Ajker Patrika

ইসলামে নিরাপদ সড়কের রূপরেখা

ইজাজুল হক, ঢাকা
আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২১, ১১: ১৭
ইসলামে নিরাপদ সড়কের রূপরেখা

জননিরাপত্তার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় ইসলাম। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। প্রত্যেক নাগরিকেরই নিরাপদে-নির্বিঘ্নে চলাফেরা ও ভ্রমণ করার অধিকার রয়েছে। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধীসহ সব মানুষের কল্যাণে নিরাপদ সড়ক ও জনপথ গড়ে তোলা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষা এবং গণপরিবহনের যথাযথ মান নিশ্চিত করা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কোরআন ও মহানবী (স.)-এর হাদিসে এ বিষয়ে মৌলিক দিকনির্দেশনা বিবৃত হয়েছে।

নিরাপদ সড়ক নির্মাণ ইমানের অঙ্গ: সড়ক ও জনপথকে মানুষের চলাচলের উপযোগী করা অনেক ফজিলতপূর্ণ কাজ। এটি ইমানের পরিচায়ক এবং মোমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘ইমানের ৭০টিরও বেশি শাখা আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান শাখা হলো, এ কথার স্বীকৃতি দেওয়া যে, আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আর সবচেয়ে নিচের শাখাটি হলো, সড়কে কোনো কষ্টদায়ক বস্তু বা প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা সরিয়ে দেওয়া।’ (বুখারি, হাদিস: ৯; মুসলিম, হাদিস: ৩৫)

সড়ক, নদী ও জনপথ দখল করা হারাম: সড়ক জনসাধারণের সম্পদ। তা কুক্ষিগত করা কিংবা কাউকে এর সুযোগ করে দেওয়া জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করার শামিল। সুতরাং সড়ক দখল করে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করা কিংবা কাউকে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ করে দেওয়া সুস্পষ্ট জুলুম ও অন্যায় কাজ, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমরা নিজেরা একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৮) 

তেমনিভাবে অবৈধ পার্কিংও গুনাহের কাজ। এতে মানুষে চলাচলে কষ্ট হয়। রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মুসলমান তো সে-ই, যার কথা ও কাজ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বুখারি, হাদিস: ১০)

ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনের ফজিলত: ইসলাম ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার প্রতি বেশ জোর দিয়েছে। সড়কে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা ইসলাম অনুমোদন করে না। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করা অনেক ফজিলতপূর্ণ কাজ। এতে সদকার সওয়াব পাওয়া যায়। সুষ্ঠু যান চলাচল নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী, নারী, শিশু ও অসহায়ের সহায়তায় এগিয়ে আসা এবং বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো মোমিনের বৈশিষ্ট্য। রসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মুসলমানরা পরস্পর ভাই ভাই। কেউ কারও প্রতি জুলুম করবে না এবং শত্রুর কাছে হস্তান্তর করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে কোনো মুসলমানের একটি কষ্ট লাঘব করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিনের তার একটি কষ্ট লাঘব করবেন।’ (বুখারি, হাদিস: ২৩১০)

অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তিকে বাহনে ওঠানো বা তার মালপত্র বহনে সহযোগিতা করাও একটি সাদাকা।’ (বুখারি, হাদিস: ২৮২৭)

আরেক হাদিসে এসেছে, ‘তুমি কাউকে তার অচেনা পথ দেখিয়ে দিলে তা তোমার জন্য একটি সাদাকা।’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫৩৪)

আরও আছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো দুধের ছাগল দান করে অথবা কাউকে ঋণস্বরূপ অর্থ প্রদান করে কিংবা কাউকে পথ দেখিয়ে দেয়, সে একটি দাস মুক্ত করার সওয়াব লাভ করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৯৫৭) 

সড়ক পরিচ্ছন্নতায় সাদাকার সওয়াব: মানুষের চলাচলের পথ, সড়ক, মহাসড়ক ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই জরুরি। এটি অনেক বড় সওয়াবের কাজ। এর বিনিময়ে রসুল (স.) জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মানুষের ওপর প্রতিদিন তার শরীরের প্রতিটি গ্রন্থির জন্য সাদাকা দেওয়া আবশ্যক। ...সড়ক থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়াও একটি সাদাকা।’ (মুসলিম, হাদিস: ১১৮১)

সড়ক থেকে এ ধরনের কষ্টদায়ক বস্তু সরানো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও জান্নাত পাওয়ার অসিলা হবে। রসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘একবার সড়কের ওপর একটি গাছের ডাল পড়ে ছিল, যা মানুষের জন্য কষ্টদায়ক ছিল, অতঃপর এক লোক তা সরিয়ে দিল। এর ফলে আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৬২৪)

অন্য হাদিসে এসেছে, রসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আমি এক ব্যক্তিকে জান্নাতের লাল গালিচায় গড়াগড়ি খেতে দেখলাম। (জান্নাতে তার এই পুরস্কার লাভের কারণ হলো) মানুষের চলাচলের পথে একটি গাছ ছিল, যার কারণে চলাচলে কষ্ট হচ্ছিল, ওই ব্যক্তি তা কেটে দিয়েছিল (ফলে আল্লাহ খুশি হয়ে তাকে জান্নাতে এই পুরস্কার দান করেন)।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৯১৪)

যান চলাচল বন্ধ করা গুনাহ: সড়ক অবরোধ করে যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা গুনাহের কাজ। তবে কখনো সড়কে অবস্থান করতে হলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করা আবশ্যক। যাতে জনসাধারণের কোনো ধরনের ভোগান্তি পোহাতে না হয়। রসুল (স.) বলেছেন, ‘খবরদার! তোমরা সড়কে বসে পড়বে না।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল, আমাদের সড়কে বসা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ, আমরা সেখানে বসেই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সমাধা করি।’ তিনি বললেন, ‘যদি তোমাদের একান্ত বসতেই হয়, তবে সড়কের প্রতি তোমাদের কর্তব্যগুলো পালন করো।’ সাহাবিরা ফের জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল, সড়কের প্রতি আমাদের কর্তব্য কী?’ তিনি  বললেন, দৃষ্টি সংযত করা, কাউকে কষ্ট না দেওয়া, সালামের জবাব দেওয়া, ভালো কাজের আদেশ করা এবং মন্দ কাজের নিষেধ করা।’ (বুখারি, হাদিস: ২৪৬৫)

অন্য হাদিসে সড়কের আরও দুটি দায়িত্বের কথা এসেছে। এক. মানুষকে পথ দেখিয়ে দেওয়া এবং দুই. নির্যাতিতের পাশে দাঁড়ানো। (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮১৬ ও ৪৯১৭)

পরিবহনে নারীর নিরাপত্তা: গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি শিশু, প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধদের অধিকারও নিশ্চিত করা জরুরি। সাধারণত আমাদের দেশের গণপরিবহনে নারীরাই সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। পরিবহনে নারীর প্রতি সহিংসতা, হয়রানি ও নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা। প্রকৃত মোমিন কখনোই এসব কাজে জড়াতে পারে না। আল্লাহ তাআলা মোমিনদের দৃষ্টি হেফাজতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামে পরনারীর প্রতি চোখ তুলে তাকানোরও অনুমোদন নেই। 

ইসলামের সোনালি যুগে নারী নিরাপত্তা ছিল তুলনারহিত। নবুওয়াতের প্রথম যুগে নারী যখন নানা বৈষম্যের শিকার, তখন রসুল (স.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম, এই দীন (ইসলাম) অবশ্যই পূর্ণতা লাভ করবে। এমন পরিবেশ তৈরি হবে যে, সানা থেকে হাজরামাওত পর্যন্ত (ছয় দিনের দূরত্ব) ভ্রমণকারী ব্যক্তি নিরাপদে ভ্রমণ করবে। সে আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবে না। তার মেষপালের জন্য বাঘের ভয় থাকবে না। অথচ তোমরা তাড়াহুড়ো করছ।’ (বুখারি, হাদিস: ৬৯৪৩)

সড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে করণীয়: সড়কে মানুষ যেন নিরাপদে চলাচল করতে পারে, সে জন্য নিরাপদ পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। যান্ত্রিক পরিবহনব্যবস্থার যুগে দুর্ঘটনা এড়াতে উন্নত ট্রাফিক সিস্টেমের পাশাপাশি চালক ও বাহনের মাননিয়ন্ত্রণ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং পরিবহন শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি যাত্রী, ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহন শ্রমিকসহ সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। কারণ কোনো ধরনের দুর্ঘটনাই আমাদের কাম্য নয়। তা ছাড়া যে কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড ইসলামের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয় অপরাধ। ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের যেমন সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রয়েছে, অনিচ্ছাকৃত কিংবা ভুলে কাউকে হত্যা করলেও বড় ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। 

স্বেচ্ছায় হত্যাকাণ্ডের পরিণতি: সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের কিছু ঘটনা স্বেচ্ছা হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে। এর পরিণতি ভয়াবহ। স্বেচ্ছায় হত্যা করার পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো মোমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। তাতে সে সব সময় থাকবে এবং আল্লাহ তাআলা তার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন ও তাকে অভিশাপ দেবেন। তেমনিভাবে তিনি তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৯৩)

অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকারীকে পরকালে ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। রসুল (স.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীকে তার চুল ও মাথা ধরে নিয়ে আসবে। তার ঘাড়ের কাটা রগগুলো থেকে তখন রক্ত ঝরতে থাকবে। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক, এই লোক আমাকে হত্যা করেছে। এমনকি সে হত্যাকারীকে আরশের খুব কাছে নিয়ে যাবে।..,’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩০২৯)

অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডও বড় অপরাধ: সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের বেশির ভাগ ঘটনা চালকের অসতর্কতা কিংবা যাত্রীর ভুলে হয়ে থাকে। ভুলে কিংবা অসতর্কতাবশত হত্যাকাণ্ডের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কোনো মোমিনকে হত্যা করা মোমিনের কাজ নয়, তবে ভুলবশত করে ফেললে ভিন্ন কথা। যে ব্যক্তি ভুলবশত কোনো মোমিনকে হত্যা করে, সে একজন দাস মুক্ত করে দেবে এবং নিহত ব্যক্তির পরিবার-পরিজনকে রক্তপণ পরিশোধ করে দেবে।... আর যে ব্যক্তি (মুক্ত করার জন্য কোনো দাস) পাবে না (তার বিধান হলো), সে একাধারে দুই মাস রোজা রাখবে।...’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৯২)

আইনের সঠিক প্রয়োগ, জনসাধারণের সদিচ্ছা, পরিবহন শ্রমিকদের দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে একটি সুন্দর ও নিরাপদ সড়কব্যবস্থা। মানুষ আস্থা রেখে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করতে পারবে দেশের যেকোনো প্রান্তে। যেখানে থাকবে না কোনো বৈষম্য ও নৈরাজ্য; থাকবে না সংঘাত ও হানাহানি। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দাম্পত্যকলহের গুঞ্জন, মুখ খুললেন জাহিদ হাসান

গভর্নর আমাকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়ার কে: বিএফআইইউর প্রধান শাহীনুল

ছাত্রীকে তিন দিন আটকে রেখে ধর্ষণ, গ্রাম্য সালিসের মাধ্যমে বিয়ে

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের যৌন সহিংসতার প্রসঙ্গ জাতিসংঘে তুললেন ভারতীয় দূত

সেই রুহুল আমিনের বসুন্ধরা, বনানী ও উত্তরার জমিসহ ৫০০ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত