শ, ইতিহাস, আন্দোলনের ভিত্তি ছাড়া কোনো দল বিকল্প হয় না। বিএনপি একটি জাতীয় ঐতিহ্য বহনকারী দল, যেটি জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে। আমরা এখন নতুন প্রজন্মকে জায়গা দিতে চাই, তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চাই, সুশাসনের নতুন আদর্শ গড়তে চাই। আমরা অবশ্যই আপডেট হচ্ছি, তবে নিজের শিকড় ভুলে নয়।
ব্যক্তি রুমিন ফারহানা হিসেবে আপনি নারী রাজনীতিকদের নেতৃত্বে কী ধরনের ভবিষ্যৎ দেখছেন বিএনপির রাজনীতিতে?
আমি মনে করি, বিএনপিই একমাত্র দল, যেখানে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী, একজন নারী সংসদ নেতা, নারী আইনজীবী ও পেশাজীবী নেত্রীরা প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছেন। আমি নিজেও যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সেটা দলের নারীবান্ধব কাঠামোর ফল। বিএনপি ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যায় নারী নেতৃত্ব তৈরি করবে—শুধু সংখ্যা নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে নারী থাকবে। রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে থেকেও নারী নেতৃত্বে আমরা সাহস, যুক্তি এবং সৌজন্যের চর্চা রাখতে চাই।
বিএনপি আজ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি জন-আকাঙ্ক্ষার নাম। দমন-পীড়ন, গুম-খুন, হয়রানি—সব পেরিয়ে আজ আমরা গণতন্ত্রের সংগ্রামে দাঁড়িয়ে আছি। আমি বিশ্বাস করি, কোনো ত্বরিত সমাধান নয়, একটি দীর্ঘ সময়ের রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের সূচনা করতে হবে এবং সেই পথেই বিএনপি জনগণের সঙ্গে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনার মাধ্যমে আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও আমার শুভেচ্ছা।

দেখতে দেখতেই যেন বছরটা শেষ হয়ে আসছে। ২০২৫ সালের হতাশা-প্রত্যাশার হিসাব কষতে কষতে বড়দিন কড়া নেড়ে দিল দরজায়। সব হতাশা ভুলে প্রত্যাশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের আগমন হয়, ভালোবাসা ও একতার বাণী ছড়িয়ে।
১৯ ঘণ্টা আগে
গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে চোখ রাখলে সমাজ তার অন্ধকার দিকগুলো আবিষ্কার করতে পারে, ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ পায়। এ কারণেই যুগে যুগে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া ব্যক্তিরা গণমাধ্যমকে ‘শত্রু’ মনে করে এসেছে। অর্থশক্তি, পেশিশক্তি দিয়ে তারা সমাজের এই দর্পণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুদ্ধের ধারণা আমূল বদলে গেছে। রাষ্ট্রের সীমান্ত, সেনাবাহিনী কিংবা প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র আর একমাত্র ক্ষমতার মানদণ্ড নয়; বরং অদৃশ্য, নীরব ও প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাইবার স্পেস।
১৯ ঘণ্টা আগে
আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তুরস্কের ভূমিকা বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুল হলো, এটিকে নস্টালজিক ‘নব্য ওসমানি খেলাফত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া। বাস্তবে তুরস্ক আজ যে রাজনীতি করছে, তা আবেগের নয়, সুচিন্তিত হিসাবের। তুরস্কের এই রাজনীতি সাম্রাজ্য ফেরানোর চেষ্টা নয়, বরং শক্তির শূন্যতা কাজে লাগিয়ে...
১৯ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

দেখতে দেখতেই যেন বছরটা শেষ হয়ে আসছে। ২০২৫ সালের হতাশা-প্রত্যাশার হিসাব কষতে কষতে বড়দিন কড়া নেড়ে দিল দরজায়। সব হতাশা ভুলে প্রত্যাশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের আগমন হয়, ভালোবাসা ও একতার বাণী ছড়িয়ে। এ দিনে পৃথিবীতে যিশুখ্রিষ্টের আগমন, শান্তি আর সৎপথের বার্তা নিয়ে। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাই দিনটি বিশেষ।
আজ বড়দিন। যিশুর অনুসারী তথা খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় উৎসব। পবিত্র এ দিনটি আজ বিশ্বজুড়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে। বহুবিধ সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশেও ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই মিলে উদ্যাপন করছে যিশুর জন্মদিন। গির্জা কিংবা ঘরোয়া পার্বণ—সবখানে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেই যিশুকে, যিনি বেথলেহেমের এক গোয়ালঘরে জন্মেছিলেন। স্মরণ করা হচ্ছে তাঁর জন্মের পবিত্র লগ্নকে।
আজ যিশুর বন্দনা গাওয়ার দিন। কারণ, এই দিনে ধরণিতে তাঁর আবির্ভাব হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে—ত্রাতা হিসেবে। তিনি অন্যকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন পাপ-পঙ্কিলতা বর্জন করে করুণা, পবিত্রতা ও সুন্দর পথে কীভাবে জীবন পরিচালনা করা যায়। ঈশ্বরের প্রতি আস্থা এনে মুক্তির পথ খুঁজতে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
বড়দিনে যিশুখ্রিষ্টের জন্মের কাহিনি পাঠ ও ধ্যান করা হয়। সেই কাহিনি অবলম্বনে গির্জায় এবং বাড়িতে বাড়িতে গোশালা নির্মাণ করে ফুলপাতা দিয়ে সাজানো হয়। এ দিনে চলে গানবাজনা, নামসংকীর্তন, ভোজন, আনন্দ-উল্লাস। এসব উৎসব-আয়োজনের চেয়েও বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে নিজেদের হৃদয়-মন ও অন্তরাত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার প্রয়াস। তাই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা বড়দিনের পূর্ববর্তী চার সপ্তাহব্যাপী ধ্যান-অনুধ্যান, মন পরীক্ষা, ব্যক্তিগত পাপ স্বীকার, সমবেত পুনর্মিলন বা ক্ষমা-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষে-মানুষে সুসম্পর্ক গড়তে সচেষ্ট হন।
ঈশ্বরের মহান বার্তাবাহক যিশুকে অনুসরণ করলে কতই না সুন্দর একটি সমাজ গঠন করা যায়! অথচ পাপাচারের পৃথিবীতে সেই সমাজ থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে বাস করি। মানবজাতির জন্য এ এক দুর্ভাগ্য! এ রকম সংকটের মুহূর্তেই যিশুর বাণী, বড়দিনের বার্তা যেন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে—মানুষে-মানুষে ভালোবাসা ও একতার বীজ বুনতে হবে; ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে সবার প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কোনো জাতি, ধর্ম বা তার অনুসারীর প্রতিই বিরুদ্ধাচরণ কাম্য নয়।
বড়দিন উপলক্ষে প্রতিবছর বাংলাদেশে সরকারি ছুটি থাকে। শান্তিপূর্ণভাবে উদ্যাপনের পাশাপাশি দিনটিতে প্রিয় স্বদেশের মঙ্গল কামনার জন্য খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা প্রার্থনা করতে ভোলেন না। এই প্রার্থনা আর শান্তিরাজ যিশুর দেখানো পথে চলার প্রয়াসই কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারে। বড়দিন সবাইকে বারবার সুযোগ দেয় দুর্নীতি, অনাচার, পাপাচার বর্জন করে সৎপথে চলার। সেই সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না। বরং কাজে লাগিয়ে গড়তে হবে একতার বাংলাদেশ; যে বাংলাদেশে ধর্মকে পুঁজি করে মিথ্যা অপবাদে কাউকে হত্যা করা হবে না—সে যে কেউ হোক।
সবার জীবনে বড়দিন শান্তি বয়ে আনুক। সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা।

দেখতে দেখতেই যেন বছরটা শেষ হয়ে আসছে। ২০২৫ সালের হতাশা-প্রত্যাশার হিসাব কষতে কষতে বড়দিন কড়া নেড়ে দিল দরজায়। সব হতাশা ভুলে প্রত্যাশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের আগমন হয়, ভালোবাসা ও একতার বাণী ছড়িয়ে। এ দিনে পৃথিবীতে যিশুখ্রিষ্টের আগমন, শান্তি আর সৎপথের বার্তা নিয়ে। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাই দিনটি বিশেষ।
আজ বড়দিন। যিশুর অনুসারী তথা খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় উৎসব। পবিত্র এ দিনটি আজ বিশ্বজুড়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে। বহুবিধ সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশেও ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই মিলে উদ্যাপন করছে যিশুর জন্মদিন। গির্জা কিংবা ঘরোয়া পার্বণ—সবখানে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেই যিশুকে, যিনি বেথলেহেমের এক গোয়ালঘরে জন্মেছিলেন। স্মরণ করা হচ্ছে তাঁর জন্মের পবিত্র লগ্নকে।
আজ যিশুর বন্দনা গাওয়ার দিন। কারণ, এই দিনে ধরণিতে তাঁর আবির্ভাব হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে—ত্রাতা হিসেবে। তিনি অন্যকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন পাপ-পঙ্কিলতা বর্জন করে করুণা, পবিত্রতা ও সুন্দর পথে কীভাবে জীবন পরিচালনা করা যায়। ঈশ্বরের প্রতি আস্থা এনে মুক্তির পথ খুঁজতে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
বড়দিনে যিশুখ্রিষ্টের জন্মের কাহিনি পাঠ ও ধ্যান করা হয়। সেই কাহিনি অবলম্বনে গির্জায় এবং বাড়িতে বাড়িতে গোশালা নির্মাণ করে ফুলপাতা দিয়ে সাজানো হয়। এ দিনে চলে গানবাজনা, নামসংকীর্তন, ভোজন, আনন্দ-উল্লাস। এসব উৎসব-আয়োজনের চেয়েও বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে নিজেদের হৃদয়-মন ও অন্তরাত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার প্রয়াস। তাই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা বড়দিনের পূর্ববর্তী চার সপ্তাহব্যাপী ধ্যান-অনুধ্যান, মন পরীক্ষা, ব্যক্তিগত পাপ স্বীকার, সমবেত পুনর্মিলন বা ক্ষমা-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষে-মানুষে সুসম্পর্ক গড়তে সচেষ্ট হন।
ঈশ্বরের মহান বার্তাবাহক যিশুকে অনুসরণ করলে কতই না সুন্দর একটি সমাজ গঠন করা যায়! অথচ পাপাচারের পৃথিবীতে সেই সমাজ থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে বাস করি। মানবজাতির জন্য এ এক দুর্ভাগ্য! এ রকম সংকটের মুহূর্তেই যিশুর বাণী, বড়দিনের বার্তা যেন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে—মানুষে-মানুষে ভালোবাসা ও একতার বীজ বুনতে হবে; ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে সবার প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কোনো জাতি, ধর্ম বা তার অনুসারীর প্রতিই বিরুদ্ধাচরণ কাম্য নয়।
বড়দিন উপলক্ষে প্রতিবছর বাংলাদেশে সরকারি ছুটি থাকে। শান্তিপূর্ণভাবে উদ্যাপনের পাশাপাশি দিনটিতে প্রিয় স্বদেশের মঙ্গল কামনার জন্য খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা প্রার্থনা করতে ভোলেন না। এই প্রার্থনা আর শান্তিরাজ যিশুর দেখানো পথে চলার প্রয়াসই কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারে। বড়দিন সবাইকে বারবার সুযোগ দেয় দুর্নীতি, অনাচার, পাপাচার বর্জন করে সৎপথে চলার। সেই সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না। বরং কাজে লাগিয়ে গড়তে হবে একতার বাংলাদেশ; যে বাংলাদেশে ধর্মকে পুঁজি করে মিথ্যা অপবাদে কাউকে হত্যা করা হবে না—সে যে কেউ হোক।
সবার জীবনে বড়দিন শান্তি বয়ে আনুক। সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা।

রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০ এপ্রিল ২০২৫
গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে চোখ রাখলে সমাজ তার অন্ধকার দিকগুলো আবিষ্কার করতে পারে, ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ পায়। এ কারণেই যুগে যুগে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া ব্যক্তিরা গণমাধ্যমকে ‘শত্রু’ মনে করে এসেছে। অর্থশক্তি, পেশিশক্তি দিয়ে তারা সমাজের এই দর্পণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুদ্ধের ধারণা আমূল বদলে গেছে। রাষ্ট্রের সীমান্ত, সেনাবাহিনী কিংবা প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র আর একমাত্র ক্ষমতার মানদণ্ড নয়; বরং অদৃশ্য, নীরব ও প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাইবার স্পেস।
১৯ ঘণ্টা আগে
আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তুরস্কের ভূমিকা বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুল হলো, এটিকে নস্টালজিক ‘নব্য ওসমানি খেলাফত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া। বাস্তবে তুরস্ক আজ যে রাজনীতি করছে, তা আবেগের নয়, সুচিন্তিত হিসাবের। তুরস্কের এই রাজনীতি সাম্রাজ্য ফেরানোর চেষ্টা নয়, বরং শক্তির শূন্যতা কাজে লাগিয়ে...
১৯ ঘণ্টা আগেরাজিউল হাসান

গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে চোখ রাখলে সমাজ তার অন্ধকার দিকগুলো আবিষ্কার করতে পারে, ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ পায়। এ কারণেই যুগে যুগে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া ব্যক্তিরা গণমাধ্যমকে ‘শত্রু’ মনে করে এসেছে। অর্থশক্তি, পেশিশক্তি দিয়ে তারা সমাজের এই দর্পণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে। সেই ধারাবাহিকতা ২০২৫ সালেও ছিল। এ বছরেও গণমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে, সাংবাদিকদের প্রাণ গেছে।
সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডাসের তথ্য বলছে, বিদ্বেষ ও দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণে ২০২৫ সালেও সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। এ বছর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিক শুধু প্রাণই দেননি, তাঁরা হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্যবস্তুও হয়েছেন।
সংগঠনটির তথ্য বলছে, বিগত ১২ মাসে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকসহ ৬৭ জন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৫৩ জনই প্রাণ দিয়েছেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিংবা অপরাধী চক্রের লক্ষ্যবস্তু হয়ে। এই ৬৭ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই প্রাণ গেছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধেও সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে সাংবাদিকদের। আফ্রিকার দেশ সুদান সাংবাদিকদের জন্য হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী যুদ্ধক্ষেত্র। মেক্সিকোয় অপরাধী চক্রের হাতে প্রাণ গেছে ৯ সাংবাদিকের। উত্তর আমেরিকার এই দেশটিকে বলা হয় সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় বিপজ্জনক রাষ্ট্র।
সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শুধু প্রাণই দিচ্ছেন না, তাঁরা আটক-গ্রেপ্তারেরও শিকার হয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অন্তত ৫০৩ জন সাংবাদিক কারান্তরীণ হয়ে আছেন।
কেবল অপরাধ চক্রের উৎপাতে অতিষ্ঠ দেশ কিংবা যুদ্ধকবলিত দেশই নয়, গণতন্ত্রের চর্চার দাবি করা দেশেও সাংবাদিকেরা দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকের ওপর সহিংসতা বেড়ে গেছে। ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন নামের অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যত সাংবাদিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তা গত তিন বছরের মোট সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনার সংখ্যার বেশি।
ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে নিপীড়নের শিকার সাংবাদিকদের বেশির ভাগই আক্রান্ত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সাংবাদিক কেন আক্রান্ত হন? বিশ্বজুড়েই দেখা যায়, যখন কোথাও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়, সাংবাদিক সেখানে যান পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে তথ্য সংগ্রহ করতে। তিনি কারও পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কাজ করেন না। শুধু জনসাধারণকে সঠিক তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টায় কোনো না কোনো পক্ষ ক্ষুব্ধ হয় সেই পক্ষের উদ্দেশ্য প্রকাশ হওয়ার ভয়ে।
আবার অপরাধী চক্র সাংবাদিককে আক্রমণ করে তাদের গোমর ফাঁসের ভয়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি থাকে। কারণ, এমন পরিস্থিতিতে মানবাধিকারের বালাই থাকে না। মাঠের পরিস্থিতি যেন বিশ্বমানবতা জানতে না পারে, সে চেষ্টার অংশ হিসেবে আক্রমণ করা হয় সাংবাদিককে।
কখনো কখনো শুধু রোষের বশেও সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করা হয়। শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী না, কখনো কখনো রাষ্ট্রও গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরে। সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন, এর উদাহরণ বিশ্বজুড়েই রয়েছে। নতুন করে আর কোনো দেশের নামোল্লেখ করতে চাই না।
কিন্তু গণমাধ্যম সরকার ও সমাজের বন্ধু হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল সমাজের নানা ত্রুটি তুলে ধরে গণমাধ্যম রাষ্ট্র গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। গণমাধ্যম সে প্রচেষ্টা করেও যাচ্ছে। গণমাধ্যমের শাসক কিংবা কোনো গোষ্ঠীর ‘দাসে’ পরিণত হওয়ার রেকর্ড যদিও আছে, কিন্তু সেটা হাতে গোনা বলা চলে। বাকি গণমাধ্যমগুলো সমাজকে সঠিক পথ দেখাতেই নিরন্তর কাজ করে চলেছে। উদাহরণও আছে ভূরি ভূরি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে ওয়াশিংটন পোস্ট ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ভূমিকা রেখেছিল, তা যুগ যুগ ধরে আলোচনা হবে। কিংবা হাল আমলে যুক্তরাজ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের করোনাকালীন ভূমিকা বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ সে দেশের গণমাধ্যমগুলো যেভাবে প্রকাশ করেছিল, সেটাও বড় উদাহরণ।
একটি জাতি গঠন কিংবা সমাজ গঠন—যে গঠনের কথাই বলা হোক না কেন, গণমাধ্যমের ভূমিকা কিছুতেই খাটো করে দেখা যাবে না। সমাজের ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরাই সাংবাদিকের কাজ। এমনকি শাসক দল যখন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়, তখন গণমাধ্যমই তাদের কথা সবার সামনে তুলে ধরে। অথচ এমনও দেখা গেছে, সেই বিরোধী দল যখন সরকারে যায়, তারাও গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা করেছে। এভাবেই যুগে যুগে সংবাদমাধ্যমকে বাকরুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
আমরা যদি একটু গভীরে ভাবি, তাহলে দেখব, সাংবাদিক যে পারিশ্রমিক পান, সে তুলনায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যে ঝুঁকি নেন, তা অনেক অনেক বেশি। কার এমন দায় পড়েছে নগণ্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নেবেন। তারপরও তিনি ঝুঁকি নেন দায়িত্বের জায়গা থেকে, তিনি ঝুঁকি নেন জনসাধারণকে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার নেশা থেকে। এই নেশাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া উচিত, দমন করা উচিত নয়। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ মানে একটি সমাজের মৃত্যুর ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া। সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
একবার ভাবুন, একটি দেশের গণমাধ্যমের কণ্ঠ যদি পুরোদমে রোধ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের অবস্থা কী হবে। কেবল ‘বাতাবি লেবুর রেকর্ড ফলনেরই’ গান শুনতে হবে পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়। কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে কেউ থাকবে না কথা বলার।
কাজেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সবার জন্যই জরুরি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে গণমাধ্যমের সেই স্বাধীনতার সুযোগে সে দূর করতে পারে সমাজের পঙ্কিলতা। বিরোধীরা চাইলে সেই স্বাধীনতার সুযোগে সরকারের অন্ধকার দিকগুলো সমাজের সামনে তুলে ধরতে পারবে। এভাবে পুরো সমাজ-রাষ্ট্রে নিশ্চিত হতে পারে জবাবদিহি।
কিন্তু বিশ্বে গণমাধ্যম নিয়ে এমন নীতি খুব কমই দেখা যায়। বরং উল্টো ঘটনাই বেশি ঘটছে। তারপরও গণমাধ্যম তার কাজ করে চলেছে, যাবে। কারণ, গণমাধ্যম হলো ফিনিক্স পাখির মতো। সে আক্রান্ত হবে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে, তারপর সেখান থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবে। গণমাধ্যম এমন একটি শিল্প, এমন একটি দায়বদ্ধতা, যা কখনো কোনো দিন কোনো হামলা, হুমকি, ত্রাসের কাছে মাথা নত করবে না।

গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে চোখ রাখলে সমাজ তার অন্ধকার দিকগুলো আবিষ্কার করতে পারে, ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ পায়। এ কারণেই যুগে যুগে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া ব্যক্তিরা গণমাধ্যমকে ‘শত্রু’ মনে করে এসেছে। অর্থশক্তি, পেশিশক্তি দিয়ে তারা সমাজের এই দর্পণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে। সেই ধারাবাহিকতা ২০২৫ সালেও ছিল। এ বছরেও গণমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে, সাংবাদিকদের প্রাণ গেছে।
সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডাসের তথ্য বলছে, বিদ্বেষ ও দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণে ২০২৫ সালেও সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। এ বছর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিক শুধু প্রাণই দেননি, তাঁরা হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্যবস্তুও হয়েছেন।
সংগঠনটির তথ্য বলছে, বিগত ১২ মাসে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকসহ ৬৭ জন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৫৩ জনই প্রাণ দিয়েছেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিংবা অপরাধী চক্রের লক্ষ্যবস্তু হয়ে। এই ৬৭ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই প্রাণ গেছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধেও সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে সাংবাদিকদের। আফ্রিকার দেশ সুদান সাংবাদিকদের জন্য হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী যুদ্ধক্ষেত্র। মেক্সিকোয় অপরাধী চক্রের হাতে প্রাণ গেছে ৯ সাংবাদিকের। উত্তর আমেরিকার এই দেশটিকে বলা হয় সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় বিপজ্জনক রাষ্ট্র।
সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শুধু প্রাণই দিচ্ছেন না, তাঁরা আটক-গ্রেপ্তারেরও শিকার হয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অন্তত ৫০৩ জন সাংবাদিক কারান্তরীণ হয়ে আছেন।
কেবল অপরাধ চক্রের উৎপাতে অতিষ্ঠ দেশ কিংবা যুদ্ধকবলিত দেশই নয়, গণতন্ত্রের চর্চার দাবি করা দেশেও সাংবাদিকেরা দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকের ওপর সহিংসতা বেড়ে গেছে। ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন নামের অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যত সাংবাদিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তা গত তিন বছরের মোট সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনার সংখ্যার বেশি।
ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে নিপীড়নের শিকার সাংবাদিকদের বেশির ভাগই আক্রান্ত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সাংবাদিক কেন আক্রান্ত হন? বিশ্বজুড়েই দেখা যায়, যখন কোথাও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়, সাংবাদিক সেখানে যান পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে তথ্য সংগ্রহ করতে। তিনি কারও পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কাজ করেন না। শুধু জনসাধারণকে সঠিক তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টায় কোনো না কোনো পক্ষ ক্ষুব্ধ হয় সেই পক্ষের উদ্দেশ্য প্রকাশ হওয়ার ভয়ে।
আবার অপরাধী চক্র সাংবাদিককে আক্রমণ করে তাদের গোমর ফাঁসের ভয়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি থাকে। কারণ, এমন পরিস্থিতিতে মানবাধিকারের বালাই থাকে না। মাঠের পরিস্থিতি যেন বিশ্বমানবতা জানতে না পারে, সে চেষ্টার অংশ হিসেবে আক্রমণ করা হয় সাংবাদিককে।
কখনো কখনো শুধু রোষের বশেও সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করা হয়। শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী না, কখনো কখনো রাষ্ট্রও গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরে। সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন, এর উদাহরণ বিশ্বজুড়েই রয়েছে। নতুন করে আর কোনো দেশের নামোল্লেখ করতে চাই না।
কিন্তু গণমাধ্যম সরকার ও সমাজের বন্ধু হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল সমাজের নানা ত্রুটি তুলে ধরে গণমাধ্যম রাষ্ট্র গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। গণমাধ্যম সে প্রচেষ্টা করেও যাচ্ছে। গণমাধ্যমের শাসক কিংবা কোনো গোষ্ঠীর ‘দাসে’ পরিণত হওয়ার রেকর্ড যদিও আছে, কিন্তু সেটা হাতে গোনা বলা চলে। বাকি গণমাধ্যমগুলো সমাজকে সঠিক পথ দেখাতেই নিরন্তর কাজ করে চলেছে। উদাহরণও আছে ভূরি ভূরি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে ওয়াশিংটন পোস্ট ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ভূমিকা রেখেছিল, তা যুগ যুগ ধরে আলোচনা হবে। কিংবা হাল আমলে যুক্তরাজ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের করোনাকালীন ভূমিকা বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ সে দেশের গণমাধ্যমগুলো যেভাবে প্রকাশ করেছিল, সেটাও বড় উদাহরণ।
একটি জাতি গঠন কিংবা সমাজ গঠন—যে গঠনের কথাই বলা হোক না কেন, গণমাধ্যমের ভূমিকা কিছুতেই খাটো করে দেখা যাবে না। সমাজের ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরাই সাংবাদিকের কাজ। এমনকি শাসক দল যখন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়, তখন গণমাধ্যমই তাদের কথা সবার সামনে তুলে ধরে। অথচ এমনও দেখা গেছে, সেই বিরোধী দল যখন সরকারে যায়, তারাও গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা করেছে। এভাবেই যুগে যুগে সংবাদমাধ্যমকে বাকরুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
আমরা যদি একটু গভীরে ভাবি, তাহলে দেখব, সাংবাদিক যে পারিশ্রমিক পান, সে তুলনায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যে ঝুঁকি নেন, তা অনেক অনেক বেশি। কার এমন দায় পড়েছে নগণ্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নেবেন। তারপরও তিনি ঝুঁকি নেন দায়িত্বের জায়গা থেকে, তিনি ঝুঁকি নেন জনসাধারণকে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার নেশা থেকে। এই নেশাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া উচিত, দমন করা উচিত নয়। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ মানে একটি সমাজের মৃত্যুর ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া। সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
একবার ভাবুন, একটি দেশের গণমাধ্যমের কণ্ঠ যদি পুরোদমে রোধ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের অবস্থা কী হবে। কেবল ‘বাতাবি লেবুর রেকর্ড ফলনেরই’ গান শুনতে হবে পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়। কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে কেউ থাকবে না কথা বলার।
কাজেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সবার জন্যই জরুরি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে গণমাধ্যমের সেই স্বাধীনতার সুযোগে সে দূর করতে পারে সমাজের পঙ্কিলতা। বিরোধীরা চাইলে সেই স্বাধীনতার সুযোগে সরকারের অন্ধকার দিকগুলো সমাজের সামনে তুলে ধরতে পারবে। এভাবে পুরো সমাজ-রাষ্ট্রে নিশ্চিত হতে পারে জবাবদিহি।
কিন্তু বিশ্বে গণমাধ্যম নিয়ে এমন নীতি খুব কমই দেখা যায়। বরং উল্টো ঘটনাই বেশি ঘটছে। তারপরও গণমাধ্যম তার কাজ করে চলেছে, যাবে। কারণ, গণমাধ্যম হলো ফিনিক্স পাখির মতো। সে আক্রান্ত হবে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে, তারপর সেখান থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবে। গণমাধ্যম এমন একটি শিল্প, এমন একটি দায়বদ্ধতা, যা কখনো কোনো দিন কোনো হামলা, হুমকি, ত্রাসের কাছে মাথা নত করবে না।

রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০ এপ্রিল ২০২৫
দেখতে দেখতেই যেন বছরটা শেষ হয়ে আসছে। ২০২৫ সালের হতাশা-প্রত্যাশার হিসাব কষতে কষতে বড়দিন কড়া নেড়ে দিল দরজায়। সব হতাশা ভুলে প্রত্যাশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের আগমন হয়, ভালোবাসা ও একতার বাণী ছড়িয়ে।
১৯ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুদ্ধের ধারণা আমূল বদলে গেছে। রাষ্ট্রের সীমান্ত, সেনাবাহিনী কিংবা প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র আর একমাত্র ক্ষমতার মানদণ্ড নয়; বরং অদৃশ্য, নীরব ও প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাইবার স্পেস।
১৯ ঘণ্টা আগে
আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তুরস্কের ভূমিকা বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুল হলো, এটিকে নস্টালজিক ‘নব্য ওসমানি খেলাফত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া। বাস্তবে তুরস্ক আজ যে রাজনীতি করছে, তা আবেগের নয়, সুচিন্তিত হিসাবের। তুরস্কের এই রাজনীতি সাম্রাজ্য ফেরানোর চেষ্টা নয়, বরং শক্তির শূন্যতা কাজে লাগিয়ে...
১৯ ঘণ্টা আগেড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার

একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুদ্ধের ধারণা আমূল বদলে গেছে। রাষ্ট্রের সীমান্ত, সেনাবাহিনী কিংবা প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র আর একমাত্র ক্ষমতার মানদণ্ড নয়; বরং অদৃশ্য, নীরব ও প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাইবার স্পেস। আজ তথ্যই শক্তি, ডেটাই অস্ত্র এবং নেটওয়ার্কই নতুন ফ্রন্টলাইন। রাষ্ট্রের অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতা, কূটনীতি, এমনকি নাগরিকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে উঠছে ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপর।
সাইবার যুদ্ধ এখন আর কল্পবিজ্ঞান নয়; এটি বাস্তব, চলমান এবং ক্রমাগত বিস্তৃত এক বৈশ্বিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা অচল করা, ব্যাংকিং সিস্টেমে অনুপ্রবেশ, নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ, ভুয়া তথ্য ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ—সবকিছুই আজ সাইবার আক্রমণের আওতায় পড়ে। এসব আক্রমণ কোনো যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই, কোনো গুলির শব্দ ছাড়াই একটি রাষ্ট্রকে কার্যত অচল করে দিতে পারে। ফলে সামরিক শক্তির পাশাপাশি সাইবার সক্ষমতা এখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এরই সঙ্গে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে নজরদারি প্রযুক্তি। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে রাষ্ট্রগুলো নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ, যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ডেটা বিশ্লেষণের দিকে ঝুঁকছে। ক্যামেরা, বায়োমেট্রিক ডেটা, মেটাডেটা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সবকিছুই নজরদারির আওতায় চলে আসছে। এতে একদিকে সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ দমনের সম্ভাবনা তৈরি হলেও, অন্যদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা, গোপনীয়তা ও মানবাধিকারের প্রশ্নও তীব্র হয়ে উঠছে।
এই প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কোন পথে যাচ্ছে—সে প্রশ্ন ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। সাইবার অস্ত্র প্রতিযোগিতা, ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব, তথ্যনির্ভর আধিপত্য এবং প্রযুক্তিগত অসমতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা তৈরি করছে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যেখানে প্রযুক্তিকে আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, সেখানে উন্নয়নশীল ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলো পড়ছে নতুন ধরনের ঝুঁকির মুখে।
এই কলামে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির উদ্ভব, রাষ্ট্রীয় কৌশলে এর প্রভাব এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তাকাঠামোর ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিফলন বিশ্লেষণ করা হবে। একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলা হবে—নিরাপত্তার নামে কতটা নজরদারি গ্রহণযোগ্য এবং এই অদৃশ্য যুদ্ধের যুগে মানবিক মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক নৈতিকতা আদৌ টিকে থাকবে কি না।
আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থার কৌশলগত আচরণে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে এই অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে তথ্য, ডেটা এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণই হয়ে উঠেছে প্রভাব বিস্তারের প্রধান হাতিয়ার। রাষ্ট্রের পাশাপাশি বহুজাতিক করপোরেশন, হ্যাকার গোষ্ঠী, সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক এবং রাষ্ট্র-সমর্থিত সাইবার ইউনিটগুলোও সাইবার স্পেসকে ব্যবহার করছে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে।
এই প্রেক্ষাপটে সাইবার হামলা, ডিজিটাল স্পাইয়িং, তথ্য চুরি, গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্কে ব্যাঘাত সৃষ্টি এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রোপাগান্ডা আধুনিক সংঘাতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। কোনো একটি দেশের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা, আর্থিক খাত, সামরিক যোগাযোগ বা নির্বাচনব্যবস্থায় সামান্য ডিজিটাল হস্তক্ষেপও তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই ধরনের আক্রমণ প্রায়ই অজ্ঞাতনামা, সীমান্তহীন এবং যুদ্ধ ঘোষণার বাইরে সংঘটিত হয়, যা প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন ও নিরাপত্তাকাঠামোকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ফলস্বরূপ, সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি আজ আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত সক্ষমতা, প্রতিরক্ষা নীতি এবং নিরাপত্তা পরিকল্পনার একটি কেন্দ্রীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রগুলো শুধু আক্রমণ প্রতিরোধেই নয়, বরং আগাম হুমকি শনাক্তকরণ, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা বিশ্লেষণ এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই প্রযুক্তির ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভর করছে। এর পাশাপাশি, সাইবার সক্ষমতা এখন আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব, সামরিক জোট এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তবে এই বাস্তবতা শুধু প্রযুক্তিগত বা সামরিক সক্ষমতার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়। সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির বিস্তার জিওপলিটিকসের সামগ্রিক কাঠামো, রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। ক্ষমতার ভারসাম্য, সার্বভৌমত্বের ধারণা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা—সবকিছুই নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে এই ডিজিটাল যুগে।
এই প্রেক্ষাপটে আধুনিক সাইবার ক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব রাষ্ট্রগুলোর জন্য কৌশলগত সতর্কতা, নীতি সমন্বয় এবং বহুপক্ষীয় নিরাপত্তা অংশীদারত্বের প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে অগ্রসর হচ্ছে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই কলামে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির বহুমাত্রিক প্রভাব বিশ্লেষণের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।
সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি আধুনিক জিওপলিটিকসের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এটি আর শুধু প্রতিরক্ষা বা আক্রমণের হাতিয়ার নয়; বরং রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত প্রভাব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার মূল নির্ধারণকারী। প্রতিটি ডিজিটাল নেটওয়ার্ক, তথ্যপ্রবাহ এবং নজরদারি সক্ষমতা আজ রাষ্ট্রকে শক্তিশালী বা দুর্বল করতে পারে—এটি শুধু প্রযুক্তির নয়, ক্ষমতারও খেলা।
এই বাস্তবতায় রাষ্ট্রগুলোর জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে কৌশলগত সতর্কতা, তথ্যভিত্তিক নীতিনির্ধারণ এবং বহুপক্ষীয় অংশীদারত্বের মাধ্যমে বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ন্যায্য এবং নিয়ন্ত্রিত সাইবার ক্ষমতার ব্যবহার আজ শুধু প্রতিরক্ষা নয়; এটি রাষ্ট্রের কূটনীতি, শক্তি ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে।
ফলস্বরূপ আধুনিক জিওপলিটিকসে সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি শুধু এক হাতিয়ার নয়; এটি রাষ্ট্রগুলোর ভবিষ্যৎ, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি রক্ষার এক অদৃশ্য, কিন্তু শক্তিশালী ভিত্তি। প্রযুক্তির অদৃশ্য স্রোতগুলোর মধ্যে আজ রাষ্ট্রের ক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং প্রভাবের মান নির্ধারিত হচ্ছে—এটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা, যা দীর্ঘদিন আমাদের স্মৃতিতে এবং নীতিতে টেকসই রেশ রেখে যাবে।

একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুদ্ধের ধারণা আমূল বদলে গেছে। রাষ্ট্রের সীমান্ত, সেনাবাহিনী কিংবা প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র আর একমাত্র ক্ষমতার মানদণ্ড নয়; বরং অদৃশ্য, নীরব ও প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাইবার স্পেস। আজ তথ্যই শক্তি, ডেটাই অস্ত্র এবং নেটওয়ার্কই নতুন ফ্রন্টলাইন। রাষ্ট্রের অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতা, কূটনীতি, এমনকি নাগরিকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে উঠছে ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপর।
সাইবার যুদ্ধ এখন আর কল্পবিজ্ঞান নয়; এটি বাস্তব, চলমান এবং ক্রমাগত বিস্তৃত এক বৈশ্বিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা অচল করা, ব্যাংকিং সিস্টেমে অনুপ্রবেশ, নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ, ভুয়া তথ্য ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ—সবকিছুই আজ সাইবার আক্রমণের আওতায় পড়ে। এসব আক্রমণ কোনো যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই, কোনো গুলির শব্দ ছাড়াই একটি রাষ্ট্রকে কার্যত অচল করে দিতে পারে। ফলে সামরিক শক্তির পাশাপাশি সাইবার সক্ষমতা এখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এরই সঙ্গে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে নজরদারি প্রযুক্তি। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে রাষ্ট্রগুলো নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ, যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ডেটা বিশ্লেষণের দিকে ঝুঁকছে। ক্যামেরা, বায়োমেট্রিক ডেটা, মেটাডেটা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সবকিছুই নজরদারির আওতায় চলে আসছে। এতে একদিকে সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ দমনের সম্ভাবনা তৈরি হলেও, অন্যদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা, গোপনীয়তা ও মানবাধিকারের প্রশ্নও তীব্র হয়ে উঠছে।
এই প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কোন পথে যাচ্ছে—সে প্রশ্ন ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। সাইবার অস্ত্র প্রতিযোগিতা, ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব, তথ্যনির্ভর আধিপত্য এবং প্রযুক্তিগত অসমতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা তৈরি করছে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যেখানে প্রযুক্তিকে আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, সেখানে উন্নয়নশীল ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলো পড়ছে নতুন ধরনের ঝুঁকির মুখে।
এই কলামে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির উদ্ভব, রাষ্ট্রীয় কৌশলে এর প্রভাব এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তাকাঠামোর ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিফলন বিশ্লেষণ করা হবে। একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলা হবে—নিরাপত্তার নামে কতটা নজরদারি গ্রহণযোগ্য এবং এই অদৃশ্য যুদ্ধের যুগে মানবিক মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক নৈতিকতা আদৌ টিকে থাকবে কি না।
আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থার কৌশলগত আচরণে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে এই অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে তথ্য, ডেটা এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণই হয়ে উঠেছে প্রভাব বিস্তারের প্রধান হাতিয়ার। রাষ্ট্রের পাশাপাশি বহুজাতিক করপোরেশন, হ্যাকার গোষ্ঠী, সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক এবং রাষ্ট্র-সমর্থিত সাইবার ইউনিটগুলোও সাইবার স্পেসকে ব্যবহার করছে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে।
এই প্রেক্ষাপটে সাইবার হামলা, ডিজিটাল স্পাইয়িং, তথ্য চুরি, গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্কে ব্যাঘাত সৃষ্টি এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রোপাগান্ডা আধুনিক সংঘাতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। কোনো একটি দেশের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা, আর্থিক খাত, সামরিক যোগাযোগ বা নির্বাচনব্যবস্থায় সামান্য ডিজিটাল হস্তক্ষেপও তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই ধরনের আক্রমণ প্রায়ই অজ্ঞাতনামা, সীমান্তহীন এবং যুদ্ধ ঘোষণার বাইরে সংঘটিত হয়, যা প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন ও নিরাপত্তাকাঠামোকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ফলস্বরূপ, সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি আজ আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত সক্ষমতা, প্রতিরক্ষা নীতি এবং নিরাপত্তা পরিকল্পনার একটি কেন্দ্রীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রগুলো শুধু আক্রমণ প্রতিরোধেই নয়, বরং আগাম হুমকি শনাক্তকরণ, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা বিশ্লেষণ এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই প্রযুক্তির ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভর করছে। এর পাশাপাশি, সাইবার সক্ষমতা এখন আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব, সামরিক জোট এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তবে এই বাস্তবতা শুধু প্রযুক্তিগত বা সামরিক সক্ষমতার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়। সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির বিস্তার জিওপলিটিকসের সামগ্রিক কাঠামো, রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। ক্ষমতার ভারসাম্য, সার্বভৌমত্বের ধারণা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা—সবকিছুই নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে এই ডিজিটাল যুগে।
এই প্রেক্ষাপটে আধুনিক সাইবার ক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব রাষ্ট্রগুলোর জন্য কৌশলগত সতর্কতা, নীতি সমন্বয় এবং বহুপক্ষীয় নিরাপত্তা অংশীদারত্বের প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে অগ্রসর হচ্ছে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই কলামে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির বহুমাত্রিক প্রভাব বিশ্লেষণের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।
সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি আধুনিক জিওপলিটিকসের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এটি আর শুধু প্রতিরক্ষা বা আক্রমণের হাতিয়ার নয়; বরং রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত প্রভাব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার মূল নির্ধারণকারী। প্রতিটি ডিজিটাল নেটওয়ার্ক, তথ্যপ্রবাহ এবং নজরদারি সক্ষমতা আজ রাষ্ট্রকে শক্তিশালী বা দুর্বল করতে পারে—এটি শুধু প্রযুক্তির নয়, ক্ষমতারও খেলা।
এই বাস্তবতায় রাষ্ট্রগুলোর জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে কৌশলগত সতর্কতা, তথ্যভিত্তিক নীতিনির্ধারণ এবং বহুপক্ষীয় অংশীদারত্বের মাধ্যমে বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ন্যায্য এবং নিয়ন্ত্রিত সাইবার ক্ষমতার ব্যবহার আজ শুধু প্রতিরক্ষা নয়; এটি রাষ্ট্রের কূটনীতি, শক্তি ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে।
ফলস্বরূপ আধুনিক জিওপলিটিকসে সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি শুধু এক হাতিয়ার নয়; এটি রাষ্ট্রগুলোর ভবিষ্যৎ, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি রক্ষার এক অদৃশ্য, কিন্তু শক্তিশালী ভিত্তি। প্রযুক্তির অদৃশ্য স্রোতগুলোর মধ্যে আজ রাষ্ট্রের ক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং প্রভাবের মান নির্ধারিত হচ্ছে—এটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা, যা দীর্ঘদিন আমাদের স্মৃতিতে এবং নীতিতে টেকসই রেশ রেখে যাবে।

রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০ এপ্রিল ২০২৫
দেখতে দেখতেই যেন বছরটা শেষ হয়ে আসছে। ২০২৫ সালের হতাশা-প্রত্যাশার হিসাব কষতে কষতে বড়দিন কড়া নেড়ে দিল দরজায়। সব হতাশা ভুলে প্রত্যাশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের আগমন হয়, ভালোবাসা ও একতার বাণী ছড়িয়ে।
১৯ ঘণ্টা আগে
গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে চোখ রাখলে সমাজ তার অন্ধকার দিকগুলো আবিষ্কার করতে পারে, ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ পায়। এ কারণেই যুগে যুগে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া ব্যক্তিরা গণমাধ্যমকে ‘শত্রু’ মনে করে এসেছে। অর্থশক্তি, পেশিশক্তি দিয়ে তারা সমাজের এই দর্পণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তুরস্কের ভূমিকা বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুল হলো, এটিকে নস্টালজিক ‘নব্য ওসমানি খেলাফত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া। বাস্তবে তুরস্ক আজ যে রাজনীতি করছে, তা আবেগের নয়, সুচিন্তিত হিসাবের। তুরস্কের এই রাজনীতি সাম্রাজ্য ফেরানোর চেষ্টা নয়, বরং শক্তির শূন্যতা কাজে লাগিয়ে...
১৯ ঘণ্টা আগেআব্দুর রহমান

আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তুরস্কের ভূমিকা বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুল হলো, এটিকে নস্টালজিক ‘নব্য ওসমানি খেলাফত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া। বাস্তবে তুরস্ক আজ যে রাজনীতি করছে, তা আবেগের নয়, সুচিন্তিত হিসাবের। তুরস্কের এই রাজনীতি সাম্রাজ্য ফেরানোর চেষ্টা নয়, বরং শক্তির শূন্যতা কাজে লাগিয়ে প্রভাব বাড়ানোর একধরনের নিয়ন্ত্রিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা কমে আসা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৌশলগত দ্বিধা এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাসের ভেতর তুরস্ক নিজেকে এমন এক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করাও কঠিন, আবার উপেক্ষা করাও অসম্ভব। গাজা থেকে লিবিয়া, কাতার থেকে সুদান—সর্বত্রই এখন তুরস্কের প্রভাব রয়েছে।
উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদানের ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকা সরাসরি সামরিক নয়, কিন্তু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। লোহিতসাগর অঞ্চলে সুদানের অবস্থান তুরস্ককে দীর্ঘদিন আকর্ষণ করে আসছে। সাওয়াকিন দ্বীপ পুনর্গঠনের আগ্রহ, মানবিক সহায়তা এবং অবকাঠামো সহযোগিতার মাধ্যমে আঙ্কারা সেখানে একটি উপস্থিতি তৈরি করেছে। কেবল তা-ই নয়, সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধেও তুরস্ক সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। দেশটিতে আঙ্কারা বিদ্যমান সরকার ও সেনাবাহিনীর—যা সুদান আর্মড ফোর্সেস বা এসএএফ নামে পরিচিত—পক্ষ নিয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসএএফ এখন তুরস্ক ও মিসরের কাছ থেকে অস্ত্র পাওয়ার আশা করছে।
গত বছর থেকেই তুরস্ক সুদানের সেনাবাহিনীকে ড্রোন, আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ও কমান্ড সেন্টার সরবরাহ করছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই সহায়তা অব্যাহত থাকবে। এমনকি তুর্কি ড্রোনচালকেরাও বর্তমানে সুদানের ভেতরে কাজ করছেন। তবে এটি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য অস্বস্তিকর। কারণ, তারা সুদানকে নিজেদের নিরাপত্তাবলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। তুরস্ক এখানে সংঘাতে না গিয়ে ভবিষ্যতের বিকল্প তৈরি করছে, যা দেশটিকে সরাসরি হুমকি নয়, কিন্তু সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
গাজা ইস্যুতে তুরস্কের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হলেও সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রিত। আঙ্কারা ফিলিস্তিন প্রশ্নে উচ্চকিত অবস্থান নিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের কঠোর সমালোচনা করেছে এবং মানবিক সহায়তা পাঠিয়ে যাচ্ছে। এতে আরব জনমতের বড় অংশে তুরস্ক নৈতিকভাবে জায়গা করে নিয়েছে। বাস্তবে তুরস্ক গাজায় সামরিকভাবে জড়ায়নি এবং জড়াতে চায়ও না। কারণ, সরাসরি সামরিক সম্পৃক্ততা মানে ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণমাত্রার সংঘাত, যা তুরস্কের বৃহত্তর আঞ্চলিক কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
কিন্তু গাজায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে যে যুদ্ধবিরতি অর্জিত হয়েছে, তাতে তুরস্কের সক্রিয় ভূমিকা আছে। ফলে গাজা তুরস্কের জন্য নৈতিক পুঁজি সংগ্রহের ক্ষেত্র, সামরিক আধিপত্য বিস্তারের নয়। এই অবস্থান মিসর ও জর্ডানের জন্য অস্বস্তিকর, কারণ তারা গাজা ইস্যুতে ঐতিহাসিক মধ্যস্থতার ভূমিকা হারানোর ঝুঁকি অনুভব করে। এই অবস্থায় গাজায় তুরস্কের ভূমিকা শুধু ত্রাণ নয়, এটি তুরস্ককে মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্গঠনে একটি কেন্দ্রীয় কূটনৈতিক ভূমিকায় বসাবে। এতে এই অঞ্চলে তুরস্কের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াবে।
লিবিয়ায় তুরস্ক সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ করেছে। এখানে আঙ্কারা প্রমাণ করেছে যে, দেশটি কেবল কথায় সীমাবদ্ধ নয়, বাস্তব সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতেও প্রস্তুত। ২০১৯-২০ সালে জাতিসংঘ স্বীকৃত ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারকে তুরস্কের ড্রোন, সামরিক উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণ সহায়তা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বায়রাকতার টিবি-২ ড্রোন ব্যবহার করে মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থিত হাফতার বাহিনীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয় তুরস্ক। এটি শুধু লিবিয়ার যুদ্ধের ফলাফল বদলায়নি, বরং পুরো আরব বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে তুরস্ক চাইলে আঞ্চলিক সংঘাতে নির্ধারক ভূমিকা নিতে পারে। এই কারণেই লিবিয়ায় তুরস্ক অনেক আরব শাসকের চোখে সরাসরি হুমকি।
মিসরের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ছিল তীব্র বৈরিতায় ভরা। মুসলিম ব্রাদারহুড প্রশ্ন, লিবিয়ার যুদ্ধ এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরের গ্যাসকেন্দ্রিক রাজনীতি এই দ্বন্দ্বকে গভীর করে তোলে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগিয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন, নিরাপত্তা সংলাপ এবং যৌথ নৌ-মহড়ার আলোচনা দেখায় যে উভয় পক্ষই বুঝেছে—স্থায়ী বৈরিতা উভয়ের কৌশলগত স্বার্থের বিরুদ্ধে। এটি কোনো আদর্শগত সমঝোতা নয়, বরং শীতল বাস্তববাদ। মিসর তুরস্ককে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না, তুরস্কও মিসরকে বন্ধু মনে করে না, কিন্তু উভয়ই জানে সংঘাতের ব্যয় অনেক বেশি।
ইরানের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আরও জটিল। একদিকে পশ্চিমা চাপ মোকাবিলায় বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সমন্বয়, অন্যদিকে সিরিয়া, ইরাক ও ককেশাসে প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইরান তুরস্ককে সুন্নি প্রভাব বিস্তারের একটি সম্ভাব্য বাহক হিসেবে দেখে, যা শিয়া-বলয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। তবু দুই দেশই সরাসরি সংঘাতে যায় না, কারণ সংঘাত মানে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বহিরাগত শক্তির জন্য সুযোগ তৈরি করা। এই কারণে ইরান-তুরস্ক সম্পর্ক সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে সাম্প্রতিক সময়ে।
তবে তুরস্কের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সিরিয়ায় দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদের পতন ঘটিয়ে বিদ্রোহী নেতা আহমেদ আল-শারাকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করার মাধ্যমে। ২০১৭ সাল থেকেই তুরস্ক আল-শারার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। তারপর ক্রমান্বয়ে আল-শারার বাহিনীকে সামরিক ও কৌশলগত সহায়তা দিয়ে সিরিয়ার মসনদ পর্যন্ত তাদের পৌঁছে দেয় আঙ্কারা। তুরস্ক মূলত দুটি কারণে আল-শারার বাহিনীকে সমর্থন দিয়েছে। এক. সিরিয়ায় নিজের কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় করা এবং দুই. দেশটি থেকে বিশেষ করে আল-শারার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ইদলিব থেকে যেন শরণার্থীর ঢেউ নিজ ভূখণ্ডে প্রবেশ না করে, তা নিশ্চিত করা। তুরস্ক কেবল আল-শারা এবং তাঁর বাহিনীকে সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতেই সহায়তা করেনি, পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার যোগাযোগেরও মাধ্যম ছিল তারা।
আরব দুনিয়াজুড়ে এই ভূমিকাগুলোকে একসূত্রে বাঁধে তুরস্কের সামরিক শিল্প। গত এক দশকে তুরস্ক প্রতিরক্ষা খাতে যে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, সেটিই তার ভূরাজনৈতিক সক্রিয়তার ভিত্তি। কাতার, মরক্কো, তিউনিসিয়া, লিবিয়া এমনকি কিছু উপসাগরীয় দেশ তুরস্কের ড্রোন ও সাঁজোয়া যান কিনেছে বা কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। এর কারণ কেবল দাম নয়, পশ্চিমা অস্ত্র কেনার সঙ্গে রাজনৈতিক শর্ত, মানবাধিকার প্রশ্ন ও দীর্ঘ ডেলিভারি সময় জড়িত থাকে। তুরস্ক এই জায়গায় নিজেকে একটি বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেছে, যেখানে প্রযুক্তি যথেষ্ট আধুনিক, দাম তুলনামূলক কম এবং রাজনৈতিক শর্ত সীমিত। এতে আরব রাষ্ট্রগুলোর কাছে তুরস্ক শুধু অস্ত্র সরবরাহকারী নয়, বরং কৌশলগত বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এই সামরিক শিল্পের প্রভাব আরব বিশ্বে দ্বিমুখী। একদিকে কিছু রাষ্ট্র তুরস্ককে অংশীদার হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। কাতারের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা এর সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ। কাতারে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি, যৌথ মহড়া এবং অস্ত্র সরবরাহ একটি গভীর নিরাপত্তা অংশীদারত্ব তৈরি করেছে। অন্যদিকে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলো তুরস্কের সামরিক শিল্পকে একটি সুপ্ত হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। কারণ, এই শিল্প তুরস্ককে কেবল রাজনৈতিক বক্তব্যের শক্তি দেয় না, বরং প্রয়োজনে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করার সক্ষমতাও দেয়, যেমনটি লিবিয়ায় দেখা গেছে।
আরব বিশ্বে তুরস্কের সামরিক শিল্পের আরেকটি প্রভাব হলো আত্মবিশ্বাসের রাজনীতি। বহু দশক ধরে আরব রাষ্ট্রগুলো সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তুরস্কের উত্থান দেখিয়েছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশও পরিকল্পিত বিনিয়োগ, রাষ্ট্রীয় সমর্থন এবং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের মাধ্যমে বিশ্বমানের সামরিক প্রযুক্তি তৈরি করতে পারে। এটি আরব সমাজের ভেতরে একধরনের অনুপ্রেরণা তৈরি করেছে, যদিও শাসকগোষ্ঠীর কাছে তা সব সময় স্বস্তিকর নয়।
তুরস্ক ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির শূন্যতা পূরণের একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে যখন ইরানের প্রভাব কিছুটা ক্ষয়ের দিকে, তখন সেই জায়গা দখলে তুরস্ক দ্রুতলয়ে এগিয়ে আসছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানের প্রভাব যখন কমে গেছে, তুরস্ক তা ব্যবহার করে পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অভিলাষ জাহির করছে। এটি শুধুই প্রতিরক্ষা নয়; সমগ্র অঞ্চলই নিজ প্রভাববলয়ে আনার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করছে। বর্তমান তুরস্ক নতুন করে কোনো অটোমান বা ওসমানি সালতানাত গড়ছে না, কিন্তু প্রভাব বিস্তার করছে। দেশটি পুরো ব্যবস্থাকে ভাঙছে না, কিন্তু নিয়ম বদলাচ্ছে। এই নিয়ন্ত্রিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সক্ষমতাই তুরস্ককে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে।

আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তুরস্কের ভূমিকা বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুল হলো, এটিকে নস্টালজিক ‘নব্য ওসমানি খেলাফত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া। বাস্তবে তুরস্ক আজ যে রাজনীতি করছে, তা আবেগের নয়, সুচিন্তিত হিসাবের। তুরস্কের এই রাজনীতি সাম্রাজ্য ফেরানোর চেষ্টা নয়, বরং শক্তির শূন্যতা কাজে লাগিয়ে প্রভাব বাড়ানোর একধরনের নিয়ন্ত্রিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা কমে আসা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৌশলগত দ্বিধা এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাসের ভেতর তুরস্ক নিজেকে এমন এক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করাও কঠিন, আবার উপেক্ষা করাও অসম্ভব। গাজা থেকে লিবিয়া, কাতার থেকে সুদান—সর্বত্রই এখন তুরস্কের প্রভাব রয়েছে।
উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদানের ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকা সরাসরি সামরিক নয়, কিন্তু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। লোহিতসাগর অঞ্চলে সুদানের অবস্থান তুরস্ককে দীর্ঘদিন আকর্ষণ করে আসছে। সাওয়াকিন দ্বীপ পুনর্গঠনের আগ্রহ, মানবিক সহায়তা এবং অবকাঠামো সহযোগিতার মাধ্যমে আঙ্কারা সেখানে একটি উপস্থিতি তৈরি করেছে। কেবল তা-ই নয়, সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধেও তুরস্ক সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। দেশটিতে আঙ্কারা বিদ্যমান সরকার ও সেনাবাহিনীর—যা সুদান আর্মড ফোর্সেস বা এসএএফ নামে পরিচিত—পক্ষ নিয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসএএফ এখন তুরস্ক ও মিসরের কাছ থেকে অস্ত্র পাওয়ার আশা করছে।
গত বছর থেকেই তুরস্ক সুদানের সেনাবাহিনীকে ড্রোন, আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ও কমান্ড সেন্টার সরবরাহ করছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই সহায়তা অব্যাহত থাকবে। এমনকি তুর্কি ড্রোনচালকেরাও বর্তমানে সুদানের ভেতরে কাজ করছেন। তবে এটি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য অস্বস্তিকর। কারণ, তারা সুদানকে নিজেদের নিরাপত্তাবলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। তুরস্ক এখানে সংঘাতে না গিয়ে ভবিষ্যতের বিকল্প তৈরি করছে, যা দেশটিকে সরাসরি হুমকি নয়, কিন্তু সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
গাজা ইস্যুতে তুরস্কের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হলেও সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রিত। আঙ্কারা ফিলিস্তিন প্রশ্নে উচ্চকিত অবস্থান নিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের কঠোর সমালোচনা করেছে এবং মানবিক সহায়তা পাঠিয়ে যাচ্ছে। এতে আরব জনমতের বড় অংশে তুরস্ক নৈতিকভাবে জায়গা করে নিয়েছে। বাস্তবে তুরস্ক গাজায় সামরিকভাবে জড়ায়নি এবং জড়াতে চায়ও না। কারণ, সরাসরি সামরিক সম্পৃক্ততা মানে ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণমাত্রার সংঘাত, যা তুরস্কের বৃহত্তর আঞ্চলিক কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
কিন্তু গাজায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে যে যুদ্ধবিরতি অর্জিত হয়েছে, তাতে তুরস্কের সক্রিয় ভূমিকা আছে। ফলে গাজা তুরস্কের জন্য নৈতিক পুঁজি সংগ্রহের ক্ষেত্র, সামরিক আধিপত্য বিস্তারের নয়। এই অবস্থান মিসর ও জর্ডানের জন্য অস্বস্তিকর, কারণ তারা গাজা ইস্যুতে ঐতিহাসিক মধ্যস্থতার ভূমিকা হারানোর ঝুঁকি অনুভব করে। এই অবস্থায় গাজায় তুরস্কের ভূমিকা শুধু ত্রাণ নয়, এটি তুরস্ককে মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্গঠনে একটি কেন্দ্রীয় কূটনৈতিক ভূমিকায় বসাবে। এতে এই অঞ্চলে তুরস্কের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াবে।
লিবিয়ায় তুরস্ক সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ করেছে। এখানে আঙ্কারা প্রমাণ করেছে যে, দেশটি কেবল কথায় সীমাবদ্ধ নয়, বাস্তব সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতেও প্রস্তুত। ২০১৯-২০ সালে জাতিসংঘ স্বীকৃত ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারকে তুরস্কের ড্রোন, সামরিক উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণ সহায়তা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বায়রাকতার টিবি-২ ড্রোন ব্যবহার করে মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থিত হাফতার বাহিনীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয় তুরস্ক। এটি শুধু লিবিয়ার যুদ্ধের ফলাফল বদলায়নি, বরং পুরো আরব বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে তুরস্ক চাইলে আঞ্চলিক সংঘাতে নির্ধারক ভূমিকা নিতে পারে। এই কারণেই লিবিয়ায় তুরস্ক অনেক আরব শাসকের চোখে সরাসরি হুমকি।
মিসরের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ছিল তীব্র বৈরিতায় ভরা। মুসলিম ব্রাদারহুড প্রশ্ন, লিবিয়ার যুদ্ধ এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরের গ্যাসকেন্দ্রিক রাজনীতি এই দ্বন্দ্বকে গভীর করে তোলে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগিয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন, নিরাপত্তা সংলাপ এবং যৌথ নৌ-মহড়ার আলোচনা দেখায় যে উভয় পক্ষই বুঝেছে—স্থায়ী বৈরিতা উভয়ের কৌশলগত স্বার্থের বিরুদ্ধে। এটি কোনো আদর্শগত সমঝোতা নয়, বরং শীতল বাস্তববাদ। মিসর তুরস্ককে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না, তুরস্কও মিসরকে বন্ধু মনে করে না, কিন্তু উভয়ই জানে সংঘাতের ব্যয় অনেক বেশি।
ইরানের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আরও জটিল। একদিকে পশ্চিমা চাপ মোকাবিলায় বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সমন্বয়, অন্যদিকে সিরিয়া, ইরাক ও ককেশাসে প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইরান তুরস্ককে সুন্নি প্রভাব বিস্তারের একটি সম্ভাব্য বাহক হিসেবে দেখে, যা শিয়া-বলয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। তবু দুই দেশই সরাসরি সংঘাতে যায় না, কারণ সংঘাত মানে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বহিরাগত শক্তির জন্য সুযোগ তৈরি করা। এই কারণে ইরান-তুরস্ক সম্পর্ক সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে সাম্প্রতিক সময়ে।
তবে তুরস্কের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সিরিয়ায় দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদের পতন ঘটিয়ে বিদ্রোহী নেতা আহমেদ আল-শারাকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করার মাধ্যমে। ২০১৭ সাল থেকেই তুরস্ক আল-শারার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। তারপর ক্রমান্বয়ে আল-শারার বাহিনীকে সামরিক ও কৌশলগত সহায়তা দিয়ে সিরিয়ার মসনদ পর্যন্ত তাদের পৌঁছে দেয় আঙ্কারা। তুরস্ক মূলত দুটি কারণে আল-শারার বাহিনীকে সমর্থন দিয়েছে। এক. সিরিয়ায় নিজের কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় করা এবং দুই. দেশটি থেকে বিশেষ করে আল-শারার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ইদলিব থেকে যেন শরণার্থীর ঢেউ নিজ ভূখণ্ডে প্রবেশ না করে, তা নিশ্চিত করা। তুরস্ক কেবল আল-শারা এবং তাঁর বাহিনীকে সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতেই সহায়তা করেনি, পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার যোগাযোগেরও মাধ্যম ছিল তারা।
আরব দুনিয়াজুড়ে এই ভূমিকাগুলোকে একসূত্রে বাঁধে তুরস্কের সামরিক শিল্প। গত এক দশকে তুরস্ক প্রতিরক্ষা খাতে যে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, সেটিই তার ভূরাজনৈতিক সক্রিয়তার ভিত্তি। কাতার, মরক্কো, তিউনিসিয়া, লিবিয়া এমনকি কিছু উপসাগরীয় দেশ তুরস্কের ড্রোন ও সাঁজোয়া যান কিনেছে বা কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। এর কারণ কেবল দাম নয়, পশ্চিমা অস্ত্র কেনার সঙ্গে রাজনৈতিক শর্ত, মানবাধিকার প্রশ্ন ও দীর্ঘ ডেলিভারি সময় জড়িত থাকে। তুরস্ক এই জায়গায় নিজেকে একটি বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেছে, যেখানে প্রযুক্তি যথেষ্ট আধুনিক, দাম তুলনামূলক কম এবং রাজনৈতিক শর্ত সীমিত। এতে আরব রাষ্ট্রগুলোর কাছে তুরস্ক শুধু অস্ত্র সরবরাহকারী নয়, বরং কৌশলগত বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এই সামরিক শিল্পের প্রভাব আরব বিশ্বে দ্বিমুখী। একদিকে কিছু রাষ্ট্র তুরস্ককে অংশীদার হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। কাতারের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা এর সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ। কাতারে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি, যৌথ মহড়া এবং অস্ত্র সরবরাহ একটি গভীর নিরাপত্তা অংশীদারত্ব তৈরি করেছে। অন্যদিকে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলো তুরস্কের সামরিক শিল্পকে একটি সুপ্ত হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। কারণ, এই শিল্প তুরস্ককে কেবল রাজনৈতিক বক্তব্যের শক্তি দেয় না, বরং প্রয়োজনে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করার সক্ষমতাও দেয়, যেমনটি লিবিয়ায় দেখা গেছে।
আরব বিশ্বে তুরস্কের সামরিক শিল্পের আরেকটি প্রভাব হলো আত্মবিশ্বাসের রাজনীতি। বহু দশক ধরে আরব রাষ্ট্রগুলো সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তুরস্কের উত্থান দেখিয়েছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশও পরিকল্পিত বিনিয়োগ, রাষ্ট্রীয় সমর্থন এবং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের মাধ্যমে বিশ্বমানের সামরিক প্রযুক্তি তৈরি করতে পারে। এটি আরব সমাজের ভেতরে একধরনের অনুপ্রেরণা তৈরি করেছে, যদিও শাসকগোষ্ঠীর কাছে তা সব সময় স্বস্তিকর নয়।
তুরস্ক ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির শূন্যতা পূরণের একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে যখন ইরানের প্রভাব কিছুটা ক্ষয়ের দিকে, তখন সেই জায়গা দখলে তুরস্ক দ্রুতলয়ে এগিয়ে আসছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানের প্রভাব যখন কমে গেছে, তুরস্ক তা ব্যবহার করে পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অভিলাষ জাহির করছে। এটি শুধুই প্রতিরক্ষা নয়; সমগ্র অঞ্চলই নিজ প্রভাববলয়ে আনার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করছে। বর্তমান তুরস্ক নতুন করে কোনো অটোমান বা ওসমানি সালতানাত গড়ছে না, কিন্তু প্রভাব বিস্তার করছে। দেশটি পুরো ব্যবস্থাকে ভাঙছে না, কিন্তু নিয়ম বদলাচ্ছে। এই নিয়ন্ত্রিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সক্ষমতাই তুরস্ককে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে।

রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০ এপ্রিল ২০২৫
দেখতে দেখতেই যেন বছরটা শেষ হয়ে আসছে। ২০২৫ সালের হতাশা-প্রত্যাশার হিসাব কষতে কষতে বড়দিন কড়া নেড়ে দিল দরজায়। সব হতাশা ভুলে প্রত্যাশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের আগমন হয়, ভালোবাসা ও একতার বাণী ছড়িয়ে।
১৯ ঘণ্টা আগে
গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে চোখ রাখলে সমাজ তার অন্ধকার দিকগুলো আবিষ্কার করতে পারে, ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ পায়। এ কারণেই যুগে যুগে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া ব্যক্তিরা গণমাধ্যমকে ‘শত্রু’ মনে করে এসেছে। অর্থশক্তি, পেশিশক্তি দিয়ে তারা সমাজের এই দর্পণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুদ্ধের ধারণা আমূল বদলে গেছে। রাষ্ট্রের সীমান্ত, সেনাবাহিনী কিংবা প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র আর একমাত্র ক্ষমতার মানদণ্ড নয়; বরং অদৃশ্য, নীরব ও প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাইবার স্পেস।
১৯ ঘণ্টা আগে