Ajker Patrika

মা-বাবার দাম্পত্য কলহ, মায়ের বিষণ্নতা ও সন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকি

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৮: ১০
মা-বাবার দাম্পত্য কলহ, মায়ের বিষণ্নতা ও সন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকি

গর্ভকালে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মা নিজের শরীরকে বদলে যেতে দেখেন। কখনো গর্ভকালীন ও গর্ভপরবর্তী সময়ে মা বিষণ্নতা শিকার হন। যেটা প্রিপার্টাম ও পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলে পরিচিত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো না থাকলে, গর্ভবতী মা বিষণ্নতা বা অ্যাংজাইটিতে ভুগলে সন্তানও সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকবে না।

গর্ভকালীন বিষণ্নতা থাকলে সন্তানের কী সমস্যা হতে পারে?
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় মায়ের বিষণ্নতা এবং উদ্বেগজনিত রোগ থাকলে প্রিম্যাচিওর বেবি অথবা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে পারে। শিশুর জন্মকালীন ওজন কম হতে পারে, যার জন্য তাকে আইসিইউতে যেতে পারে। এ কারণে শিশুটি পরবর্তীকালে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। শুধু তা-ই নয়, সন্তান প্রসবের পর মায়ের বিষণ্নতা রোগ হলে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই সেটা ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে। 

গর্ভবতী মা বিষণ্নতা বা অ্যাংজাইটিতে ভুগলে সন্তানও সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকবে না। ছবি: পেক্সেলসবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মাতৃত্বজনিত বিষণ্নতা রোগের সঙ্গে মনোসামাজিক বিষয় সম্পৃক্ত। যেমন–অস্থিতিশীল দাম্পত্য সম্পর্ক, দাম্পত্য কলহ, মেয়েসন্তান জন্ম, পারিবারিক সহিংসতা , অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে স্বামী এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের বুঝতে হবে যে শুধু নবাগত সন্তানটিই নয়, মায়েরও শরীর ও মনের বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন। নতুন মায়ের বাড়তি যত্নটুকুর খেয়াল রাখার দায়িত্ব অনেকটাই সন্তানের বাবার। কিন্তু দেখা যায়, আমাদের সমাজে সন্তান হওয়ার পর মেয়েটাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনেক স্বামী সন্তানের কান্নায় ঘুম হবে না দেখে অন্য ঘরে ঘুমান। বহু পরকীয়ার জন্ম হয়। স্ত্রী যখন গর্ভবতী বা স্ত্রী নবজাতককে সময় দিচ্ছেন সেই অবকাশে। 

গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতায় ভোগার কারণে মা যখন সন্তানকে ঠিকমতো বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন না, তখন মা ও সন্তানের বন্ধন দৃঢ় হয় না। সঠিক পরিচর্যার অভাবে সন্তানটি ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, পুষ্টিহীনতায় ভুগতে পারে। এই বিষণ্নতা অনেক সময় এত তীব্র হয়ে যায় যে মা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, কখনো সন্তানকে আঘাত করেন, মেরেও ফেলেন। কাজেই গর্ভাবস্থায় এবং প্রসব-পরবর্তী এক বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ মায়ের শরীর এবং মনের জন্য। এ সময়টায় একজন নারী পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে যত্ন পেল কী পেল না, তা আমৃত্যু মনে রাখেন। 

মা-বাবার দাম্পত্য কলহ সন্তানদের শারীরিক, মানসিক, আচরণগত, সামাজিক ও শিক্ষাগত সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে। ছবি: পেক্সেলসদাম্পত্য কলহ ও সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য
নিউরোসায়েন্স বলে, যে শিশু মা-বাবার সুস্থ সম্পর্ক দেখে বড় হয়। সে স্ট্রেসে পড়লেও নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। মা-বাবার সুসম্পর্ক শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য, দ্রুত কথা বলা এবং আবেগীয় বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। এই শিশু বড় হলে ইতিবাচক ও আত্মবিশ্বাসী হবে।

এখন অধিকাংশ নারীই কর্মজীবী। তবে কাজের ক্ষেত্রে কিছু ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হয় সন্তান হওয়ার পরে। সন্তানের মা-বাবার মধ্য়ে যদি বন্ধুত্বের জায়গাটা না থাকে, তাহলে একজন পেশাজীবী মা অনেক রকম সাহায্য স্বামীর কাছ থেকে হয়ত পাবেন না সন্তানের হবার পরে। তাই সন্তান নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর উচিত খোলাখুলি আলোচনা করা। নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য়গুলোকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার বিষয়ে কথা বলা।

ফলে মা-বাবা যদি নিজেদের সমস্যার সমাধান না করেই মনে করেন সন্তান নিলে সমস্যার সমাধান হবে, তাহলে তাদের পুরোনো সমস্যা তো ধারাবাহিকভাবে চলবেই সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিও নতুন নতুন সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হবে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে মায়ের গর্ভকালীন সময় থেকে শুরু করে প্রথম দুই বছর সন্তান যখন কথা বলতে জানে না যেটাকে আমরা প্রিভারবাল স্টেজ বলি, তখন সন্তান কিন্তু ঠিকই বুঝে যায় যে সে এই পরিবারে খুব আদরের সঙ্গে গৃহীত নয়। ফলে শিশুটি নিজেকেই দায়ী করতে থাকে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবার মধ্য়কার সমস্যার জন্য। এই শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হলেও এই মনস্তাত্ত্বিক ভোগান্তির শিকার হবে।
সন্তান যেসব ঝুঁকির সম্মুখীন হয়

কর্মজীবী মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে দাম্পত্য সম্পর্কে বোঝাপড়া থাকাটা খুব জরুরি। ছবি: পেক্সেলসমা-বাবার দাম্পত্য কলহ সন্তানদের ওপর পাঁচ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে, যেমন–শারীরিক, মানসিক, আচরণগত, সামাজিক ও শিক্ষাগত। নিউরোসায়েন্স বলছে দাম্পত্য সম্পর্কের সংকট শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যহত করে। বিবিসির ২০১৮-এর এক রিপোর্টে উঠে এসেছে, ছয় মাসের শিশুরও হৃৎপিণ্ডের গতি এবং স্ট্রেস হরমোনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া বেড়েছে মা-বাবার ঝগড়া শুনে। শিশু যখন আরেকটু বড় হয়, তখন ঘুমের সমস্যা, বিষণ্নতা তৈরি হয়। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, এটা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত হতে পারে। নির্দিষ্ট করে জার্নাল অব ফ্যামিলি সাইকোলজির ২০১৭ সালের একটি গবেষণায়, শৈশবের ইন্টারপ্যারেন্টাল ভায়োলেন্স বা মা-বাবার দাম্পত্যের দ্বন্দ্বের সঙ্গে যে শিশুর পরিচয় তাদের দুটি দলে ভাগ করা হয়। 

পাঁচ বছর চার মাসে যে শিশুরা মা-বাবার দাম্পত্য দ্বন্দ্ব দেখেছে, তাদের যখন বয়স ২৩, ২৬, ৩২ বছর হয়েছে তখন দেখা গেছে, তাদের মধ্যেও আন্তসম্পর্কের সহিংসতার হার তীব্র। গবেষণা বলছে, মা-বাবার দাম্পত্য সংকটে ছেলে ও মেয়েশিশুদের প্রতিক্রিয়া আলাদা। মেয়েরা আবেগীয় সমস্যার ভেতর দিয়ে যাবে, অন্যদিকে ছেলেরা আচরণগত ঝুঁকির ভেতর দিয়ে।

মা-বাবার দাম্পত্য কলহ দেখে বড় হওয়া আবেগীয় ও আচরণগত সমস্যার ভেতর দিয়ে যায়। ছবি: পেক্সেলসএ ধরনের শিশু নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবে, তাদের মধ্য়ে আত্মহত্য়ার প্রবণতা দেখা দেয়, স্কুলে পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ে, বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক অতিরিক্ত খারাপ হয়ে যায়, বড় হয়ে কর্মসংস্থানের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে, বিষণ্নতা এবং দুশ্চিন্তায় বেশি ভোগে, পড়াশোনায় বেশি এগোতে পারে না। এ ছাড়া আরও নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়। 

মোদ্দা কথা হলো, মা যদি মানসিকভাবে ভালো না থাকেন, পাশাপাশি সন্তানের মা-বাবার সম্পর্ক যদি ভালো না থাকে, তাহলে তার মনোদৈহিক বিকাশ চমৎকারভাবে হবে? প্লেনে উঠলে যেভাবে বলে যে অক্সিজেন মাস্কটা আগে নিজের মুখে নিন তারপর বাচ্চাকে দিন। প্রথমে নিজেকে ভালো থাকা শিখতে হবে; নিজের সম্পর্ককে ভালো রাখার জায়গাটায় জোর দিতে হবে তারপর সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে হবে। 

পরামর্শ:  চিকিৎসক, কাউন্সেলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বিডি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত