Ajker Patrika

‘ভোটাধিকার হরণে’ নির্বাচন কমিশন ও সরকার জড়িত—বিএনপির মামলায় যা আছে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৩ জুন ২০২৫, ২১: ৪৯
ছবি: আজকের পত্রিকা
ছবি: আজকের পত্রিকা

নির্বাচনের নামে দেশের জনগণকে তিনবার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে—এই অভিযোগ তুলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, একাধিক সাবেক কমিশনার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ মোট ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটির অভিযোগ—২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি, ঘটেছে ‘একটি দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের অপকৌশল’।

মামলার বাদী বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং দলের ‘গুম, খুন ও মামলা’বিষয়ক সমন্বয়ক সালাহ উদ্দিন খান। নিজেকে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘ মাঠ-অভিজ্ঞতা, নথিপত্র ও প্রত্যক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে তিনি এই মামলা করেছেন। তাঁর ভাষ্য, তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিটি ছিল ‘প্রহসন’, এবং এর পেছনে ছিল পরিকল্পিত সাংবিধানিক লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার। দণ্ডবিধির ১৭১-৭/১৭১-ঘ/ ১৭১-২/১৭১-জ/১৭১-হ ধারা এবং ১২০-ক/১০৯ ধারায় তিনি এ মামলা করেছেন।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, মামলায় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে। আসামি যেই হোক না কেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করাই পুলিশের দায়িত্ব।

মামলায় বলা হয়েছে, সংবিধানের ৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেবল জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে সংবিধান অনুসারে প্রয়োগযোগ্য। অথচ এই তিন নির্বাচনে জনগণকে ভোট দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় বসে—যা একদিকে সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল, অন্যদিকে ফৌজদারি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাদীপক্ষের দাবি, এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, আর কমিশনকে ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ‘যন্ত্রাংশ’ হিসেবে।

মামলায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেখানে দাবি করা হয়, ভোটের আগের রাতেই অধিকাংশ ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছিল, এতে ভোটগ্রহণের দিনে কার্যত কিছুই বাকি ছিল না।

‘দিনের ভোট রাতে’ হয়ে যাওয়ার কথা বলেই এই নির্বাচন ঘিরে দেশ-বিদেশে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, যা মামলার মূল দলিলে শক্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও উল্লেখ আছে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর লিখিতভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানালেও সেসব আবেদন আমলে নেওয়া হয়নি।

বিএনপির ভাষ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ভবিষ্যতের সব নির্বাচন নিজের অধীনে আয়োজনে পরিকল্পনা শুরু করে। বাদীর অভিযোগ, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, যা ছিল একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। এরপর থেকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা, সহিংসতা, অপহরণ, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু হয়। মামলায় একে ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও গণতান্ত্রিক শূন্যতার সূচনা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও মামলায় রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বিএনপির দাবি অনুযায়ী, ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হন। আর অন্য আসনগুলোতেও রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে একতরফাভাবে ফল নির্ধারণ করা হয়।

সবশেষে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেও ‘ভোটারবিহীন, সাজানো নির্বাচন’ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, ভোটার উপস্থিতি ৩০ শতাংশের নিচে থাকলেও কমিশন ভোটগ্রহণ শেষে ৪০ শতাংশ উপস্থিতি দেখিয়ে একটি ভুয়া চিত্র তুলে ধরে। বিএনপি বলছে, এই ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে—যার দায় নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না।

মামলার তালিকায় যাঁদের নাম

মামলায় অভিযুক্ত ১৯ জনের মধ্যে রয়েছেন তিনজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার—কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ, কে এম নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়াল। রয়েছেন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম, রফিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, আহসান হাবিব, আনিছুর রহমান ও মো. আলমগীর। পাশাপাশি উল্লেখ আছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম। নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে রয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, এ কে এম শহীদুল হক ও জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিজিএফআই ও এনএসআইপ্রধান (নাম অজ্ঞাত) এবং তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল আলম।

বাদীপক্ষের ভাষ্যমতে, এই ব্যক্তিরা সম্মিলিতভাবে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা হরণ করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন এবং একটি দখলদার সরকারের পক্ষে নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রভাবিত করেছেন।

মামলায় ‘রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ’-এর অভিযোগও রয়েছে। বলা হয়েছে, প্রহসনের নির্বাচন করতে গিয়ে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, যেটা জনস্বার্থে ব্যবহার না হয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ব্যবহৃত হয়েছে। বাদীপক্ষ এই বিষয়কে অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির আওতায় বিচার দাবি করেছে।

এজাহারে সাক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, ব্যালট পেপারে থাকা সিলের তথ্য, ভোটকেন্দ্রে কর্মরত কর্মকর্তাদের জবানবন্দি, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সাক্ষ্য এবং স্থানীয় ভোটার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান। বাদীর বক্তব্য, উল্লিখিত সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ঘটনার নথি বিশ্লেষণ করলে নির্বাচনী কারচুপির পূর্ণ চিত্র বেরিয়ে আসবে।

এই মামলাকে বিএনপি ‘দলীয় অবস্থান থেকে নয়, বরং রাষ্ট্র ও সংবিধান রক্ষায় দায়িত্বশীল উদ্যোগ’ হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। এ মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আইন ও রাজনীতির অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে মামলা হওয়ার পরপরই গতকাল রোববার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আজ পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাঁকে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

বিষয়:

নির্বাচন
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করে ইউটার্ন নিল দুটি জাহাজ

ইসরায়েলে ২০ লাখ রুশভাষীর বাস, রাশিয়াকে তাঁদের কথা ভাবতে হয়: পুতিন

গুমে জড়িত ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা: গুম কমিশনের প্রতিবেদন

ইরানের হামলার তীব্র নিন্দা কাতারের, পাল্টা জবাবের হুঁশিয়ারি

চীন-পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থায় ঝামেলা বাড়বে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত