Ajker Patrika

বিজেপির দুঃশাসন ও ত্রিপুরার রাজনীতি

উপসম্পাদকীয়
বিজেপির দুঃশাসন ও ত্রিপুরার রাজনীতি

গত ২৫ অক্টোবর আগরতলায় ত্রিপুরা রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কমরেড মানিক সরকারের সরকারি বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেছিলাম। ওই দিনই সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় যোগ দিতে তিনি দিল্লি যাবেন। তাই ঘণ্টাখানেক আলাপের সুযোগ পেয়েছিলাম। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজনীতি, রাজনৈতিক অবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে লেখাটি তৈরি করেছি।

ত্রিপুরা রাজ্যের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গত ছয় বছরে সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে ফ্যাসিবাদী রূপ নিয়েছে। রাজ্যের রাজনীতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিয়েছে শাসক দল বিজেপি। রাজ্যক্ষমতা লাভের পর চরম ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণে ত্রিপুরা রাজ্যে গণতান্ত্রিকতা এখন ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। এখানে সিপিএমসহ বিরোধীদের সভা-সমাবেশ করার অধিকারও হরণ করা হয়েছে। রাজ্যের পুলিশ কোথাও সমাবেশের অনুমতি দেয় না নিরাপত্তার অজুহাত তুলে। নিজ নিজ দলীয় কার্যালয়ে সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা ব্যতীত প্রকাশ্য জনসভার সব ধরনের পথ রুদ্ধ।

গত বিধানসভা নির্বাচনেও বিরোধীদের নির্বাচনী প্রচারণা বিজেপির সন্ত্রাসী বাইক বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে প্রতিহত করা হয়েছে। মানিক সরকারের নির্বাচনী এলাকায় ছয় বছরে তিনি কেবল দুইবার যেতে পেরেছেন। বারবার তাঁকে পথে যেমন আটকে দিয়েছে সন্ত্রাসী বাইক বাহিনী, তেমনি তাঁর নিরাপত্তার অজুহাতে পুলিশও তাঁকে ঢুকতে দেয়নি। কিন্তু পুলিশ বিজেপির সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ন্যূনতম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি। এ কারণে গত বিধানসভার নির্বাচনে অংশ না নেওয়া, এমনকি নির্বাচনে আর কখনো অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

ভারতের সংবিধানে রাজ্য সরকারের ক্ষমতার পরিসর খুবই সংকীর্ণ। এককেন্দ্রিক শাসনের বৃত্তে আটকে রয়েছে নির্বাচিত রাজ্য সরকারের পরিধি। তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী হলেও কেন্দ্রের অধীনে থাকার ফলে কিছু সংস্কারকাজ ছাড়া সামগ্রিক কোনো কাজ করতে পারেননি এবং সংবিধান অনুযায়ী তা সম্ভবও ছিল না। একটি নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রের প্রতিনিধি রাজ্যপাল তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করার এখতিয়ার রাখে। ভারতের রাজ্য সরকারগুলো তাই একপ্রকার ঠুঁঠো জগন্নাথ। তারপরও সিপিএমের সরকার রাজ্যবাসীকে আশানুরূপ গণতান্ত্রিক অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করে একটা পর্যায়ে এনেছিল। কিন্তু বিজেপির শাসনামলে সব ওলট-পালট করে দেওয়া হয়েছে।

এই রাজ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে সিপিএমের শাসনামলে। অতীতে উচ্চ ও নিম্নশ্রেণি বাদে অতিক্ষুদ্রসংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। শিক্ষা সম্প্রসারণে, চাকরির মাধ্যমে একটি মধ্যবিত্ত অগ্রসর শ্রেণি গড়ে উঠেছে। এই শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিই এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির ভোটব্যাংকে পরিণত হয়েছে। সিপিএমের ব্যর্থতা তাদের দ্বারা গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে রাজনৈতিক চেতনায় বিকশিত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। ফলে তারা ব্যক্তি ও পারিবারিকভাবে সচ্ছল সুবিধাভোগিতায় ধর্মের অভিমুখী হয়ে পড়েছে এবং সমর্থক হয়েছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির। 

রাজ্যের মোট ভূখণ্ডের ৬৭ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অঞ্চল। ওই অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করে এডিসি (অটোনোমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল)। নির্বাচনের মাধ্যমে এডিসির কর্তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এডিসি কর্তৃক পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়; অর্থাৎ রাজ্য সরকারের বাইরে এডিসি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অঞ্চলে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। এডিসি অঞ্চলে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ব্যতীত অন্য কারও জমি কেনার অধিকার নেই। তবে বসবাস করতে পারবে, কিন্তু জমির মালিক হতে পারবে না। ১৯৮০ সালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন বাঙালিদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা বাধিয়ে ছিল। তখন এডিসি অঞ্চল থেকে বাঙালিরা জীবন রক্ষার জন্য পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। এখন এডিসি অঞ্চলে কিছু বাঙালি মুসলিম বসবাস করছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা মুসলিম বাঙালিদের শত্রু না ভাবলেও হিন্দু বাঙালিদের চরম শত্রু মনে করে।

ত্রিপুরার বিধানসভার আসন ৬০টি। এডিসি অঞ্চলে ২০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য সংরক্ষিত। ওই আসনে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ব্যতীত অন্য কারও প্রার্থী হওয়ার বিধান নেই। এডিসি অঞ্চলের বিশাল ভূখণ্ডের বন, পাহাড়, আবাদি জমি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যেই বণ্টন করা হয়েছে। চা, রাবার, ফসল ইত্যাদির মাধ্যমে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছলতা লাভ করেছে। মিশনারিদের দ্বারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারা উন্নতি করছে। ফলে তাদের বর্ণমালাহীন ককবরক ভাষা অতীত থেকে বাংলা বর্ণমালায় ব্যবহৃত হলেও, বাঙালিবিদ্বেষ মনোভাবে বাংলার পরিবর্তে তারা ক্রমেই রোমান হরফ গ্রহণ করছে।

ত্রিপুরার ৩৩ শতাংশ ভূখণ্ডে বাঙালিসহ সব জাতির বসবাস। এটাকে সমতল ত্রিপুরা বলা হয়। এখানে বিধানসভার আসনসংখ্যা ৪০টি। ১০টি আসন নিম্নবর্গের শূদ্র অস্পৃশ্যদের জন্য সংরক্ষিত। নিম্নবর্গ ব্যতীত এই ১০ আসনে অন্য কাস্টের কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না। বাকি ৩০টি আসনে অন্যরা প্রার্থী হতে পারবেন। বিধানসভার নির্বাচনী আসন ভাগাভাগি এভাবেই সংরক্ষিত। ত্রিপুরার ভোটের রাজনীতিতে এডিসি অঞ্চলের ২০টি আসন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগে ওই আসনে সিপিএমের প্রভাব থাকলেও, গত বিধানসভার নির্বাচনে মাণিক্য রাজপরিবারের প্রদ্যোত দেববর্মা হঠাৎ রাজনীতিতে প্রবেশ করে গ্রেটার ত্রিপুরাল্যান্ড [ত্রিপুরা ফর ত্রিপুরাস] আওয়াজ তুলে ২০টি আসনের সমীকরণ পাল্টে দিয়েছেন। পাশাপাশি বিজেপির বিজয়কে নিশ্চিত করেছেন।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ত্রিপুরাবাসীকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় পানি ঢেলে দিয়েছেন। বিজেপির ভোট গতবারের তুলনায় কমেছে। কিন্তু এডিসি অঞ্চলে ত্রিপুরা মথা এবং সিপিএমের ভোট কাটাকাটির ফলে মাঝখান থেকে লাভবান হয়েছে বিজেপি। ত্রিপুরা মথা ১৫টি, সিপিএম ১টি এবং বিজেপি ৪টি আসন পেয়ে এগিয়ে গেছে। অথচ এই ২০টি আসনের ১টিও বিজেপির পাওয়ার কথা ছিল না। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরমুহূর্তে প্রদ্যোত দেববর্মার ত্রিপুরা মথা বিজেপিকে সমর্থন দিয়ে বসে। গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে এতে দিল্লির সঙ্গে ত্রিপুরা মথার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। 

ত্রিপুরায় এখন ফ্যাসিবাদী শাসনের কবলে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজ্য বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের অধিকাংশ সাবেক কংগ্রেস দলীয়। আরএসএস এখানে দীর্ঘদিন তাদের কার্য পরিচালনা করে এসেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নানা লোভ, প্রলোভন দেখিয়ে কংগ্রেস ও অরাজনৈতিক কিছু ব্যক্তিকে দলভুক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ ত্রিপুরায় প্রকাশ্য বক্তৃতায় অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে একটিও পূরণ করেননি। তাই এবার বিজেপি পরাজয় আঁচ করতে পেরে ত্রিপুরা মথাকে মাঠে নামিয়েছে।

পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসন এবং সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ভোট ডাকাতিতে অংশ নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণি পেরিয়ে রাজ্যক্ষমতায় বসেছে। শিগগির ভারতের পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভার ভোট। কেবল রাজস্থানে বিজেপির জয়ের ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে। অপর চার রাজ্যে দলটির হার অনেকটা নিশ্চিত। কেন্দ্রীয় নির্বাচনে এর প্রবল প্রভাব পড়বে। তাতে বিজেপির ভারত শাসন হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্র থেকে বিজেপির বিদায় ত্রিপুরা রাজ্যে বিজেপির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ত্রিপুরার রাজ্য বিজেপি চলছে দিল্লির আদেশ-নির্দেশের ভিত্তিতে। সেটা বন্ধ হয়ে গেলে রাজ্য বিজেপির পক্ষে দল ও সরকার ধরে রাখা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়বে বৈকি।

মযহারুল ইসলাম বাবলা, নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত