Ajker Patrika

ভালোবাসা থাক বেশি বেশি

অজয় দাশগুপ্ত
ভালোবাসা দিবসে ফুলের বাণিজ্যই হোক। ছবি: আজকের পত্রিকা
ভালোবাসা দিবসে ফুলের বাণিজ্যই হোক। ছবি: আজকের পত্রিকা

এবার যেন কিছুটা নীরবে কেটে গেল ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা কি আসলে কোনো দিবসে সীমাবদ্ধ? নাকি ভালোবাসা তার ধার ধারে? কী এই ভালোবাসা আসলে?

বয়স অনুযায়ী পাল্টে যায় ভালোবাসা। সে যদি না বদলায়, তো আধুনিক হবে কী করে? এই বদলে যাওয়া ভালোবাসা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা সবাই ভালোবাসাতেই আছি।

আপনি বাংলাদেশের মানুষ, অথচ আপনি শিরি-ফরহাদ, রাধা-কৃষ্ণ বা লায়লি-মজনুর প্রেম জানেন না, তা কি হয়? এই প্রেম এমনই যে, তা কাহিনি থেকে ক্ল্যাসিকে রূপ নিয়েছে। এ ধরনের প্রেমকে আমরা আদি প্রেম বা ভালোবাসা বলে মেনে নিতেই পারি; যা ধর্ম পেরিয়ে কাব্য, গান, ছবি—সব জায়গায় হানা দিয়েছে। এসব যদি প্রচলিত স্বামী-স্ত্রীর প্রেম হতো, এতটা কি সাড়া জাগাতে পারত? পারত না। যে কারণে পেরেছে, তার মূল জায়াগাটা অনিশ্চয়তা। যেমন, রাধা-কৃষ্ণ মিলিত হতেন গোপনে, তাঁদের ভক্তিরস, প্রেমরস সব বয়ে যেত ফল্গুধারায়। রাধা ঘর ছেড়ে যেতে পারছেন না অথচ শ্যামের বাঁশি তাঁকে ডাকছে—এই বিরহ, এই মধুর অপেক্ষা নিয়ে কত-শত গান, কবিতা। উপন্যাসের মতো বড় আকারের বইয়েও এমন প্রেম চিরঞ্জীব।

প্রেম কি শুধু দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মনের আদান-প্রদান? ভালোবাসা অঙ্কুরিত হয় পরিবারে। ছোট শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে মা যখন আদর করেন, তখনই এক ভালোবাসার জন্ম হয়। সেই শিশু বড় হতে হতে মা তাকে স্কুলের জামা পরিয়ে দেন, ব্যাগ ঝুলিয়ে দেন কাঁধে। পায়ের জুতার ফিতে বেঁধে দেন পরম মমতায়। এর নাম কি ভালোবাসা নয়? পিতা যে সারা দিনের ক্লান্তি আর শ্রমের পর ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার উঁকি দিয়ে দেখে যান তার মেয়েটি কী করছে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে দেখা সন্তানের মুখের নামই ভালোবাসা।

আমাদের এই প্রযুক্তি আর ডিজিটাল জগতে অনেক কিছুর মতো ভালোবাসাও বদলে গেছে। অন্তত ভালোবাসার সংজ্ঞা বদলে গেছে। যতটা না মন, তারচেয়ে অধিক শরীর এসে ভর করেছে। সেই ভালোবাসার নাম পরকীয়া, যার মানে আপনি একজনে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। অবশ্য এ-কথাও মানতে হবে, মনের মিল বা মনজুড়ে কেউ এলে সেই ভালোবাসার একটা আলাদা রূপ থাকে। এই ভালোবাসার নাম সুন্দর। আমি হলফ করে বলতে পারি, মানুষ তখনই সুন্দর, যখন সে ভালোবাসে। খুব মারফতি কথার প্রয়োজন নেই, আপনি যে বয়সে যেভাবেই প্রেমে পড়েন না কেন, আপনি সুন্দর হয়ে উঠবেন। চাইবেন পরিপাটি থাকতে। এত দিনের অগোছালো জামাটি ইস্তিরি ঘরে যাবে। পাতলুনের ভাঁজ হবে ঠিকঠাক। আপনার অবিন্যস্ত চুল আঁচড়ে আপনি বারবার আয়না দেখবেন। এর নামই তো ভালোবাসা।

যারা তরুণ-তরুণী, সময়টা তাদের। পৃথিবীর সব দেশে, সব ভাষায়, সব পরিবেশে তারুণ্যের কাছে যে ভালোবাসা, তার কোনো তুলনা হয় না। আমি শফিক রেহমানকে দেখি না বা তাঁর কোনো খবর জানি না দীর্ঘদিন। কিন্তু মানুষটিকে আমার ভালোবাসা দিবস এলেই মনে পড়ে। আধুনিক মানুষটি আমাদের এই ধর্মান্ধ অনাধুনিক সমাজে এক ব্যাপক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। একটি লাল গোলাপ আর ভালোবাসার ‘যায়যায়দিন’ এখন ইতিহাস। শফিক রেহমান বা ‘যায়যায়দিন’ কিংবা তাঁর টিভি শো—এখন আর কিছুই নেই, কিন্তু আছে ভালোবাসা দিবস।

যারা বলেন এটা পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা দিবস, তাঁরা ভুল বলেন না। কিন্তু কেন বলেন, সেটা বোঝেন না। এই যে আপনি ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন, গণতন্ত্র কি আমাদের ঘরের তন্ত্র? একদা যারা লাল গোলাপ আর সমাজতন্ত্রকে মিলিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, তাদের সাম্যবাদ কি আমাদের দেশের তন্ত্র? এমনকি আজকের পোশাক থেকে ল্যাপটপ—কিছুই আমাদের নয়। আমরা তাদের আপন করে নিয়েছি। আমাদের মতো করে ভালোবেসে কাছে নিয়েছি। ভালোবাসা দিবস যে দেশের, যে ইতিহাসের অংশ হবে হোক, সে এখন আমাদের তারুণ্যের উৎসব।

ভ্যালেনটাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস নিয়ে বাণিজ্য হয় এটা ঠিক। যেসব কুমতলবি বলেন এর ভেতরে আছে নগ্নতা বা এর মাধ্যমে তারুণ্য নগ্নতাকে প্রশ্রয় দেয়, তারা ভুলে যান যে এই সমাজে বছরের আর সব দিন যে পরিমাণ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন হয়, অন্তত এই দিনে তা হয় না। বরং এই একটি দিনে সবার সঙ্গে থাকার জন্য লোকদেখানোর জন্য হলেও কেউ ফুল কেনে। সেই ফুল পৌঁছে যায় তার প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে। বাঙালি তো এ কাজ আগে করত না। আমাদের অবরুদ্ধ সমাজে আমরা যদি কাউকে বলি ‘গুড’, তার মানে আমরা বলতে চেয়েছি ‘চমৎকার’। যদি ভুলে বলে ফেলি, ‘ভালো হয়েছে’, তার মানে বুঝতে হবে ‘অসাধারণ হয়েছে’। মন খুলে বলতে না পারা, মন খুলে ভালোবাসতে না পারার দেশে ভালোবাসা দিবস তো আঁধারের পর এক টুকরো সূর্যোদয়, যার আলোতে মনের বরফ গলে পড়ে। ঝকঝকে এক আকাশ এসে বলে, ‘আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো...’।

আমি ভালোবাসা দিবসে আপত্তি দেখি না। হোক তা ফুলের বাণিজ্য। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনি বাঙালিকে পূজা বা শহীদ দিবস ছাড়া আর কোনো দিন এমন ফুল কিনতে দেখেন? তা-ও গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ? এই এক দিনে রক্তে নয়, গোলাপের লালে ভেসে যায় আমাদের সমাজ। যে সমাজে মারধর নিষিদ্ধ নয়, যেখানে নারী নিত্য অবমাননার শিকার, যে দেশে চুমু খাওয়া অপরাধ, বিদায়ী বা আগমনী চুম্বনও নিষিদ্ধ, সেখানে এই ভালোবাসা দিবস একটি সুখের নাম। এক পলক দেখা আর এক পশলা বৃষ্টির নাম।

ঘৃণা আমাদের ভালো লাগার বিষয়। আমাদের পছন্দ নিন্দা। আমরা অন্যের মন্দে উৎফুল্ল হতে ভালোবাসি: এমন একটা সমাজে ভালোবাসা দিবস নামে একটা দিন থাকলে কিসের ভয়? বরং মনে হবে আছে, একটি দিন তো আছে। যেদিন ঘামে ভেজা শরীরে এক তরুণ ছুটতে ছুটতে এসে তার প্রেমিকার হাঁটুর কাছে বসে বিদেশি ছবির কায়দায় বলবে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। ঘরে ফেরা মাঝবয়সী মানুষটি সন্তানদের চোখ এড়িয়ে স্ত্রীর খোঁপায় বা হাতে ফুল তুলে দিয়ে বলবে, ‘তোমার লাইগা আনছি...’।

ভালোবাসা দিবস থাকলে থাক, কিন্তু ভালোবাসা থাক আরও বেশি।

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত