Ajker Patrika

রণজিৎ গুহ: বামপন্থী কর্মী থেকে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ

আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১৭: ০১
রণজিৎ গুহ: বামপন্থী কর্মী থেকে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ

আসছে মে মাসের ২৩ তারিখে শতবর্ষে পা রাখতেন তিনি। তাঁর ভক্ত, শিক্ষার্থী ও শুভানুধ্যায়ীরা দিনটি সাড়ম্বরে উদ্‌যাপনের জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। কিন্তু সকলের সেই উদ্যোগ নস্যাৎ করে দিয়ে আজ শনিবার ভোরে দেহত্যাগ করলেন তিনি। তিনি রণজিৎ গুহ। একটু ইতিহাস জানা মানুষমাত্রই জানেন, তিনি ছিলেন ভারতীয় ইতিহাসবিদদের মধ্যে কিংবদন্তিতুল্য। 

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, রণজিৎ গুহের বয়স হয়েছিল ৯৯ বছর। তিনি স্ত্রীর সঙ্গে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার উডসে বসবাস করতেন। সেখানেই নিজ বাসভবনে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। 

রণজিৎ গুহ শীর্ষ বাঙালি ইতিহাসবিদদের অন্যতম। ১৯২৩ সালের ২৩ মে অবিভক্ত ভারতের বাকেরগঞ্জের (ঝালকাঠির জেলার নলছিটি) সিদ্ধকাঠি গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। গত শতকের তিরিশের দশকে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় পাড়ি জমান। 

ইতিহাস গবেষণায় তিনি যে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন, তা ঈর্ষণীয়, একই সঙ্গে তুঙ্গস্পর্শী তো বটেই। তাঁর গবেষণাকর্মগুলো বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। 

রণজিৎ গুহ। ছবি: টুইটার২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাফট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ক্রিস মাঞ্জাপ্রার সঙ্গে ‘বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মৌখিক ইতিহাস প্রকল্প’ নিয়ে কাজ করেছিলেন রণজিৎ গুহ। সে সময় তিনি এক বক্তৃতায় পূর্ব বাংলায় (বর্তমানে বাংলাদেশ) তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, পারিবারিক পটভূমি ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত বলেছিলেন। 

রণজিৎ জানান, কৈশোরকালেই তিনি ডিএইচ লরেন্স, দস্তয়েভস্কি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পড়ে ফেলেছিলেন। কীভাবে সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মেছিল, সেসবও বলেছিলেন তিনি। 

রণজিৎ গুহ নিঃসন্দেহে বেঁচে থাকবেন উত্তর-ঔপনিবেশিক ও নিম্নবর্গের ইতিহাসের পথিকৃৎ হিসেবে। ভারতের কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে ভিন্নধর্মী ইতিহাস লিখেও তিনি চিরস্মরণীয় স্থান দখল করেছেন। 

রণজিতের বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী। তিনি দেশ ভাগেরও আগে ১৯৩৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে পেশা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে সেখানেই পরিবার নিয়ে থিতু হন। 

কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৩৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন রণজিৎ গুহ। পরে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। 

২০০৯ সালের এক সাক্ষাৎকারে রণজিৎ তাঁর জীবনে প্রেসিডেন্সি কলেজের অবদানের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেকে বুদ্ধজীবী ভাবি না, এমনকি রাজনৈতিক কর্মীও ভাবি না। আমি শুধু নিরলসভাবে একাডেমিক কাজ করে গেছি। আর আমার এ কাজের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজ।’ 

গত শতকের চল্লিশের দশকে রণজিৎ গুহ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৪৫ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ডেমোক্র্যাটিক ইয়ুথে যোগ দিতে লন্ডন গিয়েছিলেন। সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ড তুলে তাঁর লন্ডন যাত্রার খরচ জোগাড় করেছিল। 

পরের সাত বছরও তিনি কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৫৩ সালে হঠাৎ তাঁর মনে হয়, তিনি আরও বেশি গবেষণায় মনোযোগ দেবেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি ওই বছরেই লন্ডন থেকে কলকাতা ফিরে আসেন। 

তিনি স্ত্রী মেকঠিল্ড গুহর সঙ্গে রণজিৎ গুহ। ছবি: পারমানেন্ট ব্ল্যাক১৯৫৩ সালে চন্দন গড় কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন রণজিৎ গুহ। এরপর সেখান থেকে সেন্ট্রাল কলকাতা কলেজে (বর্তমানে মাওলানা আজাদ কলেজ) যোগ দেন। তবে তাঁর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই চাকরি চলে যায়। 

রণজিৎ গুহ এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। কলকাতার এ বিশ্ববিদ্যালয়টি উদারতাবাদী একাডেমিশিয়ানদের জন্য লীলাভূমি ছিল। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করে এসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ খুলেছিলেন। 

১৯৫৯ সালে রণজিৎ গুহ ফেলোশিপ নিয়ে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। এরপর ১৯৬৩ সালে ‘দ্য রুল অফ প্রোপার্টি ফর বেঙ্গল’ নামে সাড়া জাগানো প্রবন্ধ লিখে ফেলেন রণজিৎ গুহ। 

কিন্তু রণজিৎ গুহের গবেষণাজীবনের প্রথম দিককার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। ১৯৬১ সালে তাঁর বিখ্যাত দ্য রুল অব প্রোপার্টি ফর বেঙ্গল প্রবন্ধটি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্রে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে সেটি প্রত্যাখ্যাত হয়। পরে প্যারিসেরই প্রকাশনা সংস্থা মাউটন থেকে তাঁর গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। 

১৯৬০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত রণজিৎ গুহ সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এই সময়ে তিনি কোনো গবেষণা প্রবন্ধ কিংবা বই প্রকাশ করেননি। এমনকি কোনো একাডেমিক সম্মেলনেও যোগ দেননি। 

তবে এই স্বেচ্ছাগোপনে থাকার সময়ে তিনি কলকাতায় তাঁর সমসাময়িক বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। ‘ভারতীয় সামাজিক আন্দোলনের ওপর গান্ধীবাদী প্রভাব’ বিষয়ক গবেষণা কাজের জন্য ১৯৭০-৭১ সালে তিনি ভারতে ছিলেন। তখন তাঁর মনোযোগ ছিল ভারতের কৃষক বিদ্রোহের দিকে। তাঁর বিখ্যাত গবেষণা প্রবন্ধটি ১৯৮৩ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। 

রণজিৎ গুহের লেখা কয়েকটি বই। ছবি: টুইটাররণজিৎ কখনোই শিকড়কে ভোলেননি। তিনি ১৯৮২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ নামে প্রবন্ধ পড়েছেন। পরে সেটি বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী জার্নাল ‘এক্ষণ’ এ প্রকাশিত হয়। 

পরবর্তী দুই দশক ছিল রণজিৎ গুহের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের স্বর্ণসময়। কয়েক খণ্ডে ‘সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ’ প্রকাশ করা ছাড়াও এ সময়ে তিনি তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা ও প্রবন্ধের ওপর ভিত্তি করে বই প্রকাশ করেছেন। 

১৯৮০ সালে রণজিৎ গুহ সাসেক্স থেকে অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। এরপর ১৯৮৮ সালে অধ্যাপনা থেকে অবসর নেন। অবসরজীবন তিনি স্ত্রী মেখঠিল্ড গুহকে নিয়ে অস্ট্রিয়ার এক শহরতলিতে কাটিয়ে দিয়েছেন।

অবসরে গেলেও তিনি তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা থেকে কখনোই অবসর নেননি। সমসাময়িক তরুণদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। সেই সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো তরুণ কবিদের সঙ্গেও তাঁর ছিল নিবিড় সখ্য। 

অবসরে যাওয়ার কয়েক বছর পরেই রণজিৎ ঘোষণা দেন, এখন থেকে তিনি শুধু বাংলা ভাষায় লিখবেন। তাঁর এ ঘোষণা সবাইকে বিস্মিত করেছিল। সকলের বিস্ময়কে আরও উসকে দিয়ে তিনি পরবর্তী জীবনে বহু প্রবন্ধ ও বই বাংলায় লিখেছেন। 
আজ এই কিংবদন্তির জীবনাবসান হলো। কিন্তু বাঙালির ইতিহাসচর্চা যত দিন থাকবে, তত দিন তিনি বেঁচে থাকবেন নিঃসন্দেহে। 

স্ক্রল ডট ইন থেকে অনুবাদ করেছেন মারুফ ইসলাম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত