Ajker Patrika

বেঙ্গালুরুর ইফতারির বাজারে

ফাতিমা জাহান
আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৮: ২৩
বেঙ্গালুরুর ইফতারির বাজারে

এখন পর্যন্ত আমি পৃথিবীর যত ইফতারির বাজার দেখেছি, এর মধ্যে বৈচিত্র্যময় মনে হয়েছে বেঙ্গালুরুর ইফতারির বাজারকে। ভারতের বেঙ্গালুরু শহরের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান। টিপু সুলতানের রাজ্য বিস্তৃত ছিল বেঙ্গালুরু ও এর আশপাশের এলাকায়।

দক্ষিণ ভারতীয় নিরামিষ খাবারের সঙ্গে সেই অঞ্চলের মুসলমানদের নিজস্ব আমিষ খাবারেও মসলা ও রন্ধনপ্রণালির আঞ্চলিক ছাপ প্রকট। মজার ব্যাপার হলো, রমজান মাসে ফ্রেজার টাউনের মস্ক রোডের এই ইফতারির বাজারে মুসলমানদের চেয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষের ভিড় চোখে পড়ে বেশি। দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য এলাকার মতো এই শহরেও শুদ্ধ শাকাহারি রেস্তোরাঁর সংখ্যা বেশি। তাই একসঙ্গে এত পদের আমিষ খাবারের লোভ কেই-বা সামলাবে!

একটা লম্বা সড়কের দুই পাশে স্থায়ী ও অস্থায়ী খাবারের দোকানের মেলা বসে যায় রমজান মাসজুড়ে। বেঙ্গালুরুর বাসিন্দাদের ইফতারের মূল ও প্রধান আইটেম হলো বিভিন্ন ধরনের ফল, সমুচা ও দুধের শরবত। সমুচার আকার আমাদের দেশের চেয়ে বড়, পুর হিসেবে থাকে মূলত প্রচুর পেঁয়াজ, পুদিনাপাতা ও কাঁচা মরিচ। তবে ফ্রেজার টাউনের ইফতারির বাজারে বেশির ভাগ আইটেম আমিষ বা নন-ভেজিটেরিয়ান খাবার। চিকেন, মাটন এমনকি বিফ বা গরুর মাংসের কাবাব, কোফতা, সাসলিক, নুডলস, রোল, শরমা, কিমা পরোটা, হালিম, বিরিয়ানি পর্যন্ত এই বাজারে পাওয়া যায়। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন মানুষ আসে এই ইফতারির বাজারের নানা স্বাদের খাবার চেখে দেখার জন্য। জোহর নামাজের ওয়াক্ত থেকে শুরু হয় ইফতারি বানানোর ইন্তেজাম। দোকানিদের চালু হাত আরও চালু করতে হয়, ভিড় সামলাতে হয় দোকানিদের মাঝরাত পর্যন্ত। কিছু কিছু খাবার আছে মেরিনেট করে সামনের টেবিলে রাখা থাকে। ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী তাঁদের সামনেই বারবিকিউ করে, রান্না করে বা তেলে ভেজে দেওয়া হয়।

 ফ্রেজার টাউনের সবচেয়ে জমজমাট দোকান হলো অ্যালবার্ট বেকারি। ১২২ বছরের পুরোনো এই বেকারি সাধারণ সময়ে যত না ব্যস্ত থাকে, রমজান মাসে সেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় তার কয়েকগুণ। ইফতারের আগে দোকানে পা ফেলার জায়গা থাকে না। বেঙ্গালুরুর বিখ্যাত ভেজিটেবল বা এগ পেটিস, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘পাফ’, এখানে বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। এই বেকারির আরেকটি মুখরোচক

খাবার আলুবন, এটি তৈরি করা হয় বনরুটির ভেতরে আলুর পুর দিয়ে। তবে বেঙ্গালুরুর আইকনিক বেকারি আইটেম হলো দিল পাসান্দ। বড়, মোটা, গোল প্লেটের আকারের পেটিসের ভেতরে চিনি, নারকেল, কাজুবাদাম ও কিশমিশের পুর দিয়ে তৈরি করা হয় এই দিল পাসান্দ। বেকারি আইটেমের মধ্যে এটি এই তল্লাটের ইউনিক আইটেম।

মুসলিম খাবারের জন্য বিখ্যাত আল-বেক, তাজ, এম্পায়ার ইত্যাদি রেস্তোরাঁ। রমজান মাসে এই রেস্তোরাঁগুলোও মেন্যুর বাইরে অনেক ধরনের ইফতারির ব্যবস্থা করে। কিছু দোকানের ভেতরে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেই সব দোকানে বসার জায়গা পাওয়া মুশকিল হয় ভোজনরসিকদের ভিড়ে। বেশির ভাগ দোকানের সামনে ওয়ানটাইম ইউজ প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে হয়। তাও ভোজনরসিকদের আগ্রহের কমতি নেই। মাসব্যাপী এ এক বিরাট উৎসব।

বেঙ্গালুরুর ইফতারির বাজারের আকর্ষণীয় আইটেমের নাম ‘পাত্থর কা গোশত্’। বড়, পুরু, লম্বা গ্রানাইট পাথরের স্ল্যাবের ওপর খোলা আকাশের নিচে কাঠকয়লার আগুনে মাংসের কাবাব বা মসলাদার মাংস রান্না করা হয়। মস্ক রোডে অল্প কয়েক জায়গায় তৈরি হয় এই পাত্থর কা গোশত্। আর এ খাবারটির জন্য দোকানে ভিড় থাকে দেখার মতো। এ ছাড়া শিক কাবার, শামি কাবাব, রেশমি কাবাব, সুতা কাবাব, হারিয়ালি কাবাব, চিকেন কোলাপুরি কাবাব প্রসেস বা মেরিনেট করে দোকানের সামনে থরে থরে সাজানো থাকে বিভিন্ন রঙে।

কোনোটা লাল, কোনোটা সবুজ, কোনোটা হলুদ বা বাদামি। শুধু চিকেন, মাটন বা বিফ নয়, খরগোশ কিংবা উটের মাংসে তৈরি খাবারও পাওয়া যায় এই ইফতারির বাজারে। এর সঙ্গে মজাদার কিছু সি ফুড বা মাছের আইটেম বাজারের মধ্যমণি হয়ে উঠেছে। কাবাব বা কারির সঙ্গে খাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরোটা, রুটি, বিরিয়ানি, জিরা রাইস, ঘি রাইস বা পোলাও সাজিয়ে রাখা আছে পাশাপাশি বড় বড় পাত্রে।

আমাদের দেশের মতো ইফতারিতে বেঙ্গালুরুবাসী পেঁয়াজি, বেগুনি, চপ, ছোলা না খেলেও দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্যবাহী বোন্ডা-বাজ্জি বা পাকোড়া বা চপ, বেগুনি এই বিশাল ইফতারির বাজারের এক কোনায় উপস্থিতির জানান দিয়েছে। সঙ্গে মিলছে নারকেল, মরিচ আর বাদামের চাটনি। আমাদের দেশে আমরা নারকেলের চাটনি দিয়ে আলুর চপ বা বেগুনি না খেলেও এই খাবার কিন্তু খুবই সুস্বাদু।

 শরবতের নাম নিলে প্রথমেই আসে বেঙ্গালুরুর কিছু রঙিন শরবতের কথা। দিল ঠান্ডা, দিল আরাম, মোহাব্বত কা শরবত নাম এগুলোর। আর তারা কাচের বড় বড় স্বচ্ছ জারে গোলাপ, আম, পেস্তা, রুহ আফজা ইত্যাদি রঙে এবং ফ্লেভারে আকর্ষণ করছে সবাইকে। বিভিন্ন তাজা ফলের রস বা মিল্ক শেককে এমনিতেই বেঙ্গালুরুর আইকন বলা হয়ে থাকে অর্ধশত বছর আগে থেকে। এই অঞ্চলের মানুষ তাই পানীয় বলতে ফলের জুসকে বোঝে।

ইফতারি হবে আর মিষ্টিজাতীয় খাবারের আয়োজন থাকবে না, তা বেঙ্গালুরুবাসী মোটেও মেনে নেবে না। তাই সাধারণ ইফতারির দোকানের পাশে বিভিন্ন মিষ্টি, হালুয়া, ফিরনি, কেক, বাকলাভা সাজানো থাকে।

মাগরিবের আজানের পর আসল আসর বসে ফ্রেজার টাউনে। সারা শহর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাসিন্দা চলে আসে ফ্রেজার টাউনের ইফতারির বাজারের বিভিন্ন নন-ভেজিটেরিয়ান খাবারের স্বাদ নিতে। পাবলিক পার্কিংয়ের জায়গায় গাড়ি রাখার জায়গা মেলে না। মানুষের ভিড়ে ফ্রেজার টাউনের মূল সড়কে যানবাহন চলাচল রাত ১০টা অবধি বন্ধ রাখতে হয়।

আরও মজার ব্যাপার হলো, বিভিন্ন ঐতিহাসিক জায়গার মতো অভিজ্ঞ গাইডের সহযোগিতায় বেঙ্গালুরুর ইফতারির বাজারে ‘ইফতার বাজার’ ওয়াকের ব্যবস্থা করেন অনেকে। ইফতারির বিভিন্ন আইটেম, এগুলোর উৎপত্তিস্থল, ইতিহাস, রন্ধনপ্রণালি ইত্যাদি জেনে, নিজে চোখে দেখে, চেখে এর আস্বাদন নেন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা অতিথিরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত